কালান্তর পত্রিকা
২৪ মে, ১৯৭১
একটি নির্ভিক কণ্ঠ
এবার একটি নির্ভিক কণ্ঠ সোচ্চার। শেখ মুজিবরই পাকিস্তানের অখণ্ডতার শত্র – ইয়াহিয়া খান ও তাঁর জঙ্গী চক্রের এই অপপ্রচার ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন স্পষ্টবক্তা বাদশা খান। তিনি বলেছেন, মুজিব সাহেব পাকিস্তান ধ্বংস করতে চান নি, পাকিস্তান যদি ধ্বংস হয়ে থাকে তবে তাঁর জন্য দায়ী পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো ও মুসলিম লীগ নেতা কাইয়ুম। বাঙালীরা খাঁটি মুসলমান নয় – এমন প্রচার করতেও শয়তানরা ছাড়েনি। তাঁর জবাবে বাদশা খান বলেছেন, বাঙালীরা খাঁটি মুসলমান এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য অন্য যে কারো চাইতে তাদের বেশী। দেশ ভাগের আগে একমাত্র বাংলাদেশেই মুসলীম লীগ সরকারের অস্তিত্ব ছিল, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু বা পাঞ্জাবে তা ছিল না। বাঙালীদের চেষ্টায়ই পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। অতএব, পাকিস্তানের প্রতি বাঙালীদের আনুগত্য ছিল না, একথা অবিশ্বাস্য।
বাদশা খানও সেই একই প্রশ্ন তুলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইবে কেন? বাঙালীরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে দাবিয়ে রাখার জন্যই সামরিক আইন জারি করে বাংলাদেশে ট্যাঙ্ক, মেশিনগান ও বোমা চালিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পথ নয়। আসলে পাঞ্জাবের পুঁজিপাতি গোষ্ঠী ও সামরিক প্রভুদের ক্ষমতা কায়েম রাখার জন্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের উপর এই বলপ্রয়োগ। বাদশা খান তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বলেছেন, হতভাগ্য বাঙালীদের একমাত্র অপরাধ যে, তাঁরা নির্বাচনের মাধ্যমে গোটা পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবিকেই যদি ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সর্বনাশের কারণ বলে মনে করেন, তবে সেই ছয় দফা দাবীর বিরোধিতা গোড়া থেকেই তিনি করলেন না কেন? প্রায় এক বছর ধরে এই ছয় দফা দাবীতে আওয়ামী লীগ প্রচার এবং সেই দাবীর ভিত্তিতেই সে নির্বাচনে জয়ী হয়। বাদশা খান প্রশ্ন করেন, তখন তা বন্ধ করে দেবার কথা সামরিক রাষ্ট্রপতির মাথায় ঢোকেনি কেন? বাংলাদেশে গিয়ে তিনি কেনই বা বললেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানই পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী? মুসলীম লীগ নেতা কাইয়ুম সাহেবও তো বলেছিলেন, ছয় দফা দাবি পূর্ন পাকিস্তানের পক্ষে প্রযোজ্য। ভুট্টো সাহেবও তো আওয়ামী লীগের ছয় দফার মধ্যে পাঁচ দফা দাবি মেনে নিয়েছিলেন।
তথাপি সব কেঁচে গন্ডুষ হয়ে গেল কেন? বাদশা খান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এর উত্তর দিয়েছেন।
জিন্নার আমলে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে অনুরুপ জুলুম হয়েছিল। পাকিস্তানের সবে জন্ম হয়েছে। সীমান্ত প্রদেশের বিধানসভায় তখন ছিল বাদশা খানের দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পঞ্চাশ জন সদস্যদের মধ্যে তেত্রিশ জনই ছিলেন তাঁর দলের। জিন্না সাহেব জোর করে সেই দলের মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে সংখ্যালঘু দলকে মন্ত্রীসভা গঠন করতে ডাকলেন। কেবল তাই নয়, বান্নু যাবার পথে বাদশা খানকে গ্রেপ্তার করা হল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ইপির ফকিরকে দেবার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আরো রটিয়ে দেওয়া হল, পাকিস্তানকে তিনি বালির ঢিপি এবং এক লাথিতে তিনি তা উড়িয়ে দেবেন। প্রচার চলল, বাদশা খান বিশ্বাসঘাতক ও হিন্দুদের দালাল। সঙ্গে সঙ্গে বহু লোককে গ্রেপ্তার করা হল। এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করতে ও নামাজ পড়তে জুম্মাবারে যারা বারবারায় এসে জামায়েত হল তাদের উপর চলল বোমা ও মেশিনগান। শত শত নরনারী ও শিশু প্রাণ হারাল। তারপর সারা প্রদেশে চলল লুণ্ঠন, মারপিট ও নানাবিধ লাঞ্ছনা। হাজার হাজার খোদাই খিদমৎগারকে আন্দোলন ও তাঁর মুখপাত্র ‘’পুশতুন’’ নিষিদ্ধ করে দিল।
বাদশা খান বলেছেন, সেদিন সংখ্যাগুরুদের উপর সংখ্যালঘু কর্তৃক চাপিয়ে দেবার জন্য পাকিস্তানের জনক খোদ জিন্না সাহেব যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগকে দাবিয়ে ভুট্টোর সংখ্যালঘিষ্ঠ পিপলস পার্টিকে পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসবার জন্য সেই একই বলপ্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেছেন সামরিক রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বাদশা খান চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে গুরু যে পথ নিয়েছিলেন, শিস্যও সেই পথ ধরেই চলেছেন।
তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, বলপ্রয়োগের দ্বারা পাকিস্তানের জনসাধারণকে আর ভুলিয়ে রাখা সম্ভব নয়। যদি একসাথে থাকতে হয় তবে ভাই ভাই হয়ে থাকতে হবে। সমমর্যাদা ও সমান অধিকার স্বীকার না হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের অঙ্গ রাজ্যগুলোর সংখ্যালঘুরা আমরিক শাসকের কাছে কী-ই বা প্রত্যাশা করতে পারে? পশ্চিম পাকিস্তানের অঙ্গ রাজ্যগুলোকে মিলিয়ে আবার যদি একটি প্রদেশে পরিণত করা হয়, তা শাসন ক্ষমতায় যদি ভুট্টোর দল এসে বসে, তবে পাশতুনরা তা কিছুতেই বরদাস্ত করবে না বলে বাদশা খান হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কারণ, তাঁর মতে তা হবে দাসত্ব ও শোষণকে বরণ করে নেওয়া।
বাদশা খান পাকিস্তানের কল্যাণকামী বলেই একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। বর্ত্মান পাক সরকার যদি প্রয়োজন বোধ করেন, তাঁকে মধ্যস্ত মানতে পারেন। সম্মতি পেলে তিনি সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি নিয়ে বাংলাদেশ যাবেন। তাঁর আগে পাক সরকারকে কথা দিতে হবে যে, তাঁরা শান্তি চান। মুজিব ও তাঁর সমর্থকরা বাদশা খানের প্রস্তাবে সম্মত হবেন কি-না সেটা বড় কথা নয়, শান্তিপূর্ন পথে সমাধান সম্ভব কি-না তাঁর চেষ্টা করে দেখবেন তিনি। তাঁর প্রস্তাবে পাক সরকারের কোন সাড়া পাওা যায়নি এখনো পর্যন্ত। সাড়া পাওয়া যাবে বলেও মনে হয় না। সদিচ্ছা থাকলে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক অধিকারকে এভাবে পিষ্ট করে ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতেন না।