কম্পাস পত্রিকা
১৭ জুন ১৯৭১
বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য মাস্টারপ্ল্যান চাই
বাংলাদেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের মধ্যে শুধু ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিলেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না,দায়িত্ব লাঘবও হয় না।এদের সুসংগঠিত একটি ফলপ্রসূ শক্তিতে পরিণত করার জন্য আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন এবং অনতিবিলম্বে সে পরিকল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করাও অত্যন্ত আবশ্যক। বাংলাদেশ থেকে আগত তরুণ ছাত্র,বুদ্ধিজীবী, আইন ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার প্রত্যেকেই এই অবশ্য কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং এই বাংলার মানুষের উদ্যোগী হতে হবে।এই পরিকল্পনা রুপায়নে পশ্চিম বাংলা সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ দায়িত্ব রয়েছে।তাদের পক্ষ থেকে কতগুলি বাধ্যতামূলক নির্দেশ জারী করতে হবে। গেরিলা যুদ্ধের জন্য ভারত সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশের তরুণদের বিশেষ ট্রেনিং দান করা এবং এই রণকৌশল তাদের সুদক্ষ ও সুশিক্ষিত করে তোলা বাংলাদেশ সরকারের কর্মসূচিরর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।কিন্তু এখন পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যাগত এবং গুণগত পরিস্থিতি কিছুমাত্র সন্তোষজনক নয়।গেরিলা যুদ্ধের প্রাথমিক কর্মপন্থার জন্যই এখন পর্যন্ত সম্ভবত সাত থেকে আট হাজারের বেশী তরুণ তালিকাভুক্ত হননি।প্রকৃত ট্রেনিং কতটা দেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে অবশ্য আমরা কিছু জানিনা,কারণ স্বাভাবিক ভাবেই তা গোপন সামরিক দপ্তরের বিষয়।কত সংখ্যক তরুণকে এ কাজে পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে বহু পরস্পর বিরোধী রিপোর্ট আসছে।তবে প্রায় ষাট লক্ষ উদ্ধাস্তদের মধ্যে থেকে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সের অন্তত পাঁচ ছয় লক্ষ তরুণের নাম রেজিস্টারে থাকা উচিৎ। ভারত সরকার এবং অনান্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শরণার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এই যুবকদেরও অন্নবস্ত্রদান এবং রক্ষণাবেক্ষণের দিকে লক্ষ্য রাখছেন।কিন্তু কেন এই পাঁচ ছয় লক্ষ তরুণকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক সামরিক শিক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে না?এনসিসি পদ্ধতির ট্রেনিং (পিটি, প্যারেড, বন্ধুক চালনা,ফাস্টএইড, সমাজ কল্যাণ ও রাজনীতি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান ক্যাম্পের শরণার্থী সেবার মধ্যদিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা সবই শিক্ষণ সূচীর মধ্য পড়বে)দেওয়াটা তো বিপজ্জনক কিছু নয় ভারতীয়। ছাত্রদের জন্য এনসিসি বাধ্যতামূলক, কিন্তু তার সঙ্গে ছাত্রদের রাজনৈতিক মতপথ জড়িয়ে তো কেউ দুশ্চিতা করেনা। কোন শত্রু পক্ষীয় লোক যাতে এই বিশেষ ট্রেনিং -এর সময় শিক্ষণকারী তরুণদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে আত্নগোপনে করে থাকতে না পারে তার জন্য স্কুটিনী ও স্ক্রীনিং করার পরে এই সুশিক্ষিত ও সুসংহত বিশাল যুব বাহীনি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং কম্যান্ডো ও গেরিলা গ্রুপের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘদিন সৈন্য জোগানে সম্ভব।সমস্ত তরুণদের যদি আলাদাভাবে একটি সুশৃঙ্খল সংগঠনের মধ্যে সতর্ক বিধিনিষেধের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তাহলে স্ক্রুটিনী ও স্ক্রীনিং -এর কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। এই অজস্র শরণার্থীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা একটি বিরাট দায়িত্ব এবং প্রচন্ড সমস্যা। পশ্চিমবাংলার আইন শঙখৃলা ব্যবস্থাটাই এতে দিশেহারা হয়ে পড়তে পারে।উপরন্তু এই হত দরিদ্র, শৃঙ্খলাহীন ভারতে এই দেশত্যাগী হৃতসর্বস্ব মানুষের স্রোত যে অঅর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট সৃষ্টি করবে সেই পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্রকারীরা ধূমায়িত সাম্প্রদায়িক সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে।কিন্তু বাংলাদেশের সমস্ত শরণার্থী যুবকদেরই যদি নিয়ম শৃঙ্খলার আওতায় আনা যায় তবে তার প্রভাবে সমগ্র শরণার্থী স্রোতই নিয়ন্ত্রিত হবে।এই তরুণেরা শরণার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থের দিকে লক্ষ্য রাখবেন।অতত্রব, সর্বাগ্রে বাংলাদেশ থেকে আগত যুবশক্তিকে পূর্ণত শৃঙ্খলাবদ্ধ করার মধ্যেই রয়েছে এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতিকে সুনিয়ন্ত্রিত করার চাবিকাঠি। প্রত্যেক কর্মী ও সংগঠক কে ট্রেনিং দিয়ে শরণার্থী যুবশক্তিকে সুসংগঠিত করা ও সুনিপুণভাবে যুবশিবিরগুলি পরিচালনা করা নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ তবে অজস্র কর্মী পাওয়া সম্ভব। বহু শিক্ষিত ব্যক্তি, নানাবিধ কাজে যুক্ত মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ, যথা অধ্যাপক, শিক্ষক, আইন ব্যবসায়ী সাহিত্যিক, ডাক্তার, ও ইঞ্জিনিয়াররা আজ বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।তাদের সকলকে এই উদ্দেশ্য সংঘবদ্ধ করা প্রয়োজন। চাকুরীর সন্ধানে,আশ্রয়ের সন্ধানে, উদ্দেশহীন ভাবে বৃথাঘুরে তাদের লাভ নেই।স্বদেশীয় মানুষ ও যুবকদের পক্ষথেকে এ সম্পর্কে আদেশ জারি করা উচিৎ। আমরা আশা রাখি যে, যদি জাতীয় স্বার্থে একটি বিরাট ফলশ্রুতিপূর্ণ পরিকল্পনার আয়ত্তে এঁদের নিয়ে আসা যায় তাহলে এঁদের অধিকাংশই জীবনের বিভ্রান্ত লক্ষ্যকে পুনরায় ফিরে পাবেন।ইতিহাস, জনস্বাস্থ্য, ভুগোল,অক্ষর পরিচয়, ব্যবস্থাপনা, রাজনীতি জ্ঞান,সহায়হীন শরণার্থী সেবায় আত্ননিয়োগ সমস্তই এই পরিকল্পনার বিষয়ীভূত হবে।যদি টেকনিক্যাল ট্রেনিংয়ের জন্য যথেষ্ট লোক পাওয়া যায় তাহলে ভারতীয়দের মধ্য থেকে কর্মী সংগ্রহ করে শুন্যস্থান পূর্ণ করা যাবে।এটা স্বাভাবিক যে মুসলমান শরণার্থীরা সংখ্যায় বেশী হবেন।এই হিন্দু শরণার্থীদের মনোবলই সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত দেখা যাবে এবং বেশীর ভাগ হিন্দু যুবকেরা বাংলাদেশে আর ফিরে যাবার ইচ্ছা পোষণ করবে না।কিন্তু যদি বাংলাদেশ এবং ভারতের সর্বস্তরের নেতারা একযোগে এদের মধ্যে ব্যাপক, গভীর এবং সুশৃঙ্খলভাবে রাজনৈতিক কাজ করে যান তাহলে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস আবার ফিরে আসবে।শরণার্থীদের মধ্যে বহু হিন্দু তরুণ সবকিছু সত্ত্বেও এখনো মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিতে ইচ্ছুক। ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র, পরিকল্পনা ইত্যাদিসহযোগে এদের সুশিক্ষিত করে তুললে বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্থানী সামরিক চক্রকে সার্বিকভাবে প্রত্যাঘাত করার মুহূর্তে এঁরা এগিয়ে যাবেন।এ কাজে প্রচুর টাকা দরকার এতে কোন সন্দেহ নেই।কিন্তু শরণার্থীদের ভরণপোষণের জন্য টাকা আমাদের যোগার করতেই হবে।বিক্ষিপ্ত বা আধাখেঁচড়াভাবে নয়, এতে বড় একটা যুব শক্তিকে প্রকৃত টেনিং দিতে হলে যে আরো কিছু বেশী টাকা দরকার তা সত্য।কিন্তু এই অর্থব্যয় পরিণামে উভয়ত লাভজনক হবে।শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের জন্য এক বিরাট শক্তিকে গড়েতোলা দুটি কাজই এতে সার্থক হবে।তবে পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, পানীয়জল, পোষাক-পরিচ্ছদ, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা,গ্রন্থাগার চিকিৎসা ব্যবস্থা এই সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া যুব-শক্তিগুলোর কাজ আরম্ভ করা ঠিক নয়।যাতে অতি প্রয়োজনীয় সাধারণ জিনিসগুলোর অভাবে তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিরুক্তি দেখা না দেয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতেই হবে। যদি ভারত আজ এ দায়িত্ব যোগ্যভাবে গ্রহণ ও পালন করতে পারে তবে একদিন স্বাধীন বাংলাদেশ এজন্য ভারতকে আন্তরিক প্রীতি ও সৌহার্দ্য জ্ঞাপন করবে-আর অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশ কে পুনর্গঠিত করার কাজে স্বাধীন বাঙ্গালিরা এই লক্ষ লক্ষ সুশিক্ষিত সুনিয়ন্ত্রিত যুবকদের নিয়োগ করতে পারবেন।আজ যা অসহনীয় বোঝা মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে তাই এক বিশাল সজীব সোনার খনি বলে পরিগণিত হবে।চূড়ান্ত দুঃখজনক পরিস্থিতিকেও পরম মঙ্গলের প্রতি পরিচালিত করার এটাই এক মাত্র পথ। কিন্তু কে এই বিরাট পরিকল্পনার দায়িত্ব নেবেন এবং তা কার্যকরী করবেন?আজ অত্যান্ত তীক্ষ্ণ এবং দ্ব্যর্থহীন পদ্ধতিতে প্রত্যেকের দায়িত্ব প্রত্যেকের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে।বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি, এবং ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সামরিক কর্মচারীদের নিয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাশালী সংস্থা গঠন।
করতে হবে।প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ,মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজ কর্মীদের উপদেষ্টা হিসেবে নিতে হবে। দুটি দেশের যৌথ ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে সকলকে আমরা প্রস্তাবটি ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।ক্ষিপ্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করলে পরিস্তিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে।মনে রাখা দরকার শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা কুরতে হবে’বিশ্বের দরবারে এটা কাতরকণ্ঠে বলে বেড়ালেও দায়িত্বটা বিশ্ববিবেক বা বিশ্বমানবতার নয়, তাদের দোষারুপ করার চেয়ে নিজেদের কতগুলি কমিটমেন্ট এ আসা বেশী প্রয়োজন। এক্ষুণি শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না।সম্মুখে দীর্ঘদিন এবং দীর্ঘপথ। উভয় দেশকেই এই মহান দুঃখ বহন করার শক্তি অন্তর থেকে অর্জন করতে হবে।বলহীনের কাছে কিছুই লভ্য নয়।