জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের কথা
পাকিস্তানের জোয়ারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কম্যুনিস্ট মুসলমানরাই শুধু ক্ষত-বিক্ষত হননি, তীব্র যন্ত্রণা সইতে হয়েছে জাতীয়তাবাদী মুসলমান নামে পরিচিত মানুষদেরও। আমরা তাে মওলানা আবুল কালাম আজাদের নামে মুহুর্মুহু জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উচ্চারণ করেছি, কিন্তু পাকিস্তানবাদীদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন হিন্দুদের ‘শো বয়’। এ-রকম ‘শাে বয়’দের সংখ্যা কম ছিল অবশ্যই, কিন্তু এঁরা কেউই গুরুত্বে খাটো ছিলেন না। আমাদের নেত্রকোনা অঞ্চলেও এরকম মানুষ দু’একজন ছিলেন। ছেচল্লিশে আমি এঁদের কাউকে দেখিনি, এমন কি নামও শুনিনি। অনেক পর দু’জনকে দূর থেকে দেখেছি, কথা বলার বা পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। এঁদের একজনের নাম মুকসেদ খাঁ, অন্যজন মিয়াফর। দু’জনকেই ব্রিটিশ-বিরােধী আন্দোলনের জন্যে পুলিশী নির্যাতন ও কারাযন্ত্রণা সইতে হয়েছে। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মুকসেদ খাঁ যুগান্তর দলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন বলে শুনেছি। এবং এ-কারণে স্বদেশী ডাকাতির প্রসঙ্গেও তার নামটি এসেছে। মিয়াফর ছিলেন দরিদ্র কৃষক। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরও তিনি কংগ্রেসী আদর্শেই অটল ছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে ময়মনসিংহ শহরে তাঁকে দেখেছি। নেত্রকোনা থেকে তিনি এসেছিলেন প্রখ্যাত কংগ্রেসে নেতা মনােরঞ্জন ধরের পক্ষে
৫৫
কাজ করতে। মনােরঞ্জন ধর সে-নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস’-এর টিকিটে।
ছেলেবেলা থেকেই আবদুল ওয়াহেদ বােকাইনগরীর নাম শুনে আসছি। জমিদার-অধ্যুষিত গৌরীপুর ও রামগােপালপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বােকাইনগরের বাসিন্দা ছিলেন বলে তাঁর নামের সঙ্গে ‘বােকাইনগরী’ কথাটা যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। বােকাইনগরী নামটার সঙ্গে পরিচিত ছিল পল্লীর গৃহবধূরাও। অবিভক্ত বাংলার ব্যবস্থাপক সভার তিনি সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৩৭ সালে। তিনি ইংরেজি জানতেন না। একমাত্র তিনিই না-কি সে-সময় ব্যবস্থাপক সভায় (এসেম্বলিতে) বাংলায় বক্তৃতা দিতেন। তার বক্তৃতার সময় এসেম্বলির দর্শক-গ্যালারির একটি আসনও খালি থাকতাে না। যেমনি ব্যবস্থাপকসভায়, তেমনি জনসভায়। এমন লােকায়ত ভাষারীতিতে তিনি বক্তৃতা দিতেন যে, পল্লী বাংলার মানুষ তাঁর প্রতিটি কথার মধ্যে নিজেদের অন্তরের ভাবনার প্রতিধ্বনি শুনতে পেতাে। তিনি ছিলেন হক সাহেবের দল অর্থাৎ কৃষক প্রজা পার্টির লােক। কাজেই ছেচল্লিশ সনে তার জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। সে-সময় পাকিস্তান-বিরােধী বলে চিহ্নিত হয়ে যান তিনি। ষাটের দশকের গােড়ার দিকে আমি কিছুদিন গৌরীপুর রাজেন্দ্র কিশাের হাইস্কুলে মাস্টারী করেছি। তখন তাকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি, তাঁর জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমার মনে হয়েছে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যেমন তিনি বিরােধী ছিলেন, তেমনি ছিলেন কংগ্রেসীদেরও সমালােচক। আবার কৃষক-প্রজার অধিকারের কথা বললেও ক্যুনিস্টদের তিনি সুনজরে দেখতেন না।
ময়মনসিংহ শহরে মওলানা আলতাফ হােসেন ছিলেন একজন বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী নেতা। তার সংযােগ ছিল অনুশীলন পার্টির সঙ্গে। পাকিস্তান-বিরােধী বলে আপন সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরই তার ওপর ছিল অপরিসীম ক্রোধ। ১৯৫৭ সালে ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) গঠিত হলে তিনি তাতে যােগ দেন, বলা যেতে পারে এ পার্টির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। কিন্তু ষাটের দশকে, আইয়ুব আমলে তার ভূমিকার বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটে যায়। ন্যাপের সদস্য হিসেবেই শুধু নয়, পাকিস্তান-বিরােধী অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকে যিনি নূরুল আমিনদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরােধিতা করে আসছেন যৌবনকাল থেকে, সেই মওলানা আলতাফ হােসেনই পাকিস্তানের মৃত্যুর মাত্র বছর দুয়েক আগে যােগ দিয়ে বসলেন নূরুল আমিনের পিডিপি (পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি)তে। আর তার ফলে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর যিনি শাসকদের দৃষ্টিতে ছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহী, তাঁকেই কি-না পাকিস্তানের মৃত্যু-ঘটিয়ে-সৃষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের দালালীর অভিযােগে অভিযুক্ত হতে হলাে। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়েও রাষ্ট্রবিরােধী রূপে চিহ্নিত হয়ে থাকলেন যেমন পাকিস্তান-পর্বে, তেমনি বাংলাদেশ-পর্বেও। ব্রিটিশ শাসকদের চোখে যিনি ছিলেন সন্ত্রাসবাদী, পাকিস্তানী দৃষ্টিতে যিনি একান্ত অবাঞ্ছিত, স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁর অভিধা হয়ে গেলাে ‘পাকিস্তানের দালাল। এর জন্যে দায়ী অবিশ্যি তিনি নিজেই। তবু, এ এক নির্মম ট্রাজেডি। অপরাধের জন্যে তাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে অবশ্যই। কিন্তু তারপরও বলতে হবে : অপরাধটিই তাঁর জীবনের একমাত্র সত্য নয়। মওলানার শেষ জীবনের ক্ষুদ্র অধ্যায়টিকেই বড়াে করে দেখলে তাঁর প্রতি একান্ত অবিচার করা হবে বলেই আমার বিশ্বাস। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলােই তাে কেটেছে সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী সাম্রাজ্যবাদ
৫৬
বিরােধিতার কারণে দুঃখবরণের মধ্য দিয়ে। সেই ত্যাগ-প্রদীপ্ত ভূমিকার কথা স্মরণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধাবনত না হয়ে আমি পারি না।
মওলানা আলতাফ হােসেনকে আমি দেখেছি, তার বক্তৃতা শুনেছি, দু’একবার তার সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছি; কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযােগ আমার হয়নি।
একান্ত ঘনিষ্ঠ না হলেও অনেকটা কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম ময়মনসিংহের কলম আলী উকিলের। রাজা জগৎ কিশাের, মহারাজা সূর্যকান্ত ও মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর মতাে প্রবল প্রতাপান্বিত ও ইংরেজ-সৃষ্ট নয়া সামন্ত প্রভুদের রাজধানী মুক্তাগাছার পার্শ্ববর্তী ঈশ্বরগ্রামে কলম আলী উকিলের জন্ম । রাজা-মহারাজা উপাধিতে ভূষিত এ-সব সামন্ত জমিদার ও তাদের জ্ঞাতিগােষ্ঠীদের প্রজাপীড়ন ও অত্যাচার তিনি ছেলেবেলা থেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন। এবং তখন থেকেই এই উৎপীড়ক শ্রেণীটির প্রতি তীব্র ঘৃণাবােধ তার চৈতন্যে বাসা বাঁধে। তবে, তাঁর সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতাে কথা হলাে, তিনি উৎপীড়ককে উৎপীড়করূপেই দেখেছেন—সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখেননি। জমিদার-মহাজনদের ‘হিন্দু পরিচয়টিকে বড়াে করে দেখলে অবশ্যই তিনি মুসলিম লীগের একজন জাদরেল নেতা হয়ে যেতে পারতেন, এবং উঠে যেতেন পাকিস্তানি রাষ্ট্রক্ষমতার মঞ্চে অথবা মঞ্চের কাছাকাছি। কিন্তু ব্যক্তিক উচ্চাভিলাষহীন এই মানুষটির এ-সব দিকে কোনাে নজর ছিল না। সাম্প্রদায়িকতার উর্বর ভূমিতে বাস করেও সাম্প্রদায়িকতাবাদী হওয়ার বদলে তিনি হয়ে উঠলেন জাতীয়তাবাদী। কলকাতা সিটি কলেজে তিনি পড়াশােনা করেন, এবং ১৯২৯ সনে বিএল পাস করে ময়মনসিংহ শহরে ওকালতি করতে শুরু করেন। সেই থেকে ১৯৭৩ সনের পঁচিশে জানুয়ারি, অর্থাৎ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই শহরেই কাটিয়ে গেছেন। তাঁর সহকর্মী সতীর্থরা অনেকেই যেখানে বৈষয়িক বিচারে অনেক সফলতার চূড়া স্পর্শ করেছেন, সেখানে কলম আলী তাে একজন অসফল মানুষই রয়ে গেলেন। কৃষক প্রজার স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে তিনি শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টিতে যােগ দিয়েছিলেন। প্রথম জীবনে অসাম্প্রদায়িক প্রজা-আন্দোলন করে পরবর্তী জীবনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবল প্রবক্তা হয়ে আখের গুছিয়ে নিয়েছেনএমন অনেক বুদ্ধিমান নেতাকেই তাে আমরা দেখেছি। কলম আলী সে রকম বুদ্ধিমান হতে পারেননি। কৃষক প্রজা পার্টি’ কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরও এ পার্টির আদর্শকে তিনি ধরে রেখেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লিগারদের দৃষ্টিতে তিনি তাে অন্য অন্য জাতীয়তাবাদীদের মতােই ছিলেন ‘একঘরে’ ও ‘অচ্ছুৎ’,। উনিশ শাে চুয়ান্নর নির্বাচনে অবিশ্যি শেরে বাংলার অনুসারী রূপেই কলম আলী উকিল যুক্তফ্রন্টের টিকিটে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু এর পর পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ধাক্কা মােকাবেলা করে তিনি আর পাদপ্রদীপের সামনে থাকতে পারেননি। শেষ জীবনে তিনি মানসিকভাবে অনেকটাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় এক নিঃসঙ্গ ও ক্ষুব্ধ মানসিকতার পরিচয় আমি পেয়েছি। যেসব জাতীয়তাবাদী মুসলমান পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে আপস করতে পারেননি, পাকিস্তানী জামানায় তাঁদের প্রায় সকলকেই–কলম আলী উকিলের মতােই—নিঃসঙ্গতার বােঝা বইতে হয়েছে।
ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় কলম আলী সাহেবকে কিছুটা সক্রিয় হতে দেখা গিয়েছিল। শুনেছি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি নীরবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর সে-ভূমিকার প্রকৃতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু আমার জানা নেই। স্বাধীনতার পর তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বা আলাপ-আলােচনা করার সুযােগ হয়নি।
৫৭
আরেকজন সৌম্যকান্তি শ্বেতশ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধকে আমি ষাটের দশকে ময়মনসিংহ শহরে দেখেছি। তিনি মুজিবুর রহমান ফুলপুরী। ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানায় পাগলা গ্রাম ছিল তার জন্মস্থান, সেই সূত্রে তাঁর নামের সঙ্গে ফুলপুরী’ শব্দটা তিনি যুক্ত করে নিয়েছিলেন। বােকাইনগরীর মতাে ফুলপুরীরও আসল নামটা প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল, ফুলপুরী নামেই তাঁকে এক ডাকে সবাই চিনতাে। বােকাইনগরী যেমন সুরসিক লােকায়ত বক্তারূপে প্রসিদ্ধ ছিলেন, ফুলপুরী তেমনটি ছিলেন না। তিনিও সুবক্তা ছিলেন অবশ্যই, তবু তাঁর আসল খ্যাতি ছিল সাংবাদিক ও সম্পাদক রূপে। ময়মনসিংহ শহর থেকে কৃষক-প্রজা আন্দোলনের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক চাষী’ প্রকাশ করেন তিনি ১৯৩৬ সনের ছাব্বিশে জুন। সেই থেকে ফুলপুরী সাহেব পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন আমৃত্যু—অর্থাৎ ঊনসত্তর সনের পাঁচই জানুয়ারি পর্যন্ত। তার মৃত্যুর পরও পত্রিকাটি বেশ কয়েক বছর চালু ছিল। সাপ্তাহিক চাষীর বিশেষ ভূমিকা ছিল প্রজাস্বত্ব আইন পাসের ব্যাপারে। কৃষকদের নানা সমস্যা, জমিদার-জোতদার-মহাজনের অত্যাচার ও শােষণ-নির্যাতন, ধর্মীয় কুসংস্কার—এসব নিয়ে অনেক প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় মন্তব্য তিনি চাষীতে প্রকাশ করেছেন। নিজে কম্যুনিস্ট না হয়েও উত্তর ময়মনসিংহে ক্যুনিস্ট পার্টি পরিচালিত টংকপ্রথা-বিরােধী সংগ্রামে আদিবাসী কৃষকদের বীরত্ব ও তাদের ওপর সরকারি নির্যাতনের বস্তুনিষ্ঠ খবর তাঁর পত্রিকায় প্রকাশের দরুন মুজিবুর রহমান ফুলপুরীকে কারাদণ্ড ভােগ করতে হয়েছিল। সুসং-দুর্গাপুর অঞ্চলে যখন হাজং বিদ্রোহ চলছিল, তখন মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখা কৃষক ও আদিবাসী সমস্যা সংক্রান্ত প্রবন্ধ তিনি সাপ্তাহিক চাষীতে প্রকাশ করেছিলেন। ফুলপুরীর চাষী’র পাতায় হাত পাকিয়েই ময়মনসিংহের অনেকে পাকা লেখক হয়েছিলেন।
প্রাদেশিক বা জাতীয় পর্যায়ের নেতা না হতে পারলেও মুজিবুর রহমান ফুলপুরী সেসময়কার ময়মনসিংহ জেলায় সর্বজনমান্য সাংবাদিক ও রাজনীতিক ছিলেন। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতাপের যুগেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রচার করে গেছেন তিনি একান্ত আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার সঙ্গে।
অকৃতার এই মানুষটি সারা জীবন দুঃখ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেছেন; কিন্তু কখনাে লােভের বশবর্তী হননি। আপন নীতি-আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।
একাডেমিক পড়াশােনা তার বেশি না থাকলেও বিদ্যাচর্চায় ছিলেন অনলস। ইস্কুলের ছাত্র থাকা কালেই স্বদেশী স্বেচ্ছাসেবক দলে যােগ দিয়েছিলেন। ইস্কুল ছেড়েছিলেন, পড়াশােনা ছাড়েননি। কংগ্রেস নেতা সূর্যসােমের সান্নিধ্য তাঁকে কংগ্রেসী আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। ১৯১৮ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছর তিনি ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। কিছু কিছু কংগ্রেস নেতার সংকীর্ণ আচরণ, কৃষক-বিরােধী মনােভাব ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর দরুন তিক্ত বিরক্ত হয়েই এক সময় কংগ্রেস ছেড়ে দিয়ে তাকে মুসলিম লীগেও যােগ দিতে দেখি। ১৯২৯ সালে তাে তিনি ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদকই নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার মতাে সাম্প্রদায়িকতা-বিরােধী ও জাতীয়তাবাদী চেতনাদীপ্ত মানুষের পক্ষে যে মুসলিম লীগের মতাে সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে বেশি দিন সংযুক্ত থাকা অসম্ভব, কিছুদিনের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠলাে। তাই, এরপর তাঁকে দেখি শেরেবাংলার কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে যেতে। এক পর্যায়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে তার সংযােগ শিথিল হয়ে এলেও নিজের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী পরিচয়টি তিনি সারা জীবন বজায় রেখেছিলেন।
৫৮
ময়মনসিংহ শহরে আলতাব আলী, ওয়াহেদ আলী, লাল মিয়া প্রমুখ কম্যুনিস্টদের পাশাপাশি ছিলেন মওলানা আলতাফ হােসেন, কলম আলী উকিল ও মুজিবুর রহমান ফুলপুরীর মতাে জাতীয়তাবাদীরা। এঁদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি ও মতবাদের পার্থক্য ছিল অনেক। সেই পার্থক্য যে কখনাে কখনাে বিরােধেও রূপ নেয়নি, তা-ও নয়। তবু এঁদের ভেতরকার মূলগত মিলের দিকটিই ছিল প্রবল ও প্রখর। প্রথমত, সেই মিলটি এসেছিল জন্মসূত্রে। অর্থাৎ এঁরা সকলেই ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। রাজনীতির অঙ্গনে এই সাম্প্রদায়িক পরিচয়টিকে মুছে দেয়ার অঙ্গীকার করেই কেউ হয়েছিলেন কমুনিস্ট বা সাম্যবাদী, কেউ ন্যাশনালিস্ট বা জাতীয়তাবাদী। কিন্তু সেদিন মুসলমান সম্প্রদায়ের ভালােমন্দ দেখার একমাত্র দাবিদার সেজেছিলেন যাঁরা, সেই মুসলিম লীগ নেতাদের চোখে এঁরা সবাই হয়ে গিয়েছিলেন ইসলাম ও মুসলমানের শত্রু। সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্রবল প্রচারের ফলে, এঁরা আপন সম্প্রদায় থেকে হয়ে গিয়েছিলেন বিচ্ছিন্ন, এমন কি আপন পরিবারের সদস্যদেরও সন্দেহভাজন। হিন্দুদের দালাল’ বলে কুৎসা রটানাে হয়েছিল যে-জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের সম্পর্কে, জাতীয়তাবাদের আলখেল্লা পরা অনেক সংকীর্ণ চিত্ত ও সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতার কাছ থেকেও তাঁদের কম আঘাত সইতে হয়নি। এ-রকম বিভিন্নমুখী আঘাত সহ্য করে করেও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের ক্ষীণশিখাটি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন যাঁরা, তাঁদের উজ্জ্বল অবদানকে অস্বীকার। করলে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ চরম অকৃতজ্ঞতারই পরিচয় দেবে।
মুজিবুর রহমান ফুলপুরীর মতাে জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা পাকিস্তানের জন্মকে ঠেকাতে পারেননি বটে, কিন্তু পরবর্তী কালে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানের কবর রচনা ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা যে ফুলপুরীদেরই উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন—সে-কথাই বা অস্বীকার করি কী করে?
Reference: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন – যতীন সরকার