You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.19 | ভুট্টোর পিকিং সফরে পাকিস্তানের লাভ হয়নি | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

ভুট্টোর পিকিং সফরে পাকিস্তানের লাভ হয়নি
সাত্যকি চক্রবর্তী

শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী যখন ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রপতি নিকসনের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলােচনা করছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা শ্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো পিকিং গেলেন পাকিস্তান সরকারের এক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদলের নেতা হয়ে । শ্রী ভুট্টো ফিরে এসেছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক জগতে আবার আসর জাঁকিয়ে বসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে শ্রী ভুট্টোকে পাক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পিকিং পাঠিয়ে ছিলেন তা সফল হয়নি বলেই রাজধানীর রাজনৈতিক মহল মনে করছেন।
ভারত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রক সরকারিভাবে ভুট্টোর সফরের ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করেননি। তাঁরা পিকিঙে আমাদের চার্জ দ্য আফেয়ার্সের রিপাের্টকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করছেন। তবে রেসরকারিভাবে তারা যে অভিমত প্রকাশ করেছেন তার মােদ্দা কথা হয়—ভুট্টোর পিকিং মিশনে আর যারই লাভ হােক না কেন, পাকরাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কোন লাভ হয়নি। | চীন এবং পাকিস্তানের সম্পর্কে নিয়ে যারা পর্যালােচনা করেছেন তাদের অভিমত চীন এখন পাকিস্তানের দায়ে পড়া মিত্র, উৎসাহী বন্ধু নয়। পিকিং-এ শ্রী ভুট্টো এবং চীনা নেতাদের মন্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভুট্টো ভারতবিরােধী জিগির যতই তুলবার চেষ্টা করে থাকুন, চীনা নেতাদের সায় তাতে মেলেনি। পাকিস্তানের এই বিপদের দিনে চীন যদি আগের মতাে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চাইত তবে নিশ্চয়ই যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করত। কিন্তু চীনা নেতারা তা তাে করেনইনি, উপরস্তু শ্ৰী ভুট্টো অত্যধিক ভারতবিরােধী যে সব মন্তব্য করেছেন, চীনের সরকারি সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি সংবাদ পরিবেশনের সময় তা বাদ দিয়ে দিয়েছে।
এছাড়া বি বি সি প্রচারিত একটি ছােট্ট খবরও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। এই খবরে বলা হয়েছে পিকিং-এ শ্রী ভুট্টোর আবাসকক্ষের বাইরে একদল ছাত্র পাকিস্তান সরকারের বাঙলাদেশ নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। খবরটি যদি সত্য হয় তবে এর অর্থ হচ্ছে পাকিস্তান সরকারের বাঙলাদেশ নীতিতে চীন সরকারের পুরাে সায় নেই এবং তা ছাত্র-বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে শ্রীভুট্টোকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। চীনে কোনাে বিক্ষোভ নিঃসন্দেহে সরকারি সমর্থন ছাড়া হতে পারে না।
চীনের প্রধানমন্ত্রী শ্রীচৌ এন লাই ভােজসভায় যে বিবৃতি দিয়েছেন—তাতে পাকিস্তানকে “প্রত্যেকবারের মতাে” বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে সহযােগিতা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু বৈদেশিক শত্রু কে তা তিনি উল্লেখ করেননি। অপরদিকে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে কোনাে মন্তব্যও তিনি করেননি।
প্রকৃতপক্ষে এ বছরের প্রথম থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে তাতে পাকিস্তানি শাসকচক্র খুব আশা করেছিল পিকিং সরকারের পুরাে মদত তারা তাদের নীতির পেছনে পাবে। কিন্তু পাকিস্তানের এত প্রচেষ্টার পরেও যখন ইয়াহিয় সরকার চীনের প্রত্যক্ষ সমর্থন পেল না তখনই শ্রীভুট্টোকে পাঠানাে হলাে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে। শ্রীভুট্টো পাকিস্তানকে চীনের কাছাকাছি আনার ব্যাপার সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাই ইয়াহিয়ার ধারণা ছিল ভুট্টো নেতা হলে চীনের কাছ থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সাহায্য পেতে সুবিধা হবে।
এর আগে গত চার মাসে পাকিস্তান সরকার চীনকে তােয়াজ করার জন্য যা প্রয়ােজন তাই করছিলেন। ড. কিসিঙ্গার তার গােপন মিশনে পিকিং গেলেন পাকিস্তান সরকারের সহায়তায়। রাষ্ট্রসঙ্ঘে আলবেনিয়ার চীনের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবের সক্রিয় সমর্থক ছিল পাকিস্তান। আগস্ট মাসে হয়েছে ভারতে-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি, যার ফলে ইয়াহিয়া একদিকে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেও অপরদিকে চীনকে চাপ দেবার সুবিধা হয়েছে এই বলে যে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি চীন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, সুতরাং চীনেরও উচিত পাকিস্তানের সঙ্গে ঐ ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া।
নিঃসন্দেহে চীন এবং পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের বক্তব্যের যে সরকারি বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তাতে পাকিস্তান নেতাদের পক্ষে আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া যায়নি। শ্রীভুট্টো পিকিং যাবার আগে যতটা আস্ফালন করেছিলেন ফিরে এসে ততখানি করেননি। পাক রাষ্ট্রপতি নিউজ উইক’-এর প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজেই স্বীকার করেছেন যে চীন সামরিক সাহায্য দিলেও প্রত্যক্ষ ভাবে ভারত-পাক সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করবে না।
চীনের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি যার বিশ্লেষণ করেছেন তাদের অভিমত, পিকিং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বৈত নীতি অনুসরণ করবে। চীন যেমন সরাসরি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলবে না, অপরদিকে এমন কিছুও করবে না যাতে ভারতের পক্ষে সুবিধাজনক কোনাে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রসঙ্রে সদস্য হবার পর চীনের পক্ষে সুযােগ এসেছে এশিয়াতে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করবার এবং ভারত-পাক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তথাকথিত “নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে চীন বিশ্বের কাছে প্রমাণ করবার চেষ্টা করবে চীন শান্তিকামী যদিও এই মনােভাব পুরােপুরি বাঙলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।
চীন সম্পর্ক ওয়াকিবহাল রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে চীনের মূল স্বার্থ পশ্চিম পাকিস্তানে। সুতরাং চীন এই সুযােগে পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চাইবে। ইয়াহিয়া খান ডিসেম্বরে আগে যে অসামরিক সরকারের কথা বলছেন তাতে শ্রীভুট্টো উপপ্রধানমন্ত্রী হতে পারেন এবং এতে পিকিং-এর সাথে। আছে। অর্থাৎ এক কথায় যদি ভারত-পাক সংঘর্ষ বা মুক্তিফৌজের আক্রমণের তীব্রতায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে চীনেরই সুবিধা হবে। পশ্চিম পাকিস্তানকে চীন পুরােপুরি নিজ কজায় নিয়ে আসতে পারবে এবং তা চীনের জাতীয় স্বার্থের দিক থেকে হবে সবচেয়ে উপযােগী। এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলন বা মুক্তি-আন্দোলনের কোনাে সম্পর্ক নেই।

সূত্র: সপ্তাহ, ১৯ নভেম্বর ১৯৭১