নিউইয়র্ক টাইমস, সোমবার, জুলাই ৫, ১৯৭১
দক্ষিণ এশিয়া – দুর্যোগের পদধ্বনি
চেস্টার বোয়েলস
এসেক্স, কানেটিকাট – দুইটি অসম্ভাব্য উন্নয়ন সংঘঠিত নাহলে, দক্ষিন এশিয়া একটি দুঃখজনক ও অনাবশ্যক যুদ্ধের আসন্ন বিপদের সম্মুখীন। এগুলো হচ্ছেঃ প্রথমত, ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার কতৃক (পূর্ব পাকিস্তানে) নিজস্ব প্রজাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্য্যক্রম পরিহার করা এবং এমন একটি সিদ্ধান্তে সম্মত হওয়া যাতে ভীত ও গৃহহীন শরনার্থীদের ভারতে না যেতে হয়। দ্বিতীয়ত, ইতোমধ্যে ভারতে আশ্রিত প্রায় ছয় মিলিয়ন শরনার্থীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ব্যাপক প্রচারনা চালানো।
ভারতীয় সরকার এইসব নিঃস্ব এবং ভীত মানুষদের খাদ্য, চিকিৎসা সহায়তা এবং আশ্রয় প্রদানে দৃঢ় প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে ভারত সরকারকে ১০ মিলিয়নের বেশি খরচ করতে হচ্ছে এসব শরনার্থীদের পেছনে এমন একটা সময়ে যখন কিনা ভারত বিশ্বব্যাংক ও এর সহযোগীদের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ও কানাডা) কতৃক আর্থিক সহায়তা অনেক কম পাচ্ছে, উপরন্তু এ বছরই ভারতকে পূর্ববর্তী ৫০০ মিলিয়নের ও বেশি ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
এসব অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা রাজনৈতিক কর্মকান্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রধানমন্ত্রী গান্ধী জোর দিয়ে বলেন, “শরনার্থীদের মধ্যে মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দুসহ সকল রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ আছে”। কিন্তু রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সমগ্র পুর্ব পাকিস্তান জুড়ে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর বেশি নির্যাতন করছে। যদি এটা সত্য হয় তাহলে ভারতের ৬৫ মিলিয়ন মুসলিম সংখ্যালঘু নিয়ে একটা চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হবে। ফলশ্রুতিতে, ভারত ভয় পাচ্ছে স্বাধীন পুর্ব বাংলা যদি পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদীরা বৃহত্তম একক উপাদান, এর সাথে মিলে একটি একক বাঙ্গালী জাতি গঠন করে তাহলে তা চীনা চক্রান্ত ও পরাভাবের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে।
সাম্প্রতিককালে, ভারতীয় পার্লামেন্টের এক বক্তৃতায় মিসেস গান্ধী দাবি করেন, “এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা নয় – যেমনটা অনেকেই ভাবছেন। এটা পুরো দক্ষিন এশিয়ার শান্তির জন্য হুমকি স্বরূপ। শত শত নয়, হাজার হাজার নয় – এতো লক্ষ লক্ষ মানুষকে অস্ত্রের মুখে জোর জবরদস্তি করে দেশ ছাড়া করার অধিকার কি পাকিস্তানের আছে? এটা একটা চরম অসহনীয় পরিস্থিতি। আমাদের সরকারের ভুল থাকতে পারে কিন্তু ভীত নয়। সরকার এমন ঝুঁকি নিতে ভয় পাবে না যে ঝুঁকি প্রয়োজনীয়”।
শীঘ্রই সম্ভাব্য যেসব ঘটনা আমাদের সম্মুখীন হতে পারে সেগুলো বেশ আতঙ্কজনকঃ (১) ভারত শরনার্থী ঠেকাতে দৃঢ় প্রচেষ্টা চালাবে, বর্তমান শরনার্থীদের তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠাবে এবং পুর্ব পাকিস্তানে দুর্বল চরম বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা ব্যাহত করে সৈন্যদের হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের দিকে ধাবিত করবেঃ (২) আশা করা যাচ্ছে তখন কাশ্মির ও ভারতের পাঞ্জাব আক্রমন করে পাকিস্তান হয়তো এর বদলা নিবে; (৩) চীন ভারতকে চূড়ান্ত শর্ত দিতে পারে (যেমনটা ১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাসে পুর্ব পাকিস্তান যুদ্ধের শেষের দিকে দিয়েছিল); (৪) তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতীয় অবস্থানের সমর্থনে চীনকে বাধা প্রদান করবে এবং উদ্দীপনা বাড়তে থাকবে।
বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছি ভেবে অনেকেই হয়তো এসব দৃশ্যকল্পকে উড়িয়ে দিতে পারেন। আমার মতে এটা খুব বাস্তব একটা সম্ভাবনা এবং এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে এটা সম্ভাব্যতায় রুপ নেবে। মিসেস গান্ধীর সরকার ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের সঙ্কট নিরসনে দায়িত্ব পালন করছে, কিন্তু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ দ্রুত ভারতকে সহনসীমার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশ্বসম্প্রদায়কে জাতিসংঘের সরাসরি উদ্যোগে বা অন্য যেকোন উপায়েই হোক এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে সেটা অবশ্যই অনৈতিক এবং অমানবিক, এর বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো এবং বন্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ছয় মিলিয়ন শরনার্থীর দায়-দায়িত্ব থেকে ভারতকে অব্যাহতি দিতে হবে। একটা গণতান্ত্রিক দেশ যা কয়েক মাস আগেও অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছেছিল- এই দীর্ঘ দুর্ভোগ আর সংগ্রামে সেটা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না; কেননা এই পরিস্থিতির জন্য তারা দায়ী নয়।
একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, যতক্ষন না পর্যন্ত (পশ্চিম) পাকিস্তান পুর্ব পাকিস্তানের সাথে একটা রাজনৈতিক বোঝাপড়া এবং তাদের নায্য পাওনার নিশ্চয়তা না দিবে ততদিন পাকিস্তানে আর্থিক সহয়তা বন্ধে বিশ্ব ব্যাংক ও সহযোগীরা সবাই (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত) সম্মত হয়েছে।
মার্চের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে সংগ্রামের শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র (পশ্চিম) পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জামসহ কার্গো জাহাজে পাঠিয়েছে – যা কেবল পূর্ব পাকিস্তানে তার নিজের লোকদের প্রতি কিংবা ভারতের বিপক্ষে ব্যবহার করতে পারে পাকিস্তান। পাকিস্তানে কোনোরকম যুদ্ধাস্ত্র পাঠানো হবে না- এই মর্মে কংগ্রেসকে পুরোপুরি আশ্বস্ত করার সত্ত্বেও এই পদক্ষেপ নিলো যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমদিকে এটাকে শুধু ‘যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি আমলাতান্ত্রিক ভুল হিসাবে মেনে নেওয়া হয় যা আমেরিকার নীতির সাথে যায় না। যাহোক, কয়েকদিন আগে প্রমাণ পাওয়া যায় যে এটা কোনো দুর্ঘটনাবশত ভূল ছিলো না বরং এটি একটি ইচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত।
যদি প্রকৃতপক্ষে এটা সত্য হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারো এশিয়াতে ভয়ঙ্কর একটা ভুল করলো। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূল সিদ্ধান্তকে ক্ষমা বা সমর্থনে অজুহাত খুঁজে পেতে ইতিহাসবিদদেরও হয়তো (এমনকি ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকেও) বেগ পেতে হবে।
*** চেস্টার বোয়েলস, “প্রতিশ্রুতি রাখুন” বইয়ের লেখক, ১৯৬৩-৬৯ ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।