আনন্দবাজার
২৫ জুন ১৯৭১
ধরা পরেছে মার্কিন ফাঁকি
সম্পাদকীয়
মার্কিন সমর সম্ভার নিয়ে পাক-জাহাজগুলো করাচীর দিকে এগুচ্ছে। সংসদে উত্তেজনা বাড়ছে। সবাই জানে বাংলাদেশের কপালে দুঃখ অনেক। যারা গণতন্ত্র রক্ষায় উৎসর্গিত প্রাণ বলে কথিত তাঁরাই সেজেছেন ভক্ষক। তাঁদের অস্ত্র ব্যবহৃত হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে। ভারতের জনসাধারণ ক্ষুদ্ধ এবং রাগে ফেটে পড়েছেন বাংলাদেশের জনতা। শরণার্থীরা প্রতিবাদমুখর। ওরা ঘেরাও করছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পরিদর্শনে। দুর্গত মানুষগুলো বুঝতে পারছে না মার্কিন কর্তৃপক্ষের দ্বৈতনীতি। এদিকে তাঁরা শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশায় চোখের জল ফেলছেন, অপরদিকে বাংলাদেশের দুষমনদের হাতে তুলে দিচ্চেন মরণাস্ত্র। মানুষ মরার ব্যবসা এবং মানবতার উচ্চগ্রামী নিনাদের মধ্যে সামঞ্জস্য রাকা কঠিন কাজ। ওয়াশিংটনের যুক্তি দুর্বল। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আগে কোন মার্কিন অস্ত্র যাবে না পাকিস্তানে। দুনিয়ার সামনে নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে, মার্কিন প্রতিশ্রুতি ভূয়া। তার নেই কোন বাস্তব মূল্য। ওঁদের কথায় এবং কাজে ধরা পড়েছে লজ্জাজনক অসংগতি। সংসদ সদস্যদের উত্তেজনা খুবই স্বাভাবিক। তাঁদের প্রশ্নবাণে নাজেহাল কেন্দ্রীয় সরকার। সাঝদরিয়া থেকে পাক-জাহাজের মার্কিন সম্ভার তুলে নেবার দাবি জানাচ্ছেন নয়াদিল্লী। অবাস্তব পাঁয়তারা। জ্ঞানপাপীকে জ্ঞানদান অসম্ভব।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং বিব্রত। কত আশা নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকায়। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে তিনি করেছিলেন আলাপ-আলোচনা। অখন্ড বিশ্বাস নিয়ে ফিরেছেন তিনি দেশে। লিখিত বিবৃতিতে স্বরণ সিং বলেছেন, গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক মার্কিন সরকার সত্যভ্রষ্ট হবেন না। তারপরই হাতেনাতে ধরা পরেছে গণতন্ত্রের মহামান্য সেবকদের কান্ডকারখানা। স্বরণ সিং-এর সার্টিফিকেট প্রকৃতপক্ষে সত্যের আপলাপ। এই লাইন ক’টি বাদ দেবার জন্য সংসদে উঠেছিল দাবি। কেটে দিলে হয়ত খুশি হতেন মাননীয় সদস্যরা। কিন্তু তাতে মার্কিন সরকারের টনক নড়ত না। ভারতের দেওয়া সুনাম কিংবা বদনামে তাঁরা থোড়াই কেয়ার করেন। পাক-ভারত শক্তিসাম্য বজায় রাখা তাঁদের নীতি। চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মার্কিন কর্তার করবেন পাক-তোষণ। তাতে যদি গণতন্ত্র কিংবা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ জাহান্নামে যায়, যাক। এ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই আমেরিকার। বলদর্পিত ধনীদের চিন্তাধারা আলাদা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর হাত-পা তাদের লেজের সঙ্গে বাঁধা। ওরা জানে কিছুক্ষণ ছটফটনির পর গরীবেররা ধর্না দেবে তাদের দরজায়। টাকা পেলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক শালীনতার মাপকাঠি বানাবে তারাই। অবশিষ্ট দুনিয়া মেনে নেবে ওদের নিরূপিত সভ্যতার নিত্যনতুন সংজ্ঞা। বেশি দিন আগের কথা নয়, ১৯৬৫ সালে মার্কিন অস্ত্র নিয়ে আয়ুব খান লাড়াই-এ নেমেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে। তখনও মার্কিন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এসেছিল প্রতিশ্রুতি খেলাপের অভিযোগ। তাতে কান দেবার দরকার বোধ করেনি আমেরিকা। মার্কিন অস্ত্র ইসরাইলে গেলে ক্ষেপে ওঠে আরব দুনিয়া। ওরা বলে এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হবে ইসরাইলী নির্যাতিত আরব হননে। এসব অস্ত্র যখন পাকিস্তানে যায় তখন তারা নীরব। অনেকে নীরব। অনেকে মনে মনে খুশী। একথা তাদের ধারণায় আসে না যে, মার্কিন মারণাস্ত্র প্রযোজ্য হবে বাংলাদেশের বাঙালি হননে। এগুলো ব্যবহার করবেন নরঘাতক ইয়াহিয়া খান। ওরা ভাবে, মুসলমান ইয়াহিয়া নির্বিচারে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান খুন করলে দোষ নেই। যত দোষ ইসরাইল যদি আরব নিধনযজ্ঞ চালায়। বর্তমান দুনিয়ায় একমাত্র আমেরিকাই বিবেক বর্জিত সুবিধাবাদী নয়, অন্যেরাও বড় কম যায় না।
দুর্ভাগ্য ভারতের। এই স্বার্থদুষ্ট দুনিয়ার মুখের দিকে চেয়ে আছে নয়াদিল্লী। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভারে নুইয়ে পড়ছে তাঁদের অর্থনৈতিক কাঠামো। আকাশে জমা হচ্ছে সামাজিক অর্থনৈতিক বিপ্লবের কালমেঘ। শরনার্থীদের স্বদেশে ফেরত না পাঠালে নয়। যাঁকে পর্যুদস্ত করলে এদের প্রত্যাবর্তনের পথ হবে। সুগম, তাঁর হাতই জোরদার করছেন মার্কিন সরকার। বারবার হুমকি দিচ্ছেন নয়াদিল্লী-বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে দুনিয়া এগিয়ে না এলে ভারত নেবে তার নিজস্ব ব্যবস্থা। এ নিজস্ব ব্যবস্থাটা যে কি তা হয়ত নিজেই যানে না প্রধানমন্ত্রী। নয়াদিল্লীর তর্জন গর্জনে পাত্তা দিচ্ছে না কেউ। সবাই ভাবছে, ভারত সরকার যত গর্জায় তত বর্ষান না। সেভিয়েত রাশিয়ার কূটনৈতিক তৎপরতা নাকি গত কয়েকদিনে বেশ বেড়ে গেছে। বৃটিশ সরকার শূন্যে ফানুস ফাটিয়েছেন- পূর্ব বাংলার গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান দরকার। তা না হলে কোন বৃটিশ সাহায্য নাকি যাবে না পাকিস্তানে। ফরাসীরা আদর্শের চেয়ে অস্ত্রের ব্যবসাটা ভাল বুঝেন। আদর্শের কচকচানীতে ওঠে বুদবুদ। আর অস্ত্রের ব্যবসায়ে আসে টাকা। বুদবুদের চেয়ে টাকার দাম বেশি। ইয়াহিয়াকে নিস্ক্রিয় করার জন্য দুনিয়া কি করেছে, জানেন না ভারতের জনসাধারণ। নয়াদিল্লীর কথায় অনেকেরই নেই কোন আস্থা। ওঁদের মূল্যায়ন মিলছে না বাস্তব অবস্থার সঙ্গে। বিশ্বজনমতের একটা দাম অবশ্যই আছে। কিন্তু সবার উপরে বাহুবল। এই বলের সার্থক প্রয়োগ করতে পারলে বিশ্বজনমতের মোড় ঘুরতে বেশি সময় লাগে না। নয়াদিল্লী আত্মস্থ হোন। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো তাদের ফাঁকি দিচ্ছে। ভারতের জনমতঈ বিগড়ে যাচ্ছে। নয়াদিল্লীর শক্তির উৎস নিম্নগামী। আর দেরী নয়। স্বাধীন বাংলাদেশকে বাস্তব করে তুলুন। তা না হলে ভারতের ভরাডুবি অনিবার্য।
সম্পাদকীয়-আনন্দ বাজার পত্রিকা, ২৫ জুন, ১৯৭১।