You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.20 | দূতাবাসেও উড়ল জয় বাংলা পতাকা | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

দূতাবাসেও উড়ল জয় বাংলা পতাকা

স্বাধীন বাংলাদেশ। তার সংগ্রামের ছোঁয়াচ লেগেছে কলকাতায়। পাক ডেপুটি হাইকমিশন দখল করেছেন। জনাব এম হুসেন আলী। ওটা এখন পাকিস্তানের কূটনৈতিক দপ্তর নয়। রাতারাতি তার রূপান্তর ঘটেছে।ইসলামাবদের খােলস ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে সার্বভৌম বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন। নেমে গেছে পাকিস্তানের পতাকা। তার জায়গায় উড়ছে বাংলাদেশের নিশান। প্রাক্তন ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব হুসেন আলী কেড়ে ফেলেছেন ইসলামাবাদের প্রতি আনুগত্য। তিনি এখন স্বাধীন বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি। কি করবেন এখন ইয়াহিয়া খান? তার প্রচারযন্ত্র কিভাবে চাপা দেবে স্বাধীন বাংলার রথচক্রের এই ঘর্ঘর আওয়াজ? জনাব হুসেন আলী একা নন। তার সঙ্গে আছেন বাঙালী কূটনৈতিক কর্মীরা। একযােগে তারা অস্বীকার করেছেন হাজার মাইল দূরের এক বর্বর সরকারের অনুশাসন। সৃষ্টি হয়েছেচ এক অনন্য-সাধারণ ইতিহাস। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার রক্ত-হােলিতে ঠিক থাকতে পারেন নি জনাব হুসেন আলী, পারেন নি তার যােগ্য সহধর্মিনী এবং পারেন নি তাঁর সহকর্মী দল। পাক-জল্লাদদের বিবেক নেই, কিন্তু এরা বিবেক বর্জিত নন। বিবেকের তাড়নায় এবং মুক্তির উদগ্র আকাঙক্ষায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁরা নিজেদের ভাগ্য। দুদিন আগে যে শাসকগােষ্ঠী ছিলেন তাদের মনিব, আজ তারা ঘােরতর শত্রু। ইয়াহিয়ার চোখে এই মুক্তি-সংগ্রামীরা দুস্কৃতিকারী। আর গােটা দুনিয়ার সত্য-সন্ধানীদের দৃষ্টিতে তাঁরা মানব মুক্তির দুর্জয় যাত্রী। এদের লক্ষ্য করে নরপশুরা উঠাবে বন্দুক। আর বিবেকী জনতা জানাবেন নমস্কার।
কঠিন বাস্তবের মুখােমুখি দাঁড়িয়ে আছেন কেন্দ্রীয় সরকার। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র। লক্ষ লক্ষ শহীদের শহীদের শবে তৈরী হয়েচে ব্যবধানের বিরাট প্রাচীর যে পতাকা আজ বাংলদেশের কূটনৈতিক মিশনে উড়ছে তাতে লেগেছে জনতার উঞ্চ রক্তের স্পর্শ। এই রক্তক্ষরণ করেছে ইয়াহিয়ার জল্লাদের দল। জনাব আলী আগে ছিলেন গায়ের জোরে ক্ষমতা দখলকারী মুষ্টিমেয় ফ্যাসিস্তের প্রতিনিধি। এখন তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষের লােকায়ত্ত সরকারের মুখপাত্র। আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিয়ে ইসলামাবাদের কোন দালাল যদি এ ভবন দখল করতে আসেন তবে তার প্রতিরােধে এগিয়ে আসবেন লক্ষ লক্ষ নরনারী। আর যদি কলকাতায় অন্য কোন স্থানে তিনি বসান নূতন মিশন তবে তার সে মিশন হবে একঘরে। এ মিশনের গায়ে পড়বে ঘৃণার পদচিহ্ন। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার এখনও পাননি কূটনৈতিক স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি না আসা পর্যন্ত জনাব আলীর মিশন পাবে না তাদের ন্যায় সঙ্গত মর্যাদা। অসহনীয় হয়ে উঠেছে এই অস্বস্তিকর অবস্থা। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে। প্রতিদিন অসংখ্য নরনারী মরছেন। বন্যার স্রোতের মত শরণার্থীরা সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার আকুল আবেদন জানাচ্ছেন স্বীকৃতির জন্য। তাদের নৈতিক দাবী জোরাল। আন্তর্জাতিক আইনের নেই কোন বাধা। ভারতের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার এই স্বীকৃতির অনুকূলে। তবে কেন এই বিলম্ব? কেন এই ইতস্তত: মনােভাব? বৈদেশিক প্রতিক্রিয়ার জন্য কেন এই প্রতীক্ষ? এ-কথা সত্য, আরও দু-একটি রাষ্ট্র এগিয়ে এলে ভারতের সুবিধা অনেক। কিন্তু তারাও তাে ভাবতে পারে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত কি করে তা দেখে নেওয়া দরকার। বাংলাদেশের ঘটনাবলীর সঙ্গে নয়াদিল্লী যেভাবে জড়িত নয়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জোয়ার-ভাটা যে ভাবে দোলা দেবে না। অপর রাষ্ট্র যদি এগিয়ে না আসে তবে এককভাবে নিতে হবে নয়াদিল্লীর সিদ্ধান্ত। পরে অবশ্যই অনুসরণ করবে তাকে অন্যান্য রাষ্ট।
কলকাতার স্বাধীন বাংলার কূটনৈতিক মিশন ভবিষ্যতের সুনিশ্চিত ইঙ্গিতবাহী। কতগুলাে পাগলা-কুকুরকে লেলিয়ে দিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বশে রাখা যায় না। জানােয়ারের শাসন মানুষ মানে না। জনাব আলী এবং তাঁর সহকর্মীরা মনুষ। তাই নরপশুদের পতাকা নামিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন মুক্তির ধ্বজা। জাগ্রত বিবেকের এই নিখুত প্রকাশ এ সময়ে দেখতে না পেলে হতাশ হতেন বাংলাদেশের দরদী বন্ধুরা। গত রবিবারের ঐতিহাসিক ঘটনার পর ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের দপ্তর সম্পর্কে উদ্বেগ স্বাভাবিক। তাঁর সামনে বিক্ষোভ দেখাবার জন্য ভীড় করবেন না বাঙালী জনতা। দু-চারজন দালাল হয়ত পাকসৈন্যদের প্রহরায় তুলবে ক্ষীণ আওয়াজ। শতগুণ বিক্রম প্রচার হবে তা পাক-বেতার। পাকিস্তানের ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে হয়ত উঠবে ভুট্টে-ইয়াহিয়ার সমর্থকদের উচ্চনাদী বিক্ষোভ। তাতে কিছু আসে যায়। না। দখলদারী পাকসৈন্যরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। ওরা হামলা চালাতে পারে ঢাকার ভারতীয় মিশনে। যদি এ ধরনের কোন অঘটন ঘটে তবে তার প্রতিকার শুধুমাত্র প্রতিবাদে চলবে না। বুলেটে দুর্বিনীতের মেরুদণ্ড। আন্তর্জাতিক আইনে এই উপযুক্ত বিধান। ভারতের সাধারণ মানুষ অধীর আগ্রহে চেয়ে আছেন দিল্লীর এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের পাক-দূতাবাসগুলাের উপর। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের আহ্বান অবশ্যই পৌঁছে গেছে। সেখানে। কলকাতায় পথ দেখিয়েছেন জনাব আলী। নিশ্চয় তাঁর উত্তরসূরী মিলবে সর্বত্র। এ কাজ ত্বরান্বিত করার বাস্তব উপায় স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান। বিলম্বের সময় নেই। চরম লগ্ন আগত।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২০ এপ্রিল ১৯৭১