চীনের বিপ্লবী বিবেক আজ কোথায়?
বাংলা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা লড়াই করছেন ইয়াহিয়া খানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। জঙ্গী শাহীর রক্তলেলুপ নেকড়ের দল ছারখার করছে সােনার বাংলা। মুক্তিযােদ্ধাদের কলিজা চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে স্বৈরতন্ত্রী শােষকদের জ্বলন্ত বুলেট। লক্ষ লক্ষ শহীদের শবে ভরে যাচ্ছে বাংলাদেশের পথ-ঘাট। নারীর সম্ভ্রম নিয়ে টানাটানি করছে পাক দস্যুরা। চীনের বিপ্লবী বিবেক আজ কোথায়? পিকিং বেতারের উচচগ্রামী কণ্ঠ উত্তাল বাংলার কিনারায় ঠেকে স্তব্ধ হয়ে যায় কেন? পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে আন্দোলন শুরু হলে বগল বাজায় চীন। আন্দোলনের প্রকৃতি বিচারের ধৈর্য থাকে না নেতাদের। সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসে সত্তর কোটি চীনা নরনারীর অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি। আপােষহীন সংগ্রামের জন্য চলে অপ্লিবর্ষী আহ্বান। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য চীনা অস্ত্রগার খুলে দেবার ইঙ্গিত জানান পিকিং। রাষ্ট্র হিসাবে চীন নাকি খাটি বিপ্লবী। অন্য সবাই ভেজাল। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বােবা চীন ধরেছে ভিন্ন পথ। পশ্চিমা ফ্যাসিস্ত শয়তানদের হাতে রয়েছে চীনা অস্ত্র। বিপ্লবী বাঙালীর রক্তে মিটাচ্ছে। তারা অনন্ত পিপাসা। ইয়াহিয়ার অভিযান কাদের বিরুদ্ধে? গণতন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে? তেইশ বছরের শােষণের জ্বালার অবসান ঘটাতে যারা দৃঢ়সঙ্কল্প, তাদের বিরুদ্ধে। চীনের বিপ্লবী ভান্ডারে বিপ্লবী আশীর্বাদের ধান দূর্বা আছে বাড়ন্ত। ছিটে-ফোটাও জুটছে না পূবের জাগ্রত বাঙালীর কপালে। এমনি তাদের বরাত যে, আশীর্বাদের বদলে ওরা পাচ্ছেন চৈনিক প্রতারণা।
পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীকে শুধু অস্ত্র দিয়েই ক্ষান্ত হয় নি চীন। তার আকাশপথে পশ্চিমের পাকফ্যাসিস্তরা পাড়ি জমাচ্ছে বিপ্লবী বাঙলয়। সংখ্যালঘু ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম রাখতে চায় তারা সংখ্যাগুরুর উপর। গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরেছেন সামরিক নেতা ইয়াহিয়া খান। আর তাকে মদৎ দি পিকিং এর একনিষ্ঠ বিপ্লবী দল। এ ভন্ডামী কত দিন সহ্য করবেন দুনিয়ার গণতন্ত্রী এবং শান্তিকামী মানুষ। ভিয়েতনামে মার্কিন ধ্বংসলীলার নিন্দায় চীন পঞ্চমুখ। আর বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যার সে সাহায্যকারী। যারা এই নরমেধ যজ্ঞের প্রধান হােতা তাদের অন্যতম জুলফিকার আলি ভুট্টো। সিন্ধুর এই রাজনৈতিক শকুনি পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের জিম্মাদার এবং চীনের প্রাণের দোস্ত। এই সর্বনাশা দোস্তই ডেকে এনেছে বাংলাদেশের হাহাকার। জঙ্গী চক্রকে করে তুলেছে দুঃসাহসী। ওদের হাতে যদি চীনা এবং মার্কিন অস্ত্র না থাকত তবে বিপ্লবী বাংলাদেশ এতদিনে পশ্চিমা বর্বরদের সাগরের জলে ডুবিয়ে মারত। নিরস্ত্র জনতার চাপে ইয়াহিয়ার ডলকুত্তর দল আজ কোণঠাসা। তাদের মনোেবল নিম্নগামী। অস্ত্রাগার এবং খাদ্যভান্ডার প্রায় নিঃশেষিত। বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখতে হলে ওদের দরকার আরও অন্য, আরও রসদ এবং আরও পশ্চিমা সৈন্য। চীনের আকাশপথে ইয়াহিয়া পাঠাচ্ছেন শােণিতসিক্ত বাংলাদেশে জল্লাদের দল এবং গণহত্যার প্রয়ােজনীয় সমরসম্ভার। পিকিং নেতারা একবার ভেবে দেখেছেন কি, কে এই মুজিবর রহমান এবং কে এই ইয়াহিয়া। মুজিবর সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর গণতান্ত্রিক নেতা। আর ইয়াহিয়া জনগণের সাথে সম্পর্কহীন সামরিক নেতা। আর ভুট্টো? সিন্ধু এবং পাঞ্জাবের সংখ্যাগুরু দলের দুষ্টবুদ্ধি পালােয়ান। ভুট্টো-ইয়াহিয়ার আতাতের দোসর পিকিং সুবিধাবাদী মহানায়কগােষ্ঠী।
ভারতের পথ পরিষ্কার। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি সংসদ জানিয়েছেন অকুণ্ঠ সমর্থন। সংগ্রামী জনতার চূড়ান্ত বিজয়ের দৃঢ় প্রত্যয় ঘােষণা করেছেন তারা। ভারতের প্রত্যেকটি মানুষ দেখতে চান বাংলাদেশের বিপ্লবের সার্থক পরিণতি। তার জন্য সব রকমের ত্যাগ স্বীকারে তারা প্রস্তুত। কোথায় এখন। চীনের সংগ্রামী জনতা? কোথায় তাদের বিপ্লবী সরকার? ভারতের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাতে তাদের এত দ্বিধা কেন? চীনা বৈল্পবিক প্রচারযন্ত্রের এমনি মহিমা, তাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের দরদী বন্ধু ভারত প্রতিক্রিয়াশীল এবং ভুট্টো-ইয়াহিয়ার দোস্ত চীন প্রগতিবাদী। বাংলাদেশ আজ সভ্য দুনিয়ার সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। জাগিয়ে তুলতে হবে বিশ্ববিবেক। অসংখ্য ধিক্কারে ক্ষতবিক্ষত হােক ভুট্টো-ইয়াহিয়ার পঙ্কিলদেহ। এই সঙ্গে ছিন্ন-বিভিন্ন হয়ে যাক চীনের বৈপ্লবিক ভন্ডামীর মুখােশ। আকাশ কাপিয়ে আওয়াজ উঠুক পশ্চিমা জঙ্গীশাহী এবং তাদের প্রাণের দোস্তরা সমভাবে মানবদ্রোহী। বিশ্বের দরবারে গণহত্যার ঘৃণিত আসামী।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১ এপ্রিল ১৯৭১