পাকিস্তান কি যুদ্ধের উস্কানী দিচ্ছে?
পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর ধারণা, ইসলামাবাদ থেকে ঢাকায় যাওয়ার সােজা রাস্তা নয়াদিল্লী হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাটিতে ও জলে আটকে গিয়ে তারা সেই সােজা রাস্তা ধরার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। রাস্ত টা তাদের খুবই চেনা। এই রাস্তায় ইয়াহিয়া খান ও তার আগে অনেক পাক নেতাই হেটেছেন। পাকিস্ত নের শাসকরা জানেন, তাঁদের মামলায় ভারতকে জড়াতে পারলে কাজ হাসিল। করার অনেক সুবিধা। পাকা কাঁঠালের কোয়া ভাঙ্গলে যেমনভাবে মাছি এসে জোটে, ভারত-পাকিস্তান বিরােধ পাকলে তেমনিভাবে দুনিয়ার তাবৎ মুরুব্বি দেশ এসে জুটবে। পাকিস্তানের মিলিটারি বুটের তলায় বাংলাদেশকে পিষ্ট হয়ে যেতে দেখেও যেসব দেশ আজ আঙ্গুল নাড়ছে না তারা অনেকেই ভারত-পাকিস্তান বিরােধ সালিশী করার জন্য পা বাড়িয়ে আছে। আর ভারতের সঙ্গে ঝগড়া বাধাতে পারলে পাকিস্তানের পক্ষে চীনের কোল পাওয়া তাে মহা সুবিধা। তাছাড়া, ভারত-পাকিস্তান বিরােধটাকে অতি সহজেই একটা সাম্প্রদায়িক বিরােধের প্রতিফলন হিসেবে খাড়া করে ইয়াহিয়ার দল মুসলিম দেশগুলির সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে পারেন। বাংলা দেশের লড়াই দীর্ঘকাল চালিয়ে যেতে হলে পশ্চিম পাকিস্তানের দিকেও জেনারেল ইয়াহিয়াকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সুতরাং পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করার চেষ্টা করবে, এটা স্বাভাবিক। প্রথম চোটেই পাকিস্তান চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলে সারা পৃথিবীকে বােঝাবার চেষ্টা করেছিল যে, ভারত বাংলা দেশে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী ও অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে। এই প্রচারে কেউই ভােলেন নি। একাধিক বিদেশী সাংবাদিক বাংলাদেশের ভিতরে ঘুরে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, সশস্ত্র ভারতীয় বাহিনীর অনুপ্রবেশের কাহিনীটা একেবারেই ভূয়া। শ্রীহট্টে প্রবেশের পথে নয়টি অস্ত্র-বােঝাই ভারতীয় গাড়ী ঘায়েল করার একটা গল্পও পাকিস্তান থেকে প্রচার করা হয়েছিল। বিদেশী সাংবাদিক বলেছেন এগুলি পাকিস্তানেরই একটি চা বাগানের গাড়ী, ঐ বাগানের মধ্যে ছিল। এই ধরনের অপপ্রচারে সুবিধা করতে না পেরে পাকিস্তান এখন ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক লড়াইয়ে নামছে। ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাই-কমিশনার অফিসের কর্মীদের ও তাদের পরিবারবর্গের চলাফেরা করা, ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ করা ও বসবাস করা অসম্ভব করে তােলা। হয়েছে, নয়াদিল্লীতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার অফিসের যে দুজন কর্মচারী ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবী করা হয়েছে এবং কলকাতায় সার্কাস এ্যাভিনয়ের বাড়ীটি পাকিস্তানের নূতন ডেপুটি হাই কমিশনারের হাতে তুলে দেওয়ার আবদার জানান হয়েছে। ভারত সরকার সঙ্গতভাবেই ঢাকা থেকে ডেপুটি হাই কমিশনার অফিসের কর্মী ও তাদের পরিবারবর্গকে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত করেছেন এবং পাকিস্তানের অন্যায় আবদারগুলি প্রত্যাখ্যান করেছেন। পাকিস্তান জানে যে, ভারত তার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নয়াদিল্লীতে তার দুজন কূটনৈতিক কর্মচারীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়নি। এটাও জানা কথা যে, পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার ও তার অফিসাররা যদি বিদ্রোহ করে থাকেন তাহলে সেই বিদ্রোহ দমনে পাকিস্তান ভারতের সাহায্য আশা করতে পারে না। আসলে, এগুলি হচ্ছে ভারতের বিরুদ্ধে একটা কূটনৈতিক লড়াইয়ের প্রস্তুতি অর্থাৎ বাংলা দেশের যুদ্ধের একটা দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলার চেষ্টা।
কিন্তু পাকিস্তান কি ভারতের বিরুদ্ধে শুধু কূটনৈতিক লড়াই চালিয়েই ক্ষান্ত থাকবে? এমন কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যাতে মনে হচ্ছে, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের আরও কিছু বদ মতলব আছে। পাকিস্তান বেতার থেকে জোরগলায় বলা হয়েছে, পূর্ববঙ্গের ভারত সীমান্তে সৈন্য মােতায়েন করা হয়েছে। শুধু পূর্বেই নয়, পশ্চিমেও সীমান্তে পাকিস্তানি সৈন্য সমাবেশের খবর পাওয়া গেছে। ডেরা বাবা নানকের কাছে পাকিস্তানি ফৌজকে তাবু গাড়তে ও কামান বসাতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে, ইয়াহিয়া খা ও তার অনুগমীরা বাংলাদেশে লেজ পুড়িয়ে এসে লেজের আগুন ভারতবর্ষে ছড়াবার চেষ্টায় আছেন।
পাকিস্তান যখন প্রকাশ্যেই সদম্ভে সৈন্যবাহিনীর দ্বারা তার সীমান্ত সুরক্ষিত করার কথা বলছে তখন ভারতের কর্তব্যও পরিষ্কার। ভারতকেও তর সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করতে হবে। এই সীমান্ত পাহারা দেওয়ার ভার এখন আর সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর উপর ছেড়ে রাখা যায় না। পাকিস্তান যুদ্ধ বাধাতে পারে, একথা ধরে নিয়েই আমাদের সৈন্যবাহিনীকে তৈরি রাখতে হবে। পাকিস্তান যদি যুদ্ধ চায় তাহলে সে যুদ্ধই পাবে, একথাটা তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার হয়ে পড়েছে। ভারত সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে বিরােধে জড়িয়ে না পড়ার জন্য অতিশয় উৎসুক, যে জন্য তারা নিজেদের দেশের জনমতকেও উপেক্ষা করছেন। কিন্তু পাকিস্তান যেভাবে উস্কানী দিয়ে যাচ্ছে তাতে ভারত সরকারের ভালমানুষি বােকামির নামান্তর হতে পারে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২২ এপ্রিল ১৯৭১