৬ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে বিস্ফোরণে ২০০ মুক্তিযোদ্ধা নিহত।
১৯৭২ সালের এই দিনে দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ বিদ্যালয় মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে এক আকস্মিক মাইন বিস্ফোরণে একসঙ্গে প্রায় দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন অনেকেই। স্বাধীনের পরপরই দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়িস্থ মহারাজা গিরিজানাথ বিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। এখানে অবস্থান নিয়েছিল আটশত মুক্তিযোদ্ধা যাদের বেশীর ভাগ অন্য জেলার অধিবাসী ছিলেন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে মাইন অপসারণ করে জড়ো করছিলেন এই ক্যাম্পে। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি মাগরিবের নামাজের পর দুটি ট্রাক থেকে মাইন নামানোর সময়(১০০ গজ দুরত্তে প্রায় ১০০ মুক্তিযোদ্ধা মাইন হাত বদল করছিলেন) হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন ফঁসকে পড়ে যায় জড়ো করা মাইনের উপর। সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণ। কেঁপে উঠে গোটা দিনাজপুর। প্রাণ হারান সেখানে অবস্থান নেওয়া প্রায় দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। আহত হন অনেকেই। মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরের ছিন্নভিন্ন অংশ ছিটকে গিয়ে পড়ে আশপাশে ও গাছের ডালে। সেসব ছিন্নভিন্ন অংশ জড়ো করে সমাহিত করা হয় সদর উপজেলার চেহেলগাজী মাজারে। সেখানে তাদেরকে গণকবর দেওয়া হয়। নিকটস্থ ভারতীয় বাহিনী উদ্ধার তৎপরতা চালায় কাছেই ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে আহতদের চিকিৎসা করে এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রেরন করে।
নোটঃ মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাএ প্রখ্যাত চিএশিল্পী, শিল্পোদ্যোক্তা নিতুন কুন্ডু। লেখক, সাংবাদিক, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারের চরমপত্র খ্যাত এম,আর, আখতার মুকুল এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বাংলাদেশের চলচিত্র জগতের কিংবদন্তি প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা শিল্পী সুভাষ দত্ত এই স্কুল থেকেই ১৯৪৮ সালে ম্যা্রিট্রক পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কম্যুনিস্ট নেতা ২১শে পদক প্রাপ্ত ড. অজয় রায় ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতি ছাত্র।
৬ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ সকল মুক্তিযোদ্ধাকে মিলিশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হবে- তাজ উদ্দিন।
নবগঠিত মিলিশিয়া বোর্ডের প্রথম সভায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ বলেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছেন এমন সকল মুক্তিযোদ্ধাকে জাতীয় মিলিশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তাদের আহার, বাসস্থান এবং পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করবে সরকার। তিনি বলেন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন অনেকে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরন করেছেন তাদের এখনও সরকার কোন সুযোগ সুবিধা দিতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীনের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে অনেক দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন তাই আমরা তাদের জাতি পুনর্গঠনের কাজে লাগাতে চাই। তাদের মহকুমা পর্যায়ে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মিলিশিয়ায় যারা আসবেন পরবর্তীতে তারা লেখাপড়ায় ফিরে যেতে চাইলে বা বাড়ী ফিরে যেতে চাইলে বা অন্য পেশায় নিয়োজিত হতে চাইলে তাদের যেতে দেয়া হবে। সভায় উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামরুজ্জজামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সাবেক সেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান ও মুজিব বাহিনী কম্যান্ডার আব্দুর রাজ্জাক, ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কম্যুনিস্ট পার্টি প্রধান মনি সিংহ, বাংলাদেশ কংগ্রেস সভাপতি সুরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য, ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এমএনএ, ভারতীয় কিলো ফোরস অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ, তোফায়েল আহমেদ এমএনএ, গাজী গোলাম মোস্তফা এমপিএ, সচিব রুহুল কুদ্দুস, প্রতিরক্ষা সচিব আব্দুস সামাদ, মেজর খালেদ মোশাররফ।
৬ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ নয়াদিল্লীতে সামাদ আজাদ
নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ভারতে পৌঁছে রাজ ঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এর পর পরই তিনি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিব ডিপি ধরের সহিত বৈঠক করেন।
নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের সহিত ৪০ মিনিট ব্যাপী আলোচনা করেছেন। আলোচনায় দু দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার(সামরিক প্রশিক্ষন) বিষয়ে আলোচনা করা হয়। ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশীদের মন জয় করা সত্ত্বেও অতি শীঘ্রই তাদের প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। আলোচনায় ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব এবং দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশন প্রধান হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
পরে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরন সিং সহিত ৬০ মিনিট ব্যাপী আলোচনা করেছেন। বৈঠক শেষে জনৈক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সামাদ বলেন এটা নিশ্চিত শেখ মুজিব মুক্তি পাচ্ছেন এবং তিনি দিল্লী হয়ে ঢাকা পৌছবেন।