যুগান্তর
৬ জুন, ১৯৭১
বাংলাদেশের ব্যাপারে শুধু বিশ্ববিবেক নয়,
দেশের বিবেকও জাগাতে হবে
গত সোমবার কল্যাণসুন্দরম লোকসভায় মন্তব্য করেন- ভারত সরকার পাকিস্তানকে তুষ্ট করে চলেছে। এ কথায় শ্রীমতি গান্ধী খুবই মর্মাহত হয়েছেন। এখন সিপিআই নেতা চেমবারলিনের কুখ্যাত মিউনিখ নীতির সঙ্গে ভারত সরকারের পাকিস্তান নীতির তুলনা টানবেন এমন কথা প্রধানমন্ত্রী বোধহয় কল্পনাও করেননি। তিনি খুব জোরের সঙ্গে এই মারত্মক অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে, “আমরা বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে তৎপর রয়েছি”- এর চেয়ে বড় কোন আশ্বাসও প্রধানমন্ত্রী সেদিন দিতে পারেন নি।
মে মাসের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা করেছিলেন- নীতি সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারত অন্যান্য দেশের মনোভাবের উপর নির্ভরশীল নয়; সে নিজেই নিজের নীতি স্থির করে থাকে। কিন্তু তবু বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার বর্বর অত্যাচার শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের সরকার যে কূটনীতিক স্তরে খুবই তৎপর হয়ে ওঠেনি- এমন কথা কেউ বলতে পারবেন না। বিভিন্ন দেশের রাজধানীর সঙ্গে নয়াদিল্লী নিয়ত সংযোগ রক্ষা করে চলেছে। অন্যান্য দেশের সরকারের সঙ্গে ‘নোট’ বিনিময় করাও হয়েছে। ইয়াহিয়া ভারতের উপর কী বিপুল সমস্য চাপিয়ে দিয়েছেন তার ফল কী দারুণ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে- আমরা ঐসব দেশকে সে কথা বোঝাবার চেষ্টা করেছি।
আমরা আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিদেশে পাঠিয়েছি। তিনি কয়েকটি দেশে গিয়ে বাংলাদেশের সমস্যা বুঝিয়ে বলবেন। শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রী শ্রী মঈনুল হক চৌধুরী ইতিপূর্বেই ঐ কাজ কিছুটা সেরে এসেছেন। একই কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন শ্রম ও পুনর্বাসন মন্ত্রী শ্রী খাদিল কর। কূটনীতিক কাজে তিনি এত ব্যস্ত যে শরণার্থীদের দেখাশোনার কাজটা তিনি তার অধিনস্তদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের বিষয়ে নয়াদিল্লীর বক্তব্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে বুঝিয়ে দিয়ে তাদের আমাদের পক্ষে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়।
বাংলাদেশ নিয়ে আমরা যে প্রবল কূটনীতিক অভিযান শুরু করেছি, তা আগে আর কখনো দেখা যায়নি। যে সব দেশে আমাদের প্রতিনিধিরা যাচ্ছেন, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই পাকিস্তান কূটনীতিক সম্পর্ক আছে। তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগও আছে; এবং আছে, তাদের নিজস্ব অর্থ। আড়াই মাস ওদের লোকেরাও ইয়াহিয়ার রক্ত ক্ষুধার তান্ডব স্বচক্ষে দেখেছেন। তবু আমাদের সরকার অতি আশায় বোধ হয় ভাবছেন- ভারত গিয়ে ওদের ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝিয়ে দিলেই ওদের বিবেক একেবারে পরিস্কার হয়ে যাবে এবং ওরা ভারতের পক্ষে চলে আসবে।
ফল যা-ই দাঁড়াক বিশ্ব-বিবেক জাগ্রত করার এই প্রয়াসের জন্য ভারত সরকারের সাধুবাদ অবশ্য প্রাপ্য। কিন্তু ভারতের যে সব রাজ্য সরাসরি শরণার্থী সমস্যা দ্বারা পীড়িত হচ্ছে না, তাদের বিবেক জাগানোর চেষ্টা যথেষ্ট রকম হয়েছে কি? শ্রীমতি গান্ধী তার সহযোগী মন্ত্রীদের কিংবা সর্বশক্তিমান রাজনীতি বিষয়ক কমিটির বিবেকই কি জাগাতে পেরেছিলেন?
শরণার্থীদের ঠাঁই দেওয়ার ব্যাপারে অধিকাংশ রাজ্যের যা মনোভাব তাতে মনে হয় বিদেশে দূত না পাঠিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিবেক জাগ্র করা এবং পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর সমাবেশ ভারতের পক্ষে কী সংকট ডেকে এনেছে তা বুঝিয়ে বলার জন্য বিভিন্ন রাজ্যে দূত পাঠালেই ভাল হতো।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নয়াদিল্লী যখন সিদ্ধান্ত নেয় যে শরণার্থীদের সীমান্তের কাছাকাছিই রেখে দেওয়া হবে, তখন তাছাড়া অন্য তেমন কিছু করারো ছিলনা। পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের যত্ন-আত্তি করার জন্য গড়ে তোলা কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন দফতর পূর্বাঞ্চলের উদ্বাস্তু সমস্যার প্রকৃত অবস্থা পরিমাপ করে তদানুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করবে- এমন আশাও দুরাশা। সীমান্তের দূরবর্তী কোন রাজ্যকে একজন শরণার্থীকে ঠাঁই দেওয়ার জন্যও রাজী করানো যায়নি। শরণার্থীদের অন্য নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে কলকাতায় বসে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিধাগ্রস্ত ঘোষনা থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি অন্যান্য রাজ্যের মনোভাব পাল্টাতে সক্ষম হননি।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাণান্তকর সমস্যা সম্পর্কে ভারত সরকার কী করতে চান- গত সপ্তাহে রাজনীতি বিষয়ক কমিটির একজন সদস্যকে এ প্রশ্ন করেছিলাম। উনি বললেন কিসের সমস্যা? ভারত সরকারতো উস্বাস্তুদের সব ব্যয় বহন করছে, সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের কোন অভিযোগ থাকার কথা নয়। মোট শরণার্থীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সরকারী সাহায্য নিচ্ছে অন্যেরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের গলগ্রহ হতে বাধ্য হয়েছে- একথা তিনি মানতে নারাজ। উনি বললেন- পশ্চিমবঙ্গ যদি মনে করে যে বোঝা খুব ভারী হয়ে পড়ছে, তাহলে সীমান্ত পুনরায় বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ কি তা মেনে নেবে? ওঁর কথায় মনে হয়, সমস্যা যেন পশ্চিমবঙ্গেরই। ওঁর বক্তব্যের সঙ্গে ভারত সরকার যে ‘স্টান্ড’ নিয়েছেন তার সঙ্গতি আছে কিনা সেটা তিনি তলিয়ে দেখনি। রাজনীতি বিষয়ক কমিটিতে এ বিষয়ে শুধু ওঁর একারই মনোভাব নয়।
এই উপমহাদেশে রাজনীতিক মন্থনের ফলে অমৃত এবং বিষ দুইই উঠছে; পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে শুধু বিষটাই জুটছে। সামাজিক ও আর্থিক বিপর্যয়েও রাজ্য ক্ষয়ের মুখে; হাঁড় পাঁজরা যে কখানা আছে তা বোধ হয় মহামারীর জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়ে বিদেশে চা-পাট পাঠানো বন্ধ করে দেশের জন্য বিদেশী মুদ্রা নিয়ে আসা বন্ধ না করা পর্যন্ত বোধ হয় কেন্দ্র বা স্বচ্ছল রাজ্যগুলির হুঁস হবে না।
শরণার্থী সমস্যা নিয়ে যেসব রাজ্যের গায়ে আঁচড় লাগছে না তাদের বড় চিন্তা পশ্চিমবঙ্গের ভড়াডুবির নয়; তাদের চিন্তা শরণার্থীদের জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হলে চতুর্থ যোজনার কাজ বানচাল হবে এবং তার ফলে তাদের উন্নতি শ্লথ হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক সমস্যাদির ব্যাপারে প্রত্যেক রাষ্ট্রই নিজস্ব স্বার্থের দিকটি বজার রেখে অগ্রসর হয়ঃ তেমনি বাংলাদেশের সমস্যার মত অবস্থায় ভারতের রাজ্যগুলিও নিজেদের স্বার্থের কথাটাই আগে ভাবছে। শ্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি। তিনি বোধ হয় বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশে না গিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজধানীতে একবার ঘুরে এলে ভালো করতেন। তিনি মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায়ও তাঁর সময়টা কাজে লাগাতে পারতেন। স্বদেশে অনেকের মত পাল্টাবার প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি সমস্যার ব্যাপারেও আমরা বোধ হয় উলটপুরাণ গাইছি। শ্রীমতি গান্ধী কলকাতায় বলেছেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে যায় ভারত চায় না। ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত এটাই ছিল ভারতের মনোভাব। কারণ বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হলে ভারতের ছদ্মসামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় গভীর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়ে পারে বলে ভারত ভীত ছিল। যাই হোক, ইয়াহিয়া আক্রমণ শুরু করার পর ভারতের মনোভাবে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়েছিল। বাংলাদেশের সংগ্রামের যথার্থতা অন্যদের বুঝিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে যাদের উপর আমরা নির্ভর করে চলি আমরা কি তাদেরই চিন্তাভঙ্গি গ্রহণ করে বসে আছি?
ভারত সরকারের বিশ্বাস আর মাস তিনেকের মধ্যে পাকিস্তান আপনা থেকে ধসে পড়বে। এক দিকে যুদ্ধের বিপুল ব্যয়, অন্যদিকে বাংলাদেশের পাট চা বিক্রি করে বিদেশী মুদ্রা ঘরে আনা বন্ধ- এই দুইয়ে মিলেই পাকিস্তানের ধ্বংস আনিবার্য করে তুলবে বলে বলা হচ্ছে। তা যদি হয়, তাহলে ভারতকেও শুধু দেখতে হবে যে পাকিস্তান যেন বিদেশী সাহায্যের দ্বারা আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারে। ভারতের দূরদেশ বিদেশ পরিক্রমার সেটাও অন্যতম লক্ষ্য।
নিরাপদের শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবার ব্যাপারে ভারত কী করতে পারবে তা বোঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মুখপাত্রদের বক্তব্যঃ আগামী মাস তিনেকের মধ্যে পাকিস্থানী সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে হটিয়ে দিতে না পারলে ওদের বোধ হয় আর কখনোই হটানো যাবে না। তার অর্থ শরণার্থীদেরও ঘরে ফেরা হবে না।
এটা হয়তো মুক্তি ফৌজের অনেকের সাময়িক আশাভঙ্গ জনিত বক্তব্য; কিন্তু তবু এ বক্তব্যের দিকে ভারতকে কান দিতেই হবে।
তাছাড়া নয়াদিল্লীকে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের ধ্বংস দেখতে হবে। তা যদি হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে তার ধাক্কা পড়বে প্রচন্ড ভাবেই। শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায় ওয়ারনিং দিয়েছেন যে, তিনি হয়ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হবেন। তিনি যাতে তাড়াহুড়ো করে কিছু না করে বসেন সে ব্যাপারে ভারত সরকার কি করেন বা না করেন, তার উপর এই পশ্চিমবঙ্গ সরকার শেষ পর্যন্ত কি করবেন বা না করবেন তা নির্ভর করবে।