You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.04 | পদ্মা-যমুনার স্রোত ফিরবে না | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পদ্মা-যমুনার স্রোত ফিরবে না

পৃথিবীর যেসব দেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাটে পূর্ববঙ্গের জন্য রাজনৈতিক সমাধানের সওদা ফেরি করছে তাদের উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আমেদ সাহেব একটি সময়ােচিত সতর্কবাণী দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, এক ও অবিভক্ত পাকিস্তানের ভিত্তিতে কোন ফয়সালাই হবে না। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সার্বভৌম ও স্বাধীন এবং তার পৃথক ও স্বাধীন অস্তিত্বকে আমরা যে কোন মূল্যে রক্ষা করব। এর আগে বাংলাদেশের আর একজন নেতা মৌলানা ভাসানিও একই ধরনের কথা বলেছেন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, তাজউদ্দিন আমেদ সাহেবের এই কথাগুলি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষেরই মনের কথা।
এই সময়ে কথাটা এ রকম স্পষ্টভাবে বলার দরকার ছিল। কারণ, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খা এখন পূর্ব বাংলায় তার চন্ড শাসনের উপর একটা রাজনৈতিক সমাধানের লেবেল লাগাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। যেমন-তেমন করে একটা প্রশাসন খাড়া করে তিনি দেখাতে চাইছেন, বাংলাদেশের মানুষ তাঁর শাসন মেনে নিয়েছেন। তাঁর আশা, যদি তিনি একবার তার শাসন মুরুব্বি দেশগুলিকে বােঝাতে পারেন যে, পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তিনি হাতের মুঠোয় এনেছেন তাহলে এই মুরুব্বিদের কাছে থেকে সাহায্য ও সমর্থন পেতে তার কোন অসুবিধা হবে না। একই উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় একটি অসামরিক সরকার খাড়া করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জনাব নূরুল আমিন অবশ্য তার টোপ গিলতে রাজী হন নি। বরং তিনি পরিষ্কার করেই বলে দিয়েছেন যে, পূর্বঙ্গে এমন কেউই নেই যাকে অসামরিক সরকার চালাবার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে এবং যিনি সেই দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক। তবু ইয়াহিয়া পুতুল সরকার গড়ার চেষ্টা ছাড়ছেন বলে মনে হচ্ছে না। একবার তিনি যদি কোনমতে একটা কুইসলিং সরকার খাড়া করতে পারেন তাহলে ঢেড়া পিটিয়ে দুনিয়ার সামনে তিনি বলতে পারবেন, এই তাে দেখ, রাজনৈতিক সমাধান হয়ে গেছে। আর দুনিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলি তাে হাত ধুয়েই বসে আছে। একথা মনে করার বিকল্প কারণ রয়েছে যে, গােটা বাংলাদেশের ব্যাপারটাই এখন তারা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বিগত রাত্রির দুঃস্বপ্নের মতাে ভুলে যেতে চায় : নিজেদের বিবেকের ক্ষীণ কণ্ঠটুকু ও দেশের জনমতটুকু চাপা দেওয়ার জন্য তাদের শুধু একটা যেমততেমন অজুহাত দরকার। ইয়াহিয়া খা যদি সেই অজুহাতটা তাদের কাছে এগিয়ে দিতে পারেন তাহলে দুনিয়ার এইসব মুরুব্বি দেশ ‘কারবার যথারীতি চলিতেছে’ বলে নােটিশ ঝুলিয়ে বিশ্ব রাজনীতির টটে বসতে পারে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আমেদের হুশিয়ারি জানান দিয়ে দিল যে, ব্যাপারটা এত সহজ হবে না। ২৫ মার্চের পর থেকে যে রক্তের স্রোত বয়েছে তাকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে ঐ তারিখের আগের অবস্থায় কিছুতেই ফিরে যেতে দেবে না বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ। পদ্মা-যমুনার স্রোত যেমন বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে আবার উঠে আসবে না তেমনি ঐ রক্তের স্রোত উজানে বইবে না, ধর্ষিতা মা-বােনদের কান্নার শব্দও চাপা পড়বে না। এমন কি আজ যদি প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়া খা আওয়ামী লীগের ছয়-দফা মেনে নেয়, তাহলেও নয়। কেননা, মৃতের প্রাচীর অতীতের ইতিহাসকে আগামী দিনের ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দিয়েছে। জালিম ও মজলুম আর ভাই-বােন হবে না। জনাব তাজউদ্দিন আমেদের এই হুশিয়ারি যদি কোন দেশ উপেক্ষা করে তাহলে সে দেশ প্রকান্ড ভুল করবে; কেননা, তার কথার পিছনে রয়েছে বাংলাদেশের শিকল-ভাঙ্গা মানুষের মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিজ্ঞার অজেয় শক্তি।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর এই কথার পর ভারত সরকারের কর্তব্য স্পষ্ট। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার স্বরণ সিংহ সেদিন রাজ্যসভায় ঠিকই বলেছেন যে, পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান কি হবে সেটা ভারত বলে দেবে না, সেখানকার মানুষই তি স্থির করবে। সেখানকার মানুষ কি চাইছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না। পূর্ণ স্বাধীনতার কম আর কোন শর্তে মীমাংসা সম্ভব, এমন কোন সামান্যতম ধারণা নয়াদিল্লীর থাকলে তারা সেই ধারণা ত্যাগ করুন। অস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক সমাধান’এর কথা না বলে তারা দুনিয়ার দেশগুলিকে বলুন যে, তাজউদ্দিন আমেদ সাহেব যা বলছেন তাতে কান দেওয়ার দরকার নেই মনে করলে এইসব দেশ মারাত্মক ভুল করবে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৪ জুন ১৯৭১