সম্পাদকীয়
সংবাদ
২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
রাজশাহীতে পুলিস ও সামরিক বাহিনীর গুলীবর্ষণে গত মঙ্গলবার সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজনপ্রিয় অধ্যাপক ডঃ জোহাসহ তিন ব্যক্তি নিহত হওয়ার খবর মর্ম-বিদারক। গত তিনমাস যাবৎ এবং বিশেষ করিয়া গত এক মাস যাবৎ দেশব্যাপী গণআন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গকে বুলেট ও বেয়নেট দ্বারা আটকাইবার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় মাতিয়া বৰ্তমান শাসকচক্রের ধারক ও বাহকেরা যে চূড়ান্ত নির্যাতনমূলক ব্যবস্থাকে কায়েম রাখিয়াছে, রাজশাহীর ঘটনা তাহারই নিদর্শন। বস্তুতপক্ষে আজ সারা দেশে সরকারের তরফ হইতে সকল গণতান্ত্রিক শক্তির সহিত আলাপ-আলোচনার মারফত সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দেওয়ার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে পিষিয়া মারার জন্য সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হইয়াছে। এই দ্বিমুখী আচরণের মধ্যে কি রহস্য আছে আমরা জানিনা। তবে এ সম্বন্ধে সরকারী কর্তাদের কোন নিছক কৈফিয়ত জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবে না। কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে দুই জন বন্দীর রহস্যজনকভাবে গুলীবিদ্ধ হওয়ার এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুর ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবার কোন উপায় কি কর্তৃপক্ষীয়েরা দেশবাসীর সামনে রাখিয়াছেন ? কথায় কথায় গুলী, কথায় কথায় সেনাবাহিনী নিয়োগ এবং দিনের পর দিন কারফিউ জারী রাখিয়া রুজিরোজগারহীন নাগরিকবৃন্দকে নানাভাবে নিগৃহীত ও অপদস্ত করার সঙ্গে সঙ্গে পাইকারীভাবে মারপিট এবং মিছিলের উপর যখন তখন গুলী করিয়া লোক মারার ব্যবস্থা পরিস্থিতির শুধু অবনতিই ঘটাইতেছে। এই ধরনের আচরণ দ্বারা তিক্ততার আবহাওয়াকে তিক্ততরই করা হইতেছে। এইসব আচরণ জনসাধারণের প্রতি প্ররোচনা স্বরূপ। গত কয়েকমাসের প্রত্যেকটি পর্যায়ে দেখা যাইবে নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক গোয়ার্তুমি পরিস্থিতিকে করিয়া তুলিয়াছে। আমরা এই বন্ধ্যা ও গোয়ার্তুমির নীতি হইতে নিবৃত্ত হইবার জন্য বারবার সরকারকে আহ্বান জানাইয়াছি। আজও সেই আহ্বানই জানাইতে চাই। অবস্থার উন্নতি করিতে হইলে নির্যাতনমূলক নীতির আশ্রয় ছাড়িতে হইবে।
আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গণদাবী পূরণের জন্য রাজী থাকার মনোভাব সরকারের আছে বলিয়া সরকারী কর্মকর্তারা মুখে যে কথা বলিয়াছেন, তাহার প্রমাণ দিতে হইবে আচরণে। জনসাধারণকে শায়েস্তা করার যে মনোভাব গত দশ বছরের নির্যাতনমূলক আচরণে প্রকাশ পাইয়াছে উহা আজ একেবারেই ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। উহাকে পরিহার করিতে হইবে। আলাপ-আলোচনার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করিতে হইলে যে সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করিতে হইবে, তাহার দায়িত্ব মূলতঃ সরকারের। রাজবন্দীদিগকে কারাগারে রাখিবার বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবন করিয়া, নিরাপত্তা আইন এবং উহার মতো অন্যান্য অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বহাল রাখিয়া কিংবা কায়েমী স্বার্থের একচোখো দৃষ্টিতে বিভিন্ন বিষয় দেখিয়া সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি তাঁহারা করিতে পারিবেন না। সরকার ষড়যন্ত্র মামলাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিয়া অনায়াসেই উহা প্রত্যাহার করিয়া লইতে পারেন এবং এই প্রত্যাহার পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাইবে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহারা নিরাপত্তাবন্দীসহ অন্যান্য সমস্ত রাজবন্দীকে একটা ঘোষণা দ্বারা মুক্ত করিয়া নিয়া আলাপ-আলোচনার উপযুক্ত আবহাওয়া এই মূহূর্তেই সৃষ্টি করিতে পারেন। তাঁহারা এই সব করণীয়কে চাপা দিয়া বৃথাই সময় নষ্ট করিতেছেন।
সরকার সংগ্রামী জনগণের রায় মানিয়া লইতেছেন, এই কথাটা ঘোষণা করিয়া পরিবেশকে কুয়াশামুক্ত করিতে পারেন। কিন্তু সরকারী কর্মকর্তাদের কোন অংশ কিংবা কেহ যদি মনে করিয়া থাকেন যে, নির্যাতন দ্বারা জনসাধারণকে দাবাইয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে কোন একটা রফার মধ্যে টানিয়া লইয়া যাইতে পারিবেন, তবে উহা প্রকাণ্ড ভুল হইবে এবং তিক্ততা বৃদ্ধিতেই ইন্ধন যোগাইবে। গণতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দ আলাপ- আলোচনার মধ্য দিয়া গণদাবী আদায়ে বিমুখ নন। কিন্তু দেশবাসীকে তপ্ত– রাখিয়া তাহাদের পক্ষে আলোচনা চালানো কোনক্রমেই সম্ভব নহে। কারণ, গণতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দ যে দলেরই হউক না কেন তাঁহারা তাঁহাদের সাধ্যমতো দেশবাসীর দাবীকেই উপস্থাপিত করিতেছেন। সেখানে কোন নড়চড় হইবে না, হইতেছে না। আলাপ-আলোচনার পূর্বশর্তগুলি গণতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দের তরফ হইতে খোলা খুলি রাখা আছে। এই পূর্বশর্তগুলিকে এড়াইয়া যাওয়ার চেষ্টা করিয়া সরকার দেশবাসীর দুর্ভোগ বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে সংকটের পর সংকট সৃষ্টি করিতেছেন। এই অন্ধগলি হইতে বাহির হইবার প্রথম পদক্ষেপ হইবে নির্যাতনমূলক নীতি পরিত্যাগ করা।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯