কূটনৈতিক আগুনে লড়াই
জনার মাহতি মাসুদের বরাত খরাপ। ইসলামাবাদের ফরমান নিয়ে তিনি এলেন কলকাতায়। স্বাধীন বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন দখল না করে তিনি ছাড়বেন না। ওখানে উড়াবেন পাকিস্তানি পতাকা। তাজউদ্দিন সরকারের প্রতিনিধি জনাব হুসেন আলী দূর্গদ্বার বন্ধ করে দিয়েছেন। হাজার হাজার নরনারী তার অতন্দ্র প্রহরী। জনাব মাসুদ মস্ত বড় বীর। তার গলায় ঝুলছে পাক-ডেপুটি হাইকমিশনারের তমা। সঙ্গে ত্রিশজন অবাঙালী পাক-কূটনৈতিক যােদ্ধা। কলকাতার মাটি বড় গরম। সেখানে ইসলামাবাদের নরঘাতকদের খিদমৎগারের পা রাখা শক্ত। জনাব হােসেন আলীর দুর্গ দখলের জন্য ইয়াহিয়া চাইলেন নয়াদিল্লীর পুলিশ সাহায্য। কর্তৃপক্ষ বললেন, আদালতের শরণ নাও। আইন নিয়ে আদালতের কারবার। ইয়াহিয়ার জংলী রাজত্বে আইনের অস্তিত্ব নেই। ওখানে সৈন্যদের বন্দুকই আইন। জনাব মাসুদ যদি কোন সভ্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হতেন তবে বাস্তববােধ তার থাকত। তা নেই বলেই পদে পদে তিনি হয়েছেন বিড়ম্বিত। হােটেলেন কর্মীরা তাকে করেছেন বয়কট। ব্যাঙ্ক কর্মীরা দিয়েছেন ধিক্কার। জনতা দেখিয়েছেন বিক্ষোভ। ব্যক্তি হিসাবে তার উপর কারও আক্রোশ নেই। জনাব মাসুদের অপরাধ তিনি বর্বর সরকারের প্রতিনিধি। সীমান্তের ওপারে যারা চালিয়েছে গণহত্যা তিনি তাদের ভাড়াটিয়া উকিল। মানবদ্রোহীদের কৃতমর্মের প্রতিবাদে জনাব আলী তুলেছেন জয় বাংলা নিশান। আর নরহস্তাদের সমর্থনে জনাব মাসুদ এসেছিলেন কলঙ্কিত পাক-ধ্বজা উড়াতে। তার নৈতিক পরাজয় পরিণতি লাভ করেছে কূটনৈতিক পরাজয়।
কলকাতার পাক-ডেপুটি হাইকমিশন তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইসলামাবাদ। সঙ্গে সঙ্গে হয়ত বন্ধ হবে ঢাকার ভারতীয় মিশন। তাতে ক্ষতি নেই। কার্যতঃ এ মিশন ছিল অচল। কর্মীরা বেরুতে পারতেন না রাস্ত Tয়। পুলিশ প্রহরায় জনাব মাসুদ ঘুরে বেরিয়েছেন কলকাতার রাস্তায়। পশ্চিমবাংলা সরকারের গাড়ী ছিল তার বাহনে। ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার পেতেন না এ ধরনের সুবিধা। তার নিজের এবং কর্মীদের নিরাপত্তা বলতে কিছু ছিল না। জনতার আক্রোশ থেকে ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার যদি এমনিতর কূটনৈতিক দুঃসাহস দেখাতেন তবে হয়ত ইয়াহিয়ার চমু তাকে গুলী করে মারত। নারকীয় উল্লাসে বাংলাদেশ ধর্ষণ করেছে পাকিস্তান। লক্ষ লক্ষ আর্ত নরনারী এবং শিশু আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। কলকাতার দানবীর পাক-মিশন বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করতে হবে মানবীয় ভারতীয় মিশন। ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি নয়াদিল্লীর। সুতরাং ঢাকার মিশন বন্ধের পাক-দাবী মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে ঢাকার ভারতীয় মিশন কোন কতেই কলকাতার পাক-মিশনের পর্যায়ে পড়ে। অবস্থার মৌল পার্থক্য অবশ্যই বুঝতে পারবেন বিশ্বের বিবেকবান জনসাধারণ। যারা বুঝবেন না তারা জ্ঞানপাপী। সভ্য সমাজের জনমত গঠনে তাদের কোন ভূমিকা নেই।
আসল সমস্যা ঢাকার ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মী এবং তাদের পরিবারবর্গকে ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। ইসলামাবাদের বিশ্বাসঘাতকদের উপর কারও আস্থা নেই। ওরা হােস্টেজ হিসেবে রেখেছে ঢাকার ভারতীয় কর্মীদের। পরিবারবর্গসহ কার্যতঃ তারা এখন পাকিস্তানের বন্দী। এসব কর্মী এবং তাদের স্বজন নিরাপদ ভারতে ফিরে না আসা পর্যন্ত কোন পাক-কূটনৈতিক কর্মীকে ভারত ছাড়তে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে নয়াদিল্লীকে। তা না হলে পরে আপশােষের অন্ত থাকবে না। পাকিস্তানের সঙ্গে বােঝাপড়ায় ভাল মানুষীর স্থান নেই। ভুলে গেলে চলবে না, তার বিশ্বাসঘাতকতার দীর্ঘ তালিকা। ভুলে গেলে চলবে না। লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীর পীকৃত শব এবং তাদের রক্তধারা। যারা নিজের দেশের লােককে অতর্কিত আক্রমণে সাবাড় করতে পারে, তারা সব পারে। কূটনৈতিক কর্মী অপসারণে তাই দরকার সতর্কতা। বাংলাদেশের লড়াই চলছে এবং চলবে। দখলদার পাক-বাহিনীর সমূলে উচ্ছেদ মুক্তিযােদ্ধাদের হয়ত সমর লাগবে। ওদের বুলেটের সংগ্রামের সঙ্গে জোরদার হয়ে উঠবে পাক ভারত কূটনৈতিক সংগ্রাম। এ সংগ্রামের শেষ পরিণতি হয়ত একেবারে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদ। তাতে কোন ক্ষোভ নেই। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের কল্যাণে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষণে যদি ইসলামাবাদের স্বৈরাচারীদের বর্জন করতে হয় তবে তা করতে হবে। ইয়াহিয়া এবং তার সহকর্মীরা ভারতের দুষমন, মানবতার দুষমন এবং গণতন্ত্রের দুষমন। ওদের হাতে বাংলাদেশের তাজা খুন। মাথার উপর কোটি কোটি মানুষের অভিশাপ। এই অভিশপ্ত দানবদের সঙ্গে কোন আত্মিক যােগাযােগ থাকতে পারে না ভরতের। যেখানে আত্মিক যােগাযােগ নেই সেখানে কূটনৈতিক যােগাযােগ বিষাক্ত ক্ষত ঢাকার প্রলেপ মাত্র। বাস্তবের আঘাতে এ প্রলেপ উবে যেতে বাধ্য। ঢাকার ভারতীয় মিশন এবং কলকাতার পাক-মিশন তুলে দেবার সিদ্ধান্ত তারই ইঙ্গিতমাত্র।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৫ এপ্রিল ১৯৭১