ইয়াহিয়ার সর্বাত্মক প্রস্তুতি
কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন ইয়াহিয়া খান। রণহুঙ্কার দিয়েছেন তিনি পাঞ্জাবে। খােলা হয়েছে নূতন নূতন রিক্রটিং সেন্টার। যুবকেরা যােগ দিচ্ছেন সৈন্যবাহনীতে। স্বল্পমেয়াদী শিক্ষণের পর ওরা যাবে বাংলাদেশে। সেখানে খুড়রে বাঙালীর কবর। প্রায় তিন তিন ডিভিসন পশ্চিমা ঘাতকে এখন কুলােচ্ছে না। সাড়ে সাত কোচি নিরস্ত্র নরনারীকে কোতল করতে হলে দরকার আরও ঘাতক এবং মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র । প্রচণ্ড বাধা মুজিবুর বাহিনী। বড় বড় শহরে এবং ক্যন্টনমেন্টগুলােতে কোণঠাসা করে রেখেছে তারা পশ্চিমা জল্লাতের। বর্ষার আগেই এই লৌগহনেষ্টনী ভাঙতে না পারলে সমূহ বিপদ। নিরবিচ্ছিন্ন বৃষ্টিধারায় এবং পলপ্লাবনে গতিহীন হয়ে পড়বে ইয়াহিয়ার চমু। মুক্তিযােদ্ধারা তখন নেবে নির্মম প্রতিশােধ। ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকদের চোখের সামনে ঝুলছে কালাে পরদা। ওট সরাবার সাহস তাদের নেই। এই পরদার পিছনে জ্বলন্ত অভিশাপ নিয়ে অপেক্ষা করছে লক্ষ লক্ষ নরনানীর এবং শিশুর অশান্ত আত্মা। সবার দৃষ্টি অরণ্যের এই হিংস্র জানােয়ারদের ওপর। জীবিতের চেয়ে মৃতের মানবিক আঘাত বেশী মারাত্মক। তারাই আনে দুনিয়জোড়া ধিক্কারের উত্তাল প্রবাহ। সংশয়ের জাল ছিড়ে গেছে। বিশ্বজনতা আজ বাস্তবের মুখােমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের একটি প্রভাবশালী অংশ চান বাংলাদেশে হণহত্যার অবসান। কিন্তু ইয়াহিয়া বেপরােফা। জল এবং আকাশপথে পাঠাচ্ছেন তিনি পশ্চিমা সৈন্য। বিমান থেকে অসামরিক জনতার উপর বােমা বর্ষণই শেষ কথা নয়। বীভৎস নাটকের বীভৎসতম দৃশ্য অভিনয়ের জন্য ইয়াহিয়া কৃতসঙ্কল্প। তার জন্যই পাঞ্জাবে তার সর্বাত্মক প্রস্তুতি।
মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে অগ্নি পরীক্ষা। সামনা সামনি আক্রমণ দ্বারা সুরক্ষিত ঘাটিগুলাে থেকে পশ্চিমাদের উৎখাত সহজসাধ্য নয়। তা করতে হলে যে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র দরকার তা নেই তাদের। মাথার উপরের আকাশ ইয়াহিয়ার জঙ্গী বিমানগুলাের কাছে উন্মুক্ত। বিমানধ্বংসী কামান কিংবা জঙ্গী বিমান নেই মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রাগারে। নেই তাদের দূর কিম্বা মাঝারী পাল্লার কামান। সাঁজোয়া গাড়ী এবং ট্যাঙ্কের অভাব বােধ করছে তারা প্রতিটি রণাঙ্গনে। এ অবস্থায় ইন্দুর-মারা কৌশল প্রয়ােগ ছাড়া মুজিব বাহিনীর সামনে অন্য কোন পথ খােলা নেই। তাদের মনােবল অটুট। হয়ত সংগ্রাম চলবে দীর্ঘদিন। বর্ষার স্রোতের সঙ্গে মিশবে আরও রক্ত। চিরাচরিত ঘােলা জলে ঘটবে লাল রক্তের মিশ্রণ। কোন ডিকটেটর আপােষে ক্ষমতা ছাড়ে না। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান সহজে ঘটে না। ইয়াহিয়ার প্রথম আক্রমণ প্রতিহত । দ্বিতীয় আক্রমণের প্রস্তুতিপর্ব প্রায় সমাপ্ত। দুনিয়ার সামগ্রিক চেতনা জাগ্রত হবার আগেই হয়ত আসবে সম্ভাব্য আঘাত। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবার আগেই হয়ত শুরু হবে। সর্বাত্মক নারকীয় অভিযান। বাড়বে গণহত্যার ব্যাপকতা।
প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। সােভিয়েট রাশিয় ইসলামাবাদে কড়া চিঠি পাঠিয়ে এবং সাফ জবাব পেয়ে চুপ করে বসে আছে। আমেরিকা এখনও আমতা আমতা করছে। বাংলাদেশের হত্যাকান্ডে মার্কিন সরকার উদ্বিগ্নশুধু এইটুকু বলেই সে নীরব হয়ে গেছে। বিপ্লবী চীনের কণ্ঠে বাক্যস্ফুরণ হচ্ছে না। রাষ্ট্রসংঘ ক্লীব এবং বধির। বাংলাদেশের আর্ত নরনীর কান্না তাকে নাড়া দিচ্ছে না। আন্তর্জাতিক রেডক্রশকে আর্তত্রাণের সুযােগ দিলেন না ইয়াহিয়া খান। এই মানববিদ্রোহীর বিরুদ্ধে সক্রিয় ধিক্কার উঠল না বৃহৎ শক্তিগুলাের মুখে । আর কতদিন চলবে এ ধরনের লুকোচুরি খেলা? পশ্চিমা নেকড়ের দল উন্মাদ। নারকীয় উন্মাদনা চলছে তাদের মধ্যে। এদের বুলেটে প্রতিদিন মরছে শত শত নরনারী এবং শিশু। ক্যান্টনমেন্টগুলােতে চলছে জোর করে ধরে আনা মেয়েদের নিয়ে পাশবিক বান্ডব। অবৈধ হয়ে পড়েছে ভরাব। পাক নিক্ষিপ্ত বােমা কিম্বা গােলাগুলী হয়ত অঘটন ঘটাবে সীমান্ত অঞ্চলগুলােতে। এ আশঙ্কা এখন প্রবল। যথাসময়ে অবশ্যই সে স্বীকৃতি দেবে। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে। জাতীয় স্বার্থে এবং আদর্শের তাগিদে অবশ্যই তাকে সক্রিয়ভাবে দাঁড়াতে হবে মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে। প্রতিবেশী একটি গণতান্ত্রিক শক্তিকে স্বৈরাচারীর পায়ের চাপে পিষ্ট হতে দিতে পারে না ভারতীয় জনতা। বাংলাদেশের রক্ত-তরঙ্গের লহরী গােনার সময় আর নেই। ইয়াহিয়া ভাল কথার মানুষ নন। এ পরিচয় পেয়েছে আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়া। তাদের বলার সময় এসেছে-গণহত্যা থামাও। জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশের ন্যায্য অধিকার মেনে নাও। নইলে ফ্যাসিস্ত দস্যুর প্রাপ্য শাস্তি এথকে রেহাই পাবে না ইসলামাবাদ। একথা তারা এখনও বলতে না পারে তবে ভবিষ্যতে তাদের মানবতার ফাঁকা বুলি কেউ বিশ্বাস করবে করবে না। বাঙালী রক্তমূল্যে অবশ্যই আনবে তাদের স্বাধীনতা। ইয়াহিয়া ডুববেন। পতনের আগে গলা টিপে মারতে চাচ্ছেন তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছেন কলকারখানাগুলাে। শস্য-ভান্ডারে জ্বলছে আগুন। ক্ষেত-খামার থেকে কৃষকদের তাড়িয়ে বেরাচ্ছে পশ্চিমা সৈন্যদল। ওদের কলিজা চিরে ফেলতে না পারলে বাঁচবে না বাংলাদেশ। এ কাজ করবে বাঙ্গালীর দূর্জয় মুক্তিযােদ্ধারা। তাদের শুধু দরকার বাইরের সক্রিয় সাহায্য এবং কূটনৈতিক স্বীকৃতি।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১১ এপ্রিল ১৯৭১