সংবাদ সপ্তাহ, অগাস্ট ২, ১৯৭১
বাংলাঃ একটি জাতিকে হত্যা
এটা একটা বাঁধা ধরা অনুরোধের মতো যথেষ্ট মনে হচ্ছে । পূর্ব পাকিস্তানের হালুর ঘাট গ্রামের কতগুলো যুবককে একত্র করা হয়েছে। একজন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রধান তাদের অবিহিত করে যে তার আহত সৈন্যদের জন্য জরুরী ভাবে রক্তের প্রয়োজন । তারা কি দাতা হতে চায় ? যুবকেরা ক্ষণস্থায়ী খাটে শুয়ে পড়েছিল, সুঁই তাদের শিরাতে ঢোকান হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তাদের শরীর থেকে রক্ত নির্গত হচ্ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা মারা গিয়েছিল ।
গোবিন্দ চন্দ্রা মণ্ডল ভুলে গিয়েছেন কে তাকে প্রথম এই খবর দিয়েছিল কিন্তু যখন তিনি রাজক্ষমার কথা শুনেন যা সকল শরণার্থীদের কাছে অঙ্গীকার করা হয়েছে । তিনি তৎক্ষণাৎ তার কিশোরী কন্যাদের সাথে নিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশ্য দীর্ঘ পদব্রজে যাত্রা শুরু করেন । চন্দ্রা মণ্ডল ক্লান্ত পায়ে বর্ষার প্লাবিত জলা জমি এবং পোড়া গ্রামের মাঝে দিয়ে চলতে থাকেন। যখন তিনি তার বর্জিত এক টুকরো জমির কাছাকাছি আসেন তখন সৈন্যরা তাকে থামায়। তারপর তিনি অসহায় যন্ত্রনার মাঝে তার কন্যাদের ধর্ষিত হতে দেখেন ।
সে প্রায় দুই বছরের ছিল এবং মা তার কিশোরী কন্যাদের সাথে ছিল। তারা মাটিতে বসে যা গ্রীষ্মের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির কারনে কর্দমাক্ত ছিল। শিশুটির পেট ছিল হাস্যকর রকমের ফাঁপা, পা ছিল ফোলা , তার বাহু মানুষের আঙ্গুলের মতো ছিল। তার মা তাকে কিছু ভাত এবং শুকনো মাছ দিয়ে তুষ্ট করতে চেয়েছিল। অবশেষে শিশুটি দুর্বল ভাবে তা খায় এবং সাঁ সাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে মারা যায় ।
কিছু লোক পাকিস্তানিদের তুলনায় পশ্চিমাদের বেশি বর্বর মনে করে। যখন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের দেশে হাজার হাজার লোক প্রান হারায় যা নিয়মিত সংক্রামক মহামারীর মাধ্যমে, সংবাদপত্র গুলো একটি অবাস্তব কৌতূহলের মাধ্যমে তাদের দুঃখ কষ্টের হিসাব করে। আজ পর্যন্ত কেও পাকিস্তানের দুঃস্বপ্ন থেকে পালাতে পারে না। এক মিলিয়ন বাঙ্গালির এক চতুর্থাংশ মৃত এবং ছয় মিলিয়ন অথবা আরও বেশি জনগন মারিয়াভাবে নির্বাসিত করে যার ফল হলও ইচ্ছাকৃত ভাবে সমগ্র জাতির মাঝে ভয় দেখানো। এটা ছিল বন ( জার্মানির ) এর আয়তনের, যা ধ্বংস করা হয় এবং হঠাৎ করে লন্ডনের জনগণকে গৃহহারা করা হয় কিন্তু কষ্টের মাপকাঠিতে তা আজও অসুস্থকর আঘাত ।
এবং এখানে এর চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে। প্রত্যাশার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু আছে । পাকিস্তান নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে আর এর দ্বারা পাকিস্তানের মুসলমান এবং তার খিলান শত্রু ভারতের হিন্দুদের মাঝে অন্য আরেকটি বৃহৎ গৃহযুদ্ধের স্ফুলিংগ দেখা দিচ্ছে। গত সপ্তাহে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ক্রুদ্ধ ভাবে ঘোষণা করেন যে যদি বাংলাদেশের প্রতি ভারতে গোপন সমর্থন বিস্তৃত করে যারা বিচ্ছিন্নবাদী বাঙ্গালী জাতি হিসেবে পরিচিত। “ আমি ঘোষণা করব যে পকিস্তানের মিত্র চীন এবং ভারতের মিত্র রাশিয়াকে সম্পৃক্ততা এড়াতে দৃঢ়ভাবে চাপ দেয়া হবে। এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র কোন পক্ষের সাথে থাকবে তার মুখোমুখি হতে পারে।
ইতিমধ্যে ভৌগোলিক রাজনীতির কারনে কৌশল এবং মানবিক বিচার এর মাঝামাঝি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র তার অকৃতজ্ঞ কর্মের মুখোমুখি হয়েছে ।ইয়াহিয়া সরকারের সাথে তার প্রভাব সংরক্ষনের জন্য তাকে আলিঙ্গন করেছে । এখন তারা উদ্বিগ্ন বাঙ্গালিদের দুর্ভোগে সাহায্যের বিষয়ে। আর আমেরিকা শুধুমাত্র একটি তিক্ত বিতর্কের মাঝে নিজেকে জড়াতে পেরেছে। গত সপ্তাহে এই বিতর্ক তীব্র আকার ধারন করে যখন সেন এডওয়ারড কেনেডি পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিকদের কাছে গোপনীয় বার্তা প্রকাশ করে।“ পূর্ব পাকিস্তানের উপর দুর্ভিক্ষে অপ্রিতিকর পরিনাম প্রত্যাশা করে ” -এক তারের বার্তা। “ বিস্তৃত ক্ষুদা, কষ্টভোগ এবং সম্ভবত অনাহার প্রতিহত করা; পুনরাবৃত্তি ভালো নয় ।” কেনেডি পরিস্কারভাবে সংশ্লেষণ করেছিল যে নিক্সন প্রশাসন বাঙ্গালীর বিশাল দুর্ভোগ দামাচাপা দেওয়ার উপায় খুজচ্ছে এবং এখানেই সন্তুষ্ট না। তিনি অন্তরঙ্গভাবে পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশ টীম পাঠানোর পরিকল্পনা করছিলেন যারা ইয়াহিয়ার পাঞ্জাবি সৈন্যদের বাঙ্গালিদের প্রতিরোদ দমন করার জন্য সাহায্য করবে।
দুইটি বিপথগামী সংস্কৃতি
একটি ঠাণ্ডা মাথার পদক্ষেপ অব্যশই তা অতিক্রম করে যাওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক সংঘাতের ফাঁদে রয়েছে। শারীরিক এবং জাতিগতভাবে পাকিস্তান বিশ্বের অন্যান্য জাতিদের মাঝে অনন্য। এর জনবহুল পূর্ব অঞ্চল থেকে পশ্চিম অঞ্চল প্রায় ১০০০ মাইল ভারতের অঞ্চল দ্বারা আলাদা। এটা দুটি আমূল বিপথগামী সংস্কৃতির একটি জাতি। দুটি পুরোপুরি ভিন্ন জাতি ইতিহাসের মাধ্যমে যারা একে অপরকে ঘৃণা করে। পশ্চিম পাকিস্তানের হালকা রঙয়ের উদ্ধত পাঞ্জাবী যারা বাঙ্গালীদের ঘৃণা করে অথচ তাদের উর্বর ধানের জমি এবং আকর্ষণীয় পাট ফসলের বিল দিয়ে ১৯৪৭ সাল অর্থাৎ যখন থেকে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকে তাদের অর্থ দিয়েই বিল পরিশোধ করছে। বাঙ্গালিরা তাদের বর্বর হিসাবে গণ্য করে এবং আরও খারাপ দিক হোল ; অত্যাচারী বর্বরদের একচেটিয়া পাকিস্তানী সরকার এবং সৈন্যবাহিনী আছে। এক বাঙ্গালী নেতা বলেছিলেন, “ আমরা পশ্চিমাদের কাছে উপনিবেশ ছাড়া আর কিছুই না ।”
বধ করার পরিকল্পনা
ইয়াহিয়ার আদেশের কয়েক ঘণ্টার মাঝেই মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ঘোষণা করেন। এই দিনে পাকিস্তান সরকারীভাবে এবং ইয়াহিয়া ব্যক্তিগতভাবে মুজিবের কাছে আপস করার জন্য আপীল করে যা হয়ত জাতির আঘাতটাকে আরোগ্য করবে। কিন্তু অধিকাংশ পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করত যে ইয়াহিয়ার অন্য কোন পরিকল্পনা রয়েছে। আসলেই সপ্তাহ পূর্বে ইয়াহিয়া – মুজিব মিটিং এ বসেছিল। রাষ্ট্রপতি এবং তার ডান হাত লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ইতিমধ্যে মুজিবকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করে ফেলেছিল এবং আওয়ামীলীগের সাথে সাথে জাতীয়তাবাদ বধ করারও ।
“বেলুচিস্থানের বোমারু বিমান ” তার বায়ুর যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্য পরিচিত এবং কামানের আঘাতের মাধ্যমে স্থানীয় উপজাতীয় বিদ্রোহীদের আঘাত করে ১৯৬৬ সালে। টিক্কা খান দৃশ্যতই ইয়াহিয়া খানকে রাজি করান কিছু সময় কিনার জন্য যাতে তার সেনাবাহিনীকে তৈরি করতে পারেন। তদনুসারে ইয়াহিয়া আলোচনার জন্য মুজিবকে প্রস্তাব করেন। যখন দুই নেতারা আলোচনায় ছিল এবং বাঙ্গালীদের সাথে সাথে বিশাল বিশ্ব আপসের টুপির জন্য অপেক্ষা করছিল যা সম্ভবত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর লজিস্টিক আঘাতের লাগাম টানবে। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স এর বোয়িং ৭০৭এস ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের দীর্ঘ পথ উড়ে দখল করে। সেনাবাহিনী প্রায় দ্বিগুণ ৬০০০০ সেনা বাংলায় জড়ো করে। যখন টিক্কা জানান যে সব কিছু তৈরি; ইয়াহিয়া ঢাকার বাইরে চলে আসে এবং সেই রাতেই বেলুচিস্থানের বোমারু বাহিনীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নির্দেশ অনুযায়ী নির্মমভাবে আঘাত করা হয় এই তত্ত্বের উপর যে অসভ্য অতর্কিত আক্রমনের দ্বারা প্রতিরোধকে দ্রুত মেরে ফেলা যাবে। সেনাবাহিনী তা প্রতিহিংসার সাথে পালন করে। ট্যাংক পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার রাস্তায় আঘাত করে নির্বিচারে মানুষ এবং বাড়িঘরের উপর বিস্ফোরণ করে। নিষ্ঠুর হিংসার সাথে পাঞ্জাবী সৈন্যরা নাগরিকদের মেশিনগান দ্বারা গুচ্ছ গুচ্ছ গুলি করে। অন্যরা তখন রাজধানীর বুকের বস্তিগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। শীগ্রই শহরটি জুড়ে লাশ ছড়িয়ে থাকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর একটি রক্তাক্ত বিছানা বানানো হয়েছিল যা ছিল একটি রক্তাক্ত কসাইখানা।
রক্ত প্লাবিত রাত এবং দিন এবং সপ্তাহ যাবত হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে । গণহত্যা শুধুমাত্র ঢাকার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না , তার সাথে সাথে গ্রামাঞ্চল জুড়ে চলতে থাকে। একজন গভীর আতঙ্কিত বাঙ্গালী সাংবাদিক ভারতের সীমান্তের নিকটবর্তী তার গ্রামে বেপরোয়া সাক্ষাতের পর জানান কি রকম ভাবে জমি বিধ্বস্ত হয়েছে। “আমি এক ডজনের উপর গ্রাম পার হয়ে আসার সময় দেখেছি কিভাবে তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পরিত্যক্ত হয়েছে এবং সর্বত্র দেহ ছড়িয়ে রয়েছিল যা কাক খাচ্ছিল। গন্ধ ! আতঙ্ক ! আমি প্রার্থনা করছিলাম যাতে আমার গ্রামটিও এই রকম না হয় কিন্তু তা হয়েছিল। গ্রামটি শুধুমাত্র ধ্বংস স্তূপের এবং লাশের একটি ভর ছিল। আমার স্ত্রী এবং সন্তানেরা নিখোঁজ ছিল। সেখানে মাত্র একজন বৃদ্ধ মহিলা জীবিত ছিল এবং সে কথা বলতে পারেনি। তিনি শুধু মাটিতে বসে কাঁপছিলেন এবং বিলাপ করছিলেন।
সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হত্যা কাণ্ডের খবরের মাত্রা কমে আসছিল। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মাঝে বর্বরতা কমানোর কোন বিষয় ছিল না। গত সপ্তাহে, সংবাদ সপ্তাহের লরেন জেনকিন্স যে কিনা জেনারেল টিক্কা খানের সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড আরম্ব করার রাতে ঢাকা ছিলেন। নিম্নলিখিত রিপোর্টটি পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থানের উপর পাঠানো তারবার্তা –
রক্তক্ষরণের চার মাস পরেও পূর্ব পাকিস্তান এখনও ভয়ের মাঝে বাস করে। কিন্তু ভয় গুড়িয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, সেনাবাহিনী লজ্জাকরভাবে ভয় ধীরে ধীরে প্রবেশ করানোর পথ খুঁজছে। এটা একটা অন্ধকারাচ্ছন ভয় যা কিঞ্চিৎ রঞ্জিত হচ্ছে প্রকাশ্যও অবাধ্যতা এবং ঘৃণার মাধ্যমে। এটা একটা কঠিন বাস্তব উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে এই ভয়। এটা সেই ভয় না যা মানুষের আত্মাকে চিহ্নিত করে। সম্প্রতি ঢাকার রাস্তায় একাকী হাঁটার সময় আমার এক সংবাদিকের সাথে দেখা হয়েছিল যাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। আমাদের চোখা চোখি হওয়ার পর সে মাথা নেড়েছিল কিন্তু তিনি বিব্রত ভাবে হাজির হন। ঘাবড়ে চারপাশে তাকিয়ে সে বিড় বিড় করে বলে, “ হে আমার আল্লাহ, হে আমার আল্লাহ; যে ধরনের ভয়াবহ কাজ হয়েছে কোন সভ্য মানুষের পক্ষে তার বর্ণনা করা সম্ভব না। ” ঘণ্টা খানেক পর আরেকজন বন্ধু ব্যাখ্যা করেন; “ আমাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে যাতে কোন বিদেশী সাংবাদিকের সাথে কথা না বলি। আমরা আতঙ্কিত, আমরা মধ্যরাতের দরজায় কড়া নাড়ার (০১১) ভয়ে বসবাস করি। অনেক মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। আরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছে এবং প্রতি রাতে আরও নিখোঁজ হচ্ছে।
মুজিব যে কিনা রাতের মাঝে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। সে এখন জনশ্রুতি অনুযায়ী পশ্চিমের মিয়ানওয়ালি গ্রামে আটক রয়েছে। পূর্বে যে একজন নায়ক ছিলেন এখন তিনি একজন শহীদে পরিনত হয়েছেন। তার সুস্পষ্ট ভুল ছিল যে তিনি বাঙ্গালী দেশ প্রেমিকের প্রতীক হয়ে হয়ে উঠেছিলেন। তবুও ইয়াহিয়া বুক ঠুকে সম্প্রতি একজন প্রতিবেদককে বলেছিলেন, “ আমার জেনারেলরা মুজিবকে সামরিক আদালতে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য চাপ প্রয়োগ করচ্ছে। আমি সম্মতি প্রদান করেছি যে বিচার খুব শ্রীঘ্রই সম্পন্ন হবে। কোন নীতিই অদূরদর্শী এবং বাঙ্গালীর সহ্য করার ক্ষমতাকে কঠিন করবে। একজন পশ্চিমা কূটনৈতিক আমাকে বলেছিলেন, “ ইয়াহিয়া সহজেই তার জ্ঞান বুদ্ধি হারিয়েছেন। ইনি এমনকি বুজতেই পারছেন না তার সেনা বাহিনী কি কাজ শেষ করেছে। সে মনে করে তারা হয়ত হাজার খানেক মানুষকে মেরেছে। মুজিবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা, জোর করে তাদের শৃঙ্খলাড় মাঝে ফিরিয়ে আনলেই সব কিছু ভুলে যাবে । যা সম্পূর্ণই অর্থহীন। মানুষ তা কখনোই ভুলবে না।
গেরিলা প্রতিরোধ
প্রকৃতপক্ষেই বাঙ্গালীর মনে উচ্চ প্রশংসার সাথে এই মাসগুলোর সন্ত্রাসের স্মৃতিগুলো মনে থাকবে। সন্ত্রাসের চিহ্ন থাকা সত্তেও সেনাবাহিনী সর্বত্র হামাগুড়ি দিচ্ছিল। ঢাকার রাস্তায় লোকাল দুরন্ত ফেরিওয়ালাদের মাধ্যমে হস্তলিখিত বা টাইপ করা সরকারী ইস্তাহার নির্বাসিত করা হচ্ছিল সংবাদপত্রের মাধ্যমে। গ্রামঞ্চলের খেয়া নৌকাগুলোর মাঝে যেখানে সকল যাত্রীগন সেনাবাহিনীর সতর্ক পর্যবেক্ষণে ছিল; সেখানে অপরিচিতরা উঠে পরত এবং ফিসফিসিয়ে তাদের গণহত্যার কথা বলত আর না হয় মধুপুরের ঘন জঙ্গলের মাঝে কোথায় “ মুক্তিবাহিনী ” অথবা স্বাধীনতার বাহিনী লুকিয়ে আছে তা ইঙ্গিত করত। সর্বত্র দেশজুড়ে দ্রুত অতুলনীয় গেরিলা বাহিনীর যুদ্ধের চিহ্ন ছড়িয়ে পরেছিল। এবং পূর্ব পাকিস্তান হল আদর্শ গেরিলা খণ্ডের স্মারক হিসাবে পরিচিত দক্ষিন ভিয়েতনাম মেকং ব-দ্বীপের মত গোলকধাঁধা, যার নিম্মজিত ধানক্ষেত, পাটক্ষেত এবং কলার উপবন রয়েছে।
মুক্তি বাহিনী তাদের দৈনন্দিন বাড়িতে কিনে আনা অল্প সম্পদের ভিত্তিতে মূলধনরুপে তা প্রয়োগ করত। তারা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা যাওয়ার রেলপথ কেটে ফেলে এবং সাথে সাথে তার সমান্তরাল রাস্তাগুলোও ছিন্ন করে। ঐ পথগুলো দিয়ে অভ্যন্তরীণ ৬০% খাদ্য সরবরাহ করা হতো এবং তা পুনরুদ্ধার করার কার্যতই কোন প্রত্যাশা নেই যতক্ষণ না শান্তি পুনরদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি ঢাকার তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আঘাতের অভ্যুথানের মাধ্যমে সাফল্য অর্জিত হয়। যে কোন শহর বা গ্রামই প্রচারনার দিকে অর্থনৈতিক ভাবে স্থবির নয়। সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় হল বিদ্রোহ জয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে মনে হচ্ছিল ,যা কিনা প্রত্যেক গেরিলার জন্য জনগণের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। দুই মাস আগে নোয়াখালী প্রদেশের গ্রামবাসী মুক্তি বাহিনীর সাথে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে তার একটি সেতুও উড়িয়ে দিবে না কারন এটা সেনাবাহিনীর প্রতিশোধ বহন করে নিয়ে আসবে । গত সপ্তাহে ঐ গ্রামবাসীরাই গেরিলাদের খোঁজ করছিল এবং তাদের সেতুটি ধ্বংস করতে বলে।
নিশ্চিত ভাবে, গেরিলারা কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনী নয়। প্রায় ২০০০০ বাঙ্গালী যোদ্ধা তাদের নিজস্ব কারনে জড় হয়েছে। (এবং নতুন করে আরও ১০০০০০ পরবর্তী মাসের জন্য নিয়োগ করার প্রত্যাশা কড়া হচ্ছে পরবর্তী মাসে ভারতে গোপন প্রশিক্ষন নেয়ার জন্য।) ইচ্ছাকৃতভাবে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের এখনও ৬০০০০ সুসজ্জিত পেশাদার সৈন্য রয়েছে। এবং সভার এই সাহায্যের সত্ত্বেও, ভারত সতর্কতার সাথে বাংলাদেশ সরকারের নির্বাসনের বিষয়ে দোলায়মান। সংযমের একটি প্রকৃত কারন হলো এটি একটি ব্যয়বহুল সমস্যা এবং নিউ দিল্লীর সরকারকে ৬ মিলিয়ন বাঙ্গালী শরণার্থীর যত্ন নিতে হচ্ছে যারা এখন ভারতে আছে। “সংবাদসপ্তাহ ” –এ টনি ক্লিফটন যে পাকিস্তানী গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে শরণার্থীদের যন্ত্রণার কথা জানিয়েছেন। প্রতিবেদনটি গত সপ্তাহে কোলকাতায় প্রকাশিত হয়েছে।
এই ধকল ভারতের জন্য প্রায় অসহনীয়। শরণার্থীরা প্রায় প্রতিদিন দলে দলে দঙ্গল বেধে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে যা প্রতিদিন ৪০০০০ এর বেশি এবং পি এন লুথার সাবেক ভারতীয় কর্মসূচির দায়িত্তপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আমাকে বললেন, “ আমি এখন একটি ছোট দেশের যত্নের বিষয়ে দায়ী।” যার প্রতিদিনের খাবারের জন্য ভারতকে ৩ মিলিয়ন অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
বস্ত্র, ঘর এবং অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বাঙ্গালীদের প্রদান করতে হচ্ছে যা ভারতের প্রান্তিক অর্থনীতিকে খোঁড়া করে দিচ্ছে। তহবিলের অভাবে শরণার্থী শিবিরে কার্যত সব কিছুর ঘাটতির কারনের অনিবার্য ফলাফল হলো দুর্দশা, রোগ এবং মৃত্যু। লুথার এর মতে, একমাত্র অনুমেয় দুর্দশার সমাধান হলো, পাকিস্তানের উপর বিশ্বের চরম চাপ প্রয়োগ করা যাতে পাকিস্তান বাঙ্গালীদের হত্যা কাণ্ড বন্ধ করে। এবং বাঙ্গালিরা নিরাপদ বোধ করলেই বাড়ি ফিরবে।
এতো দুঃখ কষ্টের পরও বাঙ্গালিরা তাদের বৈরাগ্য বজায় রেখেছে। এটা ভারতে এখন বর্ষাকাল কিন্তু এখানে বর্ষাকাল হলিউডের মতো মহান বর্ষাকাল নয়। গর্জন এবং বজ্রপাতের পরিবর্তে নমনীয় এবং স্থির ভাবে পড়ে। তাবুর পালের উপর বৃষ্টি ঝরার ফলে তাতে শরণার্থীরা সিক্ত হয়। পৃথিবীর মেঝে কাঁদা হয়ে যায় এবং অপর্যাপ্ত ড্রেনের কারনে বন্যা হয়। কিন্তু শরণার্থীরা গোড়ালি পর্যন্ত পানিতে ধৈয সহকারে দাঁড়িয়ে থাকে। আগ্রহ নিয়ে তাদের ঘটনা বলে যাতে আমি অন্যদেরকেও তা শুনাতে পারি। আমার কাছে একটি নোটবুকে ভয়াবহ ধর্ষণ, খুন এবং অপহরনের ঘটনা লেখা রয়েছে। তারা বলে কি করে তাদের নিজেদের সন্তানদের ছুড়ির আঘাত পেতে দেখেছে, তাদের স্বামী অথবা ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড কি করে কার্যকর করা হয়েছে, কি করে তাদের স্ত্রীরা ক্লান্তি অথবা রোগে ধসে পরেছে। প্রত্যেকটি ঘটনাই নতুন এবং সব একই রকমের । আমার লুথারের দুঃখজনক প্রশ্ন মনে আছে , “ আমরা কি করে মনে করি যে মানব জাতি একটি উচ্চ স্তরে বিবর্ধিত হচ্ছে অথচ যখন আমরা এই ঘটনা ঘটে যেতে দেই ??? ”
সামরিক দমন এবং গেরিলা অন্তর্ঘাত চলছিল। এটা সর্বদা পাকিস্তানের নিজস্ব ভবিষ্যতের হুমকি বাড়িয়ে চলছিল। ইতিমধ্যে, বিশেষজ্ঞরা বলে দেশের অর্থনীতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। যখন থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে , রপ্তানি নিচে পরে গেছে। অত্যাবশ্যকীয় পাট ফসল যা পাকিস্তানের সর্বচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ফসল সংগ্রহের অভাবে পচন ধরেছে এবং পূর্বাঞ্চলের যারা পশ্চিম পাকিস্তানের কারখানার উপর নির্ভর করে বসবাস করত তারা এখন শরণার্থী অথবা বিদ্রোহীদের সাথে সাথে নিখোঁজ হয়ে গেছে। সংক্ষেপে, ইয়াহিয়া সরকার প্রকৃত পক্ষে দেওলিয়া হয়ে গেছে; যা ঢাকায় একজন অর্থনীতিবিদ সতর্ক করেন। সমানভাবে তিনি আরও বলেন যে প্রকৃত ভাবেই অনাহারের বিশাল দুর্যোগ হবে “ যদি না শীঘ্রই কিছু করা হয়।” একই অর্থনীতিবিদ আরও যোগ করেন যে এখানে একটি দুর্ভিক্ষ হতে চলছে যা পূর্বের কষ্টের তুলনায় কিছুই নয়। ” কিন্তু পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো সমুজ্জ্বল ঘৃণা যা ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী উৎপাদন করেছে। করাচীর একজন সম্পাদক বলেছেন, “ পাকিস্তান মার্চেই মারা গেছে। ” “এই জমি একত্তে ধরে রাখার উপায় হলো বেয়নেট এবং মশাল । কিন্তা তা ঐক্য নয় বরং দাসত্ব। ভবিষ্যতে আর কখনোই তা একটি জাতি হতে পারবে না, হবে শুধুমাত্র দুই শত্রু। ”
যুদ্ধের হুমকি
এলাকায় ইতিমধ্যে যথেষ্ট শত্রু রয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহে , নয়া দিল্লী এবং ইসলামাবাদ হতবুদ্ধিকর হারে একে অপরকে অপমান এবং অভিযোগের বাণিজ্য করেছে এবং একটি বাস্তব সম্ভবনা যে এই রাগন্বিত শব্দগুলো যুদ্ধকে তরান্বিত করতে পারে। প্রকৃত পক্ষেই কিছু ভারতীয় যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের দাবি করছে। নিউ দিল্লীর নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতে, বাংলার লাখো শরণার্থীর অবিরত যত্ন নেওয়ার জন্য চেয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ ভারতের জন্য সস্তা হবে। এটা এখনো আসেনি। একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী কর্মকর্তা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গত সপ্তাহে বলেন; গুরুতর ভাবে ভারত সেনাবাহিনীর চাপ অনুভব করছে। এবং পাকিস্তানও মুক্তিবাহিনীকে ভারতের সাহায্য করার কারনে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রতিবেশীর উপর বল প্রয়োগ করতে চাচ্ছে।
আরো গুরুতর বিপদের সম্ভবনা হলও এতে যদি কোন সাম্যবাদী দেশ চীন এবং রাশিয়া জড়িত হয়। চীনের প্রধানমন্ত্রী , চৌ- এন- লাই নিন্দা করে বলেন “ ভারত সম্প্রসারনবাদী ” এবং পিকিং পাকিস্তানের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন ; “যে তাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এটা ন্যায্য সংগ্রাম। ” এবং চৌ তার প্রতিজ্ঞা রুপান্তর করতে পারেন । ভারতীয় সীমান্তে চীনাবাহিনীর ঘাটিকে দাঙ্গার মাধ্যমে উত্তেজিত করে অথবা পাকিস্তানী বাহিনীতে “উপদেষ্টা ” নিয়োগের মাধ্যমে বাহিনীকে শক্তিশালী করে । পাকিস্তান পিকিং থেকে কিছু প্রতিশ্রুতি নিয়েছে। যখন তাদের নিজস্ব যুদ্ধ শুরু হবে তখন সামরিক ব্যবস্থা গ্রহন করবে; আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিকেরা তা সতর্ক করে। অন্যদিকে ভারতের কূটনৈতিকেরা বিপরীতভাবে সাম্যবস্থা তৈরির জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা আদায়ের চেষ্টা করে। যা বিপর্যয়কে নেতৃত্ব দিবে।
একটি পীড়াদায়ক মনোনয়ন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নিষ্ঠুর উভয়সংকটের মুখোমুখি হবে যদি কোন ভাবে দুটি সাম্যবাদী মহাশক্তিরা কোন ধরনের সম্প্রক্ততার মুখোমুখি হয়। বাঙ্গালীদের প্রতি পাকিস্তানের অনস্বীকার্য বর্বরতার সত্ত্বেও আমেরিকার দীর্ঘকাল ধরে যে কোন ধরনের সাহায্যের নিদারুন চেষ্টা , পিকিং গোলকের বাইরে রাখা তা যে কোন দেশই বুজতে পারবে। এবং একই সময় ভারত এশিয়ার সবচেয়ে বড় জাতি যার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রয়েছে, গান্ধী এবং নেহেরুর আগের সময়ে তা দেখতে পাওয়া যায়। এবং বন্ধুত্বপূর্ণ জাতি হিসাবেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টফলিওতে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাই দুটি জাতির মাঝে একটিকে পছন্দ করা যন্ত্রণাদায়ক হবে। একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বিষয়ের বিশ্লেষক মনে করেন উপমহাদেশে যুদ্ধ বিরতির উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যশই কাজ করা উচিত। তিনি আরও মন্তব্য করেন; “আমাদের প্রথম পদক্ষেপ অব্যশই শান্তিস্থাপক হিসাবে হওয়া উচিত, যা কিনা রাশিয়া তাসখনদে ১৯৬৬ সালে ভারত- পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় করেছিল। যদি তা ব্যর্থ হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এখানে অংশগ্রহন না করা । রাশিয়া এবং চীন দুই যোদ্ধাদের সাথে শুধুমাত্র সরবরাহকারী হিসাবে সংযুক্ত হতে পারে। কিন্তু যদি সরাসরি তারা জড়িত হয় তাহলে তখন ওয়াশিংটনের পক্ষে নির্লিপ্ত থাকা অসম্ভব হবে। আমাদের যে কোন একপাশে জুয়া খেলতে হবে । তাদের অন্তত যৌক্তিক সাহায্য দেওয়া দরকার যা তাদের প্রয়োজন এবং আশা করি আমরা বিজয়ী নির্বাচিত করব।
অলঙ্কার শাস্ত্র এবং ঘটনা নির্ভর পরিকল্পনা বাদে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশসমূহ ভারত উপমহাদেশের সামরিক ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চায় না। কিন্তু তা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে তারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এই সময়ের মাঝেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ এবং এশিয়ার সম্ভাব্য মিলিয়ন মানুষের জীবন ইয়াহিয়া খানের হাতে নির্ভর করছে। এবং যে মুহূর্ত থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি সম্ভাব্য মূল সাম্যবাদী বিদ্রোহকে উপেক্ষা করার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন আর তার কারনেই জাতীয়বাদী গেরিলা সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য দুঃখজনক ঘটনা হোল ইয়াহিয়া তার কর্ম ভুলে গেছে । ভুলে গেছে তার কর্মের ফল কি হতে পারে। ইসলামাবাদের একজন কূটনৈতিকের গত সপ্তাহের মন্তব্য হলো , “মাত্র একজন ব্যক্তি জীবিত আছে যে এখনও পাকিস্তানকে বাঁচাতে পারে। তিনি হলেন মুজিব ।” ইয়াহিয়া প্রতিজ্ঞা করেছেন, মুজিবকে অবশ্যই মরতে হবে। কিন্তু যেই দিন তিনি ঝুলে পড়বে তার সাথে সাথে পাকিস্তানও ঝুলে পড়বে ।
স্বস্তির রাজনীতি
যদি আমেরিকা কিছুটাও অস্পষ্টভাবে বাঙ্গালী শরণার্থীদের বিষয়ে সচেতন হন। এই সপ্তাহে বিটলসের জর্জ হারিসন এবং রিঙ্গো স্টার এই বার্তা সবাইকে পৌঁছানোর মনস্থ করেন । যখন থেকে এই বিখ্যাত রক গ্রুপ বিচ্ছিন্ন হয়েছে তারপর এটাই তাদের প্রথম উপস্থিতি। জর্জ এবং রিঙ্গো নিউ ইয়র্কের মাদিসন স্কোয়ার গার্ডেনে মঙ্গল অনুষ্ঠান করেন বাঙ্গালী গৃহহীন শিশু যাতে এগিয়ে যেতে পারে ।আর তা হলো অনেক চেষ্টার মাঝে কেবল একটি যা আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটি, ক্যথলিক মুক্তি সেবা, ইউনিসেফ এবং শিশু মুক্তি বাচ্চাদের জন্য সাথে আরও যারা পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের গণহত্যার উপর বিবেকের আলোড়নের নকশা করেছে।
অনেক বেসরকারি নাগরিক বাঙ্গালীর ত্রাণের জন্য জড়িত হচ্ছে যারা ২ বছর আগের “ বিয়াফ্রান ” দুর্ঘটনার সাথে অভিজ্ঞ ছিল। সবচেয়ে বড় ভয় হল বিয়াফ্রান শিশুদের উদ্ধারের সাথে অসদৃশ যে , বিশ্বব্যাপী তখন ব্যাপক সহানুভুতি জাগ্রত হয়েছিল কিন্তু তাদের তুলনায় বাঙ্গালী শরণার্থীদের জরুরী বিষয়ে তার উদাসী। পরিহাসের বিষয় হলো, কিছু অংশ পূর্ব পাকিস্তানের এই দুর্ভোগের মাত্রার জন্য তাদেরকেই দায়ী করে। “ বাঙ্গালী শরণার্থীরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থানচ্যুত ব্যক্তি। ” ডঃ ডেনিয়েল এল উয়িনার যে কিনা সম্প্রতি আই আর সি এর জন্য সত্য অনুসন্ধানী সফর থেকে ফিরে বলেন। “ এটা এমন একটি সমস্যা যে আন্তর্জাতিক মাত্রায় মোকাবিলা করতে হবে। কোন বেসরকারি চেষ্টাই এই সমস্যা মোকাবিলা করতে পারবে না । বেসরকারি সংস্থা শুধুমাত্র জগাখিচুড়ি দিক উপশম করতে পারে। কিন্তু সমস্যার আকার দেখে মনে হচ্ছে অসাড় মানুষের এই অনুপায় অনুভুতির ক্ষেত্রে আগ্রহ কম আছে।’’
ব্যস্ত
এ ধরনের অভিযোগের ধারনা পাওয়া যাচ্ছে যে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে তার নীতি সহনীয় পর্যায় আনার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন কিছুটা সাফল্যে প্রভাবিত করতে পেরেছে। যদি নিক্সন প্রশাসন ইয়াহিয়ার রাজত্বে সাহায্যের ক্ষেত্রে প্রধান ভিত্তি হল ইসলামাবাদের ওপর ওয়াশিংটন উদ্দেশ্য সাধনের সুবিধা দিবে। পটভূমির নীতির স্বদেশী সমালোচনার মুখে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বক বক এর মুখোমুখি হতে হচ্ছে।আগামি বছর পাকিস্তানকে ১৩১.৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিজ্ঞা বাজেটে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি কংগ্রেস এই প্রতিজ্ঞা ধরে রাখবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে যতক্ষণ না পাকিস্তান তার লক্ষাধিক গৃহহারা নাগরিকের মন্ত্রী না হয়। কিন্তু সন্দেহপ্রবন পর্যবেক্ষকেরা স্মরণ করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় একই রকমের একটি ০১১ সামরিক সাহায্য নিসিদ্ধ করছিল গত এপ্রিলে। কিন্তু পাকিস্তানী মালবাহী জাহাজে সরবরাহকৃত গোলাবারুদ ও খুচরা যন্ত্রাংশ ছিল এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পূর্বেই জাহাজের গতি পরিবর্তন করা হয় করাচীর দিকে। এবং গত সপ্তাহে সিনেটর স্তুয়ারট সিমিঞ্জটনকে অভিযুক্ত করা হয় নিষেধাজ্ঞায় খাদ থাকার কারনে। প্রশাসন সিমিঞ্জটনকে বলেন, শব্দার্থিক ও দ্ব্যর্থকবোধক বিবৃতি দিয়েছেন। পাব্লিক রেকর্ডের উপর কোন প্রমান ছাড়াই এবং যতক্ষণ না প্রকৃত ঘটনা উপস্থাপন করতে পারেন সে পর্যন্ত এই আরোপ অক্ষত থাকবে।
কৌশল
ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা স্বীকার করেন যে, সব কিছুর উপরে ওয়াশিংটন কৌশলগত বিবেচনার বাহিরেও পাকিস্তানের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে। একজন কূটনৈতিক পাকিস্তানের উপর আমেরিকার প্রভাব শেষ করতে সতর্ক করে দিয়েছেন। “ আমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হয়েছে। ” তিনি যুক্তি দেখান, “এই এলাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের জন্য খেলার মাঠ হতে পারে।” একজন সহকর্মী বিস্ময়কর রকমের অল্প বুদ্ধির সাথে যুক্ত করেন, “ আমরা এই মুহূর্তে নৈতিকতার চেয়ে স্থায়িত্তের বিষয়ে বেশি আগ্রহী …… এখন স্থায়িত্তের এতই ক্ষীণ যে তা ইয়াহিয়ার সাথে থাকারই সমান।
যদিও ঠাণ্ডা রাজনৈতিক মূল্যায়ন সত্ত্বেও সমস্যা থেকে নিজেকে প্রমান করা তা একটা জিনিসের জন্য শেষ পর্যন্ত অগ্রহণযোগ্য হবে। ওয়াশিংটন পূর্বনির্ধারিত ভাবে অনিচ্ছুক ইসলামাবাদের জন্য সাহায্য বন্ধ করে চাপ দিয়ে বিশ্ব ব্যাংক এবং এগার জাতির সাথে মতভেদ করা। প্রত্যেকের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রোগ্রাম রয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামাবাদ পূর্ব অঞ্চলের সাথে “ রাজনৈতিক সমঝোতা ” না করে। এমনকি বিশ্ব ব্যাংক পর্যন্ত পাকিস্তানের এই বিতর্কে ঘুরপাক খাচ্ছে, পালিয়ে যেতে পারছে না। পরে বিশ্ব ব্যাংকের রাষ্ট্রপতি রবার্ট ম্যাক নামারা একটি সমলোচনামূলক প্রতিবেদন দমন করার চেষ্টা করেন যা সম্প্রতি পাকিস্তান সফর শেষে একটি দল তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস নথিটি ধারন করে এবং প্রথম পাতায় ছাপায়। পরবর্তীকালে ম্যাকনামারা পাকিস্তানী সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেন লিখেন খবরটি প্রকাশ হওয়ার জন্য।
তাছাড়া ওয়াশিংটনের দ্ব্যর্থক ব্যক্তব্যের কারনে ভারত ইতিমধ্যে যেখানে প্রায় সব কর্মকর্তার বিশ্বাস যে বাইরের সাহায্য ছাড়া ইয়াহিয়া নির্যাতনের নীতি অব্যাহত রাখবে না। “ বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোন দেশ পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করার মানে হলও বাংলাদেশের গণহত্যা না দেখার ভান করার শামিল।” ভারতে পররাষ্ট্রপতি সত্তরাম সিং অভিযোগ করেন, এটা ভারত- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলবে। ” এইভাবে সঠিকভাবে বা ভুলভাবে পাকিস্তান প্রশ্নে প্রশাসনের বাস্তবমুখী বাঁধা দেওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের অন্তরবেদনার উপর জমি- শত্রুতার প্রভাব উন্নীত করে । আর এই ছাপ সকরুন আমেরিকার ছবি কে সতর্ক করে।