পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা
শফিকুল হাসান
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ শাসিত পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন প্রধানত দুটি রাজনৈতিক চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে জন্মেছিল। এদের মধ্যে প্রথমটি ছিল বামপন্থীদের নেতৃত্বে সর্বহারা, অর্ধসর্বহারা ও জাতীয় ধনিকদের সমন্বয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পরাজিত করে স্বাধীন ও সার্বভৌম ভারতবর্ষ কায়েম করা। দ্বিতীয়টি হলাে ভারতবর্ষের প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষের মুৎসুদ্দি ধনিক, জোতদার মহাজন ও আমলাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। স্বচ্ছ ও সঠিক রাজনৈতিক বক্তব্যের অভাবে, উপযুক্ত সংগঠন না থাকায় এবং নেতৃত্বহীনতার জন্য বামপন্থীদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতবর্ষের সর্বহারা জনগণের আস্থা লাভে ব্যর্থ হয়। ফলে মধ্যবিত্ত ও জাতীয় বুর্জোয়াদের সমন্বয়ে গঠিত বামপন্থীদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জনগণের মাঝে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়নি। অপরপক্ষে ভারতবর্ষের বড় ধনিক, জোতদার মহাজন, আমলা ও তার দালালশ্রেণী নিজেদের মাঝে ক্ষমতা বণ্টন করে নেবার উদ্দেশে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জনগণকে ধর্মের খােলসে এই উভয় প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠী বিপথে পরিচালিত করতে সক্ষম হয় (অবশ্য এর জন্য উভয় দলকেই কয়েক দফা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে হয়)। স্বাধীনতা সংগ্রাম সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ নিলে বামপন্থীদের হাতে ক্ষমতা চলে যেতে পারে এই ভয়ে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শােষকেরা আপােসের পথে ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতবর্ষকে পাকিস্তান এবং ভারত এ দুটি বিবদমান রাষ্ট্রে পরিণত করে এবং উল্লেখিত দুই প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এ ভাবেই ভারত ও পাকিস্তান সার্বভৌমত্বহীন তথাকথিত স্বাধীনতা লাভ করে। ধর্মের আবরণে এ দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল এই দুটি রাষ্ট্রের মাঝে বিরােধ সৃষ্টি করে শশাষণকে পূর্ণমাত্রায় বজায় রাখা, ধর্মের নামে জনগণের বিপ্লবী শক্তিকে দাবিয়ে রাখা এবং ধর্মের নাম করে অবাধে জনগণের উপর শাসন, শােষণ ও নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়া। দুটি দেশের তথাকথিত এই স্বাধীনতা দেশি ও বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীলদের স্বার্থকে পূর্ণ মাত্রায় বজায় রাখার এক ঘৃণ্য চক্রান্তের ফলমাত্র।
বামপন্থীদের দুরবস্থা
স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার প্রথম থেকেই ভ্রাতৃত্ব, সংহতি, শক্তিশালী কেন্দ্র এবং সর্বোপরি ইসলামকে রক্ষার নাম করে জনগণের উপর শােষণ ও নিপীড়ন চালাতে থাকে। পূর্ব বাংলার জনগণের উপর এই শােষণ ও নিপীড়ন ছিল সম্পূর্ণ ঔপনিবেশিক চরিত্রের। বামপন্থী দল হিসেবে কমিউনিস্টরা যাতে এই শশাষণ নিপীড়ন সম্পর্কে জনগণকে সজাগ করে, তাদের শােষণ কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে সেই উদ্দেশে পাকিস্তানে সমস্ত কমিউনিস্ট কার্যকলাপ সম্পূর্ণ বেআইনি ঘােষণা করা হয় এবং মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের ধর্ম রক্ষার অজুহাতে কমিউনিস্ট নিধন কাজে নিয়ােগ করা হয়। এই অকথ্য অত্যাচারের ফলে কার্যত স্বাধীনতা লাভের প্রথম দিকে পূর্ব বাংলায় কোনাে সুশৃঙ্খল বামপন্থী পার্টি গড়ে উঠতে পারেনি।
শােষণের রূপ
পূর্ব বাংলা একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এর প্রায় শতকরা আশি জনই কৃষক। মুসলিম লীগের কর্মীরা রাষ্ট্রীয় সহায়তা নিয়ে নিরীহ কৃষক সমাজকে চরমভাবে শশাষণ করতে থাকে। ফলে গড়ে ওঠে জোতদার, মহাজন, ইজারাদার, তহশিলদার ও গ্রাম্য টাউট-বাটপাড় দালাল ও বদ মাতব্বরদের রাজত্ব। মিথ্যা মামলা, সুদ ও ঘুষের দৌরাত্মে কৃষকরা ধীরে ধীরে তাদের চাষের জমি হারাতে থাকে এবং ভূমিহীন ও গরিব কৃষকে পরিণত হয়। এই শােষণ নিপীড়নের ফলে কৃষক তার জমি হারিয়ে ক্ষেতমজুর, বেকার বা সর্বহারা শ্রমিকে পরিণত হয়। অন্যদিকে জোতদার, মহাজন, ইউনিয়ন বাের্ডের সদস্য এবং মুসলিম লীগ কর্মীরা তাদের গণবিরােধী কার্যকলাপ দ্বারা কৃষকদের জমি ছিনিয়ে নিয়ে আরাে জমির মালিক হয়। এভাবে পূর্ব বাংলার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জমির মালিকানা অকৃষকদের হাতে চলে আসে এবং তাতে তাদের যে পুঁজি গড়ে ওঠে সে পুঁজি বিনিয়ােগ করে এই জোতদার মহাজন শ্ৰেণীই ক্রমে ক্রমে পূর্ব বাংলার উঠতি পুঁজিপতিরূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। এদিকে পাকিস্তানি সরকার বারােশ মাইল দূর থেকে ভ্রাতৃত্ব সংহতি ইসলাম শক্তিশালী কেন্দ্র এবং সর্বোপরি শিশুরাষ্ট্রের নামে পূর্ব বাংলার এই নির্যাতিত কঙ্কালসার মেহনতি জনতার উপর পূর্ণ মাত্রায় ঔপনিবেশিক চরিত্রের শােষণ চালিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে এই শােষণের মাত্রা এত বেশি হয় যে বায়ান্ন-তিপান্ন সালে পূর্ব বাংলার জনগণকে ষােল টাকা সের দরে লবণ ও বাহাত্তর টাকা মণ দরে চাল ক্রয় করতে হয়েছে। এমতাবস্থায় পূর্ব বাংলার জনগণের উপর জোতদার মহাজন দালাল বাটপাড়দের সামন্তবাদী শােষণ, পাকিস্তানি শােষক গােষ্ঠীর ঔপনিবেশিক চরিত্রের শােষণ এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত সাম্রাজ্যবাদী শােষণ, পূর্ব বাংলায় ও পাকিস্তানে একচেটিয়া ও বড় পুঁজির শােষণ এবং সরকারি আমলা অফিসারদের শােষণগুলােই পূর্ব বাংলার জনগণের নিকট দ্বন্দ্ব হিসেবে বিরাজ করতে থাকে।
ভাষা আন্দোলন
শশাষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তিকামী পূর্ব বাংলার জনগণের মনে ক্রমশ বিক্ষোভের জন্ম হয়, তাদের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। জনতা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈষয়িক অধিকার সম্বন্ধে সজাগ হতে শুরু করেন। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার এই গণবিক্ষোভ ও গণআন্দোলনকে প্রতিহত করতে এক কলঙ্কময় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানের বুক থেকে জাতি হিসেবে বাঙালির অস্তিত্বকে মুছে দেবার এক ঘৃণ্য চক্রান্তের প্রথম কাজ হিসেবে দেশের ছাপান্ন ভাগ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়। সমগ্র পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনতা এই গণবিরােধী আক্রমণের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তােলেন। পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সেই আন্দোলন ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নামে খ্যাত। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার আপামর জনতা, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ও পাবনার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে এই আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ও তার দালালরা এই উত্তাল জনতার দাবিকে নস্যাত করার জন্য ‘৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এক গণমিছিলের উপর গুলি চালিয়ে অমানুষিক বর্বরতার সঙ্গে হত্যা করে ভাষা আন্দোলনের বীর সেনানি শহীদ সালাম জব্বার রফিক আরাে অনেককে। পূর্ব বাংলার সংগ্রামী বীর জনতা সেদিন পিশাচদের হিংস্র থাবার আঘাতে দাবি ত্যাগ করেনি, বুকের রক্তে রাজপথে রাঙিয়ে তারা তাদের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, জয় করেছিল। শােষক ও শাসকগােষ্ঠী বাধ্য হয়েছে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকার করে নিতে। পূর্ব বাংলার বীর জনগণের এই বিজয় ছিল প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয়- যা এসেছিল রক্তরাঙা পিচ্ছিল পথ ধরে। পরবর্তীকালে দেখা গেল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও কার্যত এর কোনাে মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না, বরং ষড়যন্ত্রের আর এক ধাপ হিসেবে বাংলা অক্ষরকে আরবি বা রােমান অক্ষরে পরিবর্তিত করার অপর এক নতুন চক্রান্তে তারা লিপ্ত। জাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশে ভাষার উপর এ ধরনের জগণ্য আক্রমণকে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনতা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করেন।
বিমাতাসুলভ ব্যবহার
পাকিস্তানের শাসক ও শােষক গােষ্ঠী অতঃপর পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে নানাপ্রকার বিমাতাসুলভ ব্যবহার শুরু করেন। সেনাবাহিনীতে সরকারি, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে চাকরির ক্ষেত্রে, ব্যবসায় বাণিজ্যে, আমলা অফিসার বিনিয়ােগ ক্ষেত্রে, শিক্ষার খাতে, স্বাস্থ্য রক্ষার খাতে উন্নয়ন খাতে সর্বপ্রকার সুযােগ-সুবিধা থেকে পূর্ব বাংলার জনগণকে বঞ্চিত করা হয়। বিশেষ করে শিল্প ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে চরম বাধার সৃষ্টি করা হয়। দ্রব্যমূল্যে দুই দেশের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান রচিত হয়। পূর্ব বাংলার জনগণের উপর কর ও শুল্কের বােঝা বাড়িয়ে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের এক বিরাট সেনাবাহিনী প্রতিপালনের দায়িত্ব জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের আরাে বড় ধনিক পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত করার উদ্দেশে সুপরিকল্পিতভাবে পূর্ব বাংলার সকল কুটিরশিল্পগুলােকে ধ্বংস করা হয়। ফলে তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রতি গণমনে আস্থাহীনতা জন্মে এবং মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫১ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরে এই নাম বদলে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাখা হয়।
দাঙ্গা ষড়যন্ত্র
অপরদিকে শেরে বাংলা ফজলুল হক ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দেন। এ সময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টরা হাজী দানেশ, ফজলুল করিম, মণি সিং ও দেবেন শিকদারের নেতৃত্বে ‘গণতন্ত্রী দল’ নামক একটি বামপন্থী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে এই তিনটি রাজনৈতিক পার্টি যুক্তফ্রন্ট নামে প্রাদেশিক পরিষদে মুসলিম লীগকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমী স্বার্থবাদীরা আদমজি শিল্প এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধায় এবং ৯২ (ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। পূর্ব বাংলার গণরায়কে বাতিল করার জন্য তৎকালীন কুখ্যাত ইস্কান্দার মির্জা সরকার ঢাকার জনগণকে ট্যাঙ্ক ও কামান আক্রমণের আশ্রয় নিয়েছিল। পরে আপােসের মাধ্যমে শহীদ সারওয়ার্দীর (সােহরাওয়ার্দি) নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্রের দালাল সরকার হিসেবে ক্ষমতা দান করা হয়। প্রগতিশীলরা এসব ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার উদ্দেশে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করে। এই ন্যাপকে কেন্দ্র করেই কমিউনিস্টরা ১৯৫৬ সালে শহর ও গ্রামের জনগণের নিকট তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি তুলে ধরেন।
ইতিমধ্যে স্বাধীনতা পাবার দীর্ঘ নয় বছর পর ১৯৫৬ সালে শাসকগােষ্ঠী একটি তথাকথিত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে। ইসলামের নাম করে সে শাসনতন্ত্রে পূর্ববাংলার জনগণকে শােষণ করার বিভিন্ন কৌশলকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল মাত্র। জনগণ এই শাসনতন্ত্র তীব্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং সারা দেশে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, চুরি-ডাকাতি, সুদ-ঘুষ ও চোরা কারবারে ছেয়ে যায়। ১৯৫৯ সালে নির্বাচনের আশায় জনগণ যখন উন্মুখ ঠিক তেমনি সময় পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীলদের অন্যতম প্রতিনিধি শঠচুড়ামণি আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের সাতাশে অক্টোবর সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এভাবে পদে পদে শাসক ও শােষকরা জনগণের বাচার প্রতিটি দাবিকে বিভিন্ন কলা কৌশলে উপেক্ষা করে সমগ্র জাতির উপর দীর্ঘদিন ধরে চালিয়েছে অকথ্য লাঞ্ছনা, নির্মম নিষ্পেষণ এবং পদে পদে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে করেছে বঞ্চিত। দীর্ঘ এক যুগ ধরে পূর্ব বাংলার জনগণের উপর আইয়ুবশাহীর নির্যাতন সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। পশ্চিমা প্রভুদের নিকট প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত দাবির বিনিময়ে জনগণ কেবলই পেয়েছে বুলেট বেয়নেট আর অকথ্য নির্যাতন।
গণঅভ্যুত্থান
এই লাঞ্ছিত নিপীড়িত জাতি মার খেতে খেতে সংগ্রামমুখী বিপ্লবমুখী হয় এবং কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার ধনিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ এ সময় কেন্দ্রের নিকট ছয়দফা নামে একটি আপােস চুক্তি তুলে ধরেন। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী এই আপােস রফাকেও বাড়াবাড়ি মনে করতে থাকে এবং ছয় দফার প্রণেতা শেখ মুজিবর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামক এক মিথ্যে ভিত্তিহীন মামলায় যুক্ত করে বিচারের জন্য সামরিক আদালতে প্রেরণ করে।
ইত্যাদি ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার জনগণ বিশেষ করে ছাত্রসমাজে এক প্রচণ্ড গণআন্দোলন গড়ে তােলেন। আইয়ুবের জঙ্গি বাহিনীও ঢাকার পথে সান্ধ্য আইন জারি করে বিশে জানুয়ারি উনিশশ সত্তরে চালিয়েছে রাইফেল, স্টেনগান, মেশিন গান, হত্যা করেছে কমরেড আসাদুজ্জামান রুস্তম মতিউর ও আরাে অনেক নাম না জানা শহীদদের। প্রচণ্ড গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ মুজিব এক আপােস চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি পান এবং গােল টেবিল’ নামক এক আপােস আলােচনায় লিপ্ত হন। গােলটেবিল জনগণকে কিছুই দেয়নি বরং নেতাদের এই আলােচনামূলক বিশ্বাসঘাতকতায় গণঅভ্যুত্থানকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়। জনগণের মনে চাপা আক্রোশ বিসুভিয়াসের ন্যায় প্রতিনিয়ত জ্বলতে থাকে।
এই রুদ্র রােষে আইয়ুব সরকারের সিংহাসন পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটে নব জল্লাদ ইয়াহিয়ার দ্বিতীয়বার সামরিক আইন ঘােষণার মাধ্যমে। ক্ষমতা হাতে পেয়েই এই নরপিশাচ একজন আদর্শ গণতন্ত্রী ও ভালাে মানুষের ছদ্মবেশে ঘােষণা করেন তিনি দেশে সুখ শান্তি ফিরিয়ে দেবেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবেন এবং তার কথানুযায়ী তিনি নির্বাচনের দিন তারিখও ঘােষণা করেন। তার এই ঘােষণাকে পূর্ববাংলার ধনিকশ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ, দক্ষিণ পন্থী কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মস্কোপন্থী ন্যাপ, প্রতিক্রিয়াশীল তিনটি মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পি ডি পি ও কৃষক শ্রমিক পার্টি স্বাগত জানায়। এসব পার্টির কর্মকর্তারা ইয়াহিয়া খানের গণতন্ত্রী কার্যকলাপের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অপরদিকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টরা স্বাধীনতা নির্বাচন, যেখানে ব্যাপক জনগণের অংশ গ্রহণের কোনাে স্থান নেই সে বুর্জোয়া নির্বাচন কোনাে ক্রমেই গণতান্ত্রিক নির্বাচন হতে পারে না’ বলে অভিমত প্রকাশ করে এবং গণতন্ত্রের নামে এই প্রহসনকে প্রতিহত করে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন ও জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পতিষ্ঠা করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
সূত্র: দর্পণ
১৪.০৫.১৯৭১