বসিরহাট, বনগাঁ মহকুমায় শরণার্থীদের চিকিৎসায় সরকারী ভূমিকা
(স্টাফ রিপাের্টার)
কলকাতা ১৬ সেপ্টেম্বর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ, বসিরহাট, বারাসাত ও বারাকপুর মহকুমায় এখন মােট ৬৫টি শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী শরণার্থী সংখ্যা ৯,৬২,২৫৭। এছাড়া ২ লক্ষাধিক লবন্দ শিবিরে বাস করছেন। আর এর বাইরে এক বিপুল সংখ্যক শরণার্থী শিবিরের বাইরে পথিপার্শ্বস্থ গাছতলায় ছাউনি গেড়েছেন। অবিশ্রান্ত শরণার্থী স্রোতের মুখে অপেক্ষাকৃত খুবই সামান্য সংখ্যক চিকিৎসক তথা চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত কর্মী নিয়ে জেলার চিকিৎসা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তাগণ যথাসাধ্য প্রয়াসের দরুন পদব্রজে সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে সীমান্ত অতিক্রমকারী অগণিত নরনারীকে যেমন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, তেমনি খানসেনাদের বর্বর আক্রমণে গুরুতরভাবে আহত বহু নিরীহ মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছেন। তাই তাে জেলার তিনটি মহকুমা হাসপাতাল (বনগাঁ, বসিরহাট, বারাসত) এবং হাবড়া ও টাকীর দুটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে (গ্যাসট্রো এন্ট্রাইটিস), ডিপথেরিয়া, কলেরা, সূতিকারােগ, জলবসন্ত এবং অন্যান্য রােগে আক্রান্ত মােট ১৯,৪৭৫ জনের মধ্যে কেবল ১,৫৭৬ জন মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। আর পাকবাহিনীর হাতে গুরুতরভাবে আহত মােট ৫০৪ জনের মধ্যে কেবল ১০জন ছাড়া বাকী সকলেরই জীবন রক্ষা পেয়েছে। শুধু তাই নয়। ব্যাপকভাবে প্রতিটি শরণার্থীকে কলেরা ও বসন্ত প্রতিষেধক টীকা দেওয়ায় রােগের প্রকোপ বৃদ্ধি সম্ভব হয়নি। সরকারী প্রচার অধিকর্তা ও রাজ্য চিকিৎসা দপ্তরের পক্ষ থেকে গতকাল সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের বসিরহাট ও বনগাঁ হাসপাতাল এবং টাকী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পথে একটি শরণার্থী শিবিরের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগের কাজকর্মও দেখানাে হল। ১০০টি শয্যাবিশিষ্ট বসিরহাট মহকুমা হাসপাতালে শরণার্থীদের ব্যাপক আগমনের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য সাময়িকভাবে ৫০টি শয্যাবিশিষ্ট একটি শিবির হাসপাতাল যুক্ত করা হয়েছিল। এখন সেটি তুলে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৭৫টি শয্যাবৃদ্ধি করে চিরঞ্জন মেডিকেল হাসপাতাল মহকুমা মেডিকেল হাসপাতালের সঙ্গে যােগ করা হয়েছে। ফলে এখন মােট শয্যা সংখ্যা ২২৫। অথচ এ মুহূর্তে মােট ৩৮৩ জন রােগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এদের মধ্যে ২০৭ জন এসেছেন বাঙলাদেশ থেকে। একই হাসপাতালে এখনও শরণার্থীদের সঙ্গে স্থায়ী বাসিন্দাদের হয়েছে। ফলে বহু রােগীর স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না-তারা মেঝেতেই আশ্রয় গ্রহণ করছেন। এ দৃশ্য কলকাতার হাসপাতালগুলােতে স্বাভাবিক ও প্রাত্যহিক ব্যাপার। কিন্তু যেখানে আগত শরণার্থীদের জন্য সরকার সর্বপ্রকার সুযােগ-সুবিধাদানে সদা সচেষ্ট, সেখানে আজও শরণার্থীরা অমনভাবে কেন থাকবেন- বিশেষ করে সেই সব শরণার্থী-যারা পাক বাহিনীর গােলাগুলিতে গুরুতর আহত ? খুলনা জেলার সাতক্ষীরা থানার বেকারী গ্রামের দুর্গাপদ সরকার দেড় মাস আগে হানাদারদের আক্রমণের দরুণ প্রাণভয়ে ভারত সীমান্তের দিকে ছুটে আসছিলেন, পথে পাক বাহিনী ক পুঁতে রাখা মাইনে তার পা উড়ে গেছে। তিনি এখনও হাসপাতালের মেঝেতে শায়িত। প্রশ্ন উঠতে পারে বিকল্পটা কি ? বিকল্প হল সাময়িকভাবে হলেও বসিরহাট হাসপাতালে শরণার্থী নন-এমন লােকজনকে ভিন্ন হাসপাতালে রাখা। এই দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। ৪৫ জনকে কলকাতার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ৩,০৯৪ টি কলেরা ও গ্যাসট্রোএন্ট্রাইসিস রােগীকে ঐ একই সময়কালের মধ্যে চিকিৎসা করা হয়েছে; তার মধ্যে মারা গেছেন ১৭০ জন। ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক জানালেন, আগষ্ট মাসের শেষে কলেরা রােগীর সংখ্যা অনেক কমে এসেছিল। কিন্তু সম্প্রতি আবার সংখ্যাটি বাড়ছে। প্রতিদিন গড়ে ২৫ জন কলেরা রােগী আসছেন। এর মূল কারণ বন্যাজনিত পরিস্থিতি-সমগ্র বনগাঁ শহরের বৃহৎ অংশ এখন ইছামতির জলােচ্ছাসে জলবন্দী। এবং জল ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বনগাঁ হাসপাতালেও বহু মহিলা রােগী মেঝেতে শায়িত। গতকাল খানসেনাদের গুলিতে আহত জনৈকা রমনী এসে ভর্তি হয়েছেন, আধাে তন্দ্রারঘােরে তখনও তিনি ভুল বকছেন। নিজের নামটাও ভালভাবে বলতে পারলেন না। তারও স্থান সঙ্কুলান হয়নি শয্যায়, মেঝেতে পড়ে আছেন। টাকীর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, এখন ৫০টি শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত এখানকার ইনডােরে ৭,২৯৫ এবং আউটডােরে ৮,২৬৯ জন রােগীকে চিকিৎসা করা হয়েছে, এদের মধ্যে কলেরা ও গ্যাসট্রোএনট্রাইসিস রােগাক্রান্তদের সংখ্যাই সর্বাধিক ২,২২১- এবং ঐ রােগে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা গেছেন ১৩৯ জন। ২৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজন মারা গেছেন।
সূত্র: কালান্তর,১৭.৯.১৯৭১