You dont have javascript enabled! Please enable it! বিবিসির এশিয়া বিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, ২৭ মার্চ ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

বিবিসির এশিয়া বিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, ২৭ মার্চ ১৯৭১
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকিস্তানের বিষয়ে ব্রিটিশ প্রেস

১।
২৭ মার্চ – উইলিয়াম ক্রলি (৮)

আজ সকালে সকল ব্রিটিশ পত্রিকা ব্যাপকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট নিয়ে লিখেছে। বেশিরভাগ কাগজপত্র শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ববাংলার স্বাধীনতার ঘোষণার উপরে রিপোর্ট করে। এবং গৃহযুদ্ধের উপরে বর্ণনা করে। বেশিরভাগ কাগজপত্র গতকাল জাতির উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণ উদ্ধৃত করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ রিপোর্টের জন্য তারা ভারত থেকে পাওয়া রিলে খবর এবং প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া এর তথ্যের উপর নির্ভর করে। এগুলোর উৎস ছিল একটি গোপন রেডিও স্টেশন যেখান থেকে শেখ মুজিবের ভাষণ রিলে করা হয়েছিল।

সব রিপোর্ট জানায় যে শেখ মুজিব বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র নেতা। এবং যতক্ষণ না শেষ শত্রু সৈন্য পরাজিত হয় ততক্ষণ স্বাধীনতার জন্য তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া উচিত। এছাড়াও বেশ কিছু কাগজপত্র করাচিতে আগমনের সময় জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর বক্তব্য উদ্ধৃত করে। তিনি বলেছেন ‘সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান রক্ষা পেল।’ ডেইলি টেলিগ্রাফ, পূর্ব পাকিস্তান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের বক্তব্য কোট করে বলে যে পাকিস্তানের অব্যাহত অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তা রক্ষার একমাত্র পথ হচ্ছে বর্তমানে সেখানে যে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা চলছে তা বন্ধ করা।

গোপন বেতার সম্প্রচারে জানা যায় যে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এর সদস্যরা চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘিরে ফেলেছে। টাইমস এবং ফাইনানশিয়াল টাইমস – উভয় পত্রিকা ঢাকায় সৈন্য এবং ট্যাংক মোতায়েন সম্পর্কে সেখানে আমেরিকান কনসুলেটর জেনারেল এর বিবৃত্তি উদ্ধৃত করেছে। বেশিরভাগ পত্রিকা বলছে পূর্ববঙ্গে আনুমানিক ৭০০০০ পাকিস্তানি সেনা অবস্থান করছে।

বেশ কিছু কাগজপত্র এগুলো মূল্যায়ন করে সম্পাদকীয় লিখেছে। টাইমস পত্রিকা মনে করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পুলিশি কর্মকাণ্ড সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু করতে পারে। টাইমস মনে করে গত কিছু সপ্তাহের ঘটনায় মনে হয় পুর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রক্রিয়ায় দেরি হতে পারে। যদিও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন সাময়িক স্থবির হয়ে যেতে পারে তবে তা দমানো সম্ভব না। টাইমস মনে করে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন। সেনাবাহিনীর চাপ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে একশনে যেতে বলেছে।

একটি সম্পাদকীয়তে ডেইলি টেলিগ্রাফ বলেছে কোন সন্দেহ নেই যে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সম্পাদকীয় বলছে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আলাদা হওয়া যুক্তিসঙ্গত। সম্পাদকীয়তে বলা হয় গত ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর উচ্চাশা জেগেছে যে পুর্ব পাকিস্তান অবশেষে সঠিক সরকারপদ্ধতির দিকে আগাচ্ছে। এখানকার জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণীর জনগণ হিসেবে দেখা হত। টেলিগ্রাফ বলছে সামরিক সরকার যা কিছুই করুক একটি স্থায়ী ও টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থা তৈরি করতে পারবেনা।

টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা ডেভিড লসাক দিল্লী থেকে এক প্রতিবেদনে বলেছেন সেনাবাহিনী যদি পুর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন দমিয়েও দেয় – তথাপি দুই পাকিস্তানকে একসাথে রাখার সম্ভবনা শেষ হয়ে গেছে। তিনি বলেন আলোচনার মাধ্যমে কোন দির্ঘস্থায়ী চুক্তি বা সমঝোতায় আসার সম্ভবনা নেই। দুই অংশ গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ছিল মূলত সেনাবাহিনীর কাজ শুরু করার প্রস্তুতির জন্য একটু সময় বের করা। গার্ডিয়ান পত্রিকা বলেছে যে এটাই তার উদ্যেশ্য ছিল। গার্ডিয়ান সম্পাদকীয় আর বলে যে যাই হোক না কেন দুর্বিপাক আর রক্তপাত বাড়বে। প্রেসিডেন্ট বলেছেন যেকোনভাবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা হবে – এই কথার কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা এখন অপ্রতিরোধ্য।

টাইমসের পল মারটিন শেখ মুজিবের সাক্ষাতকার নিয়েছে। তিনি বলেছেন জনগণ তার পেছনে আছে। বন্দুক দিয়ে বাঙ্গালীর মুখ বন্ধ করা যাবেনা। মারটিন সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে শেখ মুজিবের কারাভোগের কথা জানান। তিনি মুজিবের একটি উধ্রিতি উল্লেখ করেন – ‘আমি আশাবাদী। আমি সবচেয়ে ভালোটাই আশা করি আর সবচেয়ে খারাপের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকি।’

গার্ডিয়ান এছাড়াও ব্রিটেনের পুর্ববাংলার বাঙালিদের কার্যক্রম রিপোর্ট করেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় গত রাতে পাক হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভের সময় ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন মুখপাত্র বলেছেন যে বিক্ষোভের কারণ এক্সহিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা উদযাপন। এবং এটা আওয়ামী লীগের ব্রিটিশ শাখা আয়োজন করে। এখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ১০০ জন ছাত্র সারারাত উৎসব পালন করে।

এছাড়াও গার্ডিয়ান রিপোর্ট করে যে বেঙ্গল স্টুডেন্টস একশন কমিটির একটি প্রতিনিধি দল আজ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনাব হিথের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে বলার জন্য সাক্ষাতের আবেদন করেছে।

গার্ডিয়ান আরও জানায়, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ রেড ক্রস জানিয়েছে যে তারা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। গত বছরের বন্যার সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের প্রতিনিধি আছে। তারা সেখানে মেডিকেল ও অন্যান্য রিলিফের ব্যাপারে অবগত আছে।
২।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
২৯ মার্চ ১৯৭১
ব্রিটিশ প্রেসে পাকিস্তান বিষয়ে আলোচনা
– বাই মার্ক টালি (এস)

আজ আবার ব্রিটেনের নেতৃস্থানীয় কাগজপত্র ব্যাপকভাবে পাকিস্তানের পরিস্থিতি বর্ননা করেছে। চাক্ষুষ সাক্ষীদের বিবরণ ছাড়াও অনেকে সম্পাদকীয় মতামত ও সঙ্কটের পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন।

টাইমস একজন নেতার মতামত প্রকাশ করেছে যিনি মনে করেন পাকিস্তানের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তা বলা অসম্ভব। এই বিষয়ে জড়িয়ে পড়ার জন্য ভারতের উপরে চাপ থাকবে। তবে টাইমস মনে করে যে ভারত এক্ষেত্রে সাবধানী পথ অবলম্বন করবয়ে কারণ তারাও অনিশ্চিত যে কি ঘটতে যাচ্ছে। গেরিলা আন্দোলন বাড়লে চীনের প্রভাব বাড়বে। টাইমস আরও মনে করে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাকে একত্রীকরণ আন্দোলন চাঙ্গা হতে পারে যে আসলে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। টাইমস মনে করে যে ইয়াহিয়ার চাইতে মিসেস গান্ধীর সমস্যা কম নয় – কারণ তিনি ইতোমধ্যে সেটা বুঝতে পেরেছেন।

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট জনাব ভুট্টো সম্পর্কে টাইমসে লিখেছেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যরা একটি শক্তিশালী সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণ করছে। কোন চিন্তাশীল পাকিস্তানি বিশ্বাস করবে না যে জনাব ভুট্টো গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন। পশ্চিম পাকিস্তানে চলবে একনায়কতন্ত্র এবং পুর্ব পাকিস্তানে চলবে নির্মম সামরিক শাসন। হ্যাজেলহার্স্ট বলেন সংবিধান প্রণয়ন সঙ্ক্রান্ত আলোচনার সময় ভুট্টোর আচরণ বাঙ্গালীদের চরম অবস্থান নিতে বাধ্য করে। বিশেষ করে তিনি যখন রাষ্ট্রপতিকে ৩ মার্চের এসেম্বলি বন্ধ ঘোষণা করার জন্য চাপ দিলেন তখন। এবং তিনি বললেন তার দলকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, ভুট্টো ও প্রেসিডেন্টকে মনে রাখতে হবে শেখের বিচার করা মানে সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানের বিচার করা।

টাইমস পল মার্টিনের একটি নিবন্ধ ছাপিয়েছে। মার্টিন বলেছেন যে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম পূর্ব পাকিস্তানে চরমপন্থীদের আন্দোলনকে যৌক্তিকতা দিয়েছে এবং তারা মনে করে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সহাবস্থান অসম্ভব। এর অর্থ এই যে যারা শেখের অহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন তারা এখন সহিংস বিপ্লবের সমর্থনে থাকবেন।

গার্ডিয়ান শুধু ঢাকা থেকে আসা মার্টিন এডেন্সির একটি দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী সম্ভবত চট্টগ্রাম ব্যতীত বাকি সব জায়গায় তাদের হোল্ড ধরে রাখার চেষ্টা করছে। পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা আন্দোলন আকারে ক্ষুদ্র ও দুর্বল অস্ত্রসজ্জিত। সেনাবাহিনী পুর্ব পাকিস্তানে শক্তি বৃদ্ধি করছে এবং এখন সেখানে তিন ডিভিশন সৈন্য আছে। এডেন্সি বলেন গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের ঘটনায় পাক সেনাবাহিনী যে সমস্যায় পড়েছে তাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হস্তক্ষেপ জরুরী হয়ে পড়েছে। সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নিতে যাচ্ছে যা আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। গত কয়েক সপ্তাহে পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধীনতার ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তবে তারা শংকিত যে এতে করে সেনাবাহিনীর কর্মকান্ড জোরালো হবে।

তিনি বলেন যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সেনাশাসক দ্বারা সম্পূর্নরূপে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কারণ সেনা অফিসারগণ বাংলা সহ্য করতে পারেননি। প্রেস্টন মনে করেন এখন আর আপস করার কোন সম্ভবনা নেই। তিনি বলেন যে, ইয়াহিয়া সব শেষ করেছেন, তিনি মুজিবকে শহীদ বানিয়েছেন, একটি রক্ষণশীল আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে পরিণত করেছেন এবং তা গনঅভ্যুত্থানে রূপ নেবেই। তিনি সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত ব্যাবহার করেছেন এবং তাকে জাতিসংঘের সম্মুখীন হতে হবে।

ফাইনানশিয়াল টাইমস এর দূরপ্রাচ্য প্রতিবেদক চার্লস স্মিথের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অসুবিধার একটি আংশিক কারণ হল এটা পাকিস্তানের অংশ। পার্টিশনের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে পাট, টেক্সটাইল মিল ও উর্বর জমি ছিল কিন্তু পশ্চিমে শুধু মাটি ছিল – কার্যত কোন শিল্প ছিল না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় ও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান শিল্পায়নের ফলে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বভাবতই পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প উৎপাদন খরচ বেশী ছিল।

স্মিথ মনে করেন সেনাবাহিনী স্বল্প মেয়াদে সফল হবে কিন্তু চীন , রাশিয়া কিংবা ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনকে তেমন জোরালো সমর্থন দেবেনা। তবে স্মিথ মনে করেন পাকিস্তানের সমস্যা সামরিক কর্ম দ্বারা সমাধান করা যাবে না। তাদের ধৈর্য, সময় ও পারশপরিক সংযম প্রয়োজন।

ডেইলি টেলিগ্রাফ একজন নেতার বরাত দিয়ে বলেছে বর্তমান ট্রাজেডি আইয়ুব খানের শাসনামলে বেশী বিস্তার লাভ করে কারণ এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে চরম অবহেলা করা হয়েছে। কাগজে আরও বলা হয়, সেনাবাহিনী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ধ্বংস করতে পারবেনা। হয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আবার গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য আলোচনা শুরু করতে হবে নতুবা দ্রুতই দেশ বিভক্ত হবে। পত্রিকাটি মনে করে সাংবিধানিক আলোচনা আবার শুরু করার জন্য একটি অলৌকিক ঘটনার প্রয়োজন হবে। কিন্তু টেলিগ্রাফ বলে – যদি তারা তা শুরু না করেন তাহলে অবর্ননীয় রক্তপাতের বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করবে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন লাভ হবেনা।

৩।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
২ এপ্রিল, ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে ব্রিটিশ প্রেস
– উইলিয়াম ক্রওলে

আরও কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর নানান ঘটনা পত্রিকায় এসেছে যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্প্রতি এসেছেন। ব্রিটিশ প্রেস আজ সকালে পূর্ব বর্ণিত ঢাকা ও প্রদেশের অন্যান্য শহরে হত্যার রিপোর্ট নিশ্চিত করেছে। অধিকাংশ কাগজপত্র যশোর শহরের পরিস্থিতির উপর পশ্চিমা সাংবাদিকদের রিপোর্টকে প্রাধান্য দিয়েছে। একজন টাইমস প্রতিবেদক নিকোলাস টমালিন – যিনি গতকাল ভারত থেকে যশোর এসেছেন – তিনি জানান – বাঙ্গালী বাহিনী ও বেসামরিক লোকেরা পাঞ্জাবি সৈন্যদের দ্বারা যশোরে বেসামরিক নাগরিক হত্যার প্রতিবাদ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিকদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করছে। টমালিন বলেন যে তিনি ‘পাঞ্জাবি বন্দী’দের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা দেখেছেন। কিছু পর্যবেক্ষক বলেন যশোরের অবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের অন্য এলাকাগুলোর সাদৃশ্যমূলক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যশোরে তাদের সেনা প্রত্যাহার করেছে এবং বাঙ্গালীদের কাছে ছেড়ে দিয়েছে এবং এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। কিন্তু নিয়মিত সৈন্য দিয়ে পুনরায় হামলা চালিয়েছে। (স্কটসম্যান পত্রিকা একজন সুইডিশ সাংবাদিকের বরাত দিয়ে জানায় – যিনি নিজেও যশোরে গিয়েছেন – তিনি দেখেছেন সেখানে কোন পাঞ্জাবি সৈন্য নেই। তবে তিনি যশোরে বাঙালিদের দ্বারা প্রতিহিংসামূলকভাবে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিশ্চিত করেন।)

এছাড়াও টাইমস কলিকাতায় অবস্থিত পিটার হ্যাজেলহার্স্টের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তিনি সেখানে আসা শরনার্থিদের কাছে জেনেছেন যে কুমিল্লা ও যশোরের বেশিরভাগ স্বনামধন্য রাজনৈতিক নেতাদের পাকসেনারা হত্যা করেছে। হ্যাজেলহার্স্ট জানান অবাঙ্গালী মুসলমান, যারা মূলত বিহার থেকে ভারতে এসেছেন, তারাও যথেষ্ট ভীতির মধ্যে আছেন। হ্যাজেলহার্স্ট বলছেন এদের অনেকেই ভারতে ফিরে আসতে শুরু করেছেন।(তিনি রিপোর্ট করেন যে বিভিন্ন বিহারি মুসলমান গতকাল সীমান্তে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।) হ্যাজেলহার্স্ট বলেছেন যদিও পশ্চিম পাকিস্তানীরা সমুদ্রপথে অবাঙালিদের পূর্বপাকিস্তান থেকে সরিয়ে নিচ্ছে তবে অনেকেই সেখানে আটকে পড়বে। কারণ প্রচুর পরিমাণে অবাঙ্গালী মুসলমান সেখানে অবস্থান করছে।

টাইমস পত্রিকার সুপরিচিত সাংবাদিক লুই হেরেন, একজন অজ্ঞাত পরিচয় যুবক – যে গত দুই বছর পূর্ব পাকিস্তানে কাটিয়েছিলেন এবং এই সপ্তাহের শুরুতে ঢাকা ত্যাগ করেছেন – এমন একজনের সাক্ষাতকার প্রকাশ করেছেন। এই সাক্ষী দাবি করেন যে, সেখানে চিহ্নিত কিছু লোক আক্রমণের শিকার – এদের মধ্যে আছে আওয়ামী লীগ নেতা, ছাত্র, অধ্যাপক ও তাদের পরিবার এবং হিন্দুরা। তিনি টাইমসকে আরও বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের আসল উদ্যেশ্য ছিল পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের নির্মুল করা যাতে করে অন্তত আগামী ১০ বছরে কোন নেতৃত্বের অস্তিত্ব না থাকে।

ডেইলি টেলিগ্রাফ ও গার্ডিয়ান পত্রিকা ভারতের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে সে ব্যাপারে ভারতীয় উদ্বেগের সংবাদকে প্রাধান্য দেয়।

৪।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
৭ এপ্রিল, ১৯৭১
নিউজনোটঃ চট্টগ্রাম
– মার্ক টালি

গতকাল বিভিন্ন জাতীয়তার ১২০ জন মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কলকাতায় পৌঁছেছেন। তাদের থেকে পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী সাংবাদিকরা চট্টগ্রামে কী ঘটেছিল এবং সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি কি সেই ব্যাপারে প্রথমবারের মত একটি সম্মিলিত ধারণা পেতে যাচ্ছেন। একজন বি বি সি সংবাদদাতা এবং ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট মতে চট্টগ্রাম থেকে আসা উদ্বাস্তুরা জানিয়েছে যে সেনাবাহিনী শহরের নিয়ন্ত্রণ রেখেছে কিন্তু অনেক মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। উদ্বাস্তুরা নিশ্চিত করেছে যে সেখানে ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে এবং সেনাবাহিনী নির্বিচারে মানুষের উপর গুলি চালায়। একজন মিল ম্যানেজার জানায় যে বাঙ্গালীদের মধ্যে কিছু অপরাধী তার মিলে লুটপাট করে ও তার চারজন পশ্চিম পাকিস্তানী সহকর্মী পরিচালককে হত্যা করে। গার্ডিয়ান রিপোর্ট বলছে যে উদ্বাস্তুরা নিশ্চিত করেছে যে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করেছে। টাইমস রিপোর্ট অনুযায়ী উদ্বাস্তুরা বলেন যে চট্টগ্রামের বন্দর আগুন দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে এটা সত্য নয়।(উদ্বাস্তুদের মধ্যে একটি ছোট্ট দল ডেইলি টেলিগ্রাফকে জানায় তারা কীভাবে চট্টগ্রাম সীমানার উত্তর পশ্চিম দিক থেকে ৪৫ মাইল পেরিয়ে এসেছে যা মূলত বাঙ্গালী নিয়ন্ত্রিত ছিল।)

টাইমস আজ একজন জার্মান প্রযুক্তিবিদের রিপোর্ট ছাপিয়েছে যিনি ঢাকা থেকে কলকাতায় পৌঁছেছেন। তিনি টাইমস সংবাদদাতাকে জানান যে সৈন্যরা শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। মানুষ খুব ভীতির মধ্যে আছে। তিনি আরো বলেন, জেনারেল টিক্কা খান আগের রিপোর্টমতো জীবিত আছেন।

গার্ডিয়ান পত্রিকায় মার্টিন ওয়াল্কটের একটা লেখা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ভারত সীমান্তের ২০ মাইল দুরবর্তি চুয়াডাঙ্গায় আছেন। তিনি জানান যে শহর স্থানীয় জনগণের নিয়ন্ত্রণে এবং লিবারেশন ফ্রন্টের সেখানে একটি সামরিক কমান্ড আছে যিনি দক্ষিণ পশ্চিম অংশের অপারেশনের জন্য ভারপ্রাপ্ত। তিনি একজন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তার স্বাক্ষাতকার নিয়েছেন যাকে চুয়াডাঙ্গার ২০ মাইল পূর্ব দিকে কুষ্টিয়া শহরে বন্দী করা হয়েছে। তিনি বলেন যে তার কোম্পানি কুষ্টিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওয়ালকট বলেন, চুয়াডাঙ্গার মানুষের মনোবল অনেক বেশী কারণ তারা কুষ্টিয়ায় সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেছে কারণ তারা সেনা কর্তৃক নির্যাতনের কারণে খুবই ক্রুদ্ধ ছিলেন। এটাই সেখানে পাকসেনাদের পরাজয়ের মূল কারণ। ওয়ালকট মনে করেন যে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের যশোর ও খুলনায় ক্যান্টনমেন্ট রেখে অন্যান্য শহরের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা পাকসেনাদের জন্য খুব বিপজ্জনক হয়ে যাবে। ওয়ালকট বলেন সেনাবাহিনী এখন যশোরের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করছে।

৫।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১৩ এপ্রিল ১৯৭১
পাকিস্তানের ব্রিটিশ প্রেস
– উইলিয়াম ক্রওলি

পাকিস্তান সংকটের উপর ব্রিটিশ জাতীয় প্রেস আজ সকালে সেখানকার অভ্যন্তরীণ সামরিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক মতামত তুলে ধরেছেন।

টাইমস একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যা দুই দিন আগে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিকডেনিস নেল্ড ঢাকা থেকে পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন শহর এখন আর্মির নিয়ন্ত্রণে তবে হাজার হাজার মানুষ তাদের গ্রামের বাড়ি পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন বাঙ্গালীদের বাড়িতে লুটতরাজ একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখনও আওয়ামী নেতাদের ও অন্যান্য বিশিষ্ট বাঙালিদের ধরপাকড় করছে। ঢাকায় রাতে কারফিউ চলছে। নেল্ড বলছেন যে গত ১৫ দিনে প্রায় ১০০০০ পাকসেনা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছে এবং এখানে এখন প্রায় ৩৫০০০ হাজার সেনা আছে। আগের রিপোর্ট মতে এখানে এখন প্রায় ৭০০০০ সৈন্য আছে যা আসলে একটু বাড়িয়ে বলা হয়েছে।

টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ান রিপোর্টে জানা গেছে যে সেনাবাহিনীর পক্ষে পূর্ববঙ্গের সব প্রধান শহুরের দখল নেয়া কয়েক দিনের ব্যাপার মাত্র। টাইমস প্রতিবেদক মতে, পাকিস্তান আর্মির কোন সরবরাহ সমস্যা নাই। সরবরাহের ধারাবাহিকতা বজায় আছে এবং প্রধান জলপথ তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। গার্ডিয়ান প্রতিবেদক মার্টিন ওয়ালকট, কলকাতা থেকে রিপোর্ট করেছেন যে, পূর্ব বাংলার পশ্চিম অঞ্চল কয়েক দিনের মধ্যে দমিয়ে রাখা হবে। সেনারা পাকশি সেতুর দখল নিয়েছে যা পূর্ববাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের যোগাযোগ রক্ষা করে।

টাইমসের পিটার হ্যাজেলহার্স্ট সঙ্কটের আন্তর্জাতিক প্রভাব নিয়ে লিখেছেন। তিনি রিপোর্ট করেছেন যে ভারতে বিদেশি কূটনীতিকদের আশংকা যে, পূর্ববাংলার সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে একটি ব্যাপক সঙ্ঘর্ষ হতে পারে। তিনি বলছেন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী বাহিনীর সদস্যরা সীমান্ত জুড়ে তাদের ক্যাম্পে অবস্থান নিতে পারে যে কারণে পাকিস্তানী বাহিনী তাদের সীমান্ত জুড়ে অবস্থান ন্যাসঙ্গত মনে করবে। তিনি আরও বলেন ভারতীয় সামরিক কৌশলবিদরা বিশ্বাস করেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি পূর্ণ বিরোধ বাধলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভারত-চীন সীমান্তে বেষ্টনী তৈরির ব্যাপারে চিনকে বলতে পারেন।

ডেইলি টেলিগ্রাফের, ক্লেয়ার হলিংওর্থ করাচি থেকে রিপোর্ট করেছেন এবং বলেছেন যে পূর্ব পাকিস্তান আরেকটি ভিয়েতনাম হয়ে উঠছে। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে জেনারেল টিক্কা খানের নিয়োগের ফলে সেনাবাহিনী সরকারের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানের মওকা পেল। তিনি বলেছেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক কর্মের ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পাকিস্তানের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে তা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন।

৬.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১৫ এপ্রিল, ১৯৭১

পাকিস্তানের উপর প্রেস রিভিউ
– মার্ক টালি

ডেইলি এক্সপ্রেস, একটি জনপ্রিয় ব্রিটিশ দৈনিক, পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর পূর্ব অংশে সিলেট জেলা থেকে তাদের প্রতিবেদক ডোনাল্ড সীম্যান এর একটি রিপোর্ট আজ প্রকাশ করেছে। তিনি সেখানে ভোগান্তির একটি কষ্টদায়ক বর্ননা দিয়েছেন। এছাড়া সিলেট থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ এর ডেভিড লোসাক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান যে সৈন্যবাহিনী বর্ষা শুরুর আগে যতদূর সম্ভব ঘরবাড়ি ঘংস করার চেষ্টা করছেন। যদিও যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবেনা। লসাকের মতে যোদ্ধাদের মনোবল এখনো অনেক উঁচু। যদিও তাদের সরঞ্জাম অপ্রতুল। খাদ্য অপ্রতুল। সেনাবাহিনীর কৌশল সর্বাধিক পীড়া দিয়ে জনগণকে হটিয়ে দেয়া এবং এলাকার ক্ষতি সাধন করা। তিনি বলেন সিলেট একটি প্রেতাত্মার শহর। লোসাক বলেন বর্ষার আগে সেনাবাহিনীর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভব না।

এছাড়া সাইমন ড্রিং যিনি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার আগে ঢাকায় ছিলেন এবং আর্মি আসার পর এলাকা ঘুরে দেখেছেন – টেলিগ্রাফে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। ড্রিং বলেছেন প্রতিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না কারণ তারা পর্যাপ্ত সংগঠিত এবং সূসজ্জিত নয়।

টাইমস এর মাইকেল হরন্সবি একটি রিপোর্ট কলকাতা থেকে লিখেছেন। তার মতানুযায়ী সেনাবাহিনী প্রতিরোধ এখন কমে যাবে। প্রকাশিত স্বাধীন সরকার গঠন এই অবস্থায় কোন ভূমিকা রাখতে পারবেনা। হরন্সবি অস্থায়ী সরকার গঠনের প্রতিবেদন সম্পর্কে সন্দিহান কারণ ভারতীয় রিপোর্ট এই তথ্যের একমাত্র উৎস হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারের নাম উল্লেখ করছে। হরন্সবির মতে সংকট সম্পর্কে ভারতীয় কভারেজ প্রচার করা মূল উদ্যেশ্য নয়। তিনি দেখিয়েছেন যে ভারতীয় প্রেস বাঙালিদের দ্বারা অবাঙালিদের হত্যার ব্যাপারে তেমন কোন তদন্ত করার চেষ্টা করেনি।

৭.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
জে স্টোনহাউজ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার
এমপি ও মার্ক টালি

পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতিতে সহায়তা সমস্যার ব্যাপারে আলোচনা।
লেবার পার্টির দুইজন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফিরে এসেছেন। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন। তারা শরণার্থীদের সাথে কথা বলে কি পরিমাণ ত্রাণ দরকার সেটা হিসেব করার চেষ্টা করেছেন। জাস্টিস ফর ইস্ট বেঙ্গল কমিটির পক্ষে ব্রুস ডগ্লাস মান স্বল্প সময়ের জন্য বর্ডার পেরিয়ে পূর্ব বাংলায় আসেন। এবং জন স্টোনহাউজ দুইটি ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে সেখানে ত্রাণ কাজের জন্য টাকা সংগ্রহে যান। জে স্টোনহাউজ যিনি গত ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন তিনি মার্ক টালির সাথে শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে কথা বলেন।

জন স্টোনহাউজ: “এটা একেবারে বিরাট ছিল। আমি যখন সেখানে গিয়েছি তখন ইতিমধ্যে সীমান্ত জুড়ে ৩০০,০০০ শরণার্থী আসা গিয়েছিল। এখন সম্ভবত অর্ধ মিলিয়ন হতে পারে। আমি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যে ব্যাবস্থা করেছে তাতে খুব অভিভূত। তবে যদি এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে তবে তা ভারত সরকারের সাধ্যের বাইরে চলে যাবে এবং আমি মনে করি তখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর এগিয়ে আসা উচিৎ।

জন স্টোনহাউজ বলতে লাগলেন সাহায্য দেবার ব্যাপারে কি কি চিন্তা করছেন।

জে এসঃ “দাতব্য সংস্থাগুলো অতীতে অনেক টাকা জোগাড় করেছে এবং আমি বিশ্বাস করি যে, তারা এর জন্য আবারও টাকা ওঠাতে পারেন।শুধু ক্যাম্পে সাহায্য না দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানেও দিতে হবে। আমি মনে করি আছে সরকারী সাহায্যও এখানে করা উচিৎ। আমি মনে করি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আগে যে টাকা তোলা হয়েছে তার কিছু ক্যাম্পেও ব্যাবহার করা উচিৎ। এবং পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ এড়ানোর জন্য কিছু জমা করাও দরকার।

মার্ক টালি: জন স্টোনহাউজ বলেন পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের ত্রাণসাহায্য করার ফলে আরো বেশী মানুষ সীমান্ত পার হতে উত্সাহিত হবে।

জে এসঃ “একজন মানুষ যখন নিজের জীবন নিয়ে শংকিত তখন বর্ডারের ঘটনা নিয়ে সে আদৌ চিন্তিত কিনা সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। সে বের হবার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। ‘

জন স্টোনহাউজ বলেন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সাহায্য পাবার ব্যাপারে সমস্যায় পড়তে পারে। তবে তিনি বলেন –

জে এসঃ ভয়াবহতা এখন এত বেশী এবং এতটাই শক্তিশালী যে, বড় ক্ষমতাশালী দেশগুলো পাকিস্তান সরকারকে সর্বোচ্চ চাপ দেবে। “তারা যথেষ্ট করেন নাই।যা করা হয়েছে তা দৃষ্টির বাইরে। মি মনে করি আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য গুরুতর হুমকি নিয়ে আলোচনা করার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি তাৎক্ষণিক বৈঠক হওয়া উচিত।

আমি মনে করি ব্রিটেন এই ব্যাআপ্রে পদক্ষেপ নিতে পারে। কারণ ব্রিটেন কমনওয়েলথের সদস্য এবং আমি মনে করি কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলো কিছু ব্যাবস্থা নিতে পারে। এছাড়াও জাতিসঙ্ঘে ব্রিটেনের অনেক প্রভাব আছে এবং এটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে পাকিস্তান বিশ্বের মতামত বুঝতে পারে।

ব্রিটেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগ করে পাকিস্তানে যে এইড দেয়া হচ্ছে সেটা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সন্তোষজনকভাবে সমাধান হবার আগে পর্যন্ত চালিয়ে যাবার ব্যাপারে আলোচনা করত পারে।

৮. এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১৪ মে ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে প্রেস রিপোর্ট
– উইলয়াম ক্রওলি

আজ সকালে দুইজন ব্রিটিশ সাংবাদিকের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে যারা পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে পূর্ব পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন।

গার্ডিয়ান পত্রিকায় রয়টারের সংবাদদাতা মরিস কুয়াইন্ট্যান্স একটি রিপোর্ট করেছেন। তিনি জানান বিদেশী সংবাদদাতাদের পাকিস্তান আর্মি সার্বক্ষনিক পাহারায় রেখেছিল এবং তাদের প্রতিবাদের পর তাদেরকে সাধারণ মানুষের সাথে বিনা নজরদারিতে কথা বলতে দেয়া হয়। রয়টার প্রতিবিধি জানান যে সাধারণ মানুষের মধ্যে মুখ খুলতে ভীত দেখা যাচ্ছিল। তিনি বলেন সরকার স্বীকার করেছে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ৩ মাস আগে যেমন ছিল তেমনটা হতে এক বছর সময় লেগে যাবে। প্রতিনিধি জানান যে পাটশিল্প স্বাভাবিকের চেয়ে ২০% নিচে নেমে গেছে। তিনি বাঙালিদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর এবং অবাঙালির বিরুদ্ধে বাঙালিদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার রিপোর্ট উদ্ধৃত করেন।

রাজশাহী থেকে ঘুরে আসা ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিনিধি হার্ভে স্টকুইনের একটি প্রতিবেদন আজ প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে গেরিলা কার্যক্রমের কথা বলেন। তিনি বলেন আর্মি ও সরকারী কর্মকর্তাদের মতে রাজশাহী ও পাবনায় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট দের কার্যক্রম বাড়তে পারে এবং পশ্চিমবঙ্গে ভারত সীমান্তে নকশালের কার্যক্রম বাড়তে পারে।কিন্তু তিনি মনে করেন বাঙ্গালীরা অনেক ভীতির মধ্যে আছে এবং একজন কমিউনিস্টের সাথে কথার বরাত দিয়ে তিনি জানান পরিস্থিতি বিপ্লবী সহিংসতার দিকে না যেয়ে চরম আকার ধারণ করতে পারে। স্টকউইন মনে করেন গেরিলাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ভয়ানক হতে পারে। তিনি জেনারেল টিক্কা খানের কথা উধ্রিত করেন – টিক্কা খান বলেছেন নক্সালের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে তাদের কেউ মদদ দিচ্ছে এবং তার জন্য ভুক্তভোগী হবে সাধারণ জনগণ।

স্টকউইন মনে করেন যদি গেরিলা কার্যক্রম বাড়ে তাহলে কমিউনিস্টরা আরও বেশী করে তাতে অংশ নেবে। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে মুক্তিবাহিনীর মনোবল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে এবং বাঙ্গালীদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দূরত্ব বৃদ্ধি পাওয়া।

ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আন্তর্জাতিক সাহায্য না নেয়ার কারণ হিসেবে স্টকউইন মনে করেন সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। জাতিসংঘের উপস্থিতি অবস্থা জটিল করে তুলতে পারে। তিনি বলেছেন, যে কোন ত্রাণ মূলত আর্মি-বিহারী জোটের কাছে যাবে যা সরকার স্বাভাবিক মনে করছেন।

৯.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১৪ মে ১৯৭১
পাকিস্তান বিষয়ে হাউজ অফ কমন্সে আলোচনা
– মার্ক টালি

গতকাল (শুক্রবার) ব্রিটিশ হাউস অফ কমন্স পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে। মার্ক টালি গতকাল হাউস অব কমন্সে ছিলেন – তিনি বিতর্কের তাৎপর্য উল্লেখ করেন।

শুক্রবার স্বাভাবিকভাবে কমন্সে বিতর্ক করার জন্য ভাল দিন নয়। সংসদের অনেক সদস্য শুক্রবার তাদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় কাটাতে চান। গতকালের বিতর্কও একটি নির্দলীয় আলোচনা ছিল। প্রথমে পেছন থেকে বিরোধী দলের একজন সদস্য বিষয়টি তোলেন এবং পরে সরকারদলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটিকে সমর্থন জানান। তাই হাউজের অবস্থান শুধুমাত্র উপস্থিত এম পি দের সংখ্যা থেকে নির্নয় করা সম্ভব ছিলোনা। উপস্থিতি কম ছিল। কিন্তু বিতর্ক ৫ ঘণ্টা স্থায়ী হয়, অনেকে বক্তব্য দেন এবং বিরোধী দল থেকে চার সাবেক মন্ত্রী বক্তৃতা করেন।

হাউজ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের অস্থিতিশীল পরিবেশের সমাধান এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে চাপ দেবার ব্যাপারে আলোচনা হয়।

বিতর্ক সম্পর্কে প্রথমেই যেটা বলা যায় তা হল সমস্ত হাউজ পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় পাকিস্তান সরকারের উপর আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন। এবং তারা মনে করেন ব্রিটিশ সরকারের উচিৎ সাহায্য করতে এগিয়ে আসা।

মূল বিতর্ক ছিল সাহায্য সংগ্রহের ব্যাপারে। জনাব ব্রুস ডগলাস মান – যিনি মূল আলোচনা উত্থাপন করেন তিনি গত মাসের শেষে পশ্চিম পাকিস্তান ছিলেন। এবং তিনি বর্ডার পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানেও আসেন। তিনি যা দেখেছেন তাতে তিনি খুব শক্ত ভাবে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেন পাকিস্তানে সমস্ত সহায়তা বন্ধ করার জন্য। অথবা অন্তত নতুন কোন সাহায্য চুক্তি যেন করা না হয় যতদিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আর্মি সরে না যায়। তিনি মনে করেন অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা হলে যুদ্ধ থামানো সম্ভব। বৈদেশিক উন্নয়ন মন্ত্রী জনাব রিচার্ড উড বলেছেন যে, সরকার এইড সমস্যা নিয়ে ভেবে দেখছেন। তিনি বিশ্বাস করেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য অবিলম্বে ত্রাণ সেবা জাতিসংঘ দিতে পারে। সেকারণে ব্রিটিশ সরকার জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারিকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন যাতে তারা পাকিস্তান সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের টিম ঢোকার জন্য ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করেন। জনাব উড বলেন যে তিনি মনে করেন না যে শুধুমাত্র সাহায্য দিয়ে পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যাবে। তবে তিনি মনে করেন এইড পলিটিক্স ব্যাবহার করে সরকার চাইলে সেখানকার শান্তি ও মানবাধিকারের ব্যাপারে আলোচনা করতে পারেন। কয়েকজন সমস্য মনে করেন সাহায্য বন্ধ করলে সাধারণ জনগণের আরও সমস্যা হতে পারে। তারা সবাই উদ্বিগ্ন।

অনেক সদস্য পাকিস্তানের একতাবদ্ধ থাকার ব্যাপারে মত দেন। সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব ডেনিশ হেনলি বলেন যে যদি পাকিস্তান বিভক্ত হয় তাহলে সেখানে অরাজকতা শুরু হবে যা পুরো উপ-মহাদেশের স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হবে। অন্যদিকে কিছু সদস্য মনে করেন যে পূর্ব পাকিস্তান তাদের নিজদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারবে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনা দুই অংশের এক থাকাকে অসম্ভব করেছে। জনাব উড বলেন যে তিনি পাকিস্তানে শান্তি পুনরায় ফিরে আসবে এমন সম্ভবনা দেখেন না।

কালকের বিতর্ক থেকে এটা স্পষ্ট যে ব্রিটিশ সরকার স্বাভাবিক পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করার জন্য সব যথাসাধ্য করতে যাচ্ছে। তবে তারা জানেন তাদের ক্ষমতা সীমিত কারণ মূল দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের উপর বর্তায়।

১০।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ফিনান্সিয়াল টাইমস এর আর্টিকেল
স্বেচ্ছা সমাধানের আবেদন – হার্ভে স্টকউইন
– মার্ক ট্যালি (এস) দ্বারা সম্পাদিত
– ২১ মে, ১৯৭১

ফাইনানশিয়াল টাইমস আজ তাদের বিশেষ সংবাদদাতা হার্ভে স্টকউইনের একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছে। তিনি পাকিস্তান সরকার অনুমোদিত পূর্ব পাকিস্তান পরিদর্শনের সাংবাদিক টিমের অন্যতম একজন সদস্য। এই মাসের শুরুতে তারা এই অনুমতি পেয়েছিলেন। তিনি তার সফর সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি মনে করেন সেখানে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। এবং দুর্ভিক্ষ অবশ্যাম্ভাবী। তিনি বলেন বাঙ্গালী ২৫ মার্চের আগে অতিআত্মবিশ্বাসী ছিল। শেখ মুজিব মনে করেন বাঙ্গালীর আকাঙ্খার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি দ্বিধান্বিত এবং রাজনৈতিকভাবে সরল ছিলেন। স্টকউইন বিশ্লেষণ করে দেখেছেন আন্দোলনের পেছনে বাঙ্গালীর প্রবল আবেগ এবং তাদের ভেতরের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিও তিনি দেখেছেন। তাদের নিজেদের উপর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস রয়েছে। এই বিশ্বাস থেকেই আন্দোলন তরান্বিত হয়েছে এবং আইয়ুব খানের পতন হয়েছে। আর্মি সাইক্লোনের পরবর্তি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করলেও পূর্ব বাংলার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এছাড়াও তিনি মনে করেন বাঙ্গালিত্তের কারণে বিহারীদের সাথে নানান বিবাদও ঘটছে। তিনি বলেন বিহারী সহ ভারত থেকে আসা উদবাস্তুরাও বাঙ্গালীদের সাথে মিশতে পারেনি। আর্মির ভূমিকা উপরের নির্দেশ অনুযায়ী সব সময় হচ্ছেনা বলে তিনি মনে করেন – যেমনটি গের রিপোর্টে বলা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমা বাহিনীর সাইক্লোনের ব্যার্থতা বিশ্বপত্রপত্রিকায় বিরূপভাবে আসায় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ভালো ছিলোনা। তবে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারেও তাদের প্রতিক্রিয়া স্বল্পতা ছিল। স্টকউইনের মতে নির্বাচনের পরেও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া স্বল্পতা ছিল। পুরো নির্বাচন চলাকালীন সময়ে তারা অনেক শান্ত ছিল। এমনকি নির্বাচন পরবর্তি মুহুর্তেও। কিন্তু যখন শেখ পূর্ব বাংলার আন্দোলন নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন ছাত্রদের চরম আন্দোলনে সেনাবাহিনী চরম ভয়ংকর ও জাতিগত রূপে আবির্ভুত হতে পারত। তিনি দেখেছেন আন্দোলন কীভাবে দেশ ভাগের আন্দোলনে মোড় নেয়। তিনি দেখেন ঢাকার বাইরে বাঙ্গালীরা প্রথমে অবাঙ্গালি ও সেনাদের উপর চড়াও হয় যার ফলে অবাঙ্গালীরাও বাঙ্গালীদের উপর চড়াও হয়।

১১।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু:
অব্যাহত উদ্বেগ
– মার্ক টালি (এস)
২৮ মে ১৯৭১

ভারতে উদ্বাস্তুর অব্যাহত প্রবাহের জন্য ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজমান। এই অন্তঃপ্রবাহ এবং সমস্যার কারণ হিসেবে মার্ক টালি কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন-

প্রায় আট সপ্তাহ ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন, ২৫ মার্চ, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি হয় যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেনাবাহিনী চেষ্টা করেছিল। তাছাড়া সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছে শুধু আন্দোলনকারীদের দমাতেই নয় বরং বাঙ্গালী- বিহারী কোন্দল নিয়ন্ত্রণ করাও প্রয়োজন ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও প্যারামিলিটারিতে বাঙ্গালিদে প্রাধান্য থাকায় তাদের সাথে বিহারীদের জাতিগত দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। এগুলোর বিস্তারিত দেখার জন্য আন্তর্জাতিক একটি দলকে পুর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে দেয়া হয় এই মাসের শুরুতে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রেডিও পাকিস্তান বলছে যে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক।

কিন্তু যদিও প্রদেশ থেকে সংবাদদাতারা কোন রিপোর্ট পাঠাননাই তবুও অন্যান্য প্রমাণাদি বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের থেকে অনেক দুরে অবস্থান করছে। উদ্বাস্তুরা এখনো পালিয়ে আসছে ভারতে।

ভারত সরকারের হিসাব যে সাড়ে তিন মিলিয়ন উদ্বাস্তু ইতিমধ্যে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং তারা এখনও আসছে। যখন খুব দীর্ঘ সীমান্ত দিয়ে এভাবে মানুষ প্রবেশ করতে থাকে তখন সেঁতা গণনা করা অসম্ভব। তবে উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘের হাই কমিশন থেকে আসা দলের শরণার্থী শিবির দেখে সমস্যার তীব্রতা সম্পর্কে সম্যক ধারনা হয়েছে। তাদের পরিদর্শনের পরে জাতিসংঘ মহাসচিব পর উ থান্ট জানান ভারতের প্রতিবেশী রাজ্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রচুর মানুষ প্রবেশের অকাট্য প্রমাণ রয়েছে।তিনি ৩ মিলিয়ন পাউন্ড শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের ওয়াদা করেন। এই শরণার্থীরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতার গল্প বলেছে। রিপোর্টারদের মন্তব্য অন্য যারা শিবির পরিদর্শন করেছেন তারা সমর্থন করেছেন।

বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আতঙ্ক দ্রুত ছড়িয়ে পরে। কোন সন্দেহ নেই, অনেক শরণার্থী শুধু সেনাবাহিনী না দেখেই পালিয়ে এসেছে। নিঃসন্দেহে সেখানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, রাহাজানি হয়েছে এবং প্রদেশে লুটপাট হয়েছে। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হল যে প্রায় সব শরণার্থী বিদেশী পর্যবেক্ষকের কাছে জোর দিয়ে বলেন যে তারা সেনাবাহিনীর ভয়ে ভীত ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার দুই পাকিস্তানের একতা রক্ষার জন্য এই পদক্ষেপ নিলেও বেসামরিক জনগণকে জীবন রক্ষার জন্য পালিয়ে যেতে হচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হোক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানে ২/৩ সপ্তাহের জন্য বৃহৎ পরিমাণ সৈন্য মোতায়েন করা হবে। কিন্তু সাধারণ উদ্বাস্তুদের থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যতদিন সেনাবাহিনী বলবত রাখবেন ততদিন পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক করবেন সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। বরং যদি আরও বহু সংখ্যক শরনার্থি আস্তে থাকে তাহলে তিনি আরও বড় সমস্যায় পড়বেন। একারণেই বিশ্ববাসী শরনার্থিদের থেকে সেনাবাহিনীর কর্মকান্ড জেনে সেই ব্যাপারে আরও উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

বাংলা ডন নিউজ টক – ২৮/২৯ মে ১০৯৭১

১২।

এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
শরণার্থীদের ব্যাপারে ব্রিটেনের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের উপর আলোচনা
৭ ই জুন ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

গত একসপ্তাহ ধরে ভারতে ইস্ট পাকিস্তান শরণার্থীদের ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রেস আরও মনোযোগ প্রদান করেছে। মার্ক টালি গত সপ্তাহের ব্রিটিশ প্রেস থেকে জানাচ্ছেন –

আরো অনেক বিদেশী সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা সীমান্ত এলাকায় আসছে। সংবাদদাতারা উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তান সরকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক বললেও শরনার্থিদের অনুপ্রবেশ বেড়েই চলছে। তারা বলেছেন যে শরনার্থিদের প্রবেশে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং যেসকল রাজ্যের পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত আছে তারা অনেক চাপের মুখে আছেন। শরনার্থিদের মধ্যে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ পত্রিকা নেতাদের শরণার্থীদের দুর্দশার ব্যাপারে অবিলম্বে তাদের সাহায্য করার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। এবং বলেছেন উদ্বাস্তুদের বাড়িতে পাঠানোর জন্য কি করা যাতে পারে।

গত সপ্তাহের মঙ্গলবার এবং বুধবার টাইমস শরণার্থীদের সম্পর্কে আলোচনার জন্য নেতাদের ডেকেছিল এবং আবার আজ একজন নেতাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তিন জন নেতাকে সি ব্যাপারে কথা বলার জন্য ডাকায় টাইমস পত্রিকা অবস্থার প্রতি যে অধিকতর জোর দিয়েছেন সেটাই প্রতীয়মান হয়। টাইমস তার পত্রিকার প্রথম পাতায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা পিটার হ্যাজেলহার্স্টএর রিপোর্ট ছাপিয়েছে। আজ টাইমসের ডেপিটি ইডিটর লুই হেরেন জানিয়েছেন কেন হ্যাজেলহার্টস্ট এই পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন এতই সমস্ত বিশ্বকে নারা দিয়েছে এবং সেখানে লাখ লাখ নিরীহ মানুষের উপর ইতিহাসের অন্যতম মানব সৃষ্ট দুর্যোগের বর্ননা উঠে এসেছে। সম্পাদকীয়তে আজ বলা হয়েছে এই মুহুর্তে কোন রাজনৈতিক সমাধানের পথ নেই যা ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের কাছে কাম্য। তাছাড়া এই মুহুর্তে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দিলে তা পাকিস্তানকে বিভাজিত করার প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করবে বলে পত্রিকায় মোট দেয়া হয়। টাইমস মনে করে যদি তা হয় তবে তা ভারতের জন্যও হুমকি।

গত সপ্তাহে গার্ডিয়ান, ফাইনানশিয়াল টাইমস এবং ডেইলি টেলিগ্রাফ শরণার্থীদের নিয়ে ব্যাপক কভারেজ দিয়েছে। একটি সম্পাদকীয়তে আজ টেলিগ্রাফ বলছে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির কারণ কি। পত্রিকাটি মনে করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দেবে তত দ্রুত সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন করতে তারা সক্ষম হবেন। টেলিগ্রাফ মনে করে যদি পাকিস্তান সরকার এই পথে কাজ করে তাহলে তাদের সব রকমের সহায়তা দেয়া যেতে পারে।

ব্রিটিশ দুটি সাপ্তাহিক এই সপ্তাহে তাদের প্রথম গল্প হিসেবে বাংলার অবস্থার উপড়ে নিবন্ধ তুলে ধরে। বাম পক্ষের নিউ স্টেটসম্যান এবং ডানপন্থী স্পেকটেটর উভয়ে প্রস্তাব করে যে ব্রিটেনের এই ব্যাপারে একটি বিশেষ ভূমিকা নেয়া উচিৎ।

গতকাল তিনটি ব্রিটিশ সানডে পত্রিকা শরণার্থীদের দুর্দশার শিরোনাম করেছে। তারা শরণার্থীদের দুর্দশার খুব মর্মভেদী ফটোগ্রাফ প্রকাশ করেছে। সানডে টাইমস কালার ম্যাগাজিন উদ্বাস্তুদের ছবিসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নিকোলাস টমালিনের আবেদনও প্রকশিত হয় যিনি পূর্ব পাকিস্তানের আর্মি একশন শুরু হবার পরে সেখানে প্রবেশ করেছিলেন। টমালিন বলেন বিশ্বে শরনার্থিদের চাইতে বেশী সহানুভূতি কেউ আশা করতে পারেনা।

আজকের লন্ডন সান্ধ্য পেপারেও উদ্বাস্তুদের উপর প্রতিবেদন এসেছে। সামনে পাতায়। ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড আজ সামনের পাতার প্রায় অর্ধেক জুড়ে জেমস ক্যামেরনের প্রতিবেদন দিয়েছে। ক্যামেরন বলেন যে, তিনি ২৫ বছর ধরে শরণার্থী পরিস্থিতিতে কাজ করছেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের শরনার্থিদের মত এত ভয়াবহ পরিস্থিতি তিনি আগে কোথাও দেখেন নাই। তিনি বলেন পশ্চিমবঙ্গ এখন যেসব সমস্যায় জর্জরিত কলেরা সমস্যা তার মধ্যে নগণ্য একটি সমস্যা মাত্র।

১৩।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকিস্তানের প্রেস ও টেলিভিশন
৮ জুন, ১০৭১
– মার্ক টালি (এস)

যেকন মিডিয়ার চেয়ে টেলিভিশন ভারতে উদ্বাস্তুদের দুর্ভোগ ও সমস্যার কথা ভালো করে ফুটিয়ে তুলতে পারে। ভারত সরকার কি ধরণের চাপে আছে তা প্রকাশ করতে পারে। গত রাতে বি বি সি টেলিভিশনে এন্থনি লরেন্সের একটি ভিডিও প্রকাশিত হয় যেখানে দেখা যায় শরনার্থিরা ক্যাম্পে আসার পথেই ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে। ছবিগুলো এতোই বীভৎস ছিল যে প্রদর্শিত করার আগে বলা হয়েছিল যারা গভীর ভাবে মর্মাহত হলেও দেখতে পারবেন শুধুমাত্র তাঁদের দেখতে অনুরোধ করা হল। লরেন্স জানান ভারত সরকারযেসকল ব্যাবস্থা নিয়েছেন এই কঠিন পরিস্থিতিতে সেটা না নিলে ভোগান্তি আর মৃত্যুর পরিমাণ আর ভয়াভহ হত।

এছাড়াও বিবিসি টেলিভিশনে গত রাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম এর সঙ্গে একটি সাক্ষাত্কার ছিল। স্যার অ্যালেক ত্রাণ তহবিল থেকে এ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের নানা অবদান বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ব্রিটেন পাকিস্তানে এইড বন্ধ করবে না যেহেতু সেখানে অবস্থা অত্যন্ত করুন – তবে তারা রাজনৈতিক সমাধান তরান্বিত করতে চাপ দেবেন যার উপর ভবিষ্যৎ এইড নির্ভর করবে।

সকল ব্রিটিশ সংবাদপত্র আজ কলকাতায় যেসকল রিলিফ যাচ্ছে ও গতকাল যেসকল অন্যান্য উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে তা বর্ননা করে।

গার্ডিয়ান আরো একটি সম্পাদকীয় লিখেছে যেখানে বলা আছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের লজ্জা পাওয়া উচিৎ যে কত ধীরে তারা সব জানতে পারছে। পত্রিকাটি মনে করে এটা এখন স্পষ্ট যে ত্রাণ তৎপরতা সমন্বয়ের জন্য একটি পৃথিবীব্যাপী সমন্বিত আয়োজনের প্রয়োজন এবং তা খুব দ্রুত গঠন করা উচিৎ। ইউ এন সেরা সমন্বয়ের প্রতিষ্ঠান হতে পারে। গার্ডিয়ান বলেছে যে জাতিসংঘ ইতিমধ্যে একটি প্রকল্প বিবেচনায় রেখেছে যা এই বছরের শরত্কালীন সভায় সাধারণ পরিষদে বিবেচনা করা হবে। গার্ডিয়ান স্বীকার করে যে ইউ এন দুর্যোগ সংস্থা তেমন সফল হবে না যদি সরকার সহযোগিতা করতে অনিচ্ছুক হয়। তবে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন যে পাকিস্তান সরকার বাইরের সহায়তা গ্রহণ করবে কিনা। গার্ডিয়ান বলে যে নিরাপত্তা পরিষদ এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে যাতে তারা জাতিসঙ্ঘ দুর্যোগ সংস্থার সাহায্য গ্রহণ করতে সরকারকে চাপ দিতে পারে।

সান ট্যাবলয়েড পত্রিকা যেটি খুবই প্রচলিত – এটি তাঁদের সম্পাদকীয়তে জোরালো ভাষায় শরণার্থীদের দুর্ভোগ ও পূর্ব পাকিস্তানে অসুবিধার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দায়ী করেছে। পাশাপাশি সান মনে করে যে সহায়তা সেখানে পাঠানো হচ্ছে তা কোন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হওয়া উচিৎ। সেটি জাতিসঙ্ঘও হতে পারে। আরেকটি জনপ্রিয় কাগজ, ডেইলি এক্সপ্রেস, একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। তারা বলে সকল সরকারের উচিৎ তাঁদের সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করা। এবং পত্রিকাটি পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করেছে।

এছাড়া সাংবাদিক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ম্যালকম মাগারিজ টাইমস এবং টেলিগ্রাফে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন যারা শরণার্থীদের সাহায্য করতে চান তারা কলিকাতায় মাদার তেরেসার চ্যারিটি মিশনারিজে টাকা পাঠাতে পারেন। স্যালভেশন আর্মি মানুষকে তাঁদের কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ শরণার্থীদের মাঝে দেবার বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আজ রাতে টেলিভিশনে বিপর্যয় জরুরী কমিটির একটি আপিল প্রচারিত হবে।

১৪।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
নিউজনোট: সংসদে বিরোধী সদস্যরা মোশন অন পাকিস্তান এর জন্য স্বাক্ষর করেছে
২৬ জুন, ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

গত রাতে ব্রিটিশ হাউস অফ কমন্স এর বিরোধী লেবার পার্টির সদস্যদের প্রায় অর্ধেক সদস্য একটি মোশন স্বাক্ষর করেন। এটি ছিল পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর নির্ম অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের উপর। সেখানে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তান শাসন করার কোন অধিকার পাকিস্তান সরকারের নেই। আরও বলা হয় জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা পর্যন্ত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার পূর্ব বাংলার জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন অনুযায়ী কাজ করবে। মোশনটির প্রধান স্পন্সর ছিলেন মিস্টার জন স্টোনহাউজ – যিনি সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন।

আরও কিছু সাবেক মন্ত্রী মোশনটি স্বাক্ষর করেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী জনাব রেগ প্রেন্টিস, ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট এবং জনাব রিচার্ড ক্রসম্যান – সাবেক মন্ত্রী যিনি এখন নিউ স্টেটসম্যান এর সম্পাদকআছেন। ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট এর মিসেস বর্তমান শ্রম মুখপাত্র জুডিথ হার্ট স্বাক্ষর করেনি। টাইমস জানায়, এই মোশন সংসদ সদস্যদের কাছে কমনওয়েলথ দেশের কোন সরকারের ওপর সবচেয়ে বড় আক্রমণ হিসাবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে বিরোধী দলের জনমত বাড়তে থাকে। এবং তারা একমত হন যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন শুধুমাত্র পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। তবে লেবার পার্টি পাকিস্তান ইস্যুতে সরকারের পলিসির বিরোধিতা করেনি।

১৫।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্রিটিশ প্রেস রিপোর্ট
৩ জুন, ১৯৭১
– টউইন ম্যাসন (এস)

কয়েকদিন আগে ঘোষণা করা হয়েছিল যে বিদেশি সংবাদদাতাদের পূর্ব পাকিস্তানে অবাধে চলাফেরা এবং রিপোর্ট করতে অনুমতি প্রদান করা হবে। আজ প্রথম তিন জন প্রতিনিধিদের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যারা এই সিদ্ধান্তের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে আছেন।

রিপোর্ট করেছেন টাইমস প্রতিনিধি মাইকেল হর্ন্সবি, গার্ডিয়ান সংবাদদাতা মার্টিন উলকট, এবং ডেইলি টেলিগ্রাফ প্রতিবেদক, ক্লেয়ার হলিংওর্থ। ঢাকা থেকে প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় তারা প্রায় একই রকম রিপোর্ট করেছেন। তিনজন সংবাদদাতা মনে যদিও ঢাকায় জীবন শান্ত এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে তবে সেখানে এখনও অন্তর্নিহিত টান, ভয় ও তিক্ততা বিরাজমান। টাইমস সংবাদদাতা, মাইকেল হর্ন্সবি বলছেন যে ঢাকায় দোকানের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ বন্ধ আছে। এবং সেনাবাহিনীর চলাফেরা প্রকট। ডেইলি টেলিগ্রাফ এর ক্লেয়ার হলিংওর্থ বলেছেন সেনাবাহিনী ঢাকার শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করেছে কিন্তু ভয়, ঘৃণা এবং পরোক্ষ প্রতিরোধ বজায় আছে। গার্ডিয়ান প্রতিনিধি মার্টিন উলকট বলছেন “ঢাকার শহর শান্ত, বরং খুব শান্ত। এবং সেখানে বাজারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ছবি বিক্রি হয় কিন্তু মানুষের মাঝে গম্ভীরতা এবং আবেগ প্রতীয়মান হচ্ছে।’

তিনজন সংবাদদাতা জানান ঢাকা বাইরে সামরিক কর্ম ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত আছে। বিশেষ করে টাঙ্গাইল কাছে মধুপুর বন এলাকায়। তারা বলেন প্রাদেশিক শহরগুলোতে অবস্থা ঢাকার মত ভালো নয়।

১৬।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার বিবৃতির উপর ব্রিটিশ প্রেসের আলোচনা
২৯ জুন, ১৯৭১
ইয়ান চার্লটন সম্পাদিত

পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্রডকাস্ট গতকাল তিনটি নেতৃস্থানীয় ব্রিটিশ সংবাদপত্রে সমালোচিত হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্রডকাস্ট প্রকাশ করে যে তিনি জাতীয় পরিষদের সামনে চার মাসের একটি কমিটি দ্বারা প্রণীত একটি নতুন সংবিধান উপস্থাপন করার পরিকল্পনা করেছেন। সামরিক আইন চলমান থাকবে – যদিও তিনি তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছেন। কোন নতুন সাধারণ নির্বাচন হবে না। শুধুমাত্র শূন্য স্থানে যেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর অযোগ্যতার জন্য খালি আছে অথবা তার ভাষায় যেসব প্রতিনিধিরা অপরাধমূলক বা সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকায় তাঁদের পদ খালি হয়েছে সেই সকল পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ডেইলি টেলিগ্রাফ নোট করে যে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাংবিধানিক পরিকল্পনার সাথে রিপোর্টে প্রকাশিত অভিশপ্ত পূর্ববাংলার ঘটনাবলী জড়িত। তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে বাঙ্গালী প্রতিনিধিদের দিয়ে একটি প্রাদেশিক প্রশাসন সেট আপ করতে চান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একটি বেসামরিক জাতীয় সরকার গঠনের জন্য চেষ্টা করবেন। কি ঘটছে তিনি আসলে তার বাইরে আছেন। তিনি এখন আরও বিনয়ী এবং দূরবর্তী গোল সেট করছেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গণপরিষদ বাদ দিয়ে চার মাসের ভেতর একটি কমিটি দিয়ে সংবিধান প্রণয়ন করতে চাচ্ছেন যা একটি বেসামরিক সরকার কর্তৃক পরিচালিত হবে। তবে এরকম হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ডেইলি টেলিগ্রাফ বলেছে পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনি হিসেবে চালানোর প্রমাণ আছে। তাই তাঁদের কতটুকু স্বাধীনতা দেয়া হবে তা তাঁদের ভাগ্যের উপর নির্ভরশিল।

টাইমস এর মতে- প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব ভাল কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানসিক চাহিদা পূরণ হবে না। তিন মাসে রাজনৈতিকভাবে সমস্যার বাইরে সেখানে যথেষ্ট সামরিক নৃশংসতা হয়েছে যার জন্য তাড়া অসন্তুষ্ট আছে। যা প্রয়োজন তা হল দক্ষ কমিটি দিয়ে সংবিধান প্রণয়ন না করে বরং একটু নম্রতার সাথে তাদেরকে ম্যানেজ করা। বাঙ্গালীদের আশার বাইরে কোন কিছু করলে তা দির্ঘ দিনের জন্য বজায় থাকবেনা।

এই মুহুর্তে সত্যিকার অর্থেই বাঙ্গালীদের জন্য ভালো হয় এমন কিছু করতে হবে। এতে তাঁরা ভাবতে শুরু করবে যে হয়ত কোন শান্তিপূর্ন সমাধান সামনে হতে পারে। হয়ত গেরিলা আক্রমণ নাও শুরু হতে পারে। এত ভোগান্তি নাও হতে পারে। শুধু ব্যাটালিয়ন অর্ডারে তাঁরা খুশী হবেনা।

সবচেয়ে রুঢ়ভাবে সমালোচনা করেছে গার্ডিয়ান পত্রিকা। তাঁরা বলেছে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের স্বপ্ন বিশ্বের কাছে কোন আশানুরূপ কিছু মনে হচ্ছেনা। তাকে বিশ্বাস করা যায় না এবং যা হচ্ছে তা দুঃখজনক। তার আসলে এখন কোন সত্যিকারের পরিকল্পনা নেই। গার্ডিয়ানের মতে তিনি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য যে পন্থা দিয়েছেন তা লজ্জাজনক। গার্ডিয়ান মনে করে শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান পারেন যে ৫০ লক্ষ মানুষ পালিয়ে গেছে তাঁদের জন্য আশানুরূপ কিছু করতে। এবং একই ভাবে যারা রয়ে গেছে তাঁদের জন্যও তিনি গুরুত্তপূর্ন। গার্ডিয়ানের মতে মুজিব পাকিস্তানের শেষ ভরসা।

স্কচম্যান নামক চতুর্থ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে ইয়াহিয়া খান হয়ত সেনাবাহিনী দিয়ে পাকিস্তান শাসন করতে পারেন কিন্তু বাস্তবে পাকিস্তান ধরে রাখা তার জন্য কঠিন হবে। যদি তিনি ভাবেন তিনি আন্তর্জাতিক সমর্থনের উপর নির্ভর করে চলবেন তবে তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবেন। যদি তিনি তা বিশ্বাস না করেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি পাকিস্তানের জনগণের মনোভাব বুঝতে ব্যার্থ হয়েছেন। তার নিষ্ঠুর পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাবে। একটি বিষয় স্পষ্ট যে বিদেশী সরকারগুলো ইয়াহিয়ার মনকে পাল্টাতে পারেনি এবং তাকে একটি স্বাভাবিক শাসন ব্যাবস্থা চালু করাতে রাজি করাতে পারেনি।

১৭। এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১ লা জুলাই, ১৯৭১
– মার্ক টালি
– ইয়াহিরা প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের মনোভাব
– ইভান চার্লটন দ্বারা সম্পাদিত (এস)

বিবিসির পূর্ব অংশের প্রতিনিধি মার্ক টালি, ঢাকা থেকে তারের মাধ্যমে জানিয়েছেন তিনি ১০ জন ব্যবসায়ী, সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলার পর স্পষ্ট হয়েছেন যে তাঁরা কেউ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সর্বশেষ রাজনৈতিক কর্মসূচির উপর সন্তস্ট নন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছু নাই। সবাই এমনটাই বলেছেন। প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগ নেতাদের নিন্দা করেছেন – এতে করে যারা নূন্যতম স্বাভাবিক পরিস্থিতির আশা করেছিলেন তাঁরা আশাহত হয়েছেন। সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে তার অবস্থান সবাইকে হতাশ করেছে। ইসলামকে জোর দেয়ার ব্যাপারে তিনি যা বলেছেন তাতে হিন্দুদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে। এতে যেসকল হিন্দুরা এখনো আছে তাঁরা হতাশ হয়েছে আর যারা চলে গেছে তাঁদের ফিরে আসার সম্ভবনা কমবে। আসলে বাঙ্গালীরা মনে করে সেনাবাহিনী এখানে ভালো কোন উদ্যেশ্য নিয়ে আসেনি। ঢাকার ৫০ মাইল দুরে ৮ টি গ্রাম ধ্বংস করে দেয়ায়া বোঝা যায় সেনাবাহিনী এখানে আসলে কি করবে। জানা যাচ্ছে সেনাবাহিনী মানুষকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং তাঁরা আর ফিরে আসছে না। ধর্ষন করছে, টাকাপয়সা কেড়ে নিয়েছে, সম্পদ নিয়ে গেছে। এই পরিবেশে সেনাবাহিনীর পক্ষে আস্থা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। এবং আসলে তাঁরা সেরকম কোন চেষ্টাও করছেনা। পাঞ্জাবি পুলিস শহরে সশস্ত্র পাহাড় দিচ্ছে এবং তারা পরিষ্কারভাবে খুব নার্ভাস। এছাড়াও অনিয়মিত সেনারা মেশিনগান সহ টহল দিচ্ছে। মানুষকে টেলিগ্রাফ অফিসে যাওয়ার আগে অনুসন্ধান করা হচ্ছে এবং সেখানে রাস্তায় স্পট চেক করা হচ্ছে। বেশ কিছু মানুষ যাদের সাথে আমি কথা বলেছি তাঁরা আমার সাথে দেখা করার জন্য ভীত ছিল। বাজারে ব্যবসায়িক কাজ যুক্তিসঙ্গতভাবে ভেঙ্গে পড়েছে এবং রাতে পথে খুব কম মানুষ দেখা যাচ্ছে। অফিস উপস্থিতির উন্নতি হয়েছে কিন্তু অধিকাংশ হিন্দু অফিসে ফিরে আসেনি। আসলে সেনাবাহিনী যে ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে তা পুনঃমেরামতের কোন চেষ্টা তাঁরা করছেনা। বাঙালি ও উর্দুভাষী মধ্যে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা এখনও খুব শক্তিশালী। এই পরিস্থিতিতে যাহাই হউক না কেন সরকার পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দিয়ে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

১৮।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
১ লা জুলাই, ১৯৭১
পাকিস্তানের ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রেস
উইলিয়াম ক্রওলি সম্পাদিত (এস)

আজ সকালের প্রেস পূর্ন পাকিস্তানের দুই জন রিপোর্টারের রিপোর্ট ছাপিয়েছে। টাইমসে মাইকেল হর্ন্সবি পাকসেনাদের দ্বারা হিন্দুদের উপর অত্যাচারের কথা লিখেছেন। তিনি ঢাকার ৪০ মাইল উত্তর পশ্চিমে সিন্দূরই গ্রামে যান। এটি অন্যতম হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তিনি জানান গত ৫ দিনে এখানে লট তরাজ চলেছে। গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন এই কাজ কোন নিরাপত্তা রক্ষার কারণ হিসেবে করার কথা না।

ডেইলি টেলিগ্রাফ এ ক্লেয়ার হলিংওর্থ ঢাকা থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি আসাম সীমান্তের চারশো গজের মধ্যে পাকিস্তানি সেনা সীমান্ত চৌকি পর্যন্ত ছিলেন। তিনি দেখেছেন গেরিলারা ভারতীয় বর্ডার অঞ্চল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কিছু ধ্বংসাত্মক কাজ করেছেন। তারা সেখানে ৫০০০ পাকিস্তানী উদ্বাস্তুকে আটক করেছেন। তিনি বলেছেন পাকসেনারা মনে করে ভারতীয় বাহিনী তাদের দেশের অর্থনিতিকে ধ্বংস করতে চায়। এবং শেলিং করার জন সামরিক কারণ নেই। গেরিলারা চা বাগান ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রায় ১২। ১৩ টা বাগান তারা মর্টার দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। তিনি জানান প্রতিদিন অনেক চা বাগান কর্মি ঢাকায় চলে যাচ্ছেন কারণ এখানকার পরিস্থিতি খুব বিপদজনক।

কলকাতা থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ সংবাদদাতা পিটার গিল রিপোর্ট করেন যে জনাব টবি জেসেল, যিনি বর্তমানে ব্রিটিশ সরকারের স্পন্সরে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশ পরিদর্শন করছেন – যিনি এখানে আসা চারজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের একজন – তিনি গত রাতে বলেন যে তিনি বিশ্বাস করেছেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হিন্দু গ্রামে আক্রমণ পরিচালনা করছে।

১৯।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ঢাকা থেকে মার্ক টালির প্রস্তান
৫ জুলাই, ১৯৭১
– ইভান চার্লটন দ্বারা সম্পাদিত (এস)

ঢাকা থেকে একটি তারবার্তায় বিবিসির মার্ক টালি বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। শুক্রবার রাতে আরেকটি বিদ্যুৎ তোরণ ঢাকায় ধ্বংস করা হয়। ঢাকা কিছু অংশে বিশ ঘন্টার জন্য বিদ্যুৎ ছিল না। গত সপ্তাহে বিভিন্ন এলাকায় বোমা নিক্ষেপের রিপোর্ট করা হয়েছিল। এর মধ্যে সরিষাবাড়ি বাজার, ময়মনসিংহ এর উত্তরে – এলাকাটি উল্লেখযোগ্য। ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য এবং আর্মি একশনের জন্য এখানকার পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। পাবনায় শুক্রবার রাতে কমপক্ষে একটি বোমা নিক্ষেপ হয়েছে। রাজশাহীতে গত সপ্তাহে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শনিবার রাতে বোমা বর্ষন হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানায় শনিবার আর্মি ওপেন ফায়ার করে এবং যারা ভারত থেকে ঢোকার চেষ্টা করেছে তাদের আক্রমণ করে। তারা মূলত ভারত থেকে গঙ্গা পেরিয়ে আসছিল। সেদিন থেকে কিছু গুলি এসেছে। গেরিলাদের কাজের সঠিক ধারনা করা কঠিন। কর্তৃপক্ষ এটা নিয়ে চিন্তিত। যেভাবেই হোক এটা থামাতে হবে। এসব রিপর্ট বর্তমান অবস্থায় আসলেও তার সোর্স কিসেবে কিছু সরকারি সোর্সও আছে। অনেক লোক গ্রামে চলে যাচ্ছে। অর্থনিতি ধ্বংসের চেষ্টা চলছে। এলোমেলো ধ্বংসাত্মক কাজ চলছে। সরকারকে অসহযোগিতা চলছে।

২০।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকিস্তানে ব্রিটিশ প্রেস
৯ জুলাই, ১৯৭১
উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

আজ সকালে ডেইলি টেলিগ্রাফ এর ক্লেয়ার হলিংওর্থ পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি জানান পাকিস্তানি ও ভারতীয় সৈন্যরা অতি নিকটে একে অপরের মুখোমুখি সীমান্তে অবস্থান করছে এবং সেখানে রোজ সীমান্ত জুড়ে বিক্ষিপ্ত ছোট আকারের গুলি বিনিময় চলছে। বাংলাদেশ গেরিলারা প্রতি রাতে সীমান্ত ক্রস করে প্রবেশ করছে। ও তারা সীমান্ত এলাকায় যোগাযোগ ব্যাবস্থার ক্ষতি করছে। ভারতীয় পার্শ্ব, উদ্বাস্তু দ্বারা পূর্ন। আর পাকিস্তানের পাশ অনেকটা ফাঁকা। কিছু উদ্বাস্তু পাকিস্তান ফিরে আসছে। তিনি মনে করেন এই অবস্থায় জাতিসংঘের শান্তি মিশনের বাহিনীর উপস্থিতি খুব দরকার। পরিস্থিতি ক্রমাগত উত্তপ্ত হচ্ছে।

আরেকজন টেলিগ্রাফ প্রতিবেদক, পিটার গিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা ক্রমাগত ভারতে প্রবেশ করছে। তাদের মধ্যে অনেক মুসলমান বাঙ্গালী আছেন যারা পাকিস্তানী বাহিনী ও মুক্তিফৌজের আক্রমণের সময় গুলিবদ্ধ হয়েছেন।

ফাইনানশিয়াল টাইমস, নেভিল ম্যাক্সওয়েল করাচি থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি ব্রিটেনের পশ্চিম পাকিস্তানের উপর রাগের ব্যাপারে লেখেন। তিনি বলেন পাকিস্তান সব সময় মনে করেছে যে ব্রিটেন হিন্দুদের পক্ষ নিচ্ছে। তিনি বলেন ঠিক উল্টো কথাটা ভারত সব সময় বলে আসছে। তিনি বলেছেন পাকিস্তান সরকার ব্রিটেনের সঙ্গে তার সম্পর্কের একটি মৌলিক হ্রস্যকরণ করতে চায়। (তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশী প্রতিবেদন পশ্চিম পাকিস্তানী ও পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করা ব্রিটিশদের কাছে উপেক্ষিত।)

ম্যাক্সওয়েল বলেছেন যে এয়ার মার্শাল আসগর খান, যিনি সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছেন – তার কথাও উপেক্ষা করা হয়েছে। ম্যাক্সওয়েল মতে, এয়ার মার্শাল আসগর খানের উপলব্ধি পাকিস্তান সরকারের থেকে ভিন্ন ছিল।

২১।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকবাহিনী ও মুক্তি বাহিনী
২৩ জুলাই ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তি বাহিনীর নাশকতা চলছে। মার্ক টালি এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে পরিস্থিতির মুখোমুখি সে ব্যাপারে লিখেছেন।

প্রথমে কেউ পূর্ব পাকিস্তানে আসলে মনে করবে এখানকার পরিস্থিত স্বাভাবিক হচ্ছে। কিছু এলাকার জন্য কথা সত্যি।

পরিস্থিতি যাই হোক মানুষকে খেতে হবে, আয় করতে হবে। তবে স্বাভাবিক হবার পরিবেশ গেরিলা একশনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মুক্তি বাহিনীর দুইটি অস্ত্র, ভয় এবং অর্থনীতির ভাঙ্গন। স্বাধীন বাংলা বেতারে মুক্তিফৌজ ঘোষণা করেছে যে যদি কেউ সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হবে। তারা শান্তি কমিটি ও অন্যান্য বিশিষ্ট সহযোগী সদস্যদের হত্যা করছে এবং কারখানা শ্রমিক, চা বাগান শ্রমিক ও পাট চাষীদের শাসানি দিচ্ছে। অর্থনৈতিক ফ্রন্টে তারা অত্যাবশ্যক কিছু ইনস্টলেশন সাবোটাজ করছে এবং ধ্বংস করছে। তারা যোগাযোগ ব্যাবস্থা যাতে পুনরায় ঠিক করা না যায় সেরকম ব্যাবস্থা নিচ্ছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই হুমকি পূরণ করার চেষ্টা করছে কিন্তু তারা একটি খুব কঠিন ঝামেলায় আছে। প্রথমতঃ তারা গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে অনেক সৈন্য রাখছে কারণ তারা মনে করছে বড় আক্রমণ হতে পারে। বাকিরা মূলত সীমান্তে আছে। এর মানে হল এই যে, কিছু জায়গায় তাদের ট্রেনিং দেয়া স্বেচ্ছাসেবকদের – যাদের রাজাকার বলা হয় – তাদের রাখা হয়েছে। এই স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা বাড়ছে এবং তাদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। তবে তারা প্রায়ই সাহায্যের চেয়ে হুমকি হয়ে যাচ্ছে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনী কার্যত অনেক জায়গায় নিখোঁজ। জনসংখ্যার মনোভাব এখনও সেনাবাহিনীর প্রতিকূল এবং সেনাবাহিনী তাদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পায় না। তবে আরেকটি সম্ভবনা আছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুক্তি ফোউজের প্রতিকূলে যাবে যদি তাদের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হয়। কিন্তু যদি সেনাবাহিনী শান্তি ফিরিয়ে না আনতে পারে তাই সাধারণ জনগণ মুক্তিফৌজের কোন তথ্য সেনাবাহিনীকে দেবে না। আসল সোর্স হল গেরিলা বাহিনী যারা ভারতের বর্ডারে অবস্থিত ক্যাম্পে অবস্থান করে। মুক্তিফৌজ খুব সহজেই আর্মিদের পোস্টের কাছে ঘুমাতে পারে আর যার ফলে মাঝে মাঝেই তাদের সীমান্ত দিয়ে আক্রমণ করতেও সমস্যা হয় না। ভারত ও পাকিস্তান আর্মিদের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে শেলিং চলতে থাকে।

এটা বলা সম্ভব নয় যে গেরিলাদের সংখ্যা কত – তবে সমস্ত সীমান্ত জুড়েই তাদের অবস্থান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কার্যত একটি অসম্ভব কাজের সম্মুখীন হয়েছে। তারা এমন একটি এলাকায় অবস্থান করছে যেখানে যোগাযোগ ব্যাবস্থা পুরোটাই গেরিলাদের নখদর্পনে। তবে তারা পাকিস্তানের দুটি প্রধান ক্ষেত্র চা আর পাট সেক্টরের নিরাপত্তা বিধান করতে পেরেছেন। আরও কিছু গেরিলাদের প্ল্যান ভেস্তে দেয়া হয়েছে। গেরিলাদের এখনো অনেক কিছু শেখা বাকি। সব কিছু নর্ভর করছে তারা কতসিন তাদের মনোবল ধরে রাখতে পারে এবং টিকে থাকতে পারে।

বাংলা ডন নিউজ টক – ২৪/২৫ জুলাই ১৯৭১

২২।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকিস্তানের শ্বেতপত্র
৬ আগস্ট ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

পাকিস্তান সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট নিয়ে। মার্ক টালি সেটার বিশ্লেষণ করেছেন।

শ্বেতপত্রে ২৫ মার্চের মিলিটারি একশনের ঘটনা আছে। পাক সরকার বলেছে যে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙ্গে যাওয়ায় তারা এই ব্যাবস্থা নিয়েছেন। এখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংবিধান প্রণয়নে ব্যার্থতাকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। তারা সংবিধান মেনে নেন নাই কারণ আওয়ামী লীগ চাচ্ছিল তাদের প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন। শ্বেতপত্রে বলা হয় আওয়ামীলীগ ভারতের সহায়তায় একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলছে। এখানে ১৯৬৭ সালের আগরতলা মামলার বিস্তারিত বর্ননা করা হয়। যেসকল গণহত্যা হয়েছে সেগুলোকে আওয়ামীলীগের সন্ত্রাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর সবগুলো উল্লেখ করা না হলেও বলা হয় যে ের অনেক গুলোই আর্মি একশন শুরুর অনেক পরেও হয়েছে। শ্বেতপত্রে প্রেসিডেন্টের সাথে ঢাকায় রাজনৈতিক নেতাদের ১৫ থেকে ২৫ মার্চের আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হয়।

শ্বেতপত্রের অন্যতম অসুবিধা হল এখানে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে আলোচনা করা হয় নাই। এটা আসলে এক পক্ষীয়। তাই অনেকের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। এখানে একচোখা রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর দুইটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আওয়ামীলীগের অনেক হত্যাকাণ্ডের কথা এখানে বলা হয়েছে। তবে আর্মির হত্যাকাণ্ড সমপর্কে কিছু বলা হয় নাই। এমনকি তাদের মিলিটারি বিচারের সম্পর্কে কিছু বলা নাই। তাছাড়া রিপোর্টে ১ মার্চ প্রেসিডেন্টের জাতীয় এসেম্বলি বাতিল করার ঘোষণা সম্পর্কে কিছু বলা হয় নাই। অনেকে মনে করেন এই একটি সিদ্ধান্তই প্রেসিডেন্টএর সদিচ্ছাকে দমিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। শ্বেতপত্রে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের ভাষণের কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে এসেম্বলি বন্ধ করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা এখানে অংশগ্রহণ না করার হুমকি দিয়েছেন। তারপরে বলা হয় দায়দায়িত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের উপর যাবে কারণ তিনি হরতালের ডাক দিয়েছিলেন।

রিপোর্টের সময়জ্ঞান বোঝা একটু কঠিন। পাকিস্তান সরকার বলেন ২৫ মার্চের আগে আওয়ামী লীগ জঙ্গিদের নৃশংসতা ও সংঘটিত অরাজকতার কাজগুলো তেমন প্রচারিত হয়নি। কিন্তু তার বক্তব্যে ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতিকে বলেন আওয়ামী লীগ বৃহৎ সংখ্যক খুন করেছে। আমাদের লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী ভাই যারা পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছেন তারা ভীতির মধ্যে আছেন আর অনেকেই ভয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। ২৬ মার্চের ভাষণের পরে চার মাস দেরি করে শ্বেতপত্র প্রকাশের কারণ রহস্যজনক।

ভারতীয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে বোঝা যায় যে পাকিস্তান সরকার জানত যে ১৯৬৭ সালে শেখ মুজিব ভারতের সাথে ষড়যন্ত্র করেছিল পাকিস্তান বিভক্ত করার ব্যাপারে। এবং এটা ১৯৭১ সালে সবাইকে জানানো হল ফেব্রুয়ারিতে একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাইয়ের পরে। যেসব প্রমাণ প্রতিবেদনে দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগ সেই সময়ে তারা জানত। তাহলে এতদিন পরে কেন সেটা উন্মোচন করা হল? তাহলে কি প্রেসিডেন্ট আওয়ামীলীগের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন? কেন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবকে বর্ণনা করেছেন?

কিন্তু সম্ভবত রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা হল এখন এর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। শুরুতে বলা হয়েছে যে শ্বেতপত্রে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সংকট আলোচিত হয়েছে। কিন্তু রিপোর্টের কোথাও তেমন কিছু বলা নাই। এমনকি সরকার কি আশা করে বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলা নাই। অথচ এটাই বিশ্ব শুনতে চায়।
২৩.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
গার্ডিয়ান পত্রিকার আর্টিকেলের উপর আলোচনা
১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত, (এস)
– রেফারেন্স নাম্বার – ৭০ জে ২১৮

আজ সকালে দ্য গার্ডিয়ানের মার্টিন উলকট কোলকাতা থেকে রিপোর্ট লিখেছেন। তিনি বাংলাদেশের জন্য যারা সংগ্রামে জড়িত তাদের লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে লিখেছেন। অনেকে এটাকে আশির্বাদ মনে করেন যে ভারত বাংলাদেশের সাথে এক হয়ে যুদ্ধে জড়াতে চায় না। কারণ তারা এটাকে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে চান না।

তিনি বলেন বাংলাদেশের আন্দোলনের নেতৃত্বকে চার ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথমতটি আওয়ামী লীগ। যেখানে শেখ মুজিবুর ‘রহমান শুধুমাত্র এখন বহুমুখী ক্ষমতাধর ব্যাক্তিই নন বরং ন্যায্যতার দাবীর দিক দিয়ে তারা এগিয়ে। দ্বিতীয়ত কিছু সাবেক পাকিস্তানী আর্মি অফিসার আছেন। তৃতীয়ত, শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কমবয়সী একটি গ্রুপ, যারা কোন দলের সাথে যুক্ত নয়। তারা ব্যক্তিগত সচিব ও নীতি পরিকল্পক হিসেবে কাজ করেন। ওয়াল্কট মনে করেন তাদের প্রভাব আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাবে।

সবশেষে আছে বিভিন্ন বামপন্থী ও কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভাসানী ও মুজাফফর গ্রুপ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব। তারা একটি আনুষ্ঠানিক পরামর্শমূলক কমিটির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত আছে। এই দলগুলোর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষপাতী এবং তরুণ বুদ্ধিজীবীদের সাথে আছে যারা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য কাজ করছে।

ওয়াল্কট বলছেন যে রাজনৈতিক ভবিষ্যত অনিশ্চিত এবং সামনে শীতকালে যুদ্ধ পরিস্থিতি কি হবে তার উপর অনেকটা নির্ভরশিল। কারণ ধারনা করা হচ্ছে আর্মি সেই সময়ে গেরিলাদের উপর আরও বেশী আক্রমণ করবে।

২৪.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পূর্ব পাকিস্তান এর অবস্থা নিয়ে আলোচনা
১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
– মার্ক টালি দ্বারা সম্পাদিত

গতকাল পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে দুটি রিপোর্ট ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতা থেকে এসেছে। রোনাল্ড রবসন দাবি করেন যে মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বৃহৎ অংশের দখল রেখেছে। তবে ঢাকা এটি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে।

পূর্ব পাকিস্তানে কয়েক শত মাইল ভ্রমণ করে আমি ব্যক্তিগতভাবে দখল করে রাখার তেমন কোন প্রমাণ পেলাম না। বিদ্রোহীরা হঠাৎ করে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়ে আবার দ্রুত সরে যায়। এলতি এলাকা দখলে তেমন কোন লক্ষণ দেখা যায়না। বর্ডার পার হওয়া অনেক সহজ। ১৭৮০ মাইলের মত বিশাল সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের প্রবেশ ঠেকানো যেকোন সেনাবাহিনীর জন্য প্রায় অসম্ভব। গত মাসে নাশকতার কর্মকাণ্ড কম হয়েছে। বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকরা অনেক সেতু এবং অন্যান্য ঝুঁকিপ্রবন পয়েন্ট পাহারা দিচ্ছে। ফলে নিয়মিত সৈন্য অন্যত্র পাহারায় থাকতে পারছে। পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক হতাহত হচ্ছে। সীমান্তে শেলিং এর অন্যতম কারণ। তবে পূর্ব পাকিস্তানে পর্যবেক্ষকদের মতে প্রতি মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩০০০ জন হতাহত হচ্ছে।

দ্বিতীয় রিপোর্টটি ইয়ান ম্যাকডোনাল্ড করেছেন। তিনি ৩ টি ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থার ত্রাণ সমন্বয়ক এবং সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছেন। সেখানে কৃষি প্রজেক্টের কাজ বন্ধ আছে। তিনি গত রাতে একটি বিবিসি রেডিও প্রোগ্রাম এডাম রাফায়েলকে বলেছিলেন যে, তিনি ভিত এইকারনে যে পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হবে। তিনি এই ফসল রোপণের সময় মাঠ বিনা চাষে পরে থাকতে দেখেছিলেন। পেট ফোলা বাচ্চারা পথের পাশে শুয়ে ছিল, ভিখারিদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে,। তিনি কৃষকদের সাথে কথা বলেছেন। তারা গত বছর ফসলের করুন দশার কারণে ঋণগ্রস্ত আছেন। তিনি বলেন যদি জাতিসঙ্ঘ প্রয়োজনীয় খাবর সরবরাহ করতে চায় তাহলে তার জন্য মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে হবে। জানুয়ারিতে যে খাবার এসেছে তা এখনো বন্দরে পরে আছে। কিছুদিন আগে প্রায় ১০০ তি জাতিসঙ্ঘ ট্রাক এসেছে কিন্তু তিনি চলে আসার আগ পর্যন্ত মাত্র ৩০ জন ড্রাইভার পাওয়া গেছে।

জাতিসংঘ বলেছে তারা খাদ্য বিতরণ করতে বিদ্যমান প্রশাসনের উপর নির্ভর করবে কিন্তু ম্যাকডোনাল্ড খুব সন্দিহান যে স্থানীয় প্রশাসন এই বিশাল সমস্যা কাঁধে নেবে কিনা। কারণ তারা গত কয়েক মাস ধরে অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন জাতিসঙ্ঘের চেষ্টা আমলাতন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেছে। ৩ মাস চেষ্টা করেও তারা স্থানীয়ভাবে কাজ শুরু করতে পারে নাই। ম্যাকডোনাল্ড প্রকৃতপক্ষে মনে করেন যে পরবর্তী কয়েক মাসে পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সমস্যার কোন সমাধান আসলে হবেনা।

২৫। এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ইভান চার্ল্টন
লেবার পার্টি কনফারেন্সে পাকিস্তান সম্পর্কে বিবৃতি
৭ ই অক্টোবর, ১৯৭১
– মার্ক টালি সম্পাদিত (গুলি)

লেবার পার্টির আজকের দিনের প্রথম এজেন্ডা হল পাকিস্তানের বিবৃতি জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে গ্রহণ করে নেয়া। এটা করা হয়েছে। আলোচনার জন্য আধা ঘণ্টা রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে কোন দ্বিমত ছিলোনা। সবাই মনে করেন পূর্ব বাংলায় মিলিটারি একশন বন্ধ না করলে এবং শেখ মুজিবকে মুক্তি না দিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। জনাব ব্রুস ডগলাস মান এমপি ব্রিটিশ সরকারের কার্যনির্বাহি কল সমর্থন করেন যেখানে বলা আছে বিষয়টি জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে উত্থাপন করার হবে। অন্যথায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হবে। পূর্ব বাংলা গেরিলাদের লড়াই এর লক্ষ্য একটাই। সেটা হল যুদ্ধে জিততে হবে। তিনি মনে করেন পাকিস্তান মৃত। জনাব জন স্টোনহাউজ এমপি. বলেন এটি অনেক বড় দুর্যোগ এবং জাতিসংঘের উচিৎ অগ্রণী ভূমিকা নেয়া এবং তিনি মনে করেন বাংলাদেশের সৃষ্টিই এখন এই সমস্যা থেকে নিষ্কৃতির একমাত্র বাস্তবতা। সাউথ ব্র্যাডফোর্ডের এম পি টম টমি বলেছেন দুই অঞ্চলের অভিবাসীদের অনেক পার্থক্য আছে এবং দুই অঞ্চলের মানুষের দর্শন ও ভিন্ন। এবং প্রায় সম্পূর্ন বিপরীতমুখী। ব্রিটেনের প্রধান উদ্বেগ ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা এবং আলোচনার ব্যাবস্থা করা। তিনি আরও পদক্ষেপ নিতে ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ দিতে চান।

মিসেস জুডিথ হার্ট পাকিস্তান সরকারকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য চাপ দেবার ব্যাপারে জোর দেন। তিনি বলেন নির্বাহীদের বিবৃতি পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব ও ট্রাজেডির বিশ্লেষণের উপর নির্ভরশিল। দির্ঘমেয়াদি সমাধান হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধান। তবে তিনি বলেন এশিয়ায় যুদ্ধ লাগার সম্ভবনা অনেক বেশী। এবং এই ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের আশু পদক্ষেপ খুবই গুরুত্তপূর্ন।

পাকিস্তানের উপর বিবৃতি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয় এবং সম্মেলন ইউরোপের পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা শুরু করে।

২৬.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ইন্দো-পাকিস্তান পরিস্থিতি রিপোর্ট
১২ অক্টোবর, ১৯৭১
– ইভান চ্যারিটন সম্পাদিত (এস)

টাইমস এর পিটার হ্যাজেলহার্স্ট নয়া দিল্লি থেকে একটি তারবার্তায় রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। তিনি জানান জনাব জগজিবন রাম, যিনি ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন পাকিস্তান যদি ঝটিকা আক্রমণ করে তাহলে ভারত পাকিস্তানের উপর আক্রম করবে। হ্যাজেলহার্স্ট জানান এই সন্দেহ করার কারণ হল জানা গেছে যে পাকিস্তান তাদের পশ্চিম সীমান্ত থেকে জনসাধারণকে অন্যত্র সরে যেতে বলেছে। এবং সীমান্তে কিছু ভারি অস্ত্র সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। ভারত বলেছে পাকিস্তান তাদের সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করেছে। উত্তেজনা ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। উভয় পাশেই। উভয় পাশে সামরিক কর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে এবং তেল ও পেট্রলের রিজার্ভ বাড়ানো হচ্ছে।

হ্যাজেলহার্স্টএর প্রতিবেদন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় পাঁচটি ডিভিশন এবং পশ্চিম সীমান্তে ১০ তি ডিভিশন জড়ো করেছেন। ভারত বলেছে তারা তাদের ২৭ টি ডিভিশনের ১২-১৩ টি পশ্চিম সীমান্তে, ১০ টি চাইনিজ সীমান্তে এবং ৩-৪ টি পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে জড়ো করেছে।

তিনি মনে করেন ভারত মনে করে যদি গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানে পাক আর্মিকে উত্যাক্ত করে তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ করতে পারে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা হচ্ছে যদি পাকিস্তান আক্রমণ করে তাহলে শীতকালীন হিমালয়ের হিমবাহ শুরুর আগেই তারা পকিস্তানকে আক্রমণ করবেন। পাশাপাশি তারা মনে করেন জোর করে যদি ভারত পূর্ব পাকিস্তানের শরনার্থিদের পূর্ব পাকিস্তানে ঠেলে পাঠায় তাহলে তাতে কোন ভালো কিছু হবে না।

পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে একটি দীর্ঘ গবেষণায় ফাইনানশিয়াল টাইমস এর কেভিন রেফারটি বলেন যে, এটা নিশ্চিত নয় যে সেনাবাহিনী বর্ষার পরেই গেরিলাদের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ শুরু করবে কিনা। তার জন্য দরকারি খাবার ও রসদ পাঠানো শুরু করবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়। যদি তারা দ্বিতীয় পথ বেছে নেয় অর্থাৎ যুদ্ধের আশংকা বাড়ার সাথে সাথে সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ে তাহলে আরও বেশী শরনার্থিদের প্রবেশ ঘটবে এবং নিহতের পরিমাণ অনেক বাড়বে। রেফার্টি বলেন, এটাই দেখার বিষয় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কোনটিকে প্রাধান্য দেবেন। তিনি আরও বলেন, ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে পূর্ব পাকিস্তানের ৪০ মিলিয়ন মানুষের দুর্ভিক্ষের সম্ভবনা।

২৭।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
গেরিলা ও খাদ্য
১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
– মার্ক টালি দ্বারা (এস)

পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের রিলিফ অপারেশন হেড বৃহস্পতিবার বলেন, আগামী চার মাসে পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করা যাবে কিনা তা নির্ভর করছে খাদ্য বণ্টন দক্ষতার উপর। মার্ক টালি সাম্প্রতিক রিপোর্টের আলোকে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।

পূর্ব পাকিস্তানে মার্চের শেষে সামরিক একশন শুরুর পর থেকেই দুর্ভিক্ষ এর ভয়ানক সতর্কবার্তা আছে। পূর্ব পাকিস্তানে যারা সম্প্রতি ভ্রমণ করে এসেছেন তারা জানিয়েছেন সেখানে বড় রকমের অপুষ্টি পরিস্থিতি চলছে। কিন্তু যারা সেখানে গিয়েছিল তাদের প্রায় সবাই জানিয়েছে কে পূর্ব পাকিস্তানের সামনে খুব বিপদ আছে।

জনাব পল মার্ক হেনরি যিনি পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের রিলিফ অপারেশনের দায়িত্বে আছেন তিনি গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন তিনি মনে করেন না যে সেখানে মজুদের ঘাটতি আছে। প্রধান সমস্যা হল বণ্টন। পূর্ব পাকিস্তানের রেলপথ আমদানি করা খাদ্যের প্রায় ৬০% বহন করার জন্য যোগ্য তবে একজন বিদেশী সংবাদদাতা ঢাকা থেকে রিপোর্ট করেছেন যে এখন মাত্র ২০% রেলপথ স্বাভাবিক আছে। জাতিসঙ্ঘ তাই জল ও সড়ক পথে দেবার চেষ্টা করছেন। তারা প্রায় এক হাজার যানবাহন ও বিভিন্ন কোস্টার এবং নৌকা সরবরাহ করবে। কিন্তু রিপোর্ট করা হয় যে রাস্তার অবস্থা এত খারাপ যে জাতিসংঘের ১০০ টি ট্রাকের মধ্যে ৭০ টি এখনো চট্টগ্রামে বন্দরে আটকে আছে।

এখানে গেরিলাদের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কারণ গেরিলাদের বিভিন্ন গ্রুপ রাস্তার অবস্থা খারাপ করেছে নানা রকম আক্রমণ করে। সম্প্রতি অন্তত তিনটি জাহাজ চালনা পোতাশ্রয়ে মাইন দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে এবং এর কারণে একটি ব্রিটিশ লাইন পূর্ব পাকিস্তানের শিপিং বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। যদিও এটা এখন বিশ্বাস করা হয় যে, এগুলোর কোনটিতে খাদ্য ছিলোনা। যদি মূল বন্দর নিরাপদ না রাখা যায় তাহলে খাদ্য সরবরাহে সমস্যা দেখা দেবে। যোগাযোগ ধ্বংস করা ছাড়াও গেরিলারা আরও অংকে সমস্যা সৃষ্টি করছে যাতে করে তাদের বিরুদ্ধে একশন নিতে সেনাবাহিনী বাধ্য হচ্ছে। সেনাবাহিনীর এই একশন অতি দ্রুত থামানো উচিৎ কারণ গেরালারা ক্রমাগত তাদের কর্মপরিধি বাড়াচ্ছে। যেসকল এলাকায় মিলিটারি একশন চলছে সেখানে খাদ্য সরবরাহ করা দুষ্কর।

গত মাসে জনাব মোশতাক আহমেদ, যিনি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আছেন, তিনি ভারতের একজন বিদেশী সংবাদদাতাকে বলেছেন যে তিনি আশা প্রকাশ করেন পূর্ব পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ত্রাণ অপারেশন পরিচালিত হবে। কিন্তু তিনি বলেন, এটি পূর্ণ মাত্রায় সফল করতে হলে আন্তর্জাতিক সংস্থাকে খাদ্য বণ্টনে এগিয়ে আসতে হবে। তার বক্তব্য এই সপ্তাহে লন্ডন প্রতিনিধির কাছে পৌঁছানো হয়। তিনি মনে করেন পাকিস্তান আর্মির চাইতে রিলিফ অপারেশন জাতিসঙ্ঘের পরিচালনা করা উচিৎ।

বাংলাদেশ আন্দোলনকারীরা জানান যেহেতু এখন পর্যন্ত কেউ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেনা তাই তাদেরকে গেরিলা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।

২৮।
বাংলা ডন নিউজ টক
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
প্রেস অন পাকিস্তান
২০ অক্টোবর ১৯৭১
– মার্ক টালি

আসামে গৌহাটি থেকে আজ ডেইলি টেলিগ্রাফ এর এক প্রতিবেদনে ক্লেয়ার হলিংওর্থ জানিয়েছেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ আসন্ন এবং কর্নেল ওসমানীর অধীনে ৩০০০০ জওয়ান প্রস্তুত আছে। তিনি জানান সিলেট জেলা ও কুমিল্লার কাছাকাছি ছাতকে ভারী যুদ্ধ হয়েছে। তিনি জানান চীনারা গেরিলাদের বস্তুগত ও নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা গেরিলাদের মধ্যে বামপন্থী প্রবণতার লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বিগ্ন আছেন। তিনি আরও জানান কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দল এবং ত্রিপুরার গেরিলা নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে যার ফলে এই সুযোগে বামপন্থিরা গেরিলাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার বৃদ্ধি করতে পারে বলে তিনি আশংকা করেন।

টাইমস গতকাল দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের উপর একটি ব্যাপক আলোচনা প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ভারত যুদ্ধ চায়না এবং যুদ্ধ শুরু হতে পারে এমন কোন উসকানি দিতে চায়না। মিসেস গান্ধী আরো বলেন যে তিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে আলোচনার কোন কারণ দেখেন না। কারণ সমস্যা পাকিস্তানের সরকার ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাঝে।

গতকাল এবং আজ (রবিবার ও সোমবার) ব্রিটিশ প্রেস রিপোর্ট ভারত ও পাকিস্তান ইস্যুতে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছে। মার্ক টালি এই প্রেস কভারেজ সম্পর্কে জানাচ্ছেন – –

২৯.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত পাকিস্তান ও প্রেস
২৫ অক্টোবর, ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

যে কেউ যিনি গতকালের এবং আজকের ব্রিটিশ পত্রিকা পড়েছেন তিনি বিভ্রান্তিতে পরে যাবেন। মূল প্রশ্ন যা আলোচনা করা হয়েছে তা হোল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা। আজকে টাইমস এবং স্কচম্যান পত্রিকা নিন। টাইমস পিটার হ্যাজেলহার্স্ট এর বরাত দিয়ে জানিয়েছে, “মিসেস গান্ধী যুদ্ধের হুমকির পরিবর্তে বিদেশে রওনা দিলেন”। অন্যটিতে লেখা হয়েছে যুদ্ধের আশঙ্কা বাদ দিয়ে মিসেস গান্ধী “বিদেশী সফরের জন্য’’ রওনা দিয়েছেন। সানডে টেলিগ্রাফ গতকাল দিল্লি থেকে রীপোর্ট করেছে যেখানে বলা হয়েছে বিদেশ ভ্রমণের প্রাক্বালে জাতির সামনে দেয়া মিসেস গান্ধীর ক্ষণস্থায়ী ভাষণে সীমান্ত এলাকার উত্তেজনা পরিস্থিতি কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। যদিও রবিবারের রিপোর্টে প্রকাশিত সামরিক কর্মকান্ড যথেষ্ট ভীতিকর। তবে অন্যদিকে দুইটি রিপোর্টে বলা হয়েছে ভারত সেনা রিজার্ভিস্টদের ডেকেছে। অবজারভার প্রতিনিধি জানান সীমান্তে রিজার্ভ বাহিনীকে ভারত সরকারের শো আপ রাখতে ও পাকিস্তানের অনুরূপ বিল্ড আপ পূরণের জন্য তলব করা হয়েছে।

আজকের ডেইলি টেলিগ্রাফ দুটি প্রতিবেদন যার শিরোনাম ভীতিকর। একটি রিপোর্ট করেছেন লাহোর থেকে ডেভিড লোসাক – তিনি শিরোনাম করেছেন “পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের বিপক্ষে যেতে উৎসাহী” – অন্যদিকে ক্লেয়ার হলিংওর্থ লিখেছেন “ভারতীয় সেনারা ধর্মঘটে যাচ্ছেন।’ লসাক জানান পাকিস্তান সেনারা লাহোর সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করেছে। লসাক মনে করেন এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন পথ নেই। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কোন চেষ্টা পাকিস্তান সরকারকে করতে দেখা যাচ্ছে না। ক্লেয়ার হলিংওর্থ জানান মিসেস গান্ধি চলে যাবার আগে তাঁর মন্ত্রীসভা ও সেনাবাহিনীর অফিসারদের সাথে দীর্ঘসময় বৈঠক করেছেন।

জন গ্রিগ যিনি সম্প্রতি সরকারী অতিথি হিসেবে ভারত সফর করে ফিরে এসেছেন তিনি গতকাল অবজারভার পত্রিকায় একটি দির্ঘ রিপোর্ট লিখেছেন। তিনি জানান মিসেস গান্ধি একটি শান্তিপূর্ন সমাধানের জন্য এখনো উদ্বিগ্ন। তবে তিনি যুদ্ধ থেকে সরে যাবেন না যদি পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে। তিনি মনে করেন মিসেস গান্ধির বিদেশ সফর শান্তির শেষ প্রচেষ্টা। তিনি পশ্চিমা দেশগুলোকে জিজ্ঞেস করবেন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা পরিবর্তন ও শরনার্থিদের প্রত্যাবর্তনের জন্য তারা নূন্যতম সহায়তা বয়া সমর্থন দেবেন কিনা।

অন্যদিকে, স্যার ফ্রেডারিক বেনেট যিনি পার্লামেন্টের সদস্য তিনি আজ টেলিগ্রাফে একটি চিঠি প্রকাশ করেছেন। তিনি সম্প্রতি পাকিস্তানের উভয় অংশ সফর করে এসেছেন। তিনি মনে করেন বাংলাদেশের বিষয়টি বায়াফ্রার মত। স্যার ফ্রেডারিক বেনেট উল্লেখ করেন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেবার একমাত্র পথ হোল সীমান্তে উত্তেজনা কমানো।তিনি বলেন যদি গেরিলা কার্যক্রম চলে তাহলে যুদ্ধ অবশ্যাম্ভাবি হবে।

টাইমসে আজ পিটার হ্যাজেলহার্স্ট একটি নিবন্ধে ভারতীয় এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আপেক্ষিক শক্তি বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন যে, উভয় বাহিনী সুশৃঙ্খল এবং সশস্ত্র। সংখ্যাসূচকভাবে ইন্ডিয়ার শক্তি তিনগুন বেশী। তবে সমস্যা হল ২৭ ডিভিশনের ১০ টাই চীনের সাথে উত্তর সীমান্তে নিযুক্ত। লজিস্টিক সাপোর্ট পাক আর্মির বেশী আছে। তিনি বলেছেন ভারত চায় না পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে – কারণ এতে করে প্রদেশ গুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। আর ৭০ মিলিয়ন শরনার্থি তাদের পুষতে হবে। তবে তিনি বলেন গেরিলারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে হয়রানি করে তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যুদ্ধের ঘোষণা দিতে পারেন। সম্ভবত কাশ্মীরে এটা শুরু হতে পারে। এবং নিরাপত্তা পরিষদের সাথে সাক্ষাত করতে চাইতে পারেন।

অবশেষে, উভয় স্কচম্যান এবং গার্ডিয়ান আজ সম্পাদকীয় লিখেছে। উভয় কাগজ সম্মত হয় যে যেহেতু মিসেস গান্ধী দূরে আছেন তাই যুদ্ধ হয়ত শুরু হবেনা। স্কচম্যান বলেছে ভারত সংযমের আপিল করেছে এবং যদি মিসেস গান্ধি শরনার্থিদের ব্যাপারে বিশ্ব সফরে কোন সমাধান না পান তাহলে তিনি তাঁর পরিকল্পনা পরিবর্তন করবেন। বিশেষ করে আমেরিকার কাছে তিনি দাবি করবেন। অন্যথায় সামরিক একশনের চাপ বৃদ্ধি পাবে। গার্ডিয়ান জানায় মিসেস গান্ধি আমেরিকা থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র চালান থামাতে পারবেন এবং জাতিসঙ্ঘ ফোর্সকে পূর্ব পাকিস্তানে আসা থামাতে পারবেন। অন্যথায় তিনি ভারতের চরমপন্থিদের ঠেকাতে পারবেন না। তবে গার্ডিয়ান মনে করে ভারতের উচিৎ জাতিসঙ্ঘ টিমকে শরনার্থি এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া।

৩০.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
প্রেস রাউন্ডআপ
১ লা নভেম্বর ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

আজ সকালে এবং পুরো সপ্তাহ জুড়ে পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট হয়েছে। গতকাল সকালে সানডে টাইমস ঢাকা থেকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এটিতে কোন স্বাক্ষর ছিল না তবে জানা যায় যে এটি সাম্প্রতিক ও নির্ভরযোগ্য। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকায় সরকারী ভবনের উপর দিনের আলোতে আক্রমণ করেছে। প্রতিবেদনে দুই সপ্তাহের আগের ঘটনা উল্লেখিত হয়ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় অবস্থিত বিদেশীরা মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও রাজাকার – উভয়দের থেকে ঝুঁকির মুখে আছে। ১৫ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী ৮০ জন গেরিলাকে আটক করার পড় তাদের আক্রমণ নতুন রূপ নিয়েছে।

ডেইলি টেলিগ্রাফ আজ ডেভিড লোসাক পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে রিভিউ করেছে। তিনি কলকাতায় থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি বলেন গত ১০ মাস্যা পাকিস্তান সরকার অনেক ভুল করেছে। তিনি বলেন যেহেতু দেশটি যুদ্ধের সম্মুখীন অনেক গুরুত্তপূর্ন সিদ্ধান্ত তারা এড়িয়ে গেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে রাখার জন্য অনেক অর্থ খরচ হচ্ছে এবং পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন ধ্বংসের সম্মুখীন। শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছে। তারা বেকার বসে আছে। আর পশ্চিম অংশের সাথে জাতিগত বিভেদ বাড়ছেই।

ফাইনানশিয়াল টাইমস আজ সকালে মিসেস গান্ধীর ব্রিটেনে সফরের উপর একটি সম্পাদকীয় লিখেছে। ফাইনানশিয়াল টাইমস বলে যে, যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ না হয় তাহলে মিসেস গান্ধির সফর ব্যার্থ হবেনা।
পত্রিকাটি বলছে যে ব্রিটেনের নীতি হওয়া উচিৎ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধ করতে কাজ করা। সাথে আমেরিকা ও রাশিয়ার সাথে সমন্বয় প্রয়োজন। ফাইনানশিয়াল টাইমস বলছে যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনাব হিথের উচিৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে ভারতের সঙ্গে ও বাঙালিদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করা। এতে করে যুদ্ধের বিকল্প কিছু হতে পারে। পত্রিকাটি মনে করে একই রকমের মেসেজ প্রেসিডেন্ট নিক্সনকেও দেয়া উচিৎ। যাতে আমেরিকাও একই অবস্থান নেয়।

৩১.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পাকিস্তান ইস্যুতে ব্রিটিশ প্রেসের সংবাদের উপর আলোচনা
৩ নভেম্বর ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি (এস)

ঢাকা থেকে পাঠানো ক্লেয়ার হলিংওর্থ এর একটি রিপোর্ট আজ সকালে প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক টেলিগ্রাফে। তিনি বলছেন যে চল্লিশ হাজার বাংলাদেশ গেরিলা এখন পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে কাজ করছে। তিনি বলেছেন যে একজন আর্মি অফিসার জানিয়েছেন যে গত দুই মাস্যা মুক্তিফৌজে র সমর্থন স্রোতের মত বেড়েছে। তিনি বলছেন যে গেরিলারা মার্চ সংঘর্ষের পর এই প্রথম শহরের ভিতরে তাদের আক্রমণ বৃদ্ধি করেছে। তারা দিনের আলোতে সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। তিনি বলেছেন ঢাকায় গেরিলাদের তিনটি গ্রুপ আছে। ব্যাংক ডাকাতি হচ্ছে। স্কুলে আক্রমণ হচ্ছে।অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের বাসায় রাখছে।

তিনি বলেন সেনাবাহিনী চাপের মুখে আছে। তারা সীমান্তে পাহারা দিচ্ছে। মফস্বলে তাদের পরিমাণ কম। পাকিস্তান সরকার জানিয়েছে যেসকল অঞ্চলে গেরিলা কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাবে সেখানকার মানুষকে জরিমানা করা হবে। তবে এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।

ক্লেয়ার জানান বরিশালে একটি সেনা ফাঁড়ির তিন মাইলের মধ্যে গত সপ্তাহে প্রায় ১০০০ গেরিলাদের একটি সম্মেলন হয়। সম্মেলন একজন নকশাল নেতা হত্যার পর তার অনুসারীরা গেরিলা গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়।

নিউ দিল্লিতে কুলদীপ নায়ার থেকে একটি রিপোর্ট করেছে টাইমস। তিনি বলেছেন যে বাঙালি নেতারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক অভিযান সম্পর্কে আগে কিছু অনুমান করতে পারে নাই। আর দিল্লীর আপাত অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তারা চুপ করে বসে থাকবে এবং যতদূর সম্ভব গেরিলাদের সাহায্য করবে। তিই বলেন মুক্তিবাহিনী তাদের নেতাদের বেশী করে চাপ দিচ্ছে চীনের সমর্থন নেবার জন্য। চরমপন্থিরা তর্ক করছে এই নিয়ে যে ভারত বাংলাদেশ যুদ্ধে জরাতে চায় না।

৩২.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা
১১ নভেম্বর ১৯৭১
– মার্ক টালি (এস)

এই সপ্তাহের শুরুতে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে পাক সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে যেখানে নাশকতামূলক বা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম চলছে সেখানে তারা জরিমানা করবে। মার্ক টালি এই ব্যাপারে জানাচ্ছেন।

পাকিস্তান সরকারের জরিমানা আরোপের সিদ্ধান্তে বোঝা আয় এই সরকার পূর্ব পাকিস্তানের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সঠিক করার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদিও জানা যায় যে আর্মি এবং পুলিশ অনেক নাশকতামূলক কাজ করছে কিন্তু সেগুলো সরকার অস্বীকার করছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা বলছে যে এগুলো অফিসিয়াল পলিসি। পাকিস্তান সরকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন বলে জানাচ্ছেন অথচ বিশ্ব বলছে যে তাদের পূর্ব পাকিস্তানের উপর কোন নিয়ন্ত্রণই নেই। বরং তারা পূর্ব বাংলার বিশাল জনগণের উপড়ে অপারেশন চালাচ্ছে। সরকারকে বুঝতে হবে যে জরিমানার এই বিষয়টি আসলে তেমন নয়।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাওয়া রিপোর্ট বলে যে সেখানে গেরিলা কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের একটি টার্গেট হোল স্কুল ও কলেজ। গেরিলারা ছাত্রদের ক্লাসে আসতে বাঁধা দিতে চায়। অর্থনিতিও একটি টার্গেট। সম্প্রতি ৩ টি পাট গুদাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গেরিলারা যারা পাকসেনাদের সহযোগী তাদের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছে। রবিবার জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য যিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সিল পেয়েছেন তাকে গুলি করা হয়েছে। আরেকটি রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা হয়েছে।রিপোর্টে বলা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের কমপক্ষে ৭ টি স্থান আছে যেখানে পাকিস্তান সরকার নিয়ন্ত্রণ করছেনা।

সরকার সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়ছে তা হোল তারা রাজাকারদের উপর নির্ভর করতে পারছেনা। যে কাজ পুলিশ বয়া আর্মি দিয়ে করা হচ্ছে। নিয়মিত পুলিশ দুর্বল হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর কাজের ফলে তাদের কাজ দমিয়ে আছে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা তেমন কাজ করছে না। জনগণ তেমন সায় দিচ্ছেনা এবং সরকারকে সহায়তা করছে না। মনে হচ্ছে সাম্প্রতিক নিষিদ্ধ করা দল আওয়ামীলীগের বিপরীতে আর কোন নতুন দল সৃষ্টি হচ্ছেনা। পরের মাস্যা জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনের জন্য ৭৮ টি আসনে নির্বাচন হবার কথা। রিপোর্ট জানাচ্ছে যে এর মধ্যে ৫২ টি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আছে। যেহেতু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতরা বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছে তাই ধারণা করা হচ্ছে যে এরা নির্বাচিত হলেও এই এলাকার মানুষের উপর কর্তৃত্ব চালাতে ও সাংবিধানিক কাজকর্ম করতে পারবে না।

আরেকটি রাজনৈতিক সমস্যা হল একটি বৃহৎ অংশ যারা আওয়ামীলীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছিল পরবর্তি জাতীয় পরিষদের জন্য। সরকার তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে তাদের বেশিরভাগ এখন ভারতে অবস্থান করছে।

লক্ষণে বোঝা যায় পূর্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এখন স্বাভাবিকের চাইতে অনেক দূরে। এই অবস্থায় কিভাবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে তা অনিশ্চিত।

৩৩।
এশিয়া সম্পর্কে আলোচনা
ইন্দো-পাকিস্তান ইস্যুতে ব্রিটিশ প্রেস
৩০ নভেমেব্র ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি (এস)

বেশিরভাগ ব্রিটিশ পত্রিকা আজ ভারতের একটি ঘটনা নিয়ে লিখেছে। বলা হয়েছে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের বালুর ঘাট পার্বত্য এলাকায় ট্যাঙ্ক ও ইনফ্যান্ট্রি নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কলকাতায় ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিনিধি ডেলিড লোসাক বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের মিলিটারি সংকট পাকিসেনা ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটি নিয়ে সরকারিভাবে প্রচার ছাড়া আর কেউ কিছু বলে নাই।

টাইমসের ডেভিড হূসেগো রাওয়ালপিন্ডি থেকে রিপোর্ট করেছেন যে ভারতীয় এবং গেরিলা বাহিনী পাকসেনাদের উপর বারবার আক্রমণ করে তাদের উসকানি দিচ্ছে এবং অন্যদিকে পাকিস্তান সেনারা যাতে পর্যাপ্ত সরবরাহ না পায় তাতে বাঁধা দিচ্ছে। হুসেগো বলছেন যে উত্তর অঞ্চলের আকাশপথ সংকটাপন্ন যেখান দিয়ে পাকিস্তান আর্মির রসদ আসে। তিনি আরও বলছেন যে রাওয়ালপিন্ডিতে পর্যবেক্ষকরা দেখতে চান কিভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সিদ্ধান্তে লম্বা সময়ের জন্য অটল থাকেন, অথবা পূর্ব বা পশ্চিম অংশে আক্রমণ করেন অথবা রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করেন।

ঢাকা থেকে গার্ডিয়ান লেখা, ওয়াশিংটন পোস্টের লি লেস্কেজ বলছেন যে এটা স্পষ্ট যে যুদ্ধ কিছু ছোট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে এবং ভারত আক্রমণাত্মক জায়গা নিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের ইচ্ছা যে ওপর পক্ষ আগ্রাসক হিসাবে আসুক কিন্তু এই উদ্বেগেই অঘোষিত সীমান্ত যুদ্ধ পরিবেশ চলছে। কিন্তু লেস্কেজ মনে করেন ভারতীয় আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ভারসাম্য বজায় রেখেছে। তিনি মনে করেন যে ভারত আশা করে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করুন যাতে করে তারা পাকিস্তানি আগ্রাসনের প্রমাণ প্রদান করতে পারে। এবং এর ফলে আরও শক্তিশালী মিলিটারি একশনে যেতে পারবে ভারত।

এছাড়াও আজকের গার্ডিয়ান একটি সম্পাদকীয় লিখেছে যেখানে তারা শিরোনাম করেছে যে ভারত যুদ্ধের উদ্রেককারী হিসেবে কাজ করছে। গার্ডিয়ান বলছে যে ভারতীয় সামরিক আক্রমণের লক্ষ্য হয় শেখ মুজিবের মুক্তি এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ বা সরাসরি সামরিক বিজয়। কিন্তু গার্ডিয়ান বলছে যে ভারতের কৌশল আরো বেশী অস্পর্শী। তারা কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মানসিকভাবে বিধ্বংসী। কূটনৈতিকভাবে কেউ এখন বিশ্বাস করেনা যে এটা আসলে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়। রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের একটি পাল্টা আক্রমণ এখন এত উত্যক্ত করার পর একটি কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া বলে মনে হতে পারে এবং মানসিকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই মুহুর্তে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবেনা এবং গার্ডিয়ান বলেছে যে শেখ মুজিব ছাড়া বাংলাদেশ দ্রুত পৃথক্ হয়ে যাবে।

৩৪.
এশিয়ান সম্পর্কিত আলোচনা
ঢাকা থেকে আহমেদ নিজামুদ্দিন
২ ডিসেম্বর ১৯৭১
– মার্ক টালি সম্পাদিত (এস)

ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্রদের মতে, ভারতীয় সৈন্যরা উৎরে সিলেট জেলার শমসেরনগর এয়ারপোর্টে এবং পশ্চিম সীমান্ত কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা রেলস্টেশনে ঢোকার চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র অগ্রিম ব্লাফ বলে দাবি করেন। একটি সূত্র অবশ্য বলেন, গুরুতর যুদ্ধ অপেক্ষমাণ কিন্তু ঢাকায় পৌঁছানো খবরে বলা হয়েছে যে ভারতীয় সৈন্যরা এখনও সীমান্তে আছে। আরও কিছু বর্ডার অঞ্চলে আক্রমণ হয়েছে। ভোমরা ও খুলনার সারকারা, আফ্রা, সিমিলিয়া, ভদ্রা, খালিশপুর শিল্পনগর, উস্টাইল এবং খুলনার আন্দাল্বার, ময়মনসিংহের কামাল্পুর, শমসেরনগর এবং সিলেট জেলার উনাচম, কসবা, সালদানদী, বরজালা, গেনাগাদার বাজার, পাথরনগর এবং কুমিল্লার হরিমঙ্গল এবং চট্টগ্রাম জেলার ছোটা হারিনা উল্লেখযোগ্য। একটি সামরিক সূত্র আজ ৫১৫ গুর্খা রেজিমেন্টের দুই ভারতীয় সৈন্যের ছবি এবং তাদের সনাক্তকরণ নম্বর প্রকাশ করে। পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের ভেতরে জৈন্তাপুর অঞ্চলে তারা নিহত হয়েছিল। ছবি দুটি প্রকাশ করে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছে যে যুদ্ধে ভারত জড়িত আছে।

এদিকে বিদ্রোহীরা যাদের কর্মকর্তারা দুর্বৃত্ত হিসাবে বর্ণনা করেন তারা গত ২৪ ঘন্টায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী শহরের বিভিন্ন অংশে পাঁচটি বোমা বিস্ফোরিত করেছে। একটি বোমা একটি বামপন্থী দল অফিসে বিস্ফোরিত হয়। সে সময় ডানপন্থী নেতা গোলাম আযম ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে, একটি জাতীয় সরকার অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানে গঠিত হতে পারে। জনাব ভুট্টোকে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা আছে। গোলাম আযম আরো দাবি করেন জাতীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের থেকে নিয়োগ দেয়া হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আস্থা সরকার ফিরে পায়।

আরেকটি বিস্ফোরণ খারাপভাবে রামপুরা, মালিবাগ এলাকায় বৈদ্যুতিক খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত করে। আরমানিটোলা মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ে দুটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। পুলিশ মারফত জানা যায় নতুন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও রহমতুল্লাহ হাইস্কুলে ধ্বংস সাধন করা হয়। বিমান বন্দর রোডে একটি পেট্রোল পাম্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুই ব্যক্তি আহত হন। তাদের একজনের অবস্থা গুরুতর। ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে উত্স বলেন যে আরও দুজন বুলেট বিদ্ধ মানুষ সেখানে ভর্তি হয়েছে । নিকটবর্তী কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে ৩৫ জন এধরনের রোগী এসেছে।

পাকিস্তান সরকারের মুখপাত্র বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান এর ট্রায়াল “শেষ হয়নি”। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম পার্শ্ববর্তী জেলা ও ঢাকা শহরের ২০ মাইল পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা শহরের দক্ষিণ দিক থেকে ২২ মাইল দূরের মেদিনীমণ্ডল থেকে একজন বুড়ো লোক, জনাব আফজাল হোসেন, কেরোসিনে তেল, ওষুধ ও কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে এসেছেন। ঢাকা সিটিতে সরকার শহরবাসীদের জন্য শুধুমাত্র যাদের রেশন কার্ড আছে তাদের কাছে কেরোসিন তেল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যখন আমি একটি ন্যায্যমূল্যের দোকান পরিদর্শন করলাম আমি দেখলাম সেখানে মানুষ তাদের স্বাভাবিক কাজ রেখে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাথাপিছু এক গ্যালন তেল নেবার জন্য প্রায় শ খানেক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রাম অঞ্চলে ভোক্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী কার্যত কোন কেরোসিন তেল ছিল না এবং সব স্থানীয় কাগজপত্র তাদের সম্পাদকীয়তে এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন। দিনের পর দিন কেরোসিন তেলের তীব্র ঘাটতি হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হল বিদ্রোহীরা চট্টগ্রাম বন্দরে একটি তেল ট্যাঙ্কার বিস্ফোরিত করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ কেরোসিন ব্যাবহার করে। তারা সন্ধ্যায় আলো জ্বালানোর জন্য এবং শহরে রান্নার জন্য তারা কেরোসিন ব্যাবহার করে।

৩৫.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত / পাকিস্তান ইস্যুতে প্রেস রিভিউ
২ ডিসেম্বর ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি, (এস)

আজ সকালে ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে জানা যায় বলে ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে দুটি পয়েন্টে রেললাইন কেটে দিয়েছে। টাইমসএর পিটার হ্যাজেলহার্স্ট দিল্লি থেকে রিপোর্ট করেন যে ভারতীয় সেনারা হিলি অঞ্চলের রেল লাইন দখল করে আছে। ক্লেয়ার হলিংওর্থ, ঢাকা থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফে লিখেছেন যে ভারতীয় আর্টিলারি যা গেরিলাদের দ্বারা সমর্থিত সেগুলো দিয়ে তারা ঢাকা চট্টগ্রাম রেল সংযোগ এবং চট্টগ্রাম এর ৩৮ মাইল উত্তরের কুমিল্লার ফেনী শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

তিনি বলেন যে ভারতীয় অপারেশন ব্যাটালিয়ন স্তর (৬০০-৮০০ লোক) এর বেশী জমা হয় নি। এবং বেশিরভাগ অপারেশন এক কোম্পানী (১২০ জন পুরুষ) সৈন্য দিয়েই করা হয়েছে। তিনি জানান গতকাল ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানী আর্টিলারি অবস্থানের উপর প্রচণ্ড শেলিং করতে থাকে। এটা ছিল রংপুরের কাছে। গানারদের গুলি করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, এই সেক্টরে ভারতের সীমান্ত পারাপার ছাড়া ছোট পাল্টা হামলা চালানোও অসম্ভব হবে, এবং তিনি তা না করার কড়া আদেশ দিয়েছিলেন।

টাইমস এবং ডেইলি টেলিগ্রাফ এর করেসপন্ডেন্টস কিছু বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে ছিলেন যারা ইন্দো- পাকিস্তান সীমান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে সফর করার জন্য অনুমোদিত ছিলেন। এটা ছিল ভারতীয় দিকে বনগাঁর কাছাকাছি। সেখানে কিছু মেশিন গান ফায়ার ছাড়া তেমন কোন সঙ্ঘর্ষ ছিলোনা। ডেইলি টেলিগ্রাফ এর পিটার গিল রিপোর্ট করেন যে সেখানে পাকিস্তানি সেনারা ছিল না বলে মনে করা হচ্ছে এবং একটি বাংলাদেশের পতাকা সীমান্তের ওপারে উড়ছিল।

একটি বিলম্বিত রিপোর্ট এশিয়ান নিউজ সার্ভিসের এ বি মুসা, যিনি খুলনা জেলার সাতক্ষীরাতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের সঙ্গে ছিলেন – তার একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। মুসা রিপোর্ট করেন যে দুই প্লাটুন মুক্তিবাহিনী ইছামতি নদী পার হয়েছিল এবং পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। মুসা বলেন যে গেরিলাদের কেউ কেউ ১২ বছর বয়সী ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে গেরিলা কার্যক্রম এর উপড়ে একটি চলচ্চিত্র গত রাতে বিবিসি টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। একজন আমেরিকান সাংবাদিক এটি চিত্রায়িত করে। এবং এখানে পাকিস্তানি লাইনের বিপরীতে গেরিলাদের অবস্থান দেখানো হয়। তাদের কাছে স্বল্প অস্ত্র ও সরঞ্জাম ছিল। তবে তারা অনেক বৃহৎ পরিসরে অপারেশন চালাচ্ছিল। তাদের দখল করা বন্দুক, গোলাবারুদ এবং মোটর ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্যাবহার করতে দেখা গেছে। একটি পূর্ণ বেসামরিক প্রশাসন গেরিলা লাইন অপারেটিং করছে বলে জানানো হয়।

৩৬.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ঢাকা থেকে আহমেদ নাজুমুদ্দিন
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
– উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

০১১ ঢাকা ফিল্ডে একটি দিনের আকাশ যুদ্ধের পড় গতকাল বিকেল পর্যন্ত আবার ১১০ টি এয়ার এটাক হয়েছে। গতরাতে ০২৩০ টায় ইন্ডিয়ান বিমান বাহিনী ঢাকা শহরে আক্রমণ করেছে। আমি ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে বোমার শব্দ শুনতে পাই কিন্তু ক্ষতির কোন খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সূত্র জানিয়েছে যে ভারতীয়রা কুমিল্লা জেলার আখাউরা ও ময়মনসিংহ জেলার কামালপুর ও উৎরে দিনাজপুরে যুদ্ধ সীমান্ত বাড়িয়েছে। সোর্স জানায় পাকিস্তানী সেনারা আক্রমণ প্রতিহত করেছে।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও পূর্ব পাকিস্তানের বন্দর শহর চট্টগ্রামে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্ল্যাক আউট চলছে। ঢাকার সঙ্গে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সাথে যোগাযোগের সকল মাধ্যম সম্পূর্ণরূপে বিঘ্নিত হয়েছে এবং স্বাভাবিক জীবন থেমে গেছে। দোকান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও অন্যান্য অফিস, বন্ধ রয়েছে। ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র গত রাতে ভারতীয় বিমান ও স্থল হামলা দেখিয়েছে। বিমান হামলা, বিমানঘাঁটি, ধ্বংসপ্রাপ্ত প্লেন এবং বন্দী পাইলটদের দেখানো হয়েছে। স্থানীয় কাগজপত্র যুদ্ধের বড় খবর দিয়েছে। যশোর, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ভয়ানক যুদ্ধের খবর এখনো আসছে।

৩৭।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রেস এর উপর আলোচনা
৭ ই ডিসেম্বর ১৯৭১
ইভান চার্লটন সম্পাদিত (এস)

ব্রিটিশ প্রেস আজ ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের ব্যাপক কভারেজ দিয়েছে। বড় বড় পত্রিকায় সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে।

ডেইলি টেলিগ্রাফ বলে যে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” হিসেবে মিসেস গান্ধি পূর্ব বাংলাকে সম্বোধন করার ভারতের সিদ্ধান্ত ঘোষণায় মিসেস গান্ধী আরো তার অবস্থান আরও স্পষ্ট করলেন। কাজেই এখন বিনা দ্বিধায় আমরা বাংলাদেশের শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করতে পারব এবং আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ ‘নাক গলানো’ হিসেবে বিবেচিত হবে না। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বিবেচনায় ভারতের পলিসি যুক্তিযুক্ত। মিসেস গান্ধিকে সেই ক্রেডিট দেয়া উচিৎ। তিনি বলেন রাজনৈতিক কোন সমাধানে পৌঁছাতে না পারায় সেই মার্চ থেকে শুরু হওয়া শরনার্থি সমস্যা খুব ভারি হয়ে আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে।

টেলিগ্রাফ বলে ভারতকে ফলো করার সঠিক প্রতিনিধি হবে রাশিয়া। হয়ত আরও ১২ টি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ আগে এগিয়ে আসতে পারে। চায়না পাকিস্তানের সমর্থক কিন্তু যদি একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয় তাহলে এগিয়ে আসতে পারে। ওয়াশিংটন তার যথারীতি ভারত-বিরোধী অবস্থানের কারণে স্বীকৃতির বিরোধিতা করবে। বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর জন্য শুধু ভারতকে দোষী করলেই হবে না এবং সাহায্য বন্ধ করলেই চলবে না। কারণ মাসের পর মাস এখানকার শান্তি হুমকির মুখোমুখি আছে – জানায় টেলিগ্রাফ।

গার্ডিয়ান সম্পাদকীয়তে বলা হয় “জনাব নিক্সন হয়ত সম্পূর্ন বিজয় পছন্দ নাও করতে পারেন। চীন এটা ঘৃণা করতে পারে। কিন্তু সত্য পরিষ্কারভাবে উদ্ভাসিত হবেই”। গার্ডিয়ান মন্তব্য করে, বাংলাদেশ, যে অঞ্চল রক্তস্নাত ও জন্মের জন্য মরিয়া – সে বাস্তবতা এখন আর দূরে নয়।

এটা যুদ্ধের প্রথম প্রধান ট্রফি কিন্তু গার্ডিয়ান যুক্তি দেয় যে ভারতীয় বিজয় আরও প্রশ্ন তৈরি করবে। বাংলার স্বায়ত্তশাসন একটি ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য চাহিদা। কিন্তু সেটা পাকিস্তানের ঘোর শত্রু দ্বারা ভূষিত করা যাবে না। এটাকে একটি পুতুল রাষ্ট্র করা যাবে না। তাই বাংলাকে তার নিজের সমস্যার সমাধানে তার নিজস্ব নেতা দরকার।

টাইমস বলছে ভারত পূর্ববাংলার রাজনৈতিক সমস্যার একটি সামরিক সমাধান চাইছে কিন্তু তার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। এটা ঠিক যে ভারত বলেছে যে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। এই প্রচারের ফলে এখন পর্যন্ত অস্বীকৃত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যৌক্তিক মনে হতে পারে।

যদি তা দ্রুত করা হয় তাহলে ভারত ১৯৬২ সালের চীনা অনুকরণ করার চেষ্টা করতে পারে এবং এটি কোন যুদ্ধ ছিল না বলে ঘোষণা দিতে পারে। আর সেই সমাধান সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়ানরা নিরাপত্তা পরিষদে স্টোনওয়াল হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য এরকম কিছু নাও ঘটতে পারে। পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের একশন থামবে না যদি এমনকি যদি পূর্ব পাকিস্তান পদদলিত হয়েও যায়।

এখানেই বিপদ নিহিত। একারণেই এদেরকে আলাদা করা এবং যুদ্ধ শেষ করা কঠিন হবে। তবে জাতিসঙ্ঘ আশা করতে পারে আপাতত যুদ্ধের পরিবর্তে কোন রকম একটা বোঝা পড়ায় আসা যায় কিনা। যাতে করে শেষ পর্যন্ত ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ ঠেকানো যায়।

৩৮.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত / পাকিস্তান সম্পর্কে ব্রিটিশ সংবাদপত্রের পর্যালোচনা
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

ব্রিটিশ প্রেসের অনেক প্রতিনিধিদের প্রতিবেদন এসেছে।
ডেইলি টেলিগ্রাফ এর পিটার গিল কলকাতা থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি বলেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনী যশোর দখল করে খুব গুরুত্তপূর্ন অর্জন করেছে। পিটার গিল বলেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ড পাকিস্তানি বাহিনীকে ধোঁকা দিয়েছিল এই বলে যে এই শহর দখলের চেষ্টায় কোন ফল নেই; শুধু শুধু রক্তপাত মাত্র। কিন্তু ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ গতকাল কলকাতায় বলেছেন ভারতীয় কৌশল ছিল মূলত সব এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনা সরানো। পিটার গিল রিপোর্ট করেছেন যে পাকিস্তানি বাহিনীর গেরিলাদের হাতে পড়ার চেয়ে একটি নিয়মিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পছন্দ করছে। ক্লেয়ার হলিংওর্থ শহর থেকে নারী ও শিশুদের উদ্বাসন ব্যবস্থা করতে জাতিসংঘের প্রচেষ্টার ওপর নজর দেন। জনাব পল মার্ক হেনরি, জাতসঙ্ঘ সহকারী মহাসচিব রেডক্রসের এখতিয়ারভুক্ত হয়ে ঢাকায় একটি নিরপেক্ষ অঞ্চল করতে চাচ্ছেন। ক্লেয়ার রিপোর্ট করেন যে ঢাকায় যখন বিমানহানার শব্দ হচ্ছে তখন সাধারণ মানুষ তেমন শঙ্কিত হচ্ছেন না কারণ তারা জানেন ভারতীয়রা মূলত মিলিটারি স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করছে।

৩৯.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
নিউজনোট: ভারত ও পাকিস্তান
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
– মার্ক টালি

গতকাল, ব্রিটিশ লেবার পার্টির আন্তর্জাতিক কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে একটি জরুরী রেজল্যুশন পাশ করে যা পাকিস্তানের জোরালোভাবে সমালোচনামূলক ছিল। রেজল্যুশন বলে যে বর্তমান সংঘাতের কারণ হচ্ছে দেশটির পূর্ব শাখার মানুষের দ্বারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধান দরাদরি করতে পাকিস্তান সরকারের অস্বীকার। রেজল্যুশনে এছাড়াও ভারত বা পাকিস্তানে কোন অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করতে সব দেশের প্রতি আহ্বান জানান হয়। লেবার পার্টির আন্তর্জাতিক কমিটি একটি পাঁচ দফা পরিকল্পনা করেছে
যা উভয় পক্ষের প্রতি যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করতে আহ্বান করে। এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং একটি রাজনৈতিক সমাধান যা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সন্তস্ট করবে সেই আবেদনও জানানো হয়।

রাজনৈতিক সমাধানের পরে উদ্বাস্তুদের সুশৃঙ্খল ভাবে ফিরে আসার জন্য ব্যাবস্থা করতে হবে। এবং বিশ্বের সাহায্য ব্যাপক পরিমাণে বাড়াতে হবে। কমিটির সকল সদস্যদের মতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারটি আপাতত স্থগিত রাখা হোক কারণ এটি যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের প্রচেষ্টার বিপরীতে যেতে পারে। পাকিস্তানের নিন্দা সত্ত্বেও, লেবার পার্টি মনে করে তাদের এই রেজল্যুশন পাশ করানো উচিৎ। অন্তত সরকারের নীতি সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য।

ব্রিটিশ সরকার পরিষ্কারভাবে ভারত ও পাকিস্তানের উপর যতটা সম্ভব প্রভাব বজায় রাখতে চেষ্টা করছেন। কূটনৈতিক সূত্র মতে, ব্রিটেন স্পষ্টভাবে ভারতে এইড বন্ধ করার ব্যাপারে আমেরিকাকে ফলো করতে যাচ্ছে না। ব্রিটিশ সরকার দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দিতে চাচ্ছেনা। সাধারণ পরিষদের ভোট না দেয়া ১০ টি দেশের মধ্যে ব্রিটেন একটি যারা উভয় পক্ষকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য আহ্বান করেছে। ব্রিটিশ সরকার নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় ভারতীয় বা পাকিস্তানি কারো পক্ষে অবস্থান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় নাই। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের আপসের পথ খুঁজে বের করার আশা যাতে ছেড়ে না দেন সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

৪০.
এশিয়া সম্পর্কে আলোচনা
ঢাকা থেকে আহমেদ নিজামুদ্দিন
১০ ই ডিসেম্বর ১৯৭১
– মার্ক টালি সম্পাদিত (এস)

এটি ঢাকা থেকে নিজামউদ্দিন আহমেদ থেকে পাওয়া। এটা গতকাল সকালে পাঠানো হয়েছে।
(বৃহস্পতিবার সকালে)

অবরোধ ও যোগাযোগের সব মাধ্যম ভেঙ্গে পড়ায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ও অভাব বেড়েছে। ঢাকা থেকে সকল ডাক সেবা বন্ধ। কয়েকটি শহর ও জেলা সদরে টেলিযোগাযোগ বাদে বাকি সর্বত্র স্থগিত হয়ে গেছে। শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি , বাস ও পাবলিক বাহন চলছে না। তবে সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার গাড়ি রাস্তায় আছে। পেট্রোলের সীমাবদ্ধতা থাকায় তা সরবরাহ করা হচ্ছে। লবণ, কেরোসিন তেল, সরিষার তেল এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য খোলা বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। সরকার নগরবাসীর সাপ্তাহিক খাদ্য রেশন এক চতুর্থাংশ কমিয়েছে। চিনি ও চাল উচ্চ দরে বিক্রি হচ্ছে।

শহর বাজারে মাছ ও মাংস সরবরাহ অপর্যাপ্ত। দোকান এবং অফিস দুপুর ২ টায় বন্ধ হয়। ব্যাংকিং সেবা অন্যান্য শিল্প বিমান অভিযানের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। তবে সাধারণভাবে মানুষ বিমান যুদ্ধ অনেক উপভোগ করে। সংবাদপত্র ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় সীমাবদ্ধ আছে।

৪১.
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত / পাকিস্তান এর উপর ব্রিটিশ প্রেস রিপোর্ট
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমে আজ সকালে জাতিসঙ্ঘের ব্যাপারে অনেক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এবং আরও আলোচিত হয়েছে যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একটি শান্তিনিষ্পত্তির জন্য বিবেচনা করতে পারেন। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর ভবিষ্যত অনিশ্চিত। পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক গভর্নর এর সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আলী খান পাকিস্তানি বাহিনী প্রদেশ থেকে প্রত্যাহারের জন্য আলোচনা শুরু করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজি এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিজে ভেটো দিয়েছিলেন। সকালের খবরের কাগজের রিপোর্ট বলে মেজর জেনারেল ফরমান আলী খানের অবস্থান সন্দেহজনক। ক্লেয়ার ঢাকা থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ এ রিপোর্ট করে জানান অফিসার সম্ভবত গৃহবন্দী আছেন।

ক্লেয়ার জানান এটা গতকাল অনুমান করা হয় যে কমপক্ষে ৫০০০ পাকিস্তানি সেনারা এখনো ঢাকা রয়ে গেছে। এবং এটি প্রত্যাশিত যে ভারতীয় বাহিনী পরবর্তী ২ দিনের মধ্যে শহর দখল করে নেবে।

নয়া দিল্লি থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ এর ডেভিড লোসাক জানান চীন ও পাকিস্তান চাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সরিয়ে নিতে। ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে চীন ও পাকিস্তানের হাই কমান্ড কিছু উদ্ধারকারী জাহাজ গাঙ্গেয় বদ্বীপে সমবেত করেছে। ডেভিড জানান এটা ধারণা করা হচ্ছে যে, এই জাহাজ যাতে চীনা পতাকা উড়ছে – এগুলো পাকিস্তানি সেনাদের সরিয়ে নিতে এসেছে। জানা যায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে পাকিস্তানের ৭০০০০ শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বেঁচে যাওয়া অনেকে গঙ্গা পোর্ট হয়ে বার্মার দিকে যাবার পথ তৈরি করছেন। লোসাক জানান ঢাকা ভারতীয় ইউনিটের উল্লেখিত প্যারাশুট অবতরণের কারণ আক্রমণ করা নয় বরং ঢাকা থেকে পালানর রাস্তা ধ্বংস করা – যাতে করে পোর্টের দিকে পাকিস্তানী সৈন্যরা পালিয়ে যেতে না পারে। lOsak janan ze ভারত সরকার উদ্ধার অভিযানে চীনা হস্তক্ষেপের কারণে চিন্তিত।

টাইমস পত্রিকায় হেনরি স্ট্যানহোপ কলিকাতা থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি যশোরে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার ওপর রিপোর্ট করেছেন। সরকারের প্রথম কাজ যুদ্ধ ট্রাইবুনাল করে যারা পাকিস্তানি সেনা শাসকদের সঙ্গে সহযোগী ছিল তাদের বিচারের ঘোষণা দেয়া হয়। তিনি জানান মুক্তিবাহিনী স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর সাথে মিলে নাগরিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করছে। স্ট্যানহোপ জানান যে ভারতীয় সেনাদের ব্যাবহার ভালো ছিল এবং তাদের কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ শোনা যায়নি।

একজন গার্ডিয়ান প্রতিনিধি, ওয়াশিংটন পোস্টের লরেন্স স্টার্ন, যশোর থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি জানান ইন্ডিয়ান ও বাংলা শহরগুলোতে মানুষ সবচেয়ে বন্ধুসুলভ অবস্থায় আছে। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যশোরে একটি বক্তৃতায় বলেন “যারা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে তাদের আমরা সহ্য করব না।’ জ্যাকসন বলেন যে ভারতের আগ্রহ হচ্ছে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তাকে ভেঙ্গে ফেলা তবে পশ্চিম পাকিস্তানকে নয়।

৪২।
এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা
ভারত / পাকিস্তান সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রেস রিপোর্ট
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
উইলিয়াম ক্রলি সম্পাদিত (এস)

আজ সকালের পত্রিকায় গতকালের ঢাকায় ভারত ও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডারদের দ্বারা আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের খবর বড় করে প্রকাশিত হয়। কিছু কিছু পত্রিকা আত্মসমর্পণ সনদের পূর্ণ টেক্সট ছাপায়। সেখানে বলা আছে বিদেশী নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের পূর্ণ সুরক্ষা দেবে ভারতীয় সেনাবাহিনী।

নিউ ইয়র্কে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব ভুট্টোর সঙ্গে একটি সাক্ষাতকার টাইমসে প্রকাশিত হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস নিউজের হেনরি ট্যানার জানাচ্ছেন যে ভূট্টো সাহেব মনে করেন পাকিস্তানের উচিৎ ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়া এবং পূর্ব বাংলার ও ভারত সরকারের বিদ্রোহীদের সমস্যা সমাধানে একটি স্থায়ী বন্দোবস্তর ব্যাবস্থা করা।

তবে জনাব ভুট্টো জানান যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের চূড়ান্ত ক্ষতি স্বীকার করেন নি এবং তিনি বলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা অল্পদিনের মধ্যেই ভারতীয়দের গোলাম হয়ে কাজ করতে পারে। তিনি বলেন, আজ না হোক কাল যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন ছিল।

এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছিল নিছক পাগলামি এবং পাকিস্তানের সমস্যা এতে সমাধান হত না।
আরেকটি রীপোর্টে জানা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ বিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে। এবং পাশাপাশি পশ্চিমে ভারতের যুদ্ধবিরতিকেও স্বাগত জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধবিরতির ঘটনায় প্রভাবক ছিল না।

ফাইনানশিয়াল টাইমস পত্রিকায় রবার্ট গ্রাহাম একটি বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তিনি নয়া দিল্লীতে অবস্থান করছেন। তিনি পূর্ব অঞ্চলে তাদের বিজয়ের ভবিষ্যৎ ও তাদের স্বীকৃতি দেয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে ভবিষ্যৎ সমপর্ক নিয়ে লিখেছেন। ভারত বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবে না কিন্তু কিন্তু ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের উপর তাদের ঘনিষ্ঠতা নির্ভর করবে। রবার্ট গ্রাহাম বলেছেন, নয়াদিল্লি যতটা সম্ভব আর্থিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন দেবে।

দ্য গার্ডিয়ান একটি ছোট প্রশ্ন করেছে। বাংলাদেশের নাগরিক যারা হবে তাদের কি নামে ডাকা হবে? লন্ডনে চারজন বাংলার অধ্যাপক জানিয়েছেন “বাংলাদেশিয়া” বলা যেতে পারে। কিন্তু লন্ডনেঢ় বাংলাদেশ মিশন সেটিকে “বাংলাদেশী” হিসেবে সংশোধিত করে।