নেপাল টাইমস | কাঠমান্ডু, ৩০ নভেম্বর ১৯৭১ | সম্পাদকীয় – অঘোষিত যুদ্ধে
ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্যদের বৈমানিক এবং ট্যাংক যুদ্ধের ভয়াবহতায় এখন ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধ আসন্ন প্রায় নিশ্চিত। বিশ্ব এখন দেখবে কিভাবে ঘনিষ্ঠ দুই দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা একটি “অঘোষিত যুদ্ধ” ঘোষণা করেছেন যা দুই দেশের মধ্যে চলছে এবং সে অনুযায়ী যে সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।
একতরফা যুদ্ধ পাকিস্তান প্রথমে নিজেরাই তাদের নিজের এলাকার একটি অংশে শুরু করেছিল যা পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা পরিচালিত। এটি কয়েক মাস পরেই একটি প্রতিরোধের যুদ্ধে পরিণত হয়। এই যুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘটছে। কিন্তু পাক শাসক এটিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে মনে করেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়ে তারা ভারতীয় ভূখণ্ডে আক্রমণ প্লেন ও ট্যাঙ্ক দিয়ে আক্রমণ করতে পাঠায়। কিন্তু প্লেনগুলো ভূপতিত করা হয়েছে এবং বেশ কিছু ট্যাংক ধ্বংস হয়ে গেছে এবং অনেক সামরিক সরঞ্জাম ভারতীয় সৈন্যদের দ্বারা বন্দী করা হয়। তারপর, পাকিস্তানি শাসকরা শঠকারী উপায়ে একটি পুতুল শাসন ইনস্টল করার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার চেষ্টা করে তাদের দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে। পিকিং এ দেখা করে আসার মাধ্যমে ভিলেন ভুট্টোর দেয়া সার্ভিসেও সামরিক শাসকেরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয় নি। তার রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হবার ইচ্ছাও অপূর্ণ রয়ে গেছে। ভুট্টোর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায় কিনা তাই এখন দেখার বিষয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিজেদের মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারা আসলে শক্তিশালী কোন শক্তির কাছে হারতে রাজি কিন্তু জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন এর ফলস্বরূপ যে বাহিনী গঠিত হয়েছে তার কাছে মোটেই নয় – এই বাহিনীর নাম মুক্তিবাহিনী । আর সেই উচ্চতর শক্তি ভারত ছাড়া অন্য কেউ হতে পারেনা। তাছাড়া, পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা এখনও ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে তাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার প্রতিশোধ নেবার স্বপ্ন দেখে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সামরিক শাসকরা তাদের দ্বারা পরিচালতএবং সংগঠিত নির্বাচনের ফল পুরো নিশ্চিহ্ন করতে চান। তারা, ২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর রাতে ঢাকার নাগরিকদের উপর ট্যাংক হামলা করে দশ মিলিয়ন মানুষকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে , এবং খুন, লুটপাট ও ধর্ষণ করে এই নির্বাচনের ফলাফলের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্ম
ও মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম ছিল এই নিপীড়নের রেজাল্ট। এখন সামরিক শাসকরা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতিনিধিদের নিশ্চিনহ করতে চাইছেন। জরুরি অবস্থা জারি এবং ভারতের বিপক্ষে উত্তেজনাকর কিছু রটানোর অজুহাত খুঁজে পেতে, তারা তাদের প্রচারণা শুরু করে এবং তার ফলস্বরূপ তাদের নিজেদের লোকদের দমন করার দ্বিতীয় পর্বের পরিকল্পনা আরম্ভ করে।
পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এই অদ্ভুত ইচ্ছা যে তারা নিজেদের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এই ব্যাপারটা বিশ্ববাসী কীভাবে দেখেন সেটা এক প্রশ্ন। গত এক বছরে পাকিস্তানের ঘটনাবলি বিশ্ববাসী বিশ্লেষণ করবে হয়ত। পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের নিজস্ব জনগণের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে জালেম ও নিষ্ঠুরের মত আচরণ করেছে , জনগণের অধিকার, জীবন ও সম্পত্তি ধ্বংস করে যুদ্ধের আবহ তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ববাসীর উচিৎ পাকিস্তানের প্রতি সংযম থাকার অনুরোধ করা – এবং তা অন্য কোন তৃতীয় দেশের কাছে নয়। ভারত, যে ১ কোটি শরণার্থীর ভার বহনের ক্ষেত্রে অসম্ভব সহ্য ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে; তাকে যারা অবরোধ প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষাদানে আগ্রহী তাদের আসল লক্ষ্য কী সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।