আবেদনে গণহত্যা বন্ধ হবে না
সংসদ প্রস্তাব নিয়েছেন। পূর্ববাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের সংগ্রামে তারা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। আর নিন্দা করেছেন পশ্চিম পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের গণহত্যার। সংসদ সদস্যদের দৃঢ় বিশ্বাস সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হবে। আবেগ কম্পিত কণ্ঠে বক্তৃতা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে প্রস্তাব। দুনিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং জনতার কাছে আবেদন জানিয়েছেন সংসদ সদস্যরা। তারা যেন পূর্ববাংলার গণহত্যা বন্ধের জন্য পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ দেন। প্রস্তাবের বয়ান সুন্দর। ভাষায় রয়েছে সরল প্রাণের আকুল ক্রন্দন। ধ্বনিত হয়েছে। দিশাহারা এবং উদ্ধেলিত সাধারণ মানুষের অন্তর বেদনা। সীমান্তের ঠিক ওপারে ফ্যাসিস্ত দস্যুদের নৃশংস অত্যাচারে হাহাকার করছে মানবাত্মা। এপারে দাঁড়িয়ে দেখছেন গণতন্ত্রী ভারতের লক্ষ লক্ষ নরনারী। যারা নরপশুদের উদ্দাম হত্যালীলা থেকে গণতন্ত্র বাচাবার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত তাদের কাছে হাতিয়ার পৌছে দিতে পারছেন না তারা। প্রতিদিন গড়ে উঠছে শবের পাহাড়। এ অবস্থায় নৈতিক সমর্থনের এবং গাঢ় সহানুভূতির বাস্তব মূল্য কতটুকু? ওপারের মুক্তিযােদ্ধাদের কাতর মিনতি জন্ম চাই। দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এ শেষ পর্যন্ত আমরা জিতবই। হত্যার ব্যাপকতা এড়াবার জন্য দরকার অস্ত্র ও সমরসম্ভার।
ইসলামাবাদের ডাকাত সর্দাররা নৈতিক উপদেশের ধার ধারেন না। তারা বিশ্বাসঘাতক এবং হীনচক্রী। আপােষ আলােচনার অছিলায় সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র এনেছেন তারা পূর্ববাংলায়। তারপর অতর্কিতে হেনেছেন প্রচণ্ড আঘাত। মুজিবর পাকিস্তানকে টুকরাে করে ফেলতে চান নি। চেয়েছিলেন ছ’দফা ভিত্তিক স্বায়ত্বশাসন। জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে তাঁর দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য। গণতন্ত্রের মৌলনীতি অনুযায়ী তিনিই গােটা পাকিস্তানের সত্যিকারের নেতা। লােকায়ত সরকার পরিচালনা এবং সংবিধান রচনার পুরাে দায়িত্ব তার উপর। ভূইফোড় ডিকটেটর ইয়াহিয়া তা স্বীকার করেন নি। পাণ্ডবলে তিনি পূর্ব বাংলাকে বগলদাবা করতে চেয়েছেন। তার ধৃষ্টতা সীমাহীন। মুজিবর রাষ্ট্রদ্রোহী, আর নরঘাতী এবং বিশ্বাসঘাতক সামরিক নেতা ইয়াহিয়া দেশপ্রেমিক। ইসলামাবাদের হঠকারীর এই প্রগলভ উক্তিই পূর্ব বাংলাকে ঠেলে দিয়েছে সার্বভৌম স্বাধীনতার পথে। মুক্তিযােদ্ধারা নেমেছেন রাস্তায়। দখলদারী সৈন্যদের বাধা দিচ্ছেন জান প্রাণ দিয়ে। হাজার হাজার শতীদের রক্তে যাদের হাত কলঙ্কিত শুধু অবেদনে বন্ধ হবে তাদের রাক্ষুসী ক্ষুধা এ কল্পনা অবাস্তব। পাকিস্তান দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ, অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার। একের হাতে জনতার সনদ এবং অপরের হাতে আসুরিক বল। একের লক্ষ গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং অপরের লক্ষ্য তার ধ্বংস। এ দু’য়ের মধ্যে কোন মিলন সেতু নেই। যদি থাকত তবে মুজিবর আয়ুবে আলােচনার সময়ই তা বেরিয়ে পড়ত। বাঙালীর উপর ডাল কুত্তাদের লেলিয়ে দেবার প্রয়ােজন ইয়াহিয়ার হত না। নয়াদিল্লী কি মনে করেন, বৃটেন এবং আমেরিকা ইয়াহিয়ার উপর সক্রিয় চাপ দিবে? সেন্টোর শরিক হিসেবে আপকালে ইসলামাবাদের শাসককুলের পাশে দাঁড়াতে ওরা কি দহরম-মহরম করেছে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সঙ্কটে। এখন পূর্ববাংলার উত্তাল তরঙ্গে নৌকা ভাসাতে তার সরম লাগছে। দুনিয়ার সর্বত্র গণ-আন্দোলনের উদ্দাম সমর্থনে চীনের বিপ্লবী আত্মা নেচে ওঠে। পূর্ববাংলার বেলায় সে নীরব। সােভিয়েট এবং চীনা অস্ত্র নিয়ে ইয়াহিয়ার ফ্যাসিস্ত বর্বরদল চালাচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যা। সামরিক অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে অসামরিক জনতা ধ্বংসে। গণহত্যা প্রতিরােধে এদের সাহায্য পাওয়া দুঃসাধ্য। অথচ তাদের সমর্থন ছাড়া রাষ্ট্রসংঘে এক পাও এগুনাে যাবে না। মুজিবর এখন যে পর্যায়ে এসেছেন সেখানে থেকে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। লক্ষ শহীদের শােণিতধারার অপমান সহ্য করবেন না বিদ্রোহী বাঙালী। স্বধীনতার ঘােষণার প্রত্যাহারের পরিণতি বর্তমান নেতৃত্বের আত্মহত্যা। সংগ্রামের চরম মূহর্তে এপর নিতে পারেন না কোন দূরদর্শী এবং বাস্তববাদী নেতা। পদ্মার জলে নৌকা ডুবিয়ে চলে গেছেন ইয়াহিয়া খান। ডুবাে নৌকা টেনে তােলা সম্ভব নয়। ইয়াহিয়া আত্মসমর্পণের অর্থ তাঁর গদীচ্যুতি। দুই চরম পথ এক জায়গার মিশাবার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তবু আপােষের অলীক স্বপ্ন দেখছেন নয়াদিল্লী। বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা বলার কোন অধিকার নেই ইসলামাবাদের। ওদের ঔপনিবেশিক শাসন চুণবিচূর্ণ। হয়ত লড়াই চলবে দীর্ঘদিন। শেষ পর্যন্ত জিতবেন। গণতন্ত্রী শক্তি। সংসদ সদস্যরাও তাই মনে করেন। এই যদি হয়ে থাকে তাদের আন্তরিক বিশ্বাস তবে ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়াে বােঝাপড়ার আশা তাঁরা ছিড়ে দিন। পশ্চিম পাকিস্তানের হিংস্র শাসকদের বিবেকের উপর চাটি মারার অভ্যাস পরিত্যাগ করেন। যে জিনিসের কোন অস্তিত্ব নেই তার উপর চাপ এবং তার কাছে আর্জি অর্থহীন। স্বাধীন বাংলা দেশের সরকারের রীতিসম্মত আবেদন আসা মাত্রই তাকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানের জন্য পস্তুত থাকুন। তাহলেই পূর্বের মুক্তিযােদ্ধারা পাবেন অফুরন্ত সংগ্রামী প্রেরণা। সম্বিত ফিরবে ফ্যাসিপ্ত বর্বরদের। শবের পাহাড় হয়ত বাড়বে কিন্তু গণতন্ত্র জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশ বাঁচবে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১ এপ্রিল ১৯৭১