You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলার বাণী ২১ এপ্রিল ১৯৭২ তারিখের মূল পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী ২১ এপ্রিল ১৯৭২ তারিখের মূল পত্রিকা

বাংলার বানী

ঢাকা ঃ রবিবার, ১০ ই বৈশাখ, ১৩৭৯

আমলার সংগোপন সংলাপ প্রসঙ্গে

 

আমলাদের সংগোপন সংলাপ থেকে  এই শিরোনামায় গতকালকের বাংলার বানীতে একটি চমকপদ খবর ছাপা হয়েছে। দুই আমলার রসালো আলাপের সময় তাদের টেলিফোনের সঙ্গে বাংলার বানীর সম্পাদকীয় বিভাগের টেলিফোনটি আকস্মিক সংযোগের ফলে যে কথাগুলো শোনা গেছে তাই সংবাদটির উতস।আমলা দু জনের একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে আমাদের সেক্টর করপোরেশনগুলির অন্যতম নব নিযুক্ত চেয়ারমানের সংগে।তার নেক নজর সংশ্লিষ্ট আমলাদের একজন হবেন কোন এক প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার।আরেকজন আরেক প্রতিস্থানের ডাইরেক্টর হবার ব্যাপারটিও পাকাপাকি হয়ে গেছে । কিন্তু ডাইরেক্টর হয়েও চট্টগ্রামে যেতে মন ভিজছে না তার। কারন সেখানে ড্রাই চলছে। নয়া ডাইরেক্টর সাহেব ব্যাচেলর মানুষ  তার আশংখা সেখানে গিয়ে তিনি শুকিয়ে মরবেন।কিন্তু নির্ভয় এসেছে অন্য আমলার তরফ থেকে । সম্ভবতঃ তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন ‘চট্টগ্রামেও পাবি । মাঝে মাঝে কাপ্তাই চলে যাবি। সংবাদটির সাদা মাটা বক্তব্য আসল ব্যাপারটির একটি ছায়া মাত্র। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় ,দুই আমলার কতকপকথনের মধ্য দিয়ে কি এক জঘন্য মানুষিকতার বিষাক্ত কীট বারবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ডাইরেক্টর হয়েও একজন আমলা যে কারণে চট্টগ্রাম যেতে অনিচ্ছুক তা হলো সেই ‘ড্রাই’ এর রাজত্বে ‘ব্যাচেলর’ আমলাটিকে শুকিয়ে মরার হাত থেকে বাচাবার জন্য পর্যাপ্ত মানুসিক খোরাকের পাত্রি প্রাপ্তি সম্পর্কিত অনিশচয়তা। আর বন্ধু আমলাটির কণ্ঠে তাই নির্ভয় বাণী, চট্টগ্রাম কাপ্তাই এমন রিক্ত নয় যে, একজন ব্যাচেলরের লালসা চরিতার্থ করার ব্যবস্থা করতে পারবে না।

এই অভয় বাণী শোনার পর সংশ্লীষ্ট আমলাটির মনে চট্টগ্রামের ড্রাইডে সম্পর্কে আর কোন ভীতি অবশিষ্ট আছে কিনা আমরা জানিনা। তবে এই টুকু জানি, এরাই আমাদের আমলা তন্ত্রের নায়ক, সরকারের কর্মশক্তির প্রাণ, ক্রিম অফ দি সোসাইটি এবং এদেরি উপর নির্ভরশীল এই দেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মহান কর্মসূচির বাস্তবায়নের দায়িত্ব। নতুন কর্মস্থলে যোগদানের আগে যারা সর্বাগ্রে খোজ করে সেখানে মেয়ে মানুস পাওয়া যায় কিনা, তাদের দিয়ে জনগণের কল্যাণের একমাত্র পন্থা সমাজতন্ত্র কায়েম তো দূরের কথা, সুষ্ঠু ভাবে সরকার পরিচালনায় সম্ভবপর আমরা ভেবে পায় না।

তবু এ কথা সত্য, আমলা তান্ত্রিক গণতন্ত্রের এই দেশে এরাই মানুসের ভাগ্য বিধাতা। প্রশংসনীয় ব্যতিক্রম নেই তা নয়। তবু বলতে হয় এই বিক্রিত ঘৃণ্য মানসিকতারি বোধ হয় প্রাধান্য বেশি আমলাতন্ত্রের রাজত্বে। কত জন কত বিনীদ্র রাত্রি কাটায় এই ড্রাইডে’ এর অভিশাপ থেকে মুক্তির তাপস্যায়। তারপর প্রভাতে ‘ক্রিম অফ তা সোসাইটি’ র জার্সি গায়ে গ্যাট হয়ে বসেন ক্ষমতার সুরক্ষিত আসনে। জনস্বার্থের নিকুচি করেন প্রতি প্রহরে সমাগত রাত্রের প্রতিক্ষায়। দিন যায় আবার সেই মনরঞ্জনের তীর্থে আত্ন নিবেদন! এই তো দুই যুগের পুরানো সমাজ শাসন আর আমলাতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ঐতিহ্য, কিন্তু এই ট্রেডিশন কি অব্যাহত থাকবে বিপ্লবী বাংলাদেশেও? অধঃপতিত বিক্রিত মানসিকতার পূজারী এই বর্ণচোরার দল কি চিরদিন চালিয়ে যাবে এই প্রতারণা আর নিচতার নিন্দিত খেলা? সাড়ে সাত কটি মানুসের বিক্ষুব্ধ চিত্তের আগুণ কি এক বার এক সংগে এদের উপর ঠিকরে পরে এদের নিশ্চিহ্ন নির্মূল করে দিতে পারে না?

আমাদের বিশ্বাস পারে। আমাদের বিশ্বাস তা হতেই হবে। কারণ, নিচতা, বিক্রিত মানসিকতা আর চরিত্রহীনতার যে বিষাক্ত কীটের দল দিনের পর দিন সমাজ দেহের পরতে পরতে দগদগে ক্ষতের জন্ম দিচ্ছে, এদের নির্মূল করতে না পারলে এই দেশ, এই সমাজের ভবিষত একান্তই অনিশ্চিত।

জুলফি-বেলটমদের সামলান

 

জনৈক বিদেশী এসেছে ঢাকায় বাংলাদেশের বৈচিত্রপূর্ণ জীবন যাত্রার উপর প্রামাণ্য গ্রন্থ তৈরির উদ্দেশ্যে। সেদ দিন তিনি গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। অমনি জিলফি ওয়ালা এক দল যুবক পাতাবাহার জামা, বেলবটম ট্রাউজার ও কমড়ে চওড়া বেল্ট এটে ভদ্র লোকের ক্যামেরার সামনে ভীড় করে দাড়ালো। ভদ্র লোক নিরুপায়। অতঃপর তিনি তার স্বদেশী পূর্ব পুরুষদের নবতর সংস্করণ সেই দুলালদেরই ছবি ক্যামেরায় ধরে রাখতে শুরু করলেন। কিন্তু বাধ সাধল পাজামা পাঞ্জাবী ও সাদামাটা পোষাক পরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তারা বলল ওরা বাংলাদেশের যুব সমাজের প্রতিচ্ছবি নয় – ওরা পরগাছা, সমাজের কলংক। আর তাই এদেশের যুব সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবার তাদের নেই।

বিদেশী ভদ্রলোক ছাত্রদের কথায় সাই দিয়েছিলেন। এতে করে অন্তত একজন বিদেশীর কাছেও আমাদের যুব সমাজের বাস্তব রূপ ধরা পড়েছে। কিন্তু আর সবাই বহু দেশ থেকে নানা রকম লোক আমাদের দেশে আসছেন। তারা স্বভাবতঃই যুব সমাজের প্রতি একটু বেশিই আগ্রহী। বিদেশীরা তাদের দেশে বসে বাংলাদেশের যুব সমাজ সম্বন্ধে যে রূপকল্পটি দাড় করিয়েছিলেন ঢাকার মাটিতে প্রথম পা রেখেই কি তাদের সে ধারনা পালটে যায় না?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দলনে যুব সমাজের ভূমিকা ছিলো সব চায়তে অগ্রণী। অথচ স্বাধীনতা লাভের পর যে সকল ছোকরাদের ব্লাউজ সেলোয়ার এটে অত্যন্ত ব্যাস্ত-সমস্ত হয়ে ঢাকার রাজপথে ঘুরতে দেখা যায় তাদের মুখে লাবণ্য ময়ী শ্রী আর দু অধরের মাঝ পথে দিয়ে বেরিয়ে ইংগ-বঙ্গোজ ভাষা আর যাই হোক তাদের জাতীয় চরিত্রকে ফু৭টিয়ে তোলে না।

আসলে এর কারণ খুজে পেতে খুব বেশি কষ্ট হবার কথা নয়। বাংলাদেশের এমন এক অভিজাত শ্রেণী রয়েছেন যারা তাদের সন্তান সন্ততীকে দেশজ সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে আগ্রহী। বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওযা কোন ঝড় ঝাপটায় এদের গায়ে এতটুকু আচোড় লাগাতে সক্ষম হয় না। বিগত স্বাধীনতা যুদ্ধে যখন আপামর জনসাধারণ এক জীবন মরণ সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন তখন তথাকথিত অভিজাত শ্রেণির অধিকাংসই সীয় সন্তান-সন্ততীদের নিয়ে ভাল তবিয়তে সংসার ধর্ম পালন করেছেন। কালের হাওয়া বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সকল ধনবীর দুলালেরাই ষোড়শ বাহিনী গঠন করে সাধারণ মানুসের জীবনকে দূর্বিসহ করে তলে। দেশ ও মাটির সঙ্গে এসের কোন সংযোগ নেই। তাই এরা এদেশে বাস করেও আচার আচরণে, পোষাক আশাকে পরদেশী ভীন্ন সংস্কৃতাশ্রয়ী।মিঠে কথায় এদের মানসিকতার কোন পরিবরতন আসবে না। পুঁজিবাদী সমাজব্যাবস্থা যেমন এদের আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে , সমাজতন্ত্রে উত্তরনের এই শুভক্ষণে তাই বাংলার যুবসমাজকে তাঁদেরই এক অংশের আচার-আচরনে পরিবর্তন আনায়ন এবং নিজেদের সংস্কৃতি চেতনার গৌরবকে অক্ষুণ্ণ রাখবার ব্যাবস্থা গ্রহন করতে হবে।