মেয়েদের দুনিয়া শরণার্থী শিবিরে কয়েকদিন
– রীণা সেনগুপ্ত
সামরিক একনায়ক ইয়াহিয়া খায়ের বর্বর অত্যাচারে বাঙলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ নারী, শিশু, বৃদ্ধ ছুটে চলে আসছে বন্যার ঢলের মত, আছড়ে পড়ছে সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে। এই বিপুলসংখ্যক নরনারী প্রতিদিন অবিরাম স্রোতে অন্যান্য স্থানের মত ২৪ পরগনা জেলারও নানা অংশে উপচে পড়ছে। সংবাদপত্রে এই সহায় মানুষের দুরবস্থার চিত্রের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ প্রকাশিত হচ্ছে আর তাই পড়ে আমরা শিউরে উঠছি। বার বার মনে হয়েছে ঘৃণ্যতম অপরাধের বলি এই মানুষগুলির কাছে যদি যেতে পারতাম, তাদের জন্য ক্ষুদ্র সামর্থ নিয়ে হাজির হতাম। কিন্তু নিজেদের কর্ম-চক্রের গােলক ধাঁধায় সে সময়, সুযােগ আর হয়ে উঠে না। শেষ পর্যন্ত আর হয়ে উঠে না। শেষ পর্যন্ত এক সুযােগ মিলে গেল। মহিলা সমিতির থেকে এই শরণার্থীদের নিকট পৌঁছতে হবে। প্রথম যে দল এই উদ্দেশ্যে রওনা হয়, কলকাতা থেকে তাতে যােগদানের সুযােগ পেয়ে গেলাম। ঠিক হল ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ মহিলা সমিতি যে সেবা কেন্দ্র পরিচালনা করছেন তাদের সঙ্গে আমরা কয়েকদিনের জন্য নিযুক্ত থাকব।
সকালবেলা ট্রেন ধরলাম শিয়ালদহে। আমরা ছয় জন কলকাতার, একত্রিত হলাম বনগাঁয় বেলা তিনটায়। পথে যেতে যেতে দেখেছি ট্রেনে অনেক তরুণ এবং কিশাের। এদের মুখে শুনলাম যশাের জেলার লােক এরা। ওরা বলছিল ইয়াহিয়ার দালাল মুসলীম লীগ ও জামাতে ইসলাম দলের লােকেরা এমন কি কিছু কিছু লােক যারা আওয়ামী লীগকে ভােট পর্যন্ত দিয়েছিল, তারা এই অবস্থার সুযােগ নিয়ে তাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, লুঠ করে নিয়েছে এবং নানা ধরণের অকথ্য অত্যাচার করছে। এই বক্তব্যের সমর্থন আমরা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শিবিরে গিয়েও পেয়েছি। এই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই এরা যা কিছু সঙ্গে নিতে পেরেছে বা পারেনি, চলে এসেছে পশ্চিমবঙ্গে।
বনগাঁ পোঁছে আমরা স্থানীয় মহিলা সমিতির নানা রকম তৎপরতার খবর পেলাম। ইট ভােলা শিবিরে গিয়ে দেখলাম ১৮০০০ শরণার্থীর এক বিশাল শিবির। এই শিবিরের দুগ্ধ বিতরণের ভার গ্রহণ করেছে স্থানীয় মহিল সমিতি। প্রতিদিন বিকালে ৪০০০ শিশুকে দুগ্ধ বিতরণ করা হয়। অত্যন্ত নিখুঁতভাবে অক্লান্ত নিষ্ঠায় এই কাজ করেন স্থানীয় মহিলা কর্মীগণ।
পরদিন সকালে দেখা হল আওয়ামী লীগের একজন এম, এন এ ও একজন এম, পি, এ’র সঙ্গে তাদের স্থানীয় অফিসে। তারা তুলে ধরলেন সামরিক বাহিনীর অকথ্য অত্যাচার, বিশেষ করে নারী নির্যাতনের কাহিনী। আমাদের অনুরােধ জানালেন বিশ্বের নারীসমাজের কাছে এই নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরতে এবং বাঙলাদেশের ঘটনার প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে।
শত দুঃখ দুর্দশা বরণ করা সত্ত্বেও বাঙলাদেশের তরুণেরা তাদের মাতৃভূমির মুক্তি সম্পূর্ণ করতে কৃতসঙ্কল্প। তারা গেরিলা যুদ্ধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে চায়। আমাদের এই ধরণের একটি শিবির দেখার সুযােগ হল, এখানে তরুণেরা নিজেদের প্রস্তুত করে তুলছেন আগামী দিনের সংকল্প পূরণের জন্য। যদিও এরা কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের অভ্যাস করছে, এদের কিন্তু খাদ্য ও পােশাকে অবস্থা অত্যন্ত করুন। ডাল, ভাত, তরকারীও পর্যাপ্ত নয়। লুঙ্গী পরে নগ্ন গায়েই কুচকাওয়াজ করছে। এদের অদম্য উৎসাহ দেখে মনে হয়, এই দুর্দশার অন্ধকারের মধ্য দিয়ে মুক্তির সূর্য উঁকি দিচ্ছে যে ২৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা খুবই কম। বিভিন্ন শিবিরে যে হিন্দু তরুণেরা রয়েছে তাদেরও আজ মুক্তিযুদ্ধে যােগ্যস্থান গ্রহণ করা দরকার। এ বিষয়ে তারা যত সচেতন হবে ততই এই মুক্তিযুদ্ধের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এ দেশে সাম্প্রদায়িক ও বিভেদপন্থী শক্তি, এই অবস্থার সুযােগে কার্যত যারা ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য সফল করার হাতিয়ার হিসাবে কাজ করছে, তাদেরও মুখের মত জবাব দেওয়া হবে। ভারতে আগত হিন্দু শরণার্থীদের মধ্যে যে প্রবনতা দেখা যাচ্ছে তাদের হতাশা কেটে যাবে এবং আবার মাতৃভূমিতে যি আকর্ষণ অনুভব করবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও স্বচ্ছ নয়। আর এর সুযােগ এপার-ওপার উভয় অংশের সুযােগসন্ধানীর গ্রহণ করে বাঙলাদেশের এই সংগ্রামকে ডুবিয়ে দিতে চাইছে।
পাড়াপােতাতে শিবির হয়েছে স্থানীয় বিদ্যালয়ে। ফলে বিদ্যালয় বন্ধ। এদের সরিয়ে না নিলে বিদ্যালয় খােলা যাবে না। কিন্তু শরণার্থীদের মধ্যে প্রচার চলছে, তাদের এখান থেকে সরিয়ে মানা শিবিরে নিয়ে যাওয়া হবে। আর একবার যদি তারা সেখানে গিয়ে পৌঁছায় তাহলে আর কেউ বাঁচবে না। তাই অনেকে বিদ্যালয় ছেড়ে দিতে রাজী নয়। মানা শিবিরে তারা যাবে না।
বেড়াচাঁপা শিবির স্থানীয় বিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাঁবু ফেলে গঠিত হয়েছে। এখানে শিবিরের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল। পানীয় জল ও পায়খানার ব্যবস্থা হয়েছে। কলেরা রােগ আয়ত্তাধীনে এসেছে। শরণার্থীদের মধ্যে বাঙলাদেশে ফিরে যাবার কোন ইচ্ছা নেই। অথচ এই দুর্দশার জীবনও স্থায়ী হতে পারে, এঁদের ধারণা যে ফিরে যাবার মত অবস্থা সহজে হবে না। যেভাবে ইয়াহিয়ার লােকেরা স্থানীয় মুসলমানদের অত্যাচার করতে বাধ্য করেছে তাতে তাদের উপর তাদের মনে হয়, আর কোনদিন তারা ভরসা করে দেশে যেতে পারবে না। এই শরণার্থীদের দেশে ফিরে যেতে হলে এদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার প্রয়ােজন। ওপার বাঙলার যে সমস্ত নেতা ও কর্মী আছেন তারা যদি বিভিন্ন শিবিরে গিয়ে এদের মধ্যে প্রচার করেন তাহলে এদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। এমনকি তরুণ হিন্দুদের যদি মুক্তিযুদ্ধে নামান যায় তাহলে ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তি ও ইয়াহিয়ার মিথ্যা প্রচার উভয়ই ব্যর্থ হতে বাধ্য। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিশুদ্ধতার মধ্য দিয়েই যে স্বাধীন বাঙলাদেশের মহিমা প্রতিষ্ঠা সম্ভব একথা যদি তাড়াতাড়ি এই শরণার্থীদের মনে জাগিয়ে তােলা যায় তবে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের পক্ষে মঙ্গল।
সূত্র: কালান্তর, ২৩.৬.১৯৭১