ফার ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউ | ৩০ অক্টোবর ১৯৭১ | ইন্ডিয়া-পাকিস্থান যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত – এ এইচ হরিহরান
নয়াদিল্লি: ভারত ও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। গত সপ্তাহে ভারতের প্রতিরক্ষা উত্পাদন মন্ত্রী বলেন, “সতর্কবার্তা থেকে যুদ্ধ শুরু করতে দুই মিনিটের বেশি সময় নেওয়া উচিত না”। এবং সামরিক শক্তি প্রদর্শন সব সময় চলে। লাহোর, করাচী এবং পাকিস্তানের অন্যান্য শহরগুলোর যানবাহন ধর্মঘটকারীরা “ভারত গুঁড়িয়ে দাও” এবং “ভারত জয় করো” স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেছেন, পাকিস্তানের মাটিতে একটি নতুন যুদ্ধ হবে এবং ভারত কেবল পাঞ্জাবের লাহোর ও শিয়ালকোটের শহরগুলিই দখল নেবেনা বরং তাদের ভালোও রাখবে।
রাম স্পষ্টতই ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী লাহোরের উপকণ্ঠে অভিযান শুরু করে, কিন্তু তাশখন্দ চুক্তির পর শহরটি দখল নেয়নি। ভারতকে এলাকা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল এবং ত্যাগ করতে হয় কাশ্মীরের কার্গিলে ও হাজী পিরের উপর কৌশলগত আধিপত্য যা অনেক কষ্টে অর্জন করতে হয়েছিল।
১৯৬৫ সালের “২২-দিনের যুদ্ধ” সম্পর্কে দ্বিধাবিভক্ত ধারণা রয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা বলেন, বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ভরণপোষণে জড়িত সমস্যাগুলির কারণে ভারত লাহোর দখল করেনি। তবে, জেনারেল হারবক সিং, যিনি সেই সময় পশ্চিম সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে লাহোরের লেচোগিল খাল জুড়ে একটি ব্রিজের ভিত্তি স্থাপন করার পর সেনা কমান্ডার ঠাণ্ডার কবলে পড়েন এবং তার জয়কে সুসংহত করতে ব্যর্থ হন। এটা কিছুটা সত্য হতে পারে কারন এই সেনা কমান্ডারকে পরবর্তীকালে বহিস্কার করা হয়েছিল।
এই সময়ে যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে যেমন কঠিন সামরিক পরিস্থিতি প্রয়োজন, পাকিস্তান তার মুখোমুখি। ১৯৬৫ সালে উভয় দেশ পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া থেকে বিরত থাকে। আজ সকল বাঙালিরা এক হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সেখানে জড়ো হয়েছে, ফলে প্রদেশের ৮০,০০০ সৈন্যকে দমন করা হবে এবং সম্ভবত যুদ্ধ শুরুর এক ঘন্টার মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য পাকিস্তান ইতোমধ্যেই পূর্বাঞ্চল থেকে এক পদাতিক বিভাগ প্রত্যাহার করেছে। এটাই কি যবনিকাপাত টানতে পারবে? পাকিস্তানি সামরিক বিমান এবং নৌ জাহাজ সিংহল ব্যবহার করতে ব্যর্থ হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে গুলির যুদ্ধে আটকে রাখার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে।
সেনা শাসকরা পূর্ব থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছে এবং পশ্চিমাঞ্চলে জড়ো করছে যাতে করে কাশ্মীর, রাজস্থান বা গুজরাটের কিছু ভারতীয় অঞ্চল দখল করা যায়, এটি পূর্ব পাকিস্তানে হওয়া নির্দিষ্ট ক্ষতি থেকে মুখ রক্ষা করার একমাত্র উপায় হবে।
সামরিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে, ১৯৬৫ সাল থেকে উভয় পক্ষই তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। পাকিস্তান সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে ৭৫ টি সামরিক বিমান ঋণ গ্রহন করেছে। তারা বিভিন্ন পশ্চিম এশীয় দেশগুলিতে বিমান বাহিনী প্রশিক্ষণ মিশন চালিয়ে যাচ্ছে, আশা করা যায় এগুলো যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সাহায্য করবে।
ভারতের সামরিক শক্তির স্বনির্ভরতা অর্জনের নীতিটি পাকিস্তান থেকে ভারতকে সুস্পষ্ট সুবিধা প্রদান করবে। ভারতীয় অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলিতে বেশ কিছু নতুন ধরনের ফিল্ম এবং গোলাবারুদ তৈরি করা হচ্ছে। বিজয়ন্ত ট্যাঙ্ক ছিল এক বিরাট সাফল্য যেটা ১৯৬৫ সালে ভারতের প্রধান অবলম্বন সেন্টুরিয়র থেকে রণকৌশলে বেশি দক্ষ বলে বিবেচিত হয়েছে। বিজয়ন্ত প্রথম বাজারে আসে ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে এবং তথ্যসুত্রানুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে যে, ১০৫ মিমি বন্দুক যুক্ত প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ শত মাঝারী ট্যাঙ্ক কাজে লাগানো হচ্ছে।
ভারত বিমানের পাশাপাশি জাহাজও তৈরি করে। হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স বর্তমানে জেট জঙ্গি হামলা যোদ্ধা এইচএফ-২৪, সুপারসনিক ইন্টারসেপ্টর এমআইজি-২২, জেট ফাইটার জিনাট, জেট-ট্রেনার এইচজেটি-১৬, পরিবহন বিমান, এইচএস-৭৪৮ এবং অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার তৈরি করছে। বোম্বায় মাজাগান ডকস লেইডার শ্রেণীর রণতরী তৈরি করে।
এদিকে ভারতীয় নাগরিকরা ইতিমধ্যেই বাঙালি শরণার্থী এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির দরুন আর্থিক ঝামেলায় পড়েছে। অর্থমন্ত্রী ইয়াফ উদ্দিন চৌধুরী সংসদ এবং জনগণকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, এই বছরে কোন সম্পূরক বাজেট প্রবর্তন করার কোনও ইচ্ছা তার না থাকলেও মিসেস গান্ধীর বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে তার সরকার ৭00 মিলিয়ন অর্থ তোলার জন্য অতিরিক্ত কর আরোপ করার ঘোষণা করেছিল।
রেলওয়ে ভ্রমন, ডাক সেবা, বিনিময় বিলের উপর নতুন কর আরোপ করা হচ্ছে। পত্রিকার প্রত্যেক কপিতে সরকার দুই পয়সা করে আবগারি শুল্ক ধার্য করেছে। সমস্ত নতুন আইন ১৫ই নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে তাদের এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে এই পদ্ধতিতে প্রথমবারের মতো ট্যাক্স সংগ্রহ করা হয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি একটা সংক্ষিপ্ত শীতাকালীন অধিবেশনের জন্য সংসদ সম্মেলন ডেকেছে, এবং যেহেতু ট্যাক্স ব্যবস্থা কেবলমাত্র ১৫ই নভেম্বর থেকে কার্যকর হয় তাই অধ্যাদেশ এসেছিল আচমকাই। কেন্দ্র কর্তৃক প্রস্তাবিত ব্যবস্থাগুলি ছাড়াও, প্রদেশকে তাদের এক্তিয়ারে থাকা কিছু নির্দিষ্ট জিনিসের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করতে হবে।
নতুন ব্যবস্থাগুলি হলো: ১ রুপি বা তার চেয়ে বেশি দামের রেলে টিকেটে ৫% অতিরিক্ত চার্জ; ভারতের অভ্যন্তরে ভ্রমণে (মে বাজেটে টিকিটের মূল্যের উপর ১০% বিদেশী ভ্রমণের কর প্রয়োগ করা হয়েছিল) ৫% অতিরিক্ত চার্জ; পোস্টকার্ড ব্যতীত সকল ডাক নিবন্ধনের জন্য ৫ পয়সা কর; বিনিময় বিল, লেনদেনের বিল, প্রমানপত্র নোট, বীমা নীতিমালা, ক্রেডিট এবং প্রক্সি লিখিত কাগজপত্রের উপর ১০ পয়সা শুল্ক; এবং পত্রিকা ও সাময়িকীতে ২ পয়সা কর।
বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের ভরণপোষণের উঠতি ব্যায় এবং পরবর্তি অর্থ ঘাটতি পূরণের জন্য এই অতিরিক্ত কর ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। হিসাব বলছে ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ঘাটতি ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৫৭০০ মিলিয়ন রুপি। আনুমানিক বাজেট ছিল ২৩০০ মিলিয়ন রুপি এবং বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২ মাস ধরে এরূপ কর আদায় করলে সেটা ৭০০ মিলিয়ন রুপির অনেক বেশি হবে।