দি উইকলি ইকনমিস্ট লন্ডন, ৩ এপ্রিল, ১৯৭১
অস্ত্রের মুখে একতা
পূর্ব পাকিস্তানের শেখ মুজিব কে আজ পরাজিত মনে হচ্ছে, কিন্তু তার থেকে বড় কথা হল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে বেসামরিক যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছে তা সে জিততে পারবেনা।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া উন্মত্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি শেখ মুজিবর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অচলাবস্থা ভাঙাকে বেঁছে নিয়েছেন। কেউ চিন্তা করেনি তিনি এটা করার সাহস করবেন এবং তাতে কোনভাবে বিজয়ী হবেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেনাবাহিনীর জোরালো ও রক্তাত্ত কর্তৃত্ব গ্রহণে উপরের হাত আছে। বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতিবেদনে যাদের সেনারা বহিষ্কারে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে দেখানো হয়েছে দ্রুত সময়ে ঢাকায় সেনা নিয়ন্ত্রনের দাবি সঠিক ছিল। এবং একটি দীর্ঘ যুদ্ধের পরে চিটাগাং মেইন পোর্টের ব্যাপারেও হয়ত একই ঘটনা সত্য হবে। সেখানে আর কতটুকু প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে সে ব্যাপারটি এখনো পরিস্কার নয়। সেনারা আপাত জয়ে তাড়িত হয়ে আকস্মিক ভাবে কিছু সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করেছে সেই সাথে ঢাকায় আওয়ামী লীগ সংগঠনের অগোছালো অবস্থার মধ্যে গোলাগুলি করেছে।
সে হয়ত প্রধান শহরকে ঠাণ্ডা করেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ধ্বংস করেছে এবং অনেক বাঙ্গালিকে আতঙ্কগ্রস্থ করেছে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সমস্যার কেবল শুরু। তাকে গ্রামাঞ্চলের পুলিশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, পূর্ব পাকিস্তানের বেশীরভাগ এলাকাই অসংখ্য জলপথ দ্বারা বেষ্টিত, এ ধরণের ভূখণ্ড প্রাত্যাহিক সৈন্যদের জন্য অসুবিধাকর হলেও গেরিলা যোদ্ধাদের প্রিয়।
পার্শ্ববর্তী পশ্চিম বাংলার মত পূর্ব বাংলারও চাষি বিপ্লবীর প্রচারক অংশ রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত শেখ মুজিবর রহমান আলাপালচনার মাধ্যমে শায়ত্বশাসনের প্রতিশ্রুতি ধরে রাখছে ততক্ষন পর্যন্ত তারা হয়ত শেখ মুজিবের ছায়াতলে চুপ থাকবে। কিন্তু সেই সাথে সেনারা যে রক্তক্ষয়ী যুক্তির সাথে এগোচ্ছে যে জুলুমকে শুধু জুলুম দিয়েই মেটাতে হবে তা হয়ত অকাট্য রয়ে যাবে। সম্ভবত এর সংখ্যা শুধু বাড়বে। সেই সাথে মে ও জুনে বর্ষার আগমনের সাথে সাথে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানির লেভেলও বাড়বে যা যে কোন সেনাবাহিনীর জন্যই দুর্গম কিন্তু স্থানীয়দের জন্য সুবিধা বয়ে আনবে। গেরিলারা সক্রিয় হয়ে উঠবে এতে কোন সন্দেহ নেই কারন সেনারা তাদের অনেক নেতাকে হত্যা করেছে। কিন্তু পূর্ব প্রদেশের ৭০,০০০ সেনাবাহিনীর অধিকাংশকে ঘিরে ধরার জন্য একটি অসংগঠিত প্রতিরক্ষার ছড়িয়ে পড়াটা যথেষ্ট। এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লজিস্টিক সাপ্লাই ও অতিরিক্ত শক্তি পেতে সমস্যা হবে।
গেরিলা কর্মকাণ্ডের হুমকির পাশাপাশি আরো সমস্যা রয়েছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার। তাকে প্রদেশের জীবন পেতে হবে, যা খুবই ধীর গতিতে আবর্তিত হচ্ছে এবং এর তিক্ত বিরক্ত জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা শাসনের আচ্ছাদনে আনতে হবে। এই তিক্ততার সাথে বেসামরিকদের প্রতি সেনাদের অবজ্ঞাও মিশ্রিত হয়েছে। অবশ্যই কিছু বাঙালি পাওয়া যাবে যারা সেনাশাসন মেনে নেবে কিন্তু বেশীরভাগই এর বিপক্ষে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হয়ত পাঞ্জাবিদের নিয়ে আসবে বেসামরিক চাকরি পরিচালনার জন্য এবং সেনাদের দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় কাজ করাবে। কিন্তু সে কোন গ্যারান্টি দিতে পারবেনা যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাতে চুপ থাকবে। এটা সম্ভবত হবে। কিন্তু সংখ্যালঘু বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ইতিমধ্যেই শেখ মুজিবের প্রদেশের সায়ত্তশাসনের ধারনায় সমর্থন দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে সম্ভবত সামরিক শাসন চলতে থাকবে এবং মিঃ ভুট্টো হয়ত এইসব পরিস্থিতে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন যা তাকে যেকোন মাপের ক্ষমতা গ্রহণ থেকে বিরত রাখবে।
যে বক্তব্যে শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেছে সেই একই বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পুনর্ব্যক্ত করেছে যে, তার উদ্দেশ্য একই আছে- ‘অবস্থা অনুমতি দিলে’ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির উপরে ক্ষমতা স্থানান্তরিত হবে। কিন্তু এই অনুমতি কবে মিলবে? এবং পূর্ব পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্য নির্বাচিত প্রতিনিধিই বা কে হবে? যদি শেখ মুজিবের কথা ওঠে তাহলে প্রেসিডেন্ট হয় তার সাথে আপোষে যাওয়ার আশা করতে পারে অথবা তাকে নতুন নির্বাচন করতে হবে। সায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতার টিকেট ছাড়া এবং কোনরকম নির্বাচন কারচুপি ছাড়া এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানে কাউকে ভোট জিততে দেখা কষ্টকর। এতে করে দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যদি পাকিস্তানের একতা ও সততার ব্যাপারে তার বর্তমান উক্তি না পাল্টায় তাহলে সে সেই দপ্তর কখনোই ছাড়তে পারবেনা যা সে মনেপ্রাণে ছাড়তে চায়।
আশা করা যায় একটি কঠোর সেনাশাসন জারি করে পরিস্থিতিকে ঠাণ্ডা করে সেই অবস্থায় নেয়া সম্ভব যেখানে প্রাদেশিক সায়ত্তশাসনের আলোচনা আবার শুরু করা যাবে। এই আশা নির্ভর করে আপনি কতখানি বিশ্বাস করেন তার উপর যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় বিশ্বাসের সাথেই আলোচনায় বসেছে নাকি সেনাবাহিনী তৈরি করার জন্য সময় কিনেছে। তার দুটোই করার প্রমাণ আছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যদি মনে না করেন, আলোচনা সবকিছু ঠিক করে দেবে তাহলে তার সাথে অমতে যাওয়া কষ্টকর হবে। শেখ মুজিবের জাতীয় সমাবেশে যোগদানের অবস্থা নিয়েই শুধু আলোচনা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শেখ মুজিবের ছয়-দফা দাবির আসল বিষয় নিয়ে কোন আলোচনাই হয়নি। এই ছয়-দফা অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবকে আজ অথবা কাল আলাদা করবে। ভারতের সাথে বিদেশি বানিজ্যের নিয়ন্ত্রণ পূর্ব পাকিস্তানে যেতে পারে যার প্রধান গুণই হচ্ছে স্বাধীন বানিজ্য নীতি। শেখ মুজিবের স্বায়ত্তশাসন চাহিদার কোন অর্ধেক পথ নেই। সুতারাং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে একমত হওয়া কঠিন নয়, আলোচনার মাধ্যমে হয় শেখ মুজিবের দাবীই সবকিছুর সমাধান অথবা কোন সমাধানই নেই। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সমাধানহীনতাকেই বেঁছে নিয়েছেন।
বাঙালি সহ্যের বাঁধ সেনারা সহজেই ভেঙ্গে দিতে পারে, এটাও একটা কারন বাইরের কেউ বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে অসম্মতি জানাতে পারে। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে গেরিলারা লক্ষণীয় সাহায্য পাবে। বুধবারে ভারতীয় সংসদে মিসেস গান্ধীর পরিচালনায় পূর্ব পাকিস্তানে জোর প্রয়োগের নিন্দা করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পূর্ব পাকিস্তানি “মুক্তি যোদ্ধাদের” পশ্চিম বাংলা ইতিমধ্যেই অস্ত্র ও আশ্রয় প্রদান করেছে, এর থেকে অধিক আগানোয় মিসেস গান্ধীর উপর চাপ রয়েছে। কিন্তু সরকারি সহযোগিতায় প্রকাশ্যে মিসেস গান্ধী ভারতীয়দের সতর্ক করে বলেন, “একটি ভুল পদক্ষেপ বা একটি ভুল শব্দ আমরা যা করতে চেয়েছি তার পুরো অর্থকে বদলে দিতে পারে”। কাজ ও কথার ব্যাপারে তার সচেতন থাকা উচিত। ভারতের সম্পৃক্ততা সন্দেহ করা হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালীদের প্রতি আরো কঠোর হয়ে পড়বে।
এতে কোন সন্দেহ নেই পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার গেরিলা সহযোগিতার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে মিসেস গান্ধী ভয় পাচ্ছেন। হিন্দু-মুসলিম এর জায়গায় যদি মাওবাদি ধারনা এসে পড়ে তাহলে তা পুরো যুক্ত বাংলার ভীত নড়িয়ে দিতে পারে এমনকি ভারতের স্বাধীনতাকেও। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ভারতীয় ৯০০ মাইলের সীমান্ত সিল করে দেওয়াটাও মিসেস গান্ধীর জন্য কষ্টকর; এবং বেসরকারি ভারতীয় সমর্থন পূর্ব পাকিস্তানি গেরিলাদের সাথে ক্লাসিক গেরিলা পদ্ধতি তৈরি করে ভারতীয় পশ্চাদভূমিকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করতে পারে।
আশ্চর্যজনক নয়, এই সঙ্কটাবস্থায় পিকিং থেকে কোন কথা নেই। সিদ্ধান্ত নিতে চাইনিজরা মনে হয় খুব কঠিন সময় পার করছে। একদিকে তারা কাশ্মির দখলে সেনা প্রস্তুতে সাহায্য করেছে, যে পন্থায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তারা উষ্ণ প্রশংসা পেয়েছে বিশেষ করে মিঃ ভুট্টোর কাছ থেকে। চাইনিজদের পশিম পাকিস্তানের সাথে কাছের লিঙ্ক রয়েছে হিমালয়ের মধ্য দিয়ে যা সম্প্রতি খোলা হয়েছে এবং সেটা বজায় রাখায় তাদের কৌশলগত আগ্রহ আছে, এই এলাকায় সবচেয়ে অনুকূল অবস্থা পাবার জন্য, যেখানে চারটি দেশ এক হয়েছে। অন্যদিকে, বাঙালি বিদ্রোহ “স্বাধীনতা যুদ্ধে” পরিণত হতে পারে যা পিকিং সাধারনত সমর্থন যুগিয়ে আসছে। অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলা প্রচারণায় মাওবাদী একটি বড় ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। কিন্তু চাইনিজদের বাঙালি সমর্থন মানে একটি আন্দোলনকে সমর্থন করা যেটা ভারতের সাথে তাদের কাছের সম্পর্ক তৈরি করবে যা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে চায়নার বিশেষ সম্পর্ককে বিপন্ন করতে পারে।
এই মুহূর্তে পিকিং জাতীয় স্বার্থ ও ভাবাদর্শগত স্বার্থের মধ্যকার পছন্দের মুখোমুখি হয়েছে। পুরো বিষয়টিকে উপেক্ষা করলে চায়না উভয়সঙ্কটে পড়তে পারে। আরো কষ্টসাধ্য হবে যদি বাঙালীদের কাছ থেকে সাহায্যের কল আসে। কিন্তু এই মুহূর্তে বাইরের সাহায্য শুধুমাত্র একটি বেসামরিক রক্তাত্ত যুদ্ধকে টানতে সাহায্য করবে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতিশীল বিদেশি সহানুভূতিশীলেরা তাদেরকে একটি ভালো পরামর্শ দিতে পারে যে, তার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কে তাড়া দিতে পারে একটি অমীমাংসিত গেরিলা যুদ্ধে পড়ার আগে বাঙালির সাথে আলোচনা পুনরায় আরম্ভ করার প্রস্তাব করতে।