কালান্তর পত্রিকা
৬ জুন, ১৯৭১
দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রের গড়িমসি
লোকসভায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম বলেছেন যে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের পূর্ণ দায়িত্ব কেন্দ্রের এবং সে দায়িত্ব তারা অস্বীকার করছে না। কিন্তু দায়িত্ব স্বীকার ও দায়িত্ব পালন এক কথা নয়। শরণার্থীদের যে প্রবল চাপ পশ্চিমবঙ্গের উপর পড়েছে তাত গুরুত্ব উপলব্ধি এ যাবত কেন্দ্রীয় সরকার করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। যদি উপলব্ধি করতেন তাবে তাঁরা সমস্যাটা জরুরী বিবেচনায় সমাধানের পথে আরো দ্রুত অগ্রসর হতেন। আসলে গোড়ায় গলদ। কেন্দ্রীয় সরকারের চূড়ামণিরা হয়তো ভেবেছিলেন দু’চার দশ লক্ষ শরণার্থী আসবে এবং তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় রেখে দিয়েই আবার স্বল্পকালের মধ্যে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়া যাবে। সমস্যাটা যে তার চেয়ে অনেক বেশী গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠতে পারে এমন দূরদৃষ্টি তাদের ছিলনা বলেই মনে হয়।
কিন্তু অবিরাম শরণার্থীর স্রোতে পশ্চিমবঙ্গ প্লাবিত হতে চলেছে। বন্যার জল বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। যে কোন সময় বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবনের মত এই জলস্রোত পশ্চিমবঙ্গের চরম বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তাই রাজ্য সরকার বিষম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। চল্লিশ লক্ষ শরণার্থীর মধ্যে অনুমান উনিশ লক্ষ ছাদের তলায় কোন রকমে মাথা গুঁজবার ঠাঁই পেয়েছে আর পাঁচ লক্ষাধিক শরণার্থী তাড়াহুড়ো করে তোলা চালায় আশ্রয় নিয়েছে। বাকি সব উন্মুক্ত আকাশ বা গাছের তলায়। প্রতিদিন জনস্রোতের মত শরণার্থীর দল চলে আসছে এপারে। নিচে জল-কাদা, উপরে বর্ষার ধারা। এই ছত্রহীন লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর কি দশা হবে এখন? মাথা গুঁজবার জন্যে তারা কোথায় যাবে? নাম তালিকাভূক্ত হবার পর চার দিনের মতো রেশন পায় তারা। বাকি ক’দিন কি দিয়ে উদরের জ্বালা নিবৃত্তি হবে তাদের?
তার উপর মহামারীর আকারে কলেরার প্রাদুর্ভাব। সর্বস্বান্ত হয়ে সুদূর পথ অতিক্রম করে যারা আসছে পথেই তারা প্রায় অর্ধ্মৃত হয়ে পড়ে। কোন প্রকারে মুমূর্ষ অবস্থায় এসে পৌঁছাবার পরেও যদি আবার তাদের চরম প্রতিকূল অবস্থারই মধ্যে পড়তে হয় তবে অবশিষ্ট প্রাণ শক্তিটুকুও নিঃশেষ হতে দেরি হয় না। হচ্ছেও তাই। কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়েই অনেকে আসছে এপারে; প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থা এতই অপ্রতুল যে তাদের মধ্যে অনেকেই প্রাথমিক চিকিৎসা পাবার আগেই চোখ বুঁজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। উপযুক্তসংখ্যক চিকিৎসক এবং শুশ্রূষাকারীরাও যেমন নেই তেমনি প্রয়োজনীয় ঔষধপত্রেরও অভাব।
এমন একটা গুরুতর পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরতার নমুনা দেখে অবাক হতে হয়। এ যাবত ত্রাণ কার্যের জন্য কেন্দ্রের কাছ থেকে এসেছে মাত্র ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বাবদ চাওয়া হয়েছে ২ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা; কিন্তু তা এখনো পর্যন্ত পৌঁছায়নি। আশ্রয়স্থল নির্মাণের জন্য ৩ কোটি টাকা চেয়ে পাওয়া গেছে মাত্র কোটি টাকা। কলেরা মহামারী আকারে দেখা দেওয়ায় কলেরা ইঞ্জেকশান ও স্যালাইন বোতল চেয়ে পাওয়া গেছে তা সমুদ্রে বারি বিন্দুবৎ। সুতরাং দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রীয় সরকার এ যাবত যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে তাতে কৃতার্থ না হয়ে পারা যায় না।
মুখে শরনার্থীদের জন্য দরদের অন্ত নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অমার্জনীয় ঔদাসীন্যের ফলে হতভাগ্য শরণার্থী ও পশ্চিমবঙ্গের নিরুপায় মানুষ উভয় কুলই যে ডুবতে বসেছে সে দিকে নজর আছে কার? কানে জল ঢুকলে টাকা হয়তো তারা কিছু দেবেন। কিন্তু টাকা দিলেই জিনিস মিলবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়? রেশন দিলেও তো তা রেঁধে খেতে হবে। শরণার্থীরা জ্বালানীর জন্য কার কাছে যাবে? সীমান্তবর্তী এলাকার যে সব শিক্ষায়তনে শরণার্থীদের ঠাঁই দেয়া হয়েছে দু’তিন সপ্তাহ বাদে গ্রীষ্মের ছুটি অন্তে যখন বিদ্যালয় খুলবে তখন এরা যাবে কোথায়? অন্যত্র না সরালে জেলার বহু ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাব। সুতরাং তাদের জন্যও নতুন আশ্রয় শিবির নির্মাণ করা দরকার। তাছাড়া যে বহু লক্ষ শরণার্তী বাতাবরণহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে অবিলম্বে তাদের তাঁবুর ছাউনী না করলে দারুণ বর্ষায় কি করে বাঁচবে তারা? সুতরাং আশ্রয় শিবির নির্মাণের জন্য চাই তাঁবু, করোগেটের শীট, অ্যাসবেস্টেস শীট, খুঁটি, নাটবল্টু, দড়িদড়া ইত্যাদি।
আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ঢিলেঢালাভাবে করার করার কাজ নয় এটা। জরুরী প্রয়োজন বোধে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অতি দ্রুত সারতে হবে এসব কাজ। তার জন্যে চাই একটি সার্বিক পরিকল্পনা ও সেই পরিকল্পনা ত্বরিতগতিতে রূপায়ণের জন্য চাই একটা উপযুক্ত পরিচালনাযন্ত্র। বর্তমান অবস্থায় ত্রাণকার্যে সামরিক ব্যাপৃত রাখ হয়তো সঙ্গত হবে না, কিন্তু সে ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন একটা বিশেষ ‘কোর’ গঠন করা এই জরুরী কাজ দ্রুত নিষ্পন্ন না করলে রাজ্য সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয় এত বড় দায়িত্ব বহন করা। অতএব কেবল অর্থ দিয়ে সাহায্য করলেই চলবে না, প্রয়োজনীয় সামগ্রীও কেন্দ্রীয় সরকারকেই সরবরাহ করতে হবে এবং শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও মূলত তাকেই নিতে হবে।