You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.10 | কম্পাস, ১০ এপ্রিল, ১৯৭১, ক্ষমাহীন অপরাধ - সংগ্রামের নোটবুক

কম্পাস, ১০ এপ্রিল, ১৯৭১, ক্ষমাহীন অপরাধ

সমস্ত ভারত আজ বাংলাদেশ বা পূর্ব বঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে অভূতপূর্ব এক উদ্বেগের মধ্যে প্রকৃত সংবাদের জন্য উদগ্রীব। যে শয়তানি চক্র করে পূর্ব বঙ্গের নেতাদের উপর ও জনসাধারণের উপর এত অতর্কিত পৈশাচিক আক্রমণ করা হয়েছিল, তার পরিণামে কত যে নিরিস্ত্র নিরীহ জনসাধারণের প্রাণ গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। রাজশানি ঢাকা যে একটি শ্মশানে পরিণত হয়েছে এ সংবাদ আর চারিদিন থেকে বেরিয়ে আসছে। এত বড় ঐতিহাসিক ঘটনাকে চাপা দেয়া সম্ভব না। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর প্রভৃতি শহরগুলিতে এত মরা এখনো রাস্তায় পড়ে আছে যা এখনো সরানো সম্ভব হয়নি, সরাবার লোক ও নেই। ৫/৬ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে। কোন বড় আকারের যুদ্ধেও এত লোক মরেনা। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে এত বড় হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। পূর্ব বঙ্গের নবজাগ্রত যুব শক্তির একটা বিরাট অংশকে ওরা হয়ত শেষ করে দিয়েছে।

এতদসত্ত্বেও জল্লাদ ইয়াহিয়া খান ব্যার্থ হয়েছে। এই পাষণ্ড জেনারেলটি মনে করেছিল যে ২/৩ দিনের এক প্রচণ্ড আঘাতেই পূর্ব বঙ্গের মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব হবে, এবং সেই প্রচণ্ড অতর্কিত আক্রমণের প্ল্যান নিখুঁতভাবে তৈরি হয়েছিল। প্রতীটি আইন সভার সদস্যদের পেছনে সামরিক গুপ্তবাহিনির চরদের ছায়ার মত অনুসরণ করার ব্যাবস্থা করে। হয়ত এমনও হতে পারে নব নির্বাচিত সদস্যদের বেশিরভাগকেই ঐ ২৫ শের রাত্রিতে ধরে ফেলে এবং হয়ত হত্যাও করে ফেলে। রাত্রির অন্ধকারেই ইউনিভার্সিটি আক্রমণ করে প্রতিটি হলের ঘুমন্ত ছেলেদের নির্বিচারে হত্যা করে এবং অধ্যাপকেরাও রেহাই পান না। আর গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুণ ধরিয়ে দেয়। তারপরে কত কি পৈশাচিক কর্মকান্ড করে সমস্ত শহরের উপর, পড় পড় কয়েকদিন ও রাত্রি তার বীভৎস বিবরণ ক্রমশ প্রকাশ হবে।

এতদসত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান ব্যার্থ হয়েছে। ২/৩ দিন তো দূরের কথা, ২ সপ্তাহ পার হতে চলল, পূর্ব বাংলার নরনারীদের মেরুদণ্ড ভগ্ন করা সম্ভব হয়নি। তাদের প্রাণে আতংক ও ত্রাস সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। শহরগুলির উপরও সর্বত্র তাদের জুলুমই রাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি, ক্যান্টনমেন্টগুলিই তাদের হাতে – শহরগুলি হয় এখনো জনগণের হাতে , নয়ত পরিত্যাক্ত উভয়পক্ষে থেকেই। দিনাজপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, প্রভৃতি শহরগুলির উপর বোমারু বিমান থেকে বোমা ফেলাতে শত্রুপক্ষের শক্তির পরিচয় প্রকাশ পায়না। উক্ত শহরগুলি যে তাদের এখনো হাতছাড়া, এবং ধ্বংস করা ছাড়া তাদের প্রতিরোধ শক্তি নষ্ট করা সম্ভব নয়, এতে তারই প্রমাণ হয় মাত্র। জনসাধারণ যদি আর একটুও এই প্রতিরোধ বজায় রাখতে পারে, তবে এই যুদ্ধ শীঘ্রই একটা অচলাবস্থায় পরিণত হবে।

জনসাধারণের পক্ষেও কিছু ভুল ধারণা ছিল, তারাও হয়ত মনে করেছিলেন যে একমাত্র জনসমুদ্রের সাহায্যেই ইয়াহিয়া বাহিনীর ঘাটিগুলিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন – ২/১ সপ্তাহের মধ্যেই। তাড়া লক্ষে লক্ষে প্রাণ দিতেও তাই কসুর করেনি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রবলভাবে সজ্জিত আধুনিক এক বেপরোয়া নির্মম শত্রুপক্ষকে একমাত্র জনসমুদ্রের ঢেউ দিয়েই ভাসিয়ে দেওয়া যায় না, প্রত্যক্ষভাবে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এ সংগ্রামে জয় অর্জন করা সহজ নয়। জনসাধারণ তাই গ্রামদেশ ওঁ নদীনালা জঙ্গল পর্বতের উপরই ক্রমশ নির্ভরশিল হতে বাধ্য হচ্ছে। ২/১ সপ্তাহের সংগ্রাম এ নয়, ২/১ বৎসরের সংগ্রামের জন্যই তাদের প্রস্তুত হতে হবে, এই জ্ঞ্যান ইভিজ্ঞতা থেকেই সঞ্চিত হচ্ছে। যদি এই সংগ্রামকে দীর্ঘায়িত করা যায় হাজার হাজার গ্রামে মাঠে প্রান্তরে নদিতে ছড়িয়ে টেনে বিস্তৃত করা যায়, তবেই শত্রুপক্ষের সাপ্লাই লাইনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, তাকে জ্বলে কাদাটে পাকে জঙ্গলে কবর দেওয়া সম্ভব হবে।

শত্রুপক্ষই চেয়েছিল একপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে ওঁ যাবে শত্রুপক্ষের বিপদ তত বাড়তে থাকবে। বর্ষা এসে গেলে শত্রুপক্ষের ক্যান্টনমেন্ট ঘাঁটি থেকে বের হওয়াও বিপজ্জনক হবে। ততদিনে জনসাধারণের শক্তির পুনর্গঠন ওঁ পুনর্বিন্যাসের কাজ অনেকটা গুছিয়ে আনা সম্ভব হবে, কেন্দ্রীয় কমান্ড পুনর্গঠিত হবে, ভারত ওঁ পৃথিবীর সাহায্য পাওয়া সম্ভব হবে। তখন, এমনকি ক্যান্টনমেন্ট বা ঘাঁটিতে আবদ্ধ ওঁ আশ্রিত শত্রু সৈন্যদের উপর গ্রাম দেশ থেকে চারিদিক থেকে প্রতি আক্রমণ সংগঠিত করাও সম্ভব হতে পারে। মর্টার জাতীয় আগ্নেয় অস্ত্রের সাহায্যে এই ঘাঁটিগুলিকে চুর্ণ করে দেওয়া অসম্ভব হবে না। আমেরিকার মত একটা সুপার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকেই যদি ভিয়েতনাম এমন আবদ্ধ ওঁ নাজেহাল হতে হয়, তবে এই ক্ষুদে সাম্রাজ্যবাদীরা ইয়াহিয়া- ভুট্টূ খানেরা কতদিন সে শক্তির মোকাবিলা করতে পারবে?

ততদিনে পৃথিবীর জনমতও সোচ্চার হতে বাধ্য। এত বড় হত্যাকাণ্ড – যে পৃথিবীতে কোথাও ঘটেনি – তার বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া না হয়েই পারেনা। গণতান্ত্রিক পশ্চিমিরা , স্বাধীনতাকামী আফ্রো-এশীয় দেশবাসীরা, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির রাষ্ট্রসমূহ আজও তেমন সোচ্চার নয় দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। এইসব দেশের রাষ্ট্রনায়কেরাই তাদের নিজ নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ বুদ্ধির খাতিরে তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে না, প্রকৃত সংবাদও তাদের নিজ নিজ দেশের লোকদের পরিবেশন করছে না। এইসব রাষ্ট্রের ভীরুতা ওঁ সুবিধাবাদী নীরবতা তদ্দেশীয় জনসাধারণ খুব বেশিদিন সহ্য করবেন, এমন মনে করার কারণ নেই।

সুখের বিষয় বা আশার কথা এই যে, ভারতের সব রাজ্যের সকল জনতা এত বড় হত্যাকাণ্ড ওঁ বিশ্বাসঘাতক তাকে আজ বসদাস্ত করতে প্রস্তুত নয়। ভারতের প্রতি কোণে কোণে তীব্য প্রতিবাদ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। পূর্ব বঙ্গের লোকদের সাহায্য করার জন্য প্রাণ কেঁদে উঠেছে। এদেশের সরকারের পক্ষেও তা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। প্রাত তিন হাজার মাইল যে সীমান্ত আছে তার এপারে সর্বত্র এদেশের জনসাধারণ পূর্ব বঙ্গের লোকদের প্রাণে মারবার চক্রান্ত ব্যার্থ করবেই। যদি আমাদের কোন রাষ্ট্র বলে শক্তি থেকে থাকে সে রাষ্ট্রের যদি সামরিক কিছু শক্তি থেকে থাকে – তা যদি এত বড় হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধে কোন কাজে না লাগে তবে সে রাষ্ট্রের ওঁ সে সামরিক শক্তির কি প্রয়োজন, মানবতার উপর এমন বিশ্বাসঘাতকতা, গণতন্ত্রের উপড়ে এমন নির্মম আঘাত, আর এত বড় হত্যাকাণ্ড আমাদের হাতের সামনেই ঘটবে, আমাদের হাসখানাও তার প্রতিবাদে বাড়ানো হবে না – এই কি সভ্যতার দায়িত্ব? কোন একটি দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ, বড় বড় শক্তিগুলির অনুমতির জন্য প্রতীক্ষা, রাষ্ট্রসংঘ নামক একটা অপদার্থ নপুংসক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা অনিচ্ছা ইত্যাদি কোন কিছুর দোহাই দিয়েই আমরা আমাদের মানবিক কর্তব্যকে এড়িয়ে যেতে পারিনা। এ দায়িত্ব এড়ালে রাষ্ট্রসংঘ যাই বলুক, বড় বড় শক্তিমান রাষ্ট্রগুলির ভোয়ে যদি আমরা আমাদের কর্তব্য পালন না করি, তবে আমাদের নিজেদের স্বাধিনিতার কোন ঐতিহাসিক অধিকার থাকেনা, থাকা উচিত নয়। আমাদের রাষ্ট্র যদি কিছু নাও করে ভারতের জনসাধারণের হাতে সে দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং করছে। সেদিন (গত রবিবার) পেট্রোলের সীমান্ত অতিক্রম করে লক্ষ লক্ষ (সত্যি লক্ষাধিক) নরনারী যশোরের সংগ্রামী বাঙালি ভাইদের দেখতে যেভাবে অগ্রসর হয়েছিল, এপারের সীমান্তরক্ষিরা সে জনস্রোতকে বন্ধ করতে সাহস পায়নি। সেই লক্ষাধিক নরনারীরা হাতে কিছু না কিছু সাহায্য খাদ্য বস্তু বস্ত্র তেল ইত্যাদি ছিল। প্রত্যেকে নিজের হাতে সে সামান্য সামগ্রী ওপারের যোদ্ধাদের হাতে হাতে পৌঁছে দেবার সে অপূর্ব দৃশ্য জারাই দেখেছেন তাড়া অভিভূত হয়েছেন। এতে হয়ত সীমান্তের আইন লঙ্ঘন করা হয়েছিল, কিন্তু মানবিকতার চিরন্তন আইন তাতেই রক্ষিত হয়েছিল। আর কিসের আইন? আজকে পূর্ব বঙ্গে কোন রাষ্ট্র আছে, না তার কোন আইন আছে। একদল নরঘাতক দস্যু অকাতরে নিরস্ত্র জনতার প্রাণ হননে ব্যাস্ত সেখানে এ সভ্যতার উপড়ে আক্রমণ এ কোন দেশের কথা নয়। পৃথিবীর সকল মানুষের এখানে দায়িত্ব ও অধিকার আসে।

কিন্তু এখানেও আমরা সবাইকে সতর্ক করে দিতে চাই যে প্রাণ ঢালা উদ্বেল সহানুভূতি দিয়েও ঐ নরঘাতক দস্যুদের ভাসিয়ে নেওয়া যাবে না। ভারতীয় জনসমুদ্রের উদ্বেল এই সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকেও সুসংগঠিতভাবে নিয়জিত করতে হবে। বহুরকমের কাজ ও সংগঠনের মধ্য দিয়ে তাকে প্রবাহিত করতে হবে। এই তিন হাজার মাইল ব্যাপী বৃহৎ সীমান্তকে একটি সক্রিয় সুসংগঠিত শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। বৃহত্তর দায়িত্ব অদূর ভবিষ্যতে দেখা দেবে। পূর্ববঙ্গে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে – সে সময় নিজেরা না খেয়ে, আধ প্যাঁটা খেয়েও অ্যাডের বাঁচিয়ে রাখতে হবে, ওদের সংগ্রামী শক্তিকে উত্তরোত্তর সক্রিয় করে তুলতে হবে, ওদের মনোবলকে আরও দৃঢ় করতে হবে, একটা দীর্ঘায়ীত সংগ্রামের প্রয়োজনে যাবতীয় জিনিস জুটিয়ে দিতে হবে। প্রকৃত তথ্য পৃথিবীর জনসাধারণের কাছে উপস্থিত করে দিতে হবে। আমরা একাজ যোই করতে পারি, তাতে ভারতও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, ভারত একটা শক্তি হিসেবে আবার পৃথিবীতে গ্রাহ্য হবে। যে জাত যত বড় দায়িত্ব নিতে সাহস রাখে, সে জাতই তত বড় হয়। ভারতের আপামর জনসাধারণের প্রাণে আজ সে প্রেরণা উপস্থিত। একে গ্রাহ্য করা, একে সংগঠিত রূপ দেয়াই আজ ভারতীয় নেতৃত্বের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত।

– সম্পাদকীয়, কম্পাস, ১০ এপ্রিল ১৯৭১