You dont have javascript enabled! Please enable it! ফ্রন্টিয়ার পত্রিকা, ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১, সাপ্তাহিক ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

সাপ্তাহিক ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ
সুত্রঃ ফ্রন্টিয়ার
তারিখঃ ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১
সম্পাদকীয়ঃ দ্যা ফ্যামিলিয়ার প্যাটার্ন 

মার্চে অনেক চিত্রই পাল্টে গিয়েছে । ভারতে ছিলো ইন্দিরার আকশচুম্বি জনপ্রিয়তা , যা ছিলো  কিছুটা ভিন্নমাত্রার । ১৮ই মার্চ ছিলো  প্যারিস প্রজাতন্ত্র  খ্যাত  এক বিখ্যাত বিদ্রোহের শততম বার্ষিকী । এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাউস আক্রমণের পরাজয়ের একটি  ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে  , কিন্তু তার  আগে বিশ্বের সকলেই  আমেরিকান শক্তির  পরাজয়ের তীব্রতা এবং তাত্পর্য অনুমান করতে সক্ষম হয়েছিল ।  রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান তাঁর পূর্ব পাকিস্তানে তার সৈন্যবাহিনীকে মোতায়েন করেছেন । আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ  প্রচলিত উপায়ে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তুত কিন্তু রক্তপাতের জন্য নয় । বাংলাদেশীদের  মধ্যে যে সাহসী ও অসম সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ  তৈরি হয়েছিলো সেটাকে তুলনা করা যায়    সিরমানভো বাঁন্দারানায়েকের নেতৃত্বে সিলন সরকারের নেয়া  “সন্ত্রাসীদের” বিরুদ্ধে পদক্ষেপ যেটাতে  কতগুলি নিহত হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি।আবারও এটা স্পষ্ট যে, এই ধরনের  সরকারগুলো কোন ধরণের সমাজতন্ত্রের আদর্শে  প্রভাবিত হয়ে শপথ গ্রহণ করে এবং সাম্রাজ্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াতে  নিজেদের  শ্রেষ্ঠ করে তোলে । বিদ্রোহী  বা বিপ্লবী  বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্রাজ্যবাদীদের কৌশল হলো  বিখ্যাত আমেরিকান কৌশল যা তারা এই শতাব্দিতে  ইন্দোচিন থেকে পাওয়া আমেরিকান অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে  যে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম এড়িয়ে চলতে হবে। আন্দোলন যখন শুরু হতে থাকবে তখনি সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করো  ।এই হল ব্লিটসচরিগ এর মতবাদ যা পূর্ববঙ্গে ইয়াহুয়ার ইয়াহিয়া যোদ্ধা এবং সিলেনিয়ান বাহিনী গ্রহণ করেছে , আর যখন ভারতবর্ষে এসব ঘটে চলেছে তখন কিছু অসাধু সংবাদপত্রের মাধ্যমে  মিথ্যা সংবাদে মানুষকে ধোকা দেয়া হচ্ছে ।

শাসকগোষ্ঠীর দরকার তড়িৎ জয়লাভ ।  যদি একটি নিরস্ত্র ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা যুদ্ধ করে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিজয় ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়, এরচেয়ে  বেশি স্বাগত আর কিভাবে জানানো যেতে পারে! এর ফলে হত্যাকাণ্ড এবং  দারিদ্র্যতা  কম হবে । কে চায় মানুষ নারী ও শিশুদের দিনের পর দিন  গৃহহীন বা জবাই করা দেখতে ? কিন্তু জনগণের জন্য এই ধরনের বিজয় একটি অলৌকিক ঘটনা হবে। অলৌকিক ঘটনা সাধারনের জীবনে  আসেনা ।এটা অনেক দূরের পথ যেখানে আবার  পূর্ব বাংলার কবিরা  গভীর রাতে  লিখতে পারবেন  গাছের পাতায় পরা  বৃষ্টির শব্দ নিয়ে কবিতা  ।

এটা কোনও বিষয় নয় যে আমাদের নেতারা এবং আমাদের সংবাদপত্র জানবে না পশ্চিমবঙ্গে কি  থেকে কি হচ্ছে ।  পত্রিকার হেডলাইনে  প্রতিদিনের প্রতিবেদনে  বলা হচ্ছে সৈন্যরা  এই বা সেই শহরে নিয়ন্ত্রন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত  করছে । তারপর সৈন্যরা পর মনে করে যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা  ব্যর্থ হয়েছে এবং ভারতের ঐক্যবদ্ধ ঐক্যের হুমকি হ্রাস পেয়েছে  । ভিয়েতনামের মতো কৌশলী চিন্তধারার একদল  গ্রামবাসীর  সাথে মিজো পাহাড়ে এই ধরনের যুদ্ধ প্রায় ৫ বছর চলেছিলো যাতে ব্যবহার হয়েছিলো স্টেন গান এবং হেলিকপ্টার । কাশ্মিরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য এই কাজ আরো সহজ ছিলো । কেউ আশা করতে পারেনি  যে নয়াদিল্লি জাতিসংঘে পূর্ববাংলার সমস্যা  উত্থাপনের ব্যাপারে খুব উত্সাহী হবেন, যেমনটা সবাই আশা করেনি সেভাবে।

মুজিব সমর্থকদের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের জন্য দাবী এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি আলাপচারিতায় পরিণত হতে দেখলে নয়াদিল্লীই সবচে বেশী খুশি হবে ।কিন্তু যেহেতু ব্যাপারগুলো এখন  ফিরিয়ে নেবার সীমা  অতিক্রম করে চলেছে, সবই একটি নিছক সমাপ্তির জন্য অপেক্ষা  করছে এখন । নয়াদিল্লি, ওয়াশিংটন এবং মস্কোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের সাথে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে । এটা জেনে আগ্রহ বোধ করছি , যখন একজন বাঙালি বিপ্লবী (তিনি পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন) প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন , তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যে জনাব পডগর্নি ও মিঃ নিক্সন উভয়ই জেনারেল ইয়াহিয়া খানে বলে গণহত্যা থামিয়েছেন।ঘটনাটি ছিলো পাডগরনির চিঠি আসার  কয়েক দিন পূর্বে । সবাই জানত এটা আসছে।

নয়াদিল্লী নব্য বাংলাদেশেকে কেমন নজরে দেখবে ? চলমান নেতৃত্ব কি   দ্রুত এবং তরুন মৌলবাদী নেতৃত্ব দ্বারা পুনোরাস্থাপিত হবে । কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের নেতৃত্ব কে নিয়ন্ত্রনের জন্য বামপন্থী নেতৃত্বে চাইবে যদি একটি ডানপন্থি  নেতৃত্ব  ক্ষমতা গ্রহণ করে । যদি কোনও ডানপন্থি নেতৃত্ব ক্ষমতা গ্রহণ করে, তবে নতুন রাষ্ট্রের অর্থনীতি পুনর্নির্মাণের জন্য ও  বৃহত্তর অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য  এক বা উভয় সুপার পাওয়ার  ক্ষমতা দেখাবে । উপমহাদেশে দুই দেশের মধ্যে মধ্যে কাজ  করা দুটি সুপার পাওয়ার কে এখানেও দেখা যেতে পারে । ভারত এর নিরাপত্তার জন্য এক পাকিস্তানের চেয়ে   দুই “পাকিস্তান”  পার্থক্য করে তোলে । কিন্তু যদি একটি শক্তিশালী বামপন্থী আন্দোলন বাংলাদেশে বৃদ্ধি পায়, তাহলে ভারত বা  সুপার পাওয়ার কারো জন্যই  পরিস্থিতি এতটা ভালো থাকবেনা ।যদি স্বাধীন বাংলাদেশে বাম শক্তি বৃদ্ধি পায় তবে চীনাদের জন্য  তাদের অস্ত্র সাহায্য করতে  কোন সমস্যা হবেনা  । ঠিক এই ভয়টাই নয়াদিল্লিতে বেশি উচ্চারিত হয়।

এর বাইরে, বাংলাদেশের  বা এর  সাইক্লোনের জন্য নয় দিল্লির উদ্বেগ সামান্যই রয়েছে। এটি অদ্ভুত কাকতালীয় যে “বাম  সেন্টার” বা “বাম-ভিত্তিক” সিলন সরকার (কোণ ক্ষত্রে মিসেস গান্ধীর জন্য একটি আদর্শ ) “চে গেভারিস্ট” বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন সিপিআই- এম এর  সরকার নক্সালবাড়ি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নেয়া ব্যাবস্থার চেয়েও । চে গুয়েভারারদের নিন্দা করার জন্য  যখন সিলনের  কমিউনিস্ট ও ট্রটস্কি (এখন একক ফ্রন্টে) সম্মিলিত হতে পারে, যখন মিসেস বন্দরনায়েকেও তার চার্জকে সমর্থন করার জন্য আহ্বান জানায় না যে সমগ্র আন্দোলনটি বিদেশী সংস্থা দ্বারা সমর্থিত। একটি সরকার যারা নিজেদের  বাম দাবি করে তাআরা  বাম থেকে  আসা  কোনও চ্যালেঞ্জ সহ্য করতে পারেনা , ডানপন্থি শক্তিই সেখানে সর্বাধিক ও সঠিক । দুই ক্ষেত্রেই , যেখানে  ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি সিলেনের চে গেভোরিস্টদের নিন্দা করার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা দেখেনা আবার  তারা বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতেও  কোন অসুবিধা পায় না। বাংলাদেশের  এবং সিলনের বিদ্রোহের মধ্যে, ভারতের দুই কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদেরকে বিস্মিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশ ও সিলনে চলা বিদ্রোহতে নিজেদের অবস্থান নিয়ে  ভারতের কমউনিস্ট  পার্টির নিজেদের বিস্মিত হওয়া উচিত । ভারতীয় কমিউনিস্টরা  কোনও ক্ষেত্রে জাতীয়তার  প্রশ্নকে প্রশ্নবিদ্ধ  করেনি  এবং এরকম পরিস্থিতি হলে তা  পর্যালোচনার জন্য  মস্কোতে প্রেরন করতো । যখন মন্ত্রিপরিষদ মিশন ভারত সফর করেছিল, তখন সিপিআই দেশের সংবিধানের প্রতি  সম্মতি জানায়। এর আগে, তারা দুই দেশ তত্ত্বের ভিত্তিতে  একটি “শিখ মাতৃভূমির” গঠন করাকে  সমর্থন করে আসছিলো । যখন ভারতের জাতীয় প্রশ্ন সোভিয়েত চিন্তাধারা বদলে গেল, তখন সিপিআই নেতৃত্ব নিখুঁত বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠে এবং প্রত্যেক বিষয়ে জাতীয় সাংস্কৃতিক অবস্থান গ্রহণ করে।

বাংলাদেশে সশস্ত্র সংগ্রাম এবং সিলেনের বিদ্রোহ নিরপেক্ষভাবে, সংসদীয় পদ্ধতিতে বিশ্বাসী কোন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে  স্বাগত জানানোর জন্য  অপ্রত্যাশিত বিষয়। এর সাপেক্ষে প্রথমত অনেক  কারন থাকতে পারে  কিন্তু অবশ্যই এটা না যে  কমিউনিস্ট পার্টি উপ মহাদেশের কোন সশস্ত্র সংগ্রামকে ভালবাসে । দ্বিতীয় কারণ হতে পারে  উপমহাদেশে যে কোনও জায়গায় বিদ্রোহ  সংসদীয় গনতন্ত্রে যারা বিশ্বাস করে  তাদের কাছে  অসন্তোষজনক ।