নয় নম্বর সেক্টরের কয়েকটি যুদ্ধ – ক্যাপ্টেন এম নুরুল হুদা
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নাম দিয়ে অতর্কিতভাবে আক্রমণ চালায় বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের উপর। নিরস্ত্র বাঙালি রুখে দাঁড়িয়ে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলো। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধে লাখো প্রাণের বলিদানে দেশ স্বাধীন করেছিলো মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীনতার কৃতিত্বের সবটুকুই প্রাপ্য বাংলার সাধারণ মানুষের। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাত হাজার আর গণবাহিনীর সংখ্যা ছিল এক লাখের উপর। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে রণকৌশলগত প্রয়োজনে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রবাসী সরকার কর্নেল এমএজি ওসমানী এমএনএ (মেম্বার ন্যাশনাল এসেম্বলী) কে কমান্ডার ইন চীফ হিসেবে নিয়োগ দেন। বরিশাল, পটুয়াখালী, ফরিদপুরের কিছু অংশ ও খুলনা জেলার কিছু অংশ বাদ দিয়ে সবটা নিয়ে ৯নং নম্বর সেক্টর গঠন করা হয়। এ লেখাটি এই প্রজন্মের তরুণ বন্ধুদের উদ্দেশ্যে ৯নং সেক্টরের কয়েকটি সশস্ত্র ঘটনাবলী তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র। এই সকল ঘটনাবলী তোমাদের এই পৃথিবীতে আগমনের পূর্বের। একাত্তরের ২০ মার্চ সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী নিয়ে আমি ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা হই। মানসিকভাবে একটা অশুভ সূচনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। ২৫ মার্চ রাতে অগ্রজ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ আনুমানিক ১১টার সময় এসে বললেন তিনি ঢাকা থেকে ফোনের মাধ্যমে খবর পেয়েছেন পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির স্বাধীনতা হরণ করার জন্য সামরিক অভিযান শুরু করেছে এবং রাজারবাগ, পিলখানা, জগন্নাথ হল ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নির্বিচারে গণতন্ত্রকামী বাঙালিদের হত্যা করছে। তাৎক্ষণিকভাবে সর্বদলীয় রাজনৈতিক সভা ডাকা হয় এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সর্বদলীয় সগ্রাম কমিটির বেসামরিক প্রধান হিসাবে নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি এই আন্দোলনকে ত্বরান্বিত ও বেগবান করে। নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের নেতৃত্বে আমি ভোর রাতে শহরে উপস্থিত ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের নিয়ে বরিশাল পুলিশ লাইনে যাই। উদ্দেশ্য পুলিশ অস্ত্রাগারের অস্ত্র সগ্রহ করে পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করবাে। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য না করলেও নীরব থেকে সাহায্য করেছেন। ভোর নাগাদ পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগারের সমস্ত অস্ত্র আমাদের বাড়িতে এনে জড়ো করা হয়। ওখানে একটিও গুলি রেখে আসিনি। মেজর জলিল অবকাশকালীন ছুটি ভোগ করছিলেন গ্রামের বাড়ি উজিরপুরে। ৭/৮ দিন পূর্বে মঞ্জুর ভাইয়ের কাছে এসে নিজ পরিচয় দিয়ে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের আশংকাই প্রকাশ করেছিলেন। আরও বলেছিলেন প্রয়োজনে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। তার ঠিকানা রেখে যান। আমি মঞ্জুর ভাইকে বললাম এ সময় মেজর জলিলের খুবই প্রয়োজন। মঞ্জুর ভাই লোক পাঠিয়ে দুপুর ১২টা নাগাদ মেজর জলিলকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন এবং সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। আমরা অস্ত্র বিতরণ করি ছাত্র, যুবক ও শ্রমিকদের মাঝে। দুপুর থেকেই স্থানীয় সদর গার্লস স্কুলে প্রশিক্ষণ শুরু করে দেই। মেজর জলিলের নেতৃত্বে পুলিশের ৩০৩ রাইফেল দিয়ে এবং একইসাথে চাঁদমারীতেও অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমাদের সাথে পরবর্তীতে বাদু ভাই আমার অগ্রজ বাবু ভাই ও পুলিশ লাইনের সুবেদার এবং আনসার প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন। ২৭ মার্চ লে. মো. নাসিউদ্দিন আহমেদ ও লে. মেহেদী আলী ইসলাম যোগদান করেন (উভয়ই পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীর প্রশিক্ষণ ও কমিশন প্রাপ্ত অফিসার)। আমাদের পরিবারের চার ভাই, অগ্রজ নুরুল হক বাদু (Ex-2/LT. PAKISTAN NATIONAL GUARD/CNG 37TH BARISAL BN 1951-1952), নূরুল ইসলাম মঞ্জুর (এমএনএ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), অনুজ নুরুল আলম ফরিদ-ছাত্র (সম্পাদক-বিপ্লবী বাংলাদেশ প্রবাসী মুজীব সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা), আমার মেজ চাচী ডাক্তার সুফিয়া বেগম (তৎকালীন বরিশাল সদর হাসপাতালের লেডী ডাক্তার), আমার সদ্য বিবাহিত জায়া—দিলরুবা রানা ও আমি সকলে মিলে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দীর্ঘ নয় মাস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ |লড়াইয়ে অবতীর্ণ হই দেশকে শত্রু মুক্ত ও স্বাধীন করার জন্য। অগ্রজ মঞ্জুরের পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর জলিল, আমি, ছাত্র আব্দুস সাত্তার কালু (প্রয়াত), বশির আহম্মদ (বেতার অপারেটর-বি-আইডব্লিউটিএ), সেনাবাহিনীর মো. ছিদ্দিক (পরবর্তীতে এমপি) আব্দুল ওয়াদুদ (পরবর্তীতে এমপি) ও আব্দুল জব্বার নদী পথে সুন্দরবন হয়ে ভারতের ২৪ পরগণার হাসনাবাদের পথে রওনা হই। উদ্দেশ্য অস্ত্র সংগ্রহ করে ফিরে এসে দক্ষিণ অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে দেশকে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা। উল্লেখ্য মঞ্জুর ১৭ এপ্রিল একটি ছোট লঞ্চে করে ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৭২ রিভারাইন ব্যাটালিয়নের মাধ্যমে বেশ কিছু নতুন এসএলআর, এসএমজি হ্যান্ড গ্রেনেড, রকেট লঞ্চারসহ প্রচুর গোলাগুলি নিয়ে আসেন এবং ভবিষ্যতে অস্ত্র সরবরাহের আশ্বাস নিয়ে আসেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড এর কাছ থেকে। ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রাপ্তির ঘটনা এটাই সর্বপ্রথম। মঞ্জুর মেজর জলিলের কাছে আমাদের জন্য একটি পরিচয়পত্র দেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর জন্য।
২৫ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর হাতে বরিশাল ও ফরিদপুরের পতন হয়। বরিশালের উপকণ্ঠে তালতলিতে হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টারে কমান্ডো নামায়। এ কারণে ছাত্রনেতা কামাল (পরবর্তীতে মেজর কামাল) গুলিবিদ্ধ হন। সদর হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল অফিসার ডা. শাহজাহান (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করেন। আহত মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকসহ প্রায় ১৫০ জনের বাহিনীর সাথে মঞ্জুর ভাইয়ের পরিবার, লে. নাসিরের পরিবার ও আমার স্ত্রীকে নিয়ে মঞ্জুর ভাই সুন্দরবন হয়ে ভারতের হাসনাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং পৌছায় ২৯/৩০ এপ্রিলে। তখন আমি ও মেজর জলিল বনগাঁও-এর সীমান্তে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর ক্যাম্পে অবস্থান করছিলাম, তার কাছ থেকে হালকা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মর্টার সংগ্রহ করার জন্য। ঐ সময়ে ভারতীয় হাসনাবাদ থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত সীমান্তের প্রহরী হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন লে. কমান্ডার মুখার্জী, অধিনায়ক বিএসএফ ৭২ এনবি। তিনি বেশ ধৈৰ্য্য সহকারে মেজর ওসমানকে বুঝাতে সক্ষম হন যে তার অস্ত্র ভাণ্ডার (ইপিআর-এর যে সমস্ত অস্ত্র নিয়ে সর্বপ্রথম ভারতে পৌছান) থেকে আমাদের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করলে আমরা দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারব। অবশেষে মেজর ওসমান রাজি হন প্রচুর হালকা অস্ত্র দিতে। এর মধ্যে ছিল চাইনিজ রাইফেল, ৩০৩-রাইফেল স্টেনগান, ২”মর্টার, ৩’’ মর্টার ও হ্যান্ড গ্রেনেড। উল্লেখ্য তিনি আমাদের একটি চাইনিজ এলএমজি দেন। এখানে বীরযোদ্ধা হাফিজ ক্যা. শফিউল্লাহ ও বেসামরিক দুইজন তরুণ অফিসারের সাথে দেখা হয়। এরা হলেন ঝিনাইদহ মহকুমা প্রশাসক জনাব তৌফিক এলাহী চৌধুরী ও পুলিশ অফিসার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। সবাই আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। এরা সবাই দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করে বীরযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পান এবং বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত হন। মে মাসের ২০-৩০ তারিখ ৯নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় টাকীতে ইয়ুথক্যাম্প টাকিপুরে এবং গেরিলা ইনডাকশন ক্যাম্প স্থাপন করা হয় বাকুন্ডিয়ায়। পরিবার বর্গের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয় হাসনাবাদ গঞ্জের একটু দূরে। এসব ব্যাপারে লে. কমান্ডার মুখার্জী ও ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মিত্র বাহিনীর ইস্টার্ণ কমান্ড-এর উপর ৯নং সেক্টর এর সার্বিকভাবে দেখাশােনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ‘চার্লি সেক্টর’ কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এমএ সালিক। এদের সাথে আলাপ করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদ স্থানে পাঠানোর সিধান্ত গ্রহণ করা হয়। সুন্দরবনের গহীন অরণ্য পথ গেরিলাদের জন্য নিরাপদ ছিল। আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয় এসব জায়গা মুক্ত রাখার। সেই লক্ষ্যে সাতক্ষীরা মহকুমার দেবহাটা, কালীগঞ্জ ও শমসের নগর থানার সমস্ত সীমান্ত চৌকিসমূহে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ওদের দাবিয়ে রাখা এবং সম্ভব হলে তাড়িয়ে বেড়াতে হবে এই নির্দেশ দেওয়া হয়। ভারতীয় সীমান্ত হিংগলগঞ্জে আক্রমণ ঘাঁটি স্থাপন করা, পরিকল্পনা ও আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। হিংগলগঞ্জের দূরত্ব হাসনাবাদ থেকে ১২ মাইল। মাটির পথ, প্রমত্তা ও খরস্রোতা কালিন্দি নদী ও ইছামতি নদী পার হয়ে যেতে হয়। ৪ জুন প্রবল ঝড় ও বৃষ্টির মাঝে রওনা হলাম ৩৫ জন তরুণ যোদ্ধা নিয়ে, হাতিয়ার দেওয়া হলো বিশটি ৩০৩ রাইফেল, চল্লিশটি হ্যান্ড গ্রেনেড, দুইটি ২’’ মর্টার ও আমার সাথে চীনা এসএমজি। রাত ১১টার দিকে ক্যাম্প-এ গিয়ে পৌছালাম। একটা স্কুল মাঠের শেষ প্রান্তে ৪টা তাঁবু (ত্রিপলের তৈরি) টানানো, সব আয়োজন বিএসএফ করে রেখেছিল। চারিদিকে পানি সেই সাথে উপর থেকে অঝোরে বৃষ্টির পানি পড়ছে দেখে সাথীরা নিরাশই হলো। যাহোক পরের দিন স্থানীয় বিএসএফ কমান্ডার ক্যাপ্টেন পান্ডেকে অন্য জায়গায় দেয়ার অনুরোধ করলাম। পান্ডে আশ্বাস দিলেন। কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর থানার নেতৃস্থানীয় কলেজ ছাত্র ও যুবকরা ইতোমধ্যে আমার সাথে যোগদান করে। এদের মধ্যে শেখ ওয়াজেদ, শেখ আতাউর, নাসির, বারেক, আকবর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তাদের দিয়ে খাজি, বসন্তপুর, রতনপুর, কালীগঞ্জ, শ্যামনগরে অবস্থিত হানাদার বাহিনীর সব সীমান্ত চৌকির অবস্থান, শক্র সংখ্যা ও রেশন সরবরাহের দিনসহ বিস্তারিত খবর সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাই। ওদের উপস্থিতিতে স্থানীয় যুবক ও ছাত্ররা এসে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। পরবর্তীতে আমাদের সাথে আটশত হতে এক হাজার জন মুক্তিযোদ্ধার সমাবেশ হয়। প্রথম দিকে আমরা রাতে নদী পেরিয়ে সীমান্ত চৌকি থেকে কিছু দূরে Anti personal mine পুঁতে ভোর হবার পূর্বেই এপারে ফিরে আসতাম। হানাদার বাহিনী যখন টহল দিত তখন মাইনের আঘাতে ধরাশায়ী হত। ক্রমেই ওরা টহলের পরিধি কমিয়ে দেয়। ওরাও সীমান্ত চৌকি এর চারিদিকে মাইন বসিয়ে যায়। এটা জানতে পেরে আমরা ফিন্ডের উপর গরু ছাগল চরানোর জন্য রাখালদের বলতাম যাতে করে, মাইন চিহ্নিত করতে সুবিধা হয়। এ ব্যাপারে লে, বেগ (এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট নেভাল কমান্ডো) সর্বদা সাহসী ভূমিকা পালন করতেন। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম হানাদার বাহিনীর দুর্বল ঘাঁটি আক্রমণ করার। আমি ৫ জুন দেবহাটা থানার খাজি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেই। এটা ছিল আমাদের প্রথম যুদ্ধ। ঐ দিন ছিল বেশ মেঘলা। সন্ধ্যার পর বৃষ্টি শুরু হলো। তখন কালিন্দি নদী বেশ উত্তাল। মাঝ রাতে আমরা তিন দলে বিভক্ত হয়ে নদী পার হই। এক দলের নেতৃত্বে ছিলেন লে, মাহফুজ আলম বেগ, আরেক দলের নেতৃত্বে সুবেদার গফুর এবং মূল দলের দায়িত্বে ছিলাম আমি। ভোর ৩-৩০ মি. এ আমরা মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ করি। দশ মিনিট ধরে গোলাবর্ষণ শেষে আমরা অগ্রসর হই, ২০০-২৫০ গজের মধ্যে গিয়ে ত্রিমুখী এলএমজির গুলিবর্ষণ করি। হানাদার বাহিনী ঐ গুলির মাঝে বাংকারে-এ পজিশন নিতে না পারায় ওদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ দুর্বল হয়ে পড়ে। ওরা ক্যাম্পের ভিতর থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছোঁড়াছুড়ি করে। তাছাড়া সন্ধ্যার পর ওরা বাইরে বের হতো না। ঠিক ভোর চারটায় ত্রিমুখী আক্রমণ করে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে আমরা সীমান্ত চৌকি এর দিকে ধাবিত হয়ে হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করি। ওরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে চারিদিকে ছুটে যায়। অন্ধকার রাত হওয়ায় ফসলের মাঠে লুকিয়ে পড়ে। এখানে ওদের গুলিতে আমাদের একজন আহত হয়। সবুজ সংকেত দিয়ে আমরা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। হানাদার বাহিনীর দুই জন মৃত ও পাঁচ জন আহত অবস্থায় পাই। এখানে প্রচুর অস্ত্র যেমন হালকা মেশিন গান, চাইনিজ রাইফেল, হ্যান্ডি গ্রেনেড ও বারুদ পাই। এই অস্ত্র আমাদের মনোবল ও আস্থা বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া ওখানে ৩০/৪০ জনের এক মাসের রেশন পাই। ভোর ৪.৩০ মি, নাগাদ ‘জয় বাংলা’র পতাকা উত্তোলন করে অস্ত্র, রেশন ও আহত বন্দীদের নিয়ে মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসি। আহত বন্দীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে স্থানীয় বিএসএফ এর হাতে তুলে দেই। জুন-জুলাইতে সীমান্ত চৌকির উপর নিয়মিত আক্রমণ চালাই। ২০ আগস্ট পরিকল্পনা মতো শ্যামনগর থানা সদর আক্রমণ ও দখল নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। স্থানীয় যোদ্ধাদের মারফত নিয়মিত শত্রুপক্ষের অবস্থানের উপর দৃষ্টি রাখি ও তথ্য সংগ্রহ করি। শ্যামনগর সীমান্ত নদীর তীর থেকে ৬/৭ মাইল অভ্যন্তরে অবস্থিত। তদুপরি কালীগঞ্জ ওদের স্থানীয়-মূল ঘাঁটি। ওখান থেকে সড়ক পথে ওরা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে। ২০ আগস্ট মাঝরাতে নদী পার হয়ে রহনপুর থেকে এক গ্রুপ এবং ধলবাড়িয়া থেকে আরেকটা গ্রুপ রওনা হই। ৩য় দল দুদলিতে গিয়ে কালীগঞ্জ-শ্যামনগর সড়ক অবরোধ করে রাখে। ওখানে আমাদের সাথে একশত বিশ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আক্রমণ পরিচালনায় লে, বেগ, সুবেদার ইলিয়াস, সুবেদার গফুর, হাবিলদার সোবহান ও মোকাররম যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। শমসের নগরের যুদ্ধে আরও অংশ নেন প্রয়াত চিত্রগ্রাহক মুহম্মদ আলম। ভোর ৪টায় আমার ২’’ মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করি। মূল বাহিনী নিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে রতনপুর হয়ে আমি অগ্রসর হই। লে, বেগ উত্তর দিক দিয়ে অগ্রসর হয়। দশ মিনিট গোলাবর্ষণ করার পর উভয়েই দল নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু হানাদার বাহিনীর লাগাতার গুলির সামনে আমাদের থমকে যেতে হয়। ওদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি খুব মজবুত। ওরা ওয়াপদা কলোনীর সম্মুখভাগের দেয়ালের বাইরে ও পরিখার মধ্যে অবস্থান নিয়েছিলো এবং দেয়াল ভেঙে মূল খুঁটির সাথে যোগাযোগ রাখছিলো। ওদের নির্গমন পথও ঐ দিকেই ছিলো। আমরা উভয় দল আক্রমণ বন্ধ রেখে সময় নিয়ে মর্টারের গােলা ওদের ব্যাঙ্কারের উপর ছোড়ার নির্দেশ দেই। শমসের নগর কালীগঞ্জ সড়কের উভয় পাশে ধান ক্ষেত এবং বর্ষার কারণে বেশ পানি ছিলো। সুবেদার ইলিয়াস ও হাবিলদার সোবহানের নেতৃত্বে দশ জন করে দুই দলে বিশ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এলএমজি, হ্যান্ড গ্রেনেড ও রাইফেল নিয়ে ধান ক্ষেতের ভিতর থেকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেই যাতে করে সূর্য ওঠার পূর্বে বাঙ্কারের নিচে পৌছাতে পারে। ওয়াপদা কলোনীর দক্ষিণ ও উত্তর দিকে ধানক্ষেত আর জলাশয় হওয়াতে গুদের গোলাগুলি নিক্ষেপের সীমাবদ্ধতা ছিল। সেজন্য একমাত্র সড়ক বরাবর তারা গোলাগুলি করেছে। ভোর ৫/৫.৩০টা নাগাদ দুই দলই বাঙ্কারের নিচে পেীছে যায় এবং আমাদের মর্টার ফায়ার বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই মুক্তিযোদ্ধারা নিজ নিজ সম্মুখবর্তী পরিখার ভিতরে গ্রেডেন ছুড়ে মারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই দলের ৪ জন এলএমজি নিয়ে অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই সময় আমি এবং লে, বেগ উভয় দিক দিয়ে অগ্রসর হতে থাকি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে। হানাদার বাহিনী সম্মুখবর্তী প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে কলোনীর মধ্যে মূল দলের সাথে অবস্থান নেন। আমরা ৩/৪ দলে ভাগ হয়ে কলোনীর ভিতর ঢুকে পড়ে গোপন অবস্থান নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেই। উভয় দল রাস্তার ঢালু পথ ধরে সামনে এগুতে থাকি এবং আমাদের পিছন থেকে বিরতি দিয়ে মর্টারের গোলাবর্ষণ করার নির্দেশ দেই। ইতোমধ্যে বেশ বেলা হয়ে যায়, ধানক্ষেতের মধ্য থেকে অগ্রবর্তী দলের সাথে যোগযোগ রক্ষা করে চলি; ওদের উপর নির্দেশ দেই বেলা ১২ টা নাগাদ ওদের অবস্থান থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করার। আড়াল থেকে এবং আমরা কলোনীর কাছাকাছি পৌছালে সবুজ সংকেত দেবো এবং তারা নিজ অবস্থান থেকে খুব উচ্চস্বরে জয় বাংলা’ ধ্বনি দিবে অন্তত তিনটা জায়গা থেকে, পাঁচ মিনিট গুলি ছুড়বে ছেড়ে ছেড়ে, কিন্তু কোনভাবেই আড়াল থেকে বাইরে আসবে না ২য় সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত। বেলা ১১ টা নাগাদ আমরা উভয় দলই কলোনীর খুব কাছে পৌছে যাই এবং একই সাথে ধাবিত হই। | নির্ধারিত সময় কলোনীর ভিতর দিয়ে গুলির শব্দ ও জয় বাংলার ধ্বনি শুনে ওরা ভীত হয়ে পড়ে এবং হঠাৎ করে সড়কের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কলোনীর ভিতর ঢুকে পড়ে। শত্রু খুঁজে বের করার জন্য। আমরা এই সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। দ্রুতবেগে গুলি ছুড়ে ঢুকে পড়ি কলোনীর ভিতর। হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত কৈখালীর দিকে ছুটতে থাকে। ওদের এলোপাথাড়ি গুলি আমাদের অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারেনি। আমাদের তিন দিকের আক্রমণের ফলে ওরা ঘাটি ছেড়ে দেয়। বেলা ১২টা নাগাদ আমরা ওদের পিছু না নিয়ে কলোনী দখল করে নেই এবং নিজ নিজ অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এখানে আহত অবস্থায় দুই জনসহ মোট ছয় জনকে বন্দি করি। বিকেল চারটায় থানা কম্পাউন্ডে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। স্থানীয় জনসাধারণের সাথে কথা বলি এবং সার্বিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। রাত আনুমানিক দশটার দিকে লে. বেগের উপর সার্বিক দায়িত্ব দিয়ে সীমান্তের ওপরে বাকুডার মূল ঘাঁটির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে মাঝ রাত নাগাদ পৌছে যাই। | ২১ আগস্ট-এর শেষ রাতে হানাদার বাহিনী স্থানীয় ঘাঁটি কালীগঞ্জ থেকে সড়কপথে এসে শ্যামনগর আক্রমণ করে। ওদের সংখ্যা ছিলো আনুমানিক দুইশত। এই আক্রমণে ওরা জিপ, ট্রাক, মেশিনগান, রিকয়েললেস রাইফেল ব্যবহার করে। | আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ছিল খুবই পরিশ্রান্ত এবং সম্ভবত অসতর্ক। এই আক্রমণের জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হয়। এই সংঘাতে দুই জন গ্রামবাসী, সুবেদার ইলিয়াস সহ মোট ছয় জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও ছয় জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাক হানাদার বাহিনী বন্দি করে। হেভিমেশিনগানের গুলি ও তার গোলাবর্ষণ এর সাথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পরিচিত ছিল না, যার ফলে তীব্র ও প্রচণ্ড গোলাগুলির সামনে টিকে থাকতে পারেনি।
লে. বেগ রতনপুর হয়ে পিছনে হটে আসেন। বেলা ৭টা নাগাদ বিএসএফ এর লোকেরা হানাদার বাহিনীর বেতার বার্তা পথিমধ্যে রোধ (intercept) করে জানতে পারে হানাদার বাহিনী শ্যামনগর পুনঃদখল করেছে ও অনেককে বন্দি করে নিয়ে গেছে। তারা এ খবর আমাকে জানায়। আমি বিএসএফ এর সহযোগিতায় কিছু যোদ্ধা নিয়ে দিনের বেলায় নদী পার হয়ে লে. বেগের সহায়তার জন্য ছুটে যাই এবং আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সবাইকে পুনঃসংগঠন করে বাকুড়া ক্যাম্পে ফিরে আসি। ঐ দিন দুপুর থেকে পাক রেডিওতে নিউজবুলেটিন বিরতিহীন প্রচার করছিল শ্যামনগর পুনঃ দখলের বার্তা। ওরা বন্দিদের কাছ থেকে আমাদের নাম জানতে পারে, এবং বারবার প্রচার করে যে আমরা আহত অবস্থায় বন্দি হয়েছি। ওরা আমাদের ভারতীয় দুষ্কৃতিকারী ও দালাল বলে আখ্যায়িত করে ও আমাদের শ্যামনগর অভিযান সম্পর্কে হানাদার নিয়ন্ত্রিত দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় ২২ আগস্ট কাল্পনিক খবর প্রকাশ করে। অল্পদিনের মধ্যেই আমরা শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ থানার অধিকাংশ স্থান পুনঃদখল করি, এবং নদীপথ মুক্ত করে সুরক্ষণ করি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের জন্য। আমাদের সুরক্ষিত পথে ১৫ আগস্ট নৌ-কমান্ডাররা চালনা ও মংলা আক্রমণ করেন। ২০ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের দিনে আমরা কালীগঞ্জ মুক্ত করি। কালীগঞ্জ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম ডাকটিকেট চালু হয়। | ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মহকুমা সদরে আমরা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। ১৭ ডিসেম্বর খুলনা মুক্ত হয়। ঐ দিন বিকেল ৪টায় খুলনা সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে মিত্র বাহিনীর ৯ ইনফ্রান্ট্রি ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল দলবীর সিং এর নিকট আত্মসমর্পণ করে পাক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত খান কর্নেল ও হানাদার বাহিনীর অন্যান্য অফিসার বৃন্দ। | আমাদের সন্তানরা আজ তোমরা স্বাধীন বাংলাদেশে বাস করছে। মনে রেখো বহু বীর যোদ্ধার বীরত্বের ও আত্মত্যাগের উপহার আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। ক্যাপ্টেন এম নুরুল হুদা জন্ম : ২ নভেম্বর ১৯৪১, বরিশাল। শিক্ষা : বরিশাল বিএম স্কুল, বিএম কলেজ, বরিশাল। প্রাইভেট পরীক্ষায় বিএ। ২ জুলাই ১৯৬৬ তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এ নিয়োগ পান। ১৯৬৩ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও মিছিল করায় দুইবার কারাবরণ। কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে ১৯৬৯ সালে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান। মুক্তিযুদ্ধে নয় নম্বর সেক্টরের একজন সাব-সেক্টর কমান্ডার এবং সম্মুখ সমরের সৈনিক।
রেফারেন্স – স্বাধীনতা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া, pp. 50-55
Photo: Osmani, Major Jalil and others