You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | শেখ হাসিনা যেভাবে জানতে পেরেছিলেন - হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক
শেখ হাসিনা যেভাবে জানতে পেরেছিলেন – হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী

পনেরাে আগস্ট ভোরবেলা টেলিফোন বেজে উঠল। ঘুমিয়েছিলাম। টেলিফোন ধরলাম। অপর কণ্ঠ থেকে—স্যার, আমি ফারুক বলছি লন্ডন থেকে। খবর শুনেছেন স্যার? কী খবর? ঢাকার খবর। কী হয়েছে ঢাকায় আবার? স্যার, ঢাকায় অভুথান হয়ে গেছে। শেখ সাহেবের ভাগ্যে কী ঘটেছে, এখনাে অনিশ্চিত স্যার। বলাে কী? সম্ভবত স্যার শেখ সাহেব মারা গেছেন।

ফারুক আহমদ চৌধুরী তখন লন্ডনে ডেপুটি হাইকমিশনার। ফোন রেখে স্ত্রী মাহজাবিনকে বললাম। মাহজাবিন বিশ্বাস করতে পারছিল না। আমিও না। তবুও ঘটনা যখন ঘটেই গেছে তার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। ব্রাসেলসে ফোন করলাম। ব্রাসেলসে ফোন করলাম রাষ্ট্রদূত সানাউল হক সাহেবকে। জানতে চাইলাম, ঢাকার খবর কী? রাষ্ট্রদত নীরব। কথা বলছেন না। একপর্যায়ে টেলিফোন রেখে দিলেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে খবর দিতে চান না বলে মনে হল। ভাবনায় পড়ে গেলাম, কী করি।

আবার ফোন করলাম রাষ্ট্রদূত ধরতেই বললাম  ড ওয়াজেদকে দিন, কথা বলব। ড ওয়াজেদকে খুলে বললাম সবকিছু। তবে একথা বললাম, পূর্ণ বিবরণ না পাওয়া পর্যন্ত হাসিনা-রেহানাদের যেন না জানায়। তাঁকে আরও বললাম, যে কোনাে সাহায্যের জন্য আমাকে জানাতে যেন ভুল না হয়। আমি যে-কোনাে সাহায্য করতে প্রস্তুত একথাও বললাম।

টেলিফোন রেখে বিবিসি শুনতে গেলাম। রেডিও অন করতেই শােনা গেল বাংলাদেশে অখনি হয়ে গেছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। অবশ্য বিবিসি একথাও বলল, খবরটি এখনাে অসমর্থিত।

রেডিও বন্ধ করে ভাবছিলাম কী করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভেসে উঠল। বারবার মনে পড়ল শেখ সাহেবের কথা। প্রথম দিন দেখা হতেই শেখ সাহেব আমাকে অনেক কথা বলেছিলেন। একপর্যায়ে বলেছিলেন, ঘটনাবলি ভালাে যাচ্ছে না। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল, শেখ সাহেব তাঁর মৃত্যুর আগাম বার্তা পেয়ে গেছেন।

কয়েকঘণ্টা পর ব্রাসেলস থেকে সানাউল হকের টেলিফোন। খুব অস্থির। হাসিনা-রেহানাকে নিয়ে যেন খুব ঝামেলায় আছেন। ওদের তাড়িয়ে দিলেই বাঁচেন মনে হল। বললেন, জানাে হুমায়ুন, প্যারিস থেকে আবুল ফতেহ গাড়ি পাঠায়নি। কথা ছিল গাড়ি পাঠাবে, ওদের নিয়ে যাবে, এখনাে গাড়ি আসেনি। ফতেহকে পাওয়া যায়নি। ওর  বাসায় কেউ টেলিফোন ধরছে না। পারিসে শফি সামিকে টেলিফোন করলাম। শফি তখন অন্য হাসপাতালে। শফিকে বললাম, ফতেহকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেখ সাহেবের মেয়ে আশার কথা প্যারিসে। ওরা যদি আসে, গুদেরকে আদর যত্ন করে বলল, ঠিক আছে। আমার বাড়িতে রাখব।

শফি আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আবার ফোন করলাম ব্রাসেলসে। সানাউল হককে বললাম, ওদেরকে গাড়ি দিয়ে জার্মান সীমান্তে অন্তত পৌঁছে দেন। সানাউল হক রাজি হলেন না। বিস্মিত হলাম। কী বলছেন আপনি! এইটুকু মানবতাবােধও কি নেই? অথচ শেখ সাহেব তাকে খুব স্নেহ করতেন। অনেকের অমতে তাঁকে রাষ্ট্রদূত বানিয়েছিলেন। সামান্যতম কৃতজ্ঞতাবােধও নেই। আমি ক্রুব্ধ হলাম। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই লােক কি এমন আচরণ করতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের গাড়ি দিতে রাজি নন, বাড়িতে ঠাই দেয়া দূরের কথা। কী বলব—এই লােকই পরবর্তীতে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন।

 
যাকগে এসব কথা। হককে বললাম, আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। ও আমার জার্মানির বাড়িতে আসবে। আমি তাদের আশ্রয় দেব। আমি অকৃতজ্ঞ নই। আমার চাকরির কোনো মায়া নেই। মানবতা আমার কাছে মুখ্য। আমার বাবা-মা মানুষের সেবা করতে শিখিয়েছেন। তারা বলেছেন, মানুষের বিপদে-আপদে যেন ছুটে যাই। ফলাফল কী হবে জেনেও আমি ওদের জার্মানিতে আনার ব্যবস্থা করলাম।
 
পনেরাে আগস্ট সন্ধ্যায় ওরা জার্মানি পেীছল। এদিনই কামাল হােসেনের জার্মানী পৌঁছানোর কথা। সঙ্গে থাকবেন পররাষ্ট্র দফতরের পরিচালক রেজাউল করিম। বেল্গ্রেড থেকে কামাল হোসেন আসছেন। আমি বিমানবন্দরে গিয়ে তাঁকে স্বাগত জানালাম। ড কামাল তখনও ঢাকার খবর জানেন না। আমি তাঁদের বাসায় নিয়ে গেলাম। কামাল হোসেন খুবই অস্থির, কথা বলতে পারছেন না। হাসিনা-রেহানার আগেই ড কামাল জার্মানী পেীছেছেন।
 
সারাদিনই কাটালাম রেডিও শুনে। যখন জানতে পারলাম খন্দকার মােশতাক আহমদ প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তখন আবারও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। কখন থেকেই তিনি নানা ষড়যন্ত্র করছিলেন। মােশতাক চেয়েছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। ষােলাে বছর পর স্মৃতিচারণ করছি। শেখ সাহেবের মেয়েরা যখন অামার বাসায় পেীছল তখন কী দশা! ভাষায় বর্ণনা করার মতাে নয়। জীবনে অনেক দুর্ঘটনার সন্মুখীন হয়েছি। এমন হইনি কখনাে। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। হিমশীতল পরিবেশ। একপর্যায়ে তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কান্নায় বাড়ির নিস্তব্ধতা কেটে গেল।
 
ঢাকায় ফোন করলাম। কোনাে টেলিফোন কাজ করছে না। ঢাকার সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে টেলিফোন পাঠালাম বিস্তারিত জানার জন্য। কোন উত্তর এলোনা। লন্ডনে ফোন করলাম, রেডিও রিপোর্ট ছাড়া কিছু জানেনা। হাসিনা-রেহানা জানতো না ঢাকায় শেখ পরিবারের সবাই মারা গেছেন। তাদের সবকিছু জানানাে হয়নি। আমার বাসিয় তিনটি রেডিও ছিল। একটি রেডিও ছাড়া বাকি দুটি আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রেখে দিলাম।  
 
কীভাবে যেন হাসিনা-রেহানা জেনে গেল, শেখ সাহেব মারা গেছন। এই খবর শােনামাত্র ড ওয়াজেদ বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমার মনে আছে, শেখ হাসিনা আমায় বলেছিল, জানি-জানি কামাল-জামালও চলে গেছে। হাসিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিল ! চাচা, আমার মা ও রাসেলকে আমাদের কাছে আনার ব্যবস্থা করুন।
 

রাত তখন দশটা। আমি জানতাম বেগম মুজিব মারা গেছেন। তবু আমি বললাম, ঠিক আছে আমি দেখছি কী করা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা কীভাবে যেন নিশ্চিত হয়ে গেল-বেগম মুজিব নেই। কী বলৰ ওদের অবস্থার কথা। হাসিনার অনুরােধেই আমি টেলিগ্রাম পাঠালাম ঢাকায়, শেখ রাসেলকে যেন জার্মানি পাঠানো হয়। আমার ধারণার বাইরে ছিল, এই অল্প বয়সের শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। কোনাে জবাব এল না। জার্মান সরকারকে জানালাম, আমার বাসায় শেখ সাহেবের দুই মেয়ে, মেয়ের জামাই ও দুই নাতি-নাতনী রয়েছে। জার্মান সরকার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাসার সামনে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। জার্মান পররাষ্ট্র মন্থণালয় বিস্তারিত জানতে চাইল-তারা বলল, এক্সেলেন্সি, আমরা আপনার সাহসী ভূমিকাকে উৎসাহিত করছি। তবু আপনি নিজে কোনাে ঝামেলায় পড়েন কিনা খেয়াল রাখবেন। বললাম, কোনাে অসুবিধা হবে না।

মানবিক দায়িত্ব পালন করছি। মনে আছে, ভেঙ্ক অফিসার আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন নিশ্চিত না হই অসুবিধা হবে না, একথা ভেবে। তার ভাষায়-অসুবিধা হতে পারে। সতর্ক থাকবেন। আমাদের জানাবেন সবকিছু। একপর্যায়ে হাসিনা জানতে চাইল কে এই ঘটনার নায়ক। আমি বললাম, রেডিও রিপাের্ট থেকে শুনেছি খন্দকার মােশাকের কথা। হাসিনা কোনােমতেই বিশ্বাস করতে রাজি নয়। আব্বার সঙ্গে মােশতাক চাচা কত ঘনিষ্ঠ। পরিবারের একজন সদস্যের মতো। তিনি এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন না। হাসিনা অবিশ্বাস করলে কী হবে, মােশতাকই এ ঘটনার নায়ক। অভ্যুত্থান সুবাদে প্রেসিডেন্ট।

 
সারা দুনিয়া থেকে টেলিফোন আসা শুরু হল আমার কাছে। তারা জানতে চাইল। শেখ পরিবারের দু-সদস্যের কথা। সংবাদপত্র থেকেও ফোনের পর ফোন। এক জার্মান মহিলা মিশনে ঢুকে বললেন, তোমরা কেমন জাতি, তােমাদের নেতাকে হত্যা করতে পারাে, তােমরা এক অসভ্য জাতি। মহিলা কোনাে অবস্থাতেই থামতে রাজি নন। তাকে বললাম, শেখ সাহেবের মেয়েদের আমি আশ্রয় দিয়েছি। মহিলা ১২ বছরের এক বালককে নিয়ে এলেন। বললেন, তোমরা কীভাবে এ বয়সের বালককে হত্যা করতে পার। রাষ্ট্রদূত হিসেবে পরিচয় দিতে তখন লজ্জা লাগছিল।
 

এই যখন অবস্থা, তখন জার্মান প্রবাসী কিছু বাংলাদেশী যুবক এসে ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। তারা বলল, আমি কেন শেখ সাহেবের মেয়েদের ঠাই দিয়েছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যেন ছাদের বাসা থেকে বের করে নেয়। তা না হলে আমাকে তারা দেখে নেবে। তারা কয়েকটি পাসপাের্ট বের করে বলল—তাতে যেন ইসলামী  প্রজাতন্ত্রের সিল মেরে দিই। তাদের ধারণা বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্র হয়ে গেছে।

১৬ আগস্ট, ড কামাল হােসেন লন্ডনের পথে পাড়ি দিলেন। আমার বাসায় যে কক্ষে ড. কামাল উঠেছিলেন সেটি খালি করা হল। আমার এক ভাগিনা এসে হাজির। সুঠাম দেহের অধিকারী ভাগিনা যখন তার কক্ষে যাচ্ছিল, তখন শেখ সাহেবের এক মেয়ে তাকে দেখে ফেলে। তারা ভাবে, অন্য কেউ হয়তাে এসেছে, তাদেরকে হত্যা করতে। সারারাত তারা ঘুমায়নি।

প্রয়াজেন আমাকে জার্মান সােভিয়েত দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযােগ রাখার অনুরােধ জানালেন। তার ধারণা ছিল, সেভিয়েত ইউনিয়ন তাদেরকে আশ্রয় দেবে। আমি জানালাম, আশ্রয় নিতে চাইলে সােভিয়েত কেন, জার্মানিতেই হবে। এটি কোনো সমস্যা নয়। ইচ্ছা করলে লন্ডনেও যাওয়া যেতে পারে। এ সময় ভারতীয় হাইকমিশনার মি, রহমান টেলিফোন করে শেখ পরিবারের সদস্যদের কুশলদি জানলেন। বললাম, তারা ভালাে আছে, আমি দেখাশােনা করছি। তিনি বললেন, মিসেস গান্ধী খুব খুশি হয়েছেন আমি আশ্রয় দিয়েছি জেনে। হাসিনাকে বললাম, ভারতীয় হাই কমিশনার মি. রহমান দেখা করতে চান তার সঙ্গে। সাক্ষাতের ব্যবস্থা হল। আমি গৱহাজির থাকলাম। ড ওয়াজেদ সবাইকে নিয়ে গেলেন কার্লশােতে। সেখানে শিক্ষাসফরে এসেছিলেন তিনি।

 
কিছুদিন পর ভারতীয় হাই কমিশনায় জানালেন, শেখ পরিবারের সদস্যরা নিরাপদে, সুস্থভাবে বসবাস করছেন দিল্লিতে। ২৪ আগস্ট জেনেভা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবু সাঈদ চৌধুরী টেলিফোনে জানালেন, মােশতাক সাহেব খুবই ক্ষিপ্ত, কেন আমি হাসিনা-রেহানাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। আবু সাঈদ বললেন, প্লিজ, আপনি ঢাকা যাবেন না। গেলে বিপদ হবে। দু-দিন পর ঢাকা থেকে বার্তাঃ আমাকে ওএসডি করা হয়েছে। জার্মান বন্ধু বলল, ঢাকা যাবার দরকার নেই। জার্মানিতেই আপনার চাকরি হবে। জার্মান সােশ্যাল ডেমােক্রেটিক পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি মি, এইচ আর ডিঙ্গেলস বললেন, কোনো চিন্তা নেই, আমরা আছি। 

Reference: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন – ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, pp 64-67