৫ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ সুজন সিং উবান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেছেন।
ঢাকায় অবস্থানরত মুজিব বাহিনীর অঘোষিত প্রধান মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে বঙ্গভবনে দেখা করেছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার কাছ থেকে বাংলাদেশ মুজিব বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত হন। উবানের মুজিব বাহিনী দেশের ভিতরে গেরিলা তৎপরতা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং দক্ষিন চট্টগ্রামে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তিনি রাঙ্গামাটিতে তার সদর দপ্তর স্থাপন করেছেন।
নোটঃ শেখ মুজিব পুত্র শেখ জামাল ও সৈয়দ নজরুল পুত্র সৈয়দ আশরাফ মুজিব বাহিনীতে যুক্ত ছিলেন।
৫ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ বাঙ্গালী সামরিক কর্মকর্তার পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিমান ছিনতাই করে ভারতে পলায়ন।
বাঙ্গালী সামরিক কর্মকর্তা লেঃ হুমায়ুন রেজা একটি হাল্কা পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিমান ছিনতাই করে ভারতের পাঞ্জাবের হোসিয়ারপুরে (আদমপুর বিমান ঘাটি) পলায়ন করেছেন। ভারতীয় পুলিশ প্রথমে রেজাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে রেজা নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেয় এবং সহযাত্রী পাইলট মেজর কাশেমকে গুলি করে হত্যার কথা স্বীকার করে। পাকিস্তান কতৃপক্ষ বিমান, মেজর কাশেমের মৃতদেহ এবং লেঃ হুমায়ুন রেজাকে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তরের জন্য তাগিদ দিয়েছে। বিদেশী রেডিও এর বরাত দিয়ে পাকিস্তান রেডিও এ সংবাদ প্রচার করে।
৫ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ বাংলাদেশ রেডক্রস পুনর্গঠিত
সাবেক পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান রেডক্রস এর কমিটি বাতিল করে স্বাধীন বাংলাদেশ রেডক্রস কমিটি পুনর্গঠন করা হয়।
সভাপতি- গাজী গোলাম মোস্তফা, এমপিএ ঢাকা
সাধারন সম্পাদক- ডাঃ আবুল কাশেম
সদস্য –হেদায়েতুল ইসলাম, মোশাররফ হোসেন,শামসুল হক, মইনুদ্দিন, আরহাম সিদ্দিকি, মোস্তফা সারওয়ার, আনোয়ার আহমেদ চৌধুরী, আজিজুর রহমান, মতিউর রহমান, ডাঃ জসীম উদ্দিন, মুজিবুর রহমান, রফিক উদ্দিন ভুইয়া, শওকত আলি খান, মোজাফফর হোসেন, আব্দুর রশিদ, জামশেদ আহমেদ চৌধুরী, আবু সালেক, শেখ মোশাররফ হোসেন, আজিজুর রহমান আক্কাস, মোশাররফ হোসেন, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, মোঃ মহসিন, তোফায়েল আহমেদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, ডাঃ আসহাবুল হক, শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী, ডঃ হালিম খান, ডঃ নুরুল ইসলাম, সচিব, প্রশাসক ও উপসচিব স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রায় সকলেই এমপিএ, এমএনএ
৫ জানুয়ারী ১৯৭২ যোগাযোগ মন্ত্রী শেখ আব্দুল আজিজ কলকাতা গিয়েছেন।
যোগাযোগ মন্ত্রী শেখ আব্দুল আজিজ শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের কাজে প্রয়োজনীয় সংখ্যক যানবাহন ও নৌযান সংগ্রহের উদ্দেশে কলকাতা গিয়েছেন। সেখানে তিনি পশ্চিম বাংলার গভর্নর এবং সিনিয়র অফিসারদের সাথে দেখা করবেন। তার সাথে আলি আহমেদ এমপিএ এবং আব্দুর রহমান এমপিএ আছেন। তিনি উক্ত কাজ ছাড়াও নেতাজী ভবন পরিদর্শন, রবীন্দ্রনাথের বাড়ী জোড়াসাঁকো এবং কবি নজরুলের সাথে দেখা করতে তার বর্তমান বাড়ী যাবেন।
নোটঃ পশ্চিম বঙ্গে গভর্নর শাসন চলছিল।
৫ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ সাত বুদ্ধিজীবীর লাশ উদ্ধার। দাফন ও সৎকার
ঢাকার মিরপুর হরিরামপুর কবরস্থান সংলগ্ন ২টি গর্ত থেকে ৪ তারিখে ৭টি লাশ উদ্ধার হয়। নিহত বুদ্ধিজীবীদের নিকট আত্মীয় স্বজন ৪ তারিখেই কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর লাশ সনাক্ত করেছেন তাদের মধ্যে আছেন সন্তোষ ভট্টাচার্য,ডঃ সিরাজুল হক খান, ডঃ ফয়জুল মহী, ডঃ মুর্তজার লাশ। বাকী ৩টি লাশ আজ তাদের স্বজনেরা সনাক্ত করেন। তাদের মধ্যে আছেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, জনাব রাশিদুল হাসান, ডঃ আবুল খায়ের এর লাশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ জন মুসলিম বুদ্ধিজীবীর নামাজে জানাজা হয়। জানাজায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এআর মল্লিক সহ বিপুল সংখ্যক লোক অংশ নেয়। বুদ্ধিজীবীদের বিকেল ৩টায় তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদুল জামিয়ার সামনে কবর দেয়া হয়। সন্তোষ ভট্টাচার্যের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয় শ্যামপুর শ্মশান ঘাটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এক শোক সভায় মিলিত হয়ে নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ এবং হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তির দাবী করে।
নোটঃ এই সাত জনের প্রথম গনকবর বর্তমান বুদ্ধিজীবী কবরস্থান বা তার কাছাকাছি।
৫ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ ছাত্রলীগের মুজিব দিবস পালন
মুজিব দিবসের কর্মসূচীর অংশ হিসেবে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ এক সমাবেশের আয়োজন করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকি, সভায় ভাষণ দেন দলের সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ডাকসু সহ সভাপতি আসম রব, ডাকসু জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন। সভায় বক্তারা অবিলম্বে পাকিস্তানে আটক শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন অন্যথায় সারা পৃথিবীতে শান্তি বিঘ্নিত হবে। বক্তারা পাকিস্তান আর্মির নিয়াজি, রাও ফরমান আলী সহ শীর্ষ রাজনীতিক ফরিদ আহমেদ, ডাঃ মালিক, নুরুল আমিনের ফাঁসী দাবী করেন।
সভায় কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহন করা হয় শোক প্রস্তাবঃ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সকল অংশগ্রহনকারী নিহতদের প্রতি শোক প্রস্তাব গ্রহন করা হয় এবং যে কোন মূল্যে শহীদানের আদর্শ প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহন করা হয়। রাজনৈতিক প্রস্তাবঃ ১)স্বাধীন বাংলাদেশে নির্ভেজাল গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি, ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণ এক কথায় মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শপথ গৃহীত। ২) সমাজের সর্বস্তরে শোষণ বন্ধ এবং কৃষক শ্রমিকের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শপথ গ্রহন ৩) স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যকারী দেশ ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ভুটানের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় ৪) স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় সাম্রাজ্যবাদী চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চরম ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় ৫) সকল বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা প্রদান অন্যান্য প্রস্তাব ঃ ১) কারাগারে আটক সকল মুক্তিযোদ্ধার মুক্তি ২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহ থেকে ভারতীয় বাহিনী অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা ৩) মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সকল ব্যক্তির পুনর্বাসন ৪) আহত নিহত সকল মুক্তিযোদ্ধার জন্য মাসিক ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা।
৫ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দিল্লী গমন
পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ দিল্লী রওয়ানা হওয়ার আগে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের জানান পাকিস্তান সরকার আন্তজার্তিক রেডক্রসের প্রতিনিধিকে শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। বাংলাদেশ সরকার আগে আন্তজার্তিক রেডক্রসকে শেখ মুজিবের অবস্থা জানার জন্য বলেছিল। আন্তজার্তিক রেডক্রস বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে যে শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করতে পাকিস্তান সরকার অনুমতি দেয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন তার দিল্লী সফরের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য ভারতে অবস্থিত বিদেশী দুতাবাস সমুহকে জড়িত করা। এ ছাড়াও ভারত সরকারের সাথে ব্যবসা সম্পর্কেও আলোচনা করবেন। তিনি বলেন বাংলাদেশ সরকার অপর দেশ সমুহ থেকে স্বীকৃতি ভিক্ষা করবে না। স্বীকৃতি এমনিতেই অর্জন হবে। সচিব এল রহমান, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোশাররফ হোসেন, পররাষ্ট্র দপ্তরের পরিচালক ফারুক আহমেদ চৌধুরী, বাণিজ্য বিভাগের যুগ্ন সচিব এনাম আহমেদ চৌধুরী, বাসস এর আতাউস সামাদ তার সফর সঙ্গী হিসেবে দিল্লী গিয়েছেন। কলকাতা থেকে হোসেন আলী দিল্লীতে মন্ত্রীর সাথে মিলিত হয়েছেন। দিল্লীতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরন সিং বিমানবন্দরে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে ৮ দেশের রাষ্ট্রদূত মন্ত্রীকে স্বাগত জানান।
৫ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ
বঙ্গভবনে সেনা কর্মকর্তাদের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ নবজাত রাষ্ট্রকে একটি সমাজতান্ত্রিক,গনতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিনত করার লক্ষে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্যম ও শক্তি কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন। দেশমাতৃকার বীরযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন সশস্র বাহিনীর দৃঢ় সংকল্প তাদের দেশপ্রেমিক চেতনা এবং দেশের লাখো লাখো লোক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ফলেই স্বাধীনতা সংগ্রাম ঐতিহাসিক বিজয়মণ্ডিত হয়েছে। তিনি বলেন পৃথিবীর কোন জাতিই তাদের মুক্তির জন্য এত রক্ত দেয়নি। এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য সশস্র বাহিনীর প্রতি প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানী, চীফ অফ স্টাফ কর্নেল রব, ডেপুটি চীফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার, মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, শেখ আজিজ, ইউসুফ আলী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, ফণীভূষণ মজুমদার ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে কর্নেল দাস উপস্থিত ছিলেন।