You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.02.25 | শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার আহ্বান | দৈনিক পয়গাম - সংগ্রামের নোটবুক

সম্পাদকীয়
দৈনিক পয়গাম
২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার আহ্বান

গত পরশু রাত্রে সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব দেশবাসীর প্রতি শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আকুল আবেদন জানাইয়াছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য ওই দিন রমনা রেস কোর্স ময়দানে তাহার সম্মানার্থে আয়োজিত ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা সভার শেষে ঢাকা ক্লাবের নিকটে একটি সামরিক যানের আরোহী তিনজন সৈনিক ও সভা প্রত্যাগত জনতার কিছুসংখ্যক লোকের মধ্যে যে অপ্রীতিকর দুর্ঘটনা ঘটে তার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব দেশবাসীর প্রতি শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার এই আবেদন জানান। বিবৃতিতে তিনি উক্ত দুর্ঘটনার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন, রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ লোকের জনসভা এই মর্মে শপথ গ্রহণ করিয়াছেন যে, শহীদের রক্ত ও জনগণের আত্মত্যাগপূত তাদের ঐতিহাসিক আন্দোলনকে তাঁহারা কিছুতেই ব্যর্থ ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হইতে দিবেন না। অবিশ্রান্ত সংগ্রাম পরিচালনার ফলশ্রুতিরূপে দেশের দিগন্তে যে সম্ভাবনার আলো উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে তা যাহাতে বিনষ্ট না হয় সেজন্য যে-কোন মূল্যে আমাদিগকে শান্তি ও শৃংখলা অক্ষুণ্ণ রাখিতে হইবে, যে-কোন উস্কানি ও উত্তেজনার পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের অবশ্যই ধৈর্য ও শৃঙ্খলা রক্ষা করিতে হইবে। প্রসঙ্গতঃ শেখ মুজিব জনসাধারণকে কোন ভাবে উত্তেজিত কিংবা প্ররোচিত না করার জন্য সরকারের প্রতিও আহ্বান জানান।
তাঁহার এ আবেদন ও আহ্বানের প্রতি আমরা সংশ্লিষ্ট সকল মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। দেশের প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা ও এর যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতির আমূল সংশোধনের দাবীতে ছাত্র সমাজ আজ দেশজোড়া এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের সূত্রপাত করিয়াছেন। অনেক ছাত্র অনেক কৃষক আর সাধারণ মানুষের রক্ত দান ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে এ আন্দোলন আজ দুর্বার এবং লক্ষ্য সমীপবর্তী হইয়া উঠিয়াছে। ক্ষমতাসীন সরকারও আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া ছাত্র জনতার প্রায় সমস্ত দাবী মানিয়া লইয়া শাসন কাঠামোর চূড়ান্ত রদবলের জন্য দেশের জননেতাদের আলোচনার টেবিলে আহ্বান করিয়াছেন। বৈঠক অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত হিসাবে নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্র জনতার পক্ষ হইতে যে সব শর্ত আরোপ করা হইয়াছিল সে সব শর্তও সরকার পূরণ করিয়াছেন, সবচেয়ে প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ যে শর্ত জননেতা শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার- সে শর্তও আজ পূরণ করা হইয়াছে। শেখ মুজিব মুক্ত নাগরিক হিসাবেই রাওয়ালপিণ্ডিতে আলোচনা বৈঠকে অংশগ্রহণ করিতেছেন। দেশের অন্যতম জননেতা মওলানা ভাসানী অবশ্য নিজে এ বৈঠকে যোগদানে অনিচ্ছুক, তবে এ সম্পর্কে তাহার সাম্প্রতিক বক্তব্যের আলোকে আশা করা যায় তাঁহার দলও শেষ পর্যন্ত এতে অংশগ্রহণ করিতে যাইতেছেন।
আসন্ন এই বৈঠকের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তাই ঐতিহাসিক। এ বৈঠকে দেশ ও জাতির ভাগ্য নূতন করিয়া নির্ধারিত হইতে যাইতেছে। গত একুশ বছরে ক্রমাগতভাবে সঞ্চিত যত ক্লেদ, যত গ্লানি ও জঞ্জালের বোঝা বহন করিয়া দেশ আজ যে সংকটসন্ধিতে আসিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়াছে সেই সংকট, সেই সন্ধি উত্তরণের সার্থক এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের গুরু দায়িত্ব আজ এ বৈঠকের উপরই ন্যস্ত। এ সময় যদি ঠিক বৈঠক কোন ভুল সিদ্ধান্ত বা কোন ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যদি বাহিরের কোন উত্তেজনা বা অশান্তির ফলশ্রুতিরূপে দলে দলে কোন রূপ ঐক্যমত ও সমঝোতায় পৌছিতে ব্যর্থ হইয়া আদৌ কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম হয়, তবে জাতির জন্য তাহা হইবে দুর্ভাগ্যের কারণ, দেশের জন্য তার ফল হইবে অত্যন্ত অশুভ এবং দুঃখজনক। তাই দেশের এই সময় সন্ধিক্ষণে ক্ষমতাসীন সরকার ও নেতৃবৃন্দের মধ্যে জাতির ভবিষ্যত নির্ধারণের এই ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠানের মুহূর্তে কি জনগণ কি সরকার সকল মহলকেই দেশে পরিপূর্ণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রাণপণে যত্নপর থাকিতে হইবে, কোন মহলের কোনরূপ প্ররোচনা বা উস্কানির খপ্পরে পড়িয়া এই ঐতিহাসিক আয়োজনকে বানচাল করিয়া দেওয়া চলিবে না, যদি একে পণ্ড করার অশুভ চক্রান্ত হিসাবে কোন দিক হইতে কোন উস্কানি ও প্ররোচনা আসেই তবু অটল ধৈর্য ও সহিঞ্চুতার সাথে তার মোকাবিলা করিতে হইবে। প্রবল উস্কানির মুখেও শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখিয়া তেমন চক্রান্তকে ব্যর্থ করিয়া দিতে হইবে। শেখ মুজিব এ আহ্বানই দেশের জনগণের কাছে জানাইয়াছেন। এ ব্যাপারে গণ আন্দোলনের ঐতিহ্য সৃষ্টিকারী বিপ্লবী ছাত্র সমাজের বিশেষ দায়িত্ব স্মরণ করাইয়া দিয়া দেশের জনসাধারণের মধ্যে তাঁহার এ আহ্বানে শুভ ও ত্বরিৎ প্রতিক্রিয়া আমরা কামনা করিতেছি।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯