যুগান্তর
২৪ জুলাই, ১৯৭১
মুজিবের নয়, ইয়াহিয়ার বিচার চাই
সম্পাদকীয়
জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁর হাতে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য সম্পর্কে অস্থায়ী বাংলাদেশি সরকারের
পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহম্মদ যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সে উদ্বেগ তাঁর একার নয়, পৃথিবীর সকল সভ্য মানুষেরই এই বিষয়ে উদ্বেগ বোধ করার কথা। শাসক হিসাবে যাঁর বন্দুকের জোর ছাড়া আর কোন জোরই নেই সেঁই ইয়াহিয়া খাঁ বিচারের নামে হত্যা করতে চাইছেন শেখ মুজিবুর রহমানকে- যিনি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত নেতা। জঙ্গি শাসককে এই জিঘাংসাপরায়ণতা থেকে নিবৃত্ত করার দায়িত্ব সারা পৃথিবীর, সমগ্র মনুষ্যজাতির।
বিদেশী সাংবাদিকের কাছে দম্ভভরে বাংলাদেশের কসাই ইয়াহিয়া খাঁ বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে
সামরিক আদালতে গোপন ‘বিচারের’ সম্মুখীন করা হবে এবং তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হবে তাতে তাঁর মৃত্যুদন্ড হতে পারে। দশ লক্ষ মানুষের হত্যা, অসংখ্য নারীর নির্যাতন, লুন্ঠন ও ধ্বংসের জন্য যিনি দায়ী তিনি কি করে অন্যের বিচার করবেন? জল্লাদ যেখানে হাকিম সেখানে বিচার কিভাবে হবে? আর শেখ মুজিবুর রহমান এমন কি করেছে যার জন্য তাঁকে ইয়াহিয়ার কাছে প্রাণ বলি দিতে হবে? দেশদ্রোহীতা? মুজিব যদি দেশদ্রোহী তাহলে ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করছিলেন কেন? এই ‘বিচার’ গোপনেই বা অনুষ্ঠিত হবে কেন? যাকে ইয়াহিয়া খাঁ নিজে একদা ‘ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী’ বলে অখ্যায়িত করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আজ কি অভিযোগ, কি সাক্ষ্যপ্রমাণ, এসব কথা দেশের লোককে ও পৃথিবীর মানুষকে জানতে দেওয়া হবে না কেন? ঘৃণিত ইহুদী হত্যাকারী আইকম্যানের বিচারও তো প্রকাশ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এমনকি ন্যুরেনবার্গের বিচারও গোপনে হয়নি।একজন নিরস্ত্র, নিঃসঙ্গ মানুষ তাঁর হাতের মুঠোয়, আদালত তাঁর নিজেরই তৈরি। তবু সেই মানুষকেই তাঁর এত ভয় যে, সকলের চোখের সামনে সেই মানুষটিকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারছেন না? শুধু যে প্রকাশ্য বিচার হবে না, তাই নয়, পিন্ডির মিলিটারী ডীকটেটরা বলেছেন, কোন বিদেশী উকিলের সাহায্যও পাবেন না শেখ সাহেব।
অর্থাৎ যে মামলা তিনি সাজাবেন সেই মামলা যাতে ফেঁসে না যায়, তার জন্য তিনি খুব হুঁশিয়ার। বিচারের নামে প্রহসনে দন্ডটা আগেই দিয়ে রাখা হয়েছে, বাকি সবটা মিথ্যা চাল।
এটা লক্ষ্য করার বিষয় যে, বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাবার হুমকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া এ কথাও গেয়ে রেখেছেন যে, মৃত্যুদন্ডের আদেশ মকুব করার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। তাঁর এই কথার ইঙ্গিত সম্ভবত এই যে, মুজিবের প্রাণকে বাজি করে তিনি রাজনৈতিক জুয়াখেলায় নামবেন। মুজিবের অনুগামীদের সম্ভবত প্রাচ্ছন্নভাবে তিনি এটাই জানিয়ে দিতে চান যে, তাঁরা যদি তাঁদের নেতাকে প্রাণে বাঁচাতে চান তাহলে তাঁর সঙ্গে একটা আপোষে আসতে হবে। কিন্তু তার এই শয়তানি চাল ব্যর্থ হতে বাধ্য। কেননা, বাংলাদেশের মানুষ ইসলামাবাদের পশুশক্তির বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ে নেমেছে সেটা মরপণ লড়াই। কোন ভয় দেখিয়ে বা চাল দিয়ে তাদের সঙ্কল্প থেকে বিচ্যুত করা যাবে না। সে কথা না বুঝে ইয়াহিয়া যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসির দড়ি পরাতে যান, তাহলে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি জনাব কে,এম, সাহবুদ্দিনের ভাষায়,’বাংলাদেশ তাঁকে কোন দিন ক্ষমা করবে না। তখন জবাব হবে-রক্তের বদলে রক্ত, প্রাণের বদলে প্রাণ’
কিন্তু রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া খাঁকে এই চরম নির্বুদ্ধিতার পথ থেকে নিবৃত্ত করবে কে? বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহম্মদ এই বিচারের প্রহসন বন্ধ করে শেখের প্রাণ বাঁচাবার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। সেক্রাটারি জেনারেলের নিশ্চই এই বিষয়ে একটা কর্তব্য রয়েছে। মানবিকতার নামে, ন্যায্যবিচারের নামে তাঁর নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের তরফ থেকেও ইসলামাবাদের শাসকদের উপর চাপ আসা উচিত যাতে বন্দী অবস্থায় মুজিবের কোন রকম শারীরিক ক্ষতি না হয় বিশেষ করে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের মতো যারা মনে করে যে ইয়াহিয়াকে ক্ষেপিয়ে না দিয়ে তাঁকে দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে কাজ করান উচিত সেসব রাষ্ট্র এবার প্রমাণ দিক যে, পিন্ডির নায়করা তাদের কথার বিন্দুমাত্র দাম দেননা। মুজিবের বিচার প্রহসন বন্ধ করার দাবীতে সারা পৃথিবীর জনমত সোচ্চার হয়ে ওঠা উচিত। আর ভারতবর্ষের দিক থেকে আসা উচিত সবচেয়ে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। নয়াদিল্লী পরিষ্কার জানিয়ে দিক যে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার জন্য বিচারের মধ্যে ভাঁওতা দেওয়া হলেও ভারত বুঝে নেবে, পাকিস্তান বাংলাদেশ সমস্যার কোন চায় না এবং তখন আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরে যাওয়ার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ভারত যে কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।