You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.06 | ইয়াহিয়া খানকে কে বাঁচাবে? | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়া খানকে কে বাঁচাবে?

যে-হাঁস সােনার ডিম পাড়ে অতি-লােভে সেই হাঁসকেই খুন করতে পারে এমন মূখের সন্ধান আমরা শিশুপাঠ্য নীতিকথাতেই পেয়েছি, কিন্তু বাস্তবে সেই মহামূর্খতের দেখা পাওয়া গেল ইসলামাবাদে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তার পূর্বসূরীরা তেইশ বছর ধবে পূর্ব বাংলার সােনার ডিম দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উদর করেছেন। কিন্তু ইসলামাবাদ ধবে নিয়েছিল যে, পূর্ব বাংলার মানুষ বরাবরই মুখ বুজে পশ্চিম পাকিস্তানকে সােনার ডিম জুগিয়ে যাবে, ভুলেও ভাবে নি যে এর ফলে একদিন গােটা পূর্ব বাংলাই হাত ছাড়া হয়ে যাবে আর সেই সঙ্গে বন্ধ হবে সােনার ডিমের চালান। নীতিকথার সেই মূর্খটা তবু গায়ের জোরে হাঁসটাকে বাঁচিয়ে নিজের দখলে রাখার চেষ্টা করে নি, কিন্তু ইয়াহিয়া খান ও তার অন্ধ সাঙ্গোপাঙ্গেরা আবার সেই ব্যর্থ চেষ্টাতেই মেতেছেন। পূর্ব বাংলা থেকে শােষণ-করা যে কোটি কোটি টাকা দিয়ে ইসলামাবাদের গদীর ভিত তৈরি হত সেটি তাে গেছেই, তার ওপর মিলিটারির বুটের তলায় পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে পিষ্ট করতে গিয়ে পাক শাসকদের আবার বাড়তি কোটি কোটি টাকা গলে যাচ্ছে। সে-খরচের বহরটাও রােজ প্রায় এক কোটি টাকার মতাে। ইয়াহিয়া খান সাহেব যেন একটি মােমবাতির দুটি দিক একই সঙ্গে জ্বেলে দিয়েছেন। ফলে পাকিস্তানের বৈষয়িক ব্যবস্থার বাতিটি যে নিবুনিবু হয়ে এসেছে তাতে আর আশ্চর্য কী? অপেক্ষা এখন শুধু লালবাতি ফোকার। পাক সরকার স্বভাবতঃই চোখে অন্ধকার দেখছেন। দেশে-দেশে আবেদন পাঠিয়েছেন সাহায্য দাও। অন্ততঃ ঋণ শােধের দায় থেকে কিছুদিনের জন্যে মুক্তি পেলেও পাকিস্তান নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পায়।
তবে পূর্ব বাংলায় সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার আগে যে পাকিস্তানের বৈষয়িক অবস্থা খুব একটা ভালাে ছিল তা নয়। অর্থনীতিবিরা বলেন, কোনাে দেশের সঞ্চিত বিদেশী মুদ্রার পরিমাণ ২০ কোটি ডলারের কম হলেই বিপদ আসন্ন মনে করা উচিত। পাকিস্তানের সেই বিপদ আসন্ন মনে করা উচিত। পাকিস্তানের সেই বিপদ এসেছে অনেক দিন আগেই। গত জানুয়ারীতেই সঞ্চিত বিদেশী মুদ্রার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১০ কোটি ডলারের কম। আর এপ্রিলের শেষে ঐ থলিতে ৮ কোটি ডলারের খুব বেশি জমা নেই। এর কারণ রপ্তানির পরিমাণেও বিশেষ বাড়ে নি। এই অবস্থাতেই পাক শাসকেরা ভারতের সঙ্গে হাজার বছরের যুদ্ধের থিওরি অনুযায়ী প্রতি বছর রাজেটের অর্ধেকেরও বেমি টাকা ব্যয় করেছে সামরিক যন্ত্রটিকে চালু রাখতে। এখন বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে এই সংকট ইসলামাবাদকে একেবারে দেউলিয়া করে দেওয়ার উপক্রম করেছে। রপ্তানি করে বছরে পাকিস্তানের মােট বিদেশী মুদ্রা আয় হত ৩০০ কোটি টাকার বেশি আর তার প্রায় অর্ধেকটাই আসত পূর্ব বাংলার পাট ইত্যাদি বেঁচে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে রপ্তানি এখন বন্ধ। গত দু’মাসে রপ্তানি বাবদ ক্ষতির পরিমাণ ৪০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে বলে আশঙ্কা করছে পাকিস্তান টাইমস্ পত্রিকা। আর পূর্ব বাংলা থেকে কাঁচামাল আমদানির অভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক কল-কারখানাও অচল, হাজার হাজার কর্মী বেকার। পশ্চিম পাকিস্তানের কল-কারখানায় যা তৈরি হচ্ছে তাও জমে উঠেছে। কারখানারই দোরগােড়ায়, কারণ ঐ সব পণ্য চড়া দামে পূর্ব বাংলাকে বছরে প্রায় ১৩০ থেকে ১৪০ কোটি টাকার মাল বিক্রী করত, আর পূর্ব বাংলা থেকে কিনত মাত্র ৮০-৯০ কোটি টাকার মাল। বাঙলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার ফলে এখন এই লােভনীয় বাজারটি গেছে হাতছাড়া হয়ে। ইতিমধ্যেই এর দরুণ ২৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে বলে হিসেব দিয়েছে খােদ পাকিস্তান টাইমস্। এই সঙ্কটের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে রােজ কোটি কোটি টাকা গলে যাওয়ায় পাক সরকার অমদানির ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করছে, ফলে কাঁচামালের অভাব আরাে গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ওপর যদি আবার অন্যান্য দেশের ধার শােধ করতে হয় তবে ইয়াহিয়া খান সাহেবের মাথায় হাত দিতে হবে বৈকি?
পাকিস্তানকে যে-সব দেশ অর্থ সাহায্য দেয় তারা অবশ্য ইয়াহিয়া খানকে ভরাডুবি থেকে বাঁচাতে রাজী আছে—তবে তার জন্যে তারা বড় চড়া মাশুল চাইছে। বাঙলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পাকিস্তানি টাকার আন্তর্জাতিক দাম অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। উত্তমর্ণ দেশগুলি তাই পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে, এই সুযােগে পাকিস্তানি টাকার আন্তর্জাতিক মূল্য হ্রাস করা হােক। গত কয়েক বছরেও বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফন্ডের পক্ষ থেকে এই চাপ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তখন পাক সরকার কোনােরকমে তা ঠেকিয়েছিলেন। এবার বােধহয় আর তার পারা যাবে না। কিন্তু ডিভ্যেলুয়েশনের ফলে পাকিস্তানের বরাতে হয়ত কিছু অর্থ সাহায্য জুটবে, কিন্তু তার আদি রােগ সারবে কী? টাকার দাম হ্রাসের ফলে রপ্তানির ক্ষেত্রে সাধারণতঃ যে-সুবিধে হয় পাকিস্তান তা পাবে কোথা থেকে? রপ্তানি বৃদ্ধির জন্যে পথমতঃ উৎপাদন বৃদ্ধি দরকার। বাঙলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধের বােঝা ঘাড়ে নিয়ে এবং বাঙলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর উৎপাদন বৃদ্ধি পাকিস্তানের পক্ষে কতখানি সম্ভব? আর বিদেশ থেকে যে-অর্থ সাহায্য পাওয়া যাবে তা তাে ব্যয় হবে বাঙলাদেশে দমননীতি চালাতে, উৎপাদন বৃদ্ধিতে নয়। সুতরাং, বিদেশী রাষ্ট্রগুলিকে এই প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে যে, বাঙলাদেশে পাকিস্তানি বর্বরতা চলতে থাকা সত্ত্বেও কি তারা পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য দিয়ে যাবেন? নীতি বা মানবতা আর আমরা পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে আশা করি না কারণ বাঙলাদেশে পাক ফৌজের পাশবিক কীর্তিকলাপ সম্পর্কে কেউই মুখ খােলে নি। কিন্তু নিছক অর্থনৈতিক বিচারেও পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য দেওয়া কি এখন শুধু ফুটপাত্রে জল ঢালার মতাে হাস্যকর প্রয়াস। অবশ্য চীন পাকিস্তানকে সাহায্য দেবে বলে যে শােনা যাচ্ছে, সে-বিষয়ে কিছু মন্তব্য করা বৃথা, কারণ চীনের কাছে ন্যায়নীতি বা অর্থনীতি কোনােটাই বড় নয়, সবচেয়ে বড় তার নিজের স্বার্থ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ মে ১৯৭১