শেখ মুজিব তােমাকে শুদ্ধতম ভালােবাসা, শ্রদ্ধা, সালাম । তােমার জন্য বাঙালি লাল সবুজের পতাকা পেয়েছে। স্বতন্ত্র মানচিত্রের মালিকানা হয়েছে। সেই তােমার রক্তের সিঁড়ি বেয়ে জাতি বন্ধুর পথ পাড়ি দিচ্ছে। অমানিশার নিকষ আঁধারে আটকে আছে। তােমার প্রিয় মাতৃভূমির প্রিয় স্বজনরা ভালাে নেই। দিকভ্রান্ত হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের কালাে রাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হয়েছেন। ওই রাতে বাংলাদেশ বিদীর্ণ হয়েছে। ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বহু রক্তে কেনা জাতীয় পতাকা। এরপর পানি গড়িয়েছে। বছর গেছে। অপশক্তি বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দেয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করেনি। ইতিহাসকে নিজেদের মতাে করে বিকৃত করেছেন ঘৃণিত ওই অপশক্তি। কিন্তু সেটা ধােপে টেকেনি। ইতিহাস আপন আলােয় উম্ভাসিত হয়েছে। জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারে বিচার হয়েছে। এরপরেও ইতিহাসের গতি বদলে দেয়ার অপচেষ্টা করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেনি। জাতীয় শােক দিবসের ছুটি বাতিল করেছে।
শেষতক এই অপচেষ্টা বিফল হয়েছে। আদালতের রায়ে মর্যাদা পেয়েছে জাতীয় শােক দিবস। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারও আদালতের দেয়া রায়ের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। জাতীয় শােক দিবসে সরকারি ছুটি ঘােষণা করেছে। তাই বাঙালি জাতি এবারকার জাতীয় শােক দিবসকে আরেক দফায় নতুন প্রেক্ষাপটে জাতির পিতাকে স্মরণ করছে। বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন? ছােট্ট এই প্রশ্নের জবাব অনেক বড়। ২১ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হয়ে দেখেছি জীবনে বহুবার আশাভঙ্গের ব্যর্থতার তীব্র আঘাত বঙ্গবন্ধুর হৃদয় বিদীর্ণ করেছে। জীবন-মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়িয়েছেন। চোখের সামনে মৃত্যু দেখেছেন নৈরাশ্য গ্রাস করেনি কখনাে। মাঝে মাঝে কিছু ঘটনাপ্রবাহ, জীবনকে বিরূপ ঘূর্ণির আবর্তে ফেলে আছাড় দিলেও আবার ভেসে উঠেছেন।
ষাটের দশক ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির শেষপর্যায়। পাকিস্তানের প্রতি বাঙালি মােহভঙ্গ শেষ হয়ে গেছে। বাংলার রাজনীতির আকাশে উদয় হয়েছে তরুণ সূর্যের। শেখ মুজিব তখন বঙ্গবন্ধু হিসেবে পরিচিত নন। কিন্তু অমিত সাহস, অসাধারণ বাগিতা, অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতা, অনমনীয় মনােবল, দূরদৃষ্টি ও দেশের প্রতি, প্রতিটি বালির প্রতি উদার ভালােবাসার ভাণ্ডার নিয়ে তখনই তিনি দেশবাসীর দৃষ্টি কেড়েছেন। তার সাহচর্যে এসেই আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময় ও তুকির পরিবর্তন ঘটেছে। নিবেন স্বপ্নভঙ্গের মতাে হঠাৎ যেন সূর্যের আলাে চোখে লেগেছে। সেই থেকে প্রতিদিন জীবন-জগৎকে নতুনভাবে দেখছি। এখনাে মনের অজান্তে হৃদয়ের গভীরে স্বপ্নের উনােথ ঘটেছে। আমার রাজনৈতিক জীবনের গৌরবময় সুৰূর্ণ মুহূর্তগুলাে স্বাটের দশকের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছিল।
ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণঅভুথান এবং সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ একে একে সব যেন ছবির মতাে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমি ছিলাম এসব আন্দোলনের পুরােভাগে এবং সৌভাগ্য সেই দিনগুলােতে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেই আমার ভূমিকা পালনের দুর্লভ সুযােগ পেয়েছিলাম। সত্যিই খুব ভাগ্যবান আমি। ১৯৬২ সালের শিক্ষা-আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।
আজকাল অনেকেই অনেক কথা বলছেন। এখন স্বাধীনতার ঘােষক হিসেবে যার কথা বলা হচ্ছে তিনি জীবিত থাকাকালে কখনাে নিজেকে ঘােষক বলে দাবি করেননি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। আর বঙ্গবন্ধু একদিনে স্বাধীনতার ডাক দেননি। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি হয়েছিলেন স্বাধীনতার মূল নেতা। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম দিলেও তা হয়নি। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পূর্বাণী হােটেলে বঙ্গবন্ধু এমএনএদের নিয়ে মিটিং করার সময়ে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশন মূলতবি করে। ওই সময়ে পল্টনে লাখাে মানুষের সমাবেশে অনেকের মধ্যে আমিও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘােষণা দেই।
আমরা শ্লোগান তুলেছিলাম ; ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। পাঞ্জাব না বাংলা, পিত্তি না ঢাকা।’ ২ তারিখে ওই যে পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি, সেই পতাকা বাংলাদেশের মানচিত্র দিয়ে আগেই তৈরি ছিল। জাতীয় সংগীত কী হবে তাও ঠিক করেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সঠিক পথে এগিয়ে গেছেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি বিজয়ী না হত তাহলে কী ঘটত সেটাও বুঝতে হবে। ভাসানী থেকে শুরু করে অনেকেই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে “ভােটের বাক্সে লাথি মারাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’ স্লোগান দিয়েছেন। কিন্তু ভােটের বাজে লাথিও পড়েনি, বাংলাদেশও স্বাধীন হয়নি। বঙ্গবন্ধু যখন ঘােষণা দেন তখনই দেশ স্বাধীন হয়েছে।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে অসহযােগ আন্দোলনে সারা বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে এগিয়ে এসেছিল তা ছিল কল্পনাতীত। একদিক দিয়ে মার্শাল ল রেগুলেশন (এমএলআর) আরেক দিকে আওয়ামী লীগ রেগুলেশনে (এএলআর) দেশ চলেছে। বঙ্গবন্ধু যা বলেছেন মানুষ তাই করেছে। তিনি নিরীহ বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার ঘােষণা দেন। জাতি ট্রেনিং নেয়। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে আগেই বােঝাপড়া ছিল কিছু হলে তারা সহযােগিতা করবে।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করল তখন নিৱন্ত্র জাতি সশন্ত্রে রূপান্বিত হয়ে ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করল। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছে পাঁচ লাখ মা বােন। বঙ্গবন্ধু জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাঙালি এক কাতারে মিলে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কিছু দালাল যারা স্বাধীনতা চায়নি, তারা ছাড়া সবাই যে যেখানে ছিলেন সমর্থন করেছেন।
সুতরাং কৃতিত্ব সবার। নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু । অথচ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরেই বিভক্তি সৃষ্টি করেছে চিহ্নিত পরাশক্তি। বাঙ্গালি স্লোগান দিয়েছিল । “তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি।’ অথচ বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর বাঙালি হয়েছে বাংলাদেশী। ‘জয় বাংলা”, শ্লোগান দিয়ে মানুষ হাতিয়ার তুলে নিয়ে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। সেখানে আনা হয়েছে জিন্দাবাদ। ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে।
বঙ্গবন্ধুর সময়জ্ঞান অত্যন্ত প্রবল ছিল। প্রতিদিন সকাল ৯টায় গণভবনে যেতেন। তার মতাে পাচুয়াল মানুষ পৃথিবীতে বিরল। এক মিনিটও এদিক-ওদিক হত না। একবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কুষ্টিয়ায় যাওয়ার কথা। দুমিনিট দেরিতে গিয়ে দেখি হেলিকপ্টার ছেড়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু কুষ্টিয়া থেকে ফোন করলেন । এ বয়সেই মিস করা শুরু করেছ? সেজন্য তােমাকে একটু শিক্ষা দিলাম যাতে ভবিষ্যতে আর মিস না হয়।’
বঙ্গবন্ধুর মন ছিল সুবিশাল। অপরের দুঃখ সইতে পারতেন না। শিশুদের ভালােবাসতেন। একদিন গাড়িতে যাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ছােট একটা বাচ্চা বলল । আসসালামু আলাইকুম মুজিব সাহেব।’ বঙ্গবন্ধু গাড়ি থামিয়ে শিশুটিকে কাছে নিয়ে আদর করলেন। বঙ্গবন্ধু শত্রুকেও আপন করে নিতেন। তিনি যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন তখন যারা সেখানে ডিউটি করত কিংবা কয়েদি হয়েছিল তারাও নেতার আপন হয়ে যেত। তিনি পৃথিবীর যেখানেই গেছেন আমাকে সঙ্গে নিয়েছেন। ছেলের মতাে স্নেহ করতেন। রাজনৈতিক শিক্ষা দিতেন ছাত্রের মতাে। আমি চিরদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী। আমার জীবন ধন্য বঙ্গবন্ধুর আদর-স্নেহে মানুষ হয়েছি। বড় হয়েছি। তাঁর ভালােবাসার ঋণ কখনাে শেষ করতে পারব না।
পুরােনাে গণভবনে একটা বড় বটগাছ ছিল। একদিন ওই গাছের পাশ দিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ পায়চারি করছিলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন : তােফায়েল লুক আট দি ট্রি। এই গাছটি আর বড় হবে না। পাতা ঝরে যাবে। ডাল ভাঙবে। একসময়ে গাছটি যে এখানে ছিল তার কোনো চিহ্নই থাকবে না। তেমনি আমিও এত জনপ্রিয় হয়েছি যে আর জনপ্রিয় হতে পারব না। আমি দেশের জন্য কিছু করতে চাই। এখন অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্ন পরিপূর্ণভাবে পূরণ করে যেতে পারেননি। দেখে যেতে পারেননি অর্থনৈতিক মুক্তি। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক অবস্থানকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাড় করলেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। আগামী বাংলাদেশে আবারাে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুত হবে, এই বিশ্বাস সবার, প্রতিটি বাঙালির এবং আমারও।
তাই তাে এবারকার জাতীয় শােক দিবসে বাঙালির অঙ্গীকার বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করতে হবে। খুনিদের ফাঁসিতে ঝােলাতে হবে। তবেই বাংলাদেশ অপবাদ মুক্ত হবে। বাঙালির পাপ মােচন হবে। শতভাগ পরিশুদ্ধ হব আমরা সবাই। আর তখনই আমরা উচ্চকিত কণ্ঠে বলতে পারব ‘শেখ মুজিব তােমাকে শুদ্ধতম ভালােবাসা, শ্রদ্ধা, সশ্রদ্ধ সালাম। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
Reference – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন – ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী