সামনে পর্বত প্রমাণ সমস্যা
বাঙলাদেশ থেকে লক্ষাধিক শরণার্থী ত্রিপুরা, আসাম এবং পশ্চিম বাংলায় এস পড়েছেন। শেষ পর্যন্ত তাদের সংখ্যা অঙ্কের কোন কোঠায় দাঁড়াবে তা নিশ্চয় করে বলা মুস্কিল। ইয়াহিয়ার সৈন্যদল মরিয়া। তারা। বাঙলাদেশের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশকে ভিটেমাটি ছাড়া না করে ছাড়বে না। গত ছাব্বিশ মার্চের পর থেকেই বিপুল হারে শরণার্থী আগমনের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। প্রায় চার সপ্তাহ পার হতে চলেছে।
এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার শরণার্থী সমস্যার মােকাবিলার বাস্তব পরিকল্পনা নিয়ে আসরে নামেন নি। সীমান্ত অঞ্চলে ত্রাণ ব্যবস্থা যা চালু হয়েছে তা মানুষের চিরন্তন মানবতাবােধের কীঞ্ছিত প্রকাশ। তার পিছনে অবশ্যই রয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা। সীমান্ত পার হয়ে যারা এসেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন বাঙালী এবং অবাঙালী। বাঙালী হিন্দু-মুসলমান শরণার্থীর সঙ্গে অবাঙালী মুসলমান শরণার্থীর মনের মিল অনেক ক্ষেত্রেই নেই বলে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। বাঙলাদেশের অবাঙালী মুসলমানরা নাকি ইয়াহিয়ার সমর্থক। মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা নিয়েছে নাকি গুপ্তচরবৃত্তি। এ ধরনের ঢালাও অভিযােগ অযৌক্তিক। যখন একটা গুজব রটে তখন তা সত্য মিথ্যার ধার ধারে না। সম্ভাব্য অপ্রীতিকর অবস্থা এড়াবার জন্য দরকার অবাঙালী শরনার্থীদের সীমান্ত অঞ্চল থেকে সরিয়ে ফেলা। এই সঙ্গে আরও দরকার সব শ্রেনীর শরণার্থীর নাম এবং আনুসাঙ্গিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করা। তা না হলে ভবিষৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন সহজসাধ্য হবে না।
এতগুলাে মানুষের প্রতিদিনের প্রয়ােজন মিটান পর্বত প্রমাণ সমস্যা। শরণার্থীর ক্রমবর্ধমান চাপে ভারতের অর্থনীতি পঙ্গু হতে বাধ্য। ইয়াহিয়ার নেকড়েদের হাতে তাদের ছেড়ে দেওয়া অসম্ভব। কোন সভ্য রাষ্ট্র তা পারেন না। বাঙলাদেশের শরণার্থী ইসলামাবাদের ফ্যাসিস্ত শাসকদের সৃষ্টি। এরা শুধু আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিম বাংলা কিম্বা ভারতের অতিথি নন, গােটা দুনিয়ার অতিথি। বিশ্বের ত্রাণ সমিতিগুলাের কাছে নয়াদিল্লী সাহায্যের জরুরী আবেদন জানাচ্ছেন কেন? রাষ্ট্রসঙ্ঘকে জিজ্ঞাসা করলেন না কেন—এসব দুর্গততের দায়িত্ব কে নেবেন? এদের উৎখাতের জন্য যারা দায়ী এবং গণহত্যার বিভীষিকা সৃষ্টির যারা নায়ক তারা ক্ষতিপূরণ দেবে না কেন? কেন তারা মানবগ্রোহিতার শাস্তি থেকে রেহাই পাবে? আন্তর্জাতিক সাহায্য যতদিন না আসবে, ততদিন পশ্চিম বাংলার ত্রাণকার্যে অর্থ জোগাতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলাের অর্থ ক্ষমতা খুবই সীমিত। তবু তারা য করছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যােগ্য। অনেক মুসলিম সেবা প্রতিষ্ঠান আছে পশ্চিম বাংলায় এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। তারাও যদি শক্তি জড় করে সেবার কাজে নেমে পড়েন তবে শরণার্থীরা পাবেন আসীম সান্তনা। ইয়াহিয়ার বর্বরতা অত্যাচারিতদের মধ্যে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের শরণার্থী। বিপদের দিনে এদের পাশে দাঁড়ানাে শুধুমাত্র ভারত নয় গােটা দুনিয়ার নৈতিক কর্তব্য।
সীমান্ত অঞ্চলের বর্তমান ত্রাণ ব্যবস্থা সাময়িক। অদুর ভবিষ্যতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে নিয়ে কি করা হবে তার চিন্তা এখনই প্রয়ােজন। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে বাঙলাদেশের গণতন্ত্রী শক্তির চূড়ান্ত জয়লাভ ছাড়া লড়াই শেষ হবে না। সংগ্রাম হয়ত চলবে দীর্ঘদিন। বাঙলাদেশের ভাগ্যে যদি তাই থাকে তবে কোন শরণার্থীই আপাতত ফিরে যাবেন না। অনির্দিষ্টকালের জন্য তারা থাকবেন। ভারতে। সামরিক স্ট্রটেজী অনুযায়ী পিছু হটা সামনে চলা সাধারণ রীতি। ইয়াহিয়ার ঘাতকবাহিনী গ্রামাঞ্চলে যত ঢুকবে শরণার্থীর সংখ্যা তত বাড়বে। মুজিব বাহিনী যত এগুবে শরনার্থীর আগমন তত কমবে। বেশ কিছুদিন চলবে এই অস্থির অবস্থা। ইয়াহিয়াকে পর্যুদস্ত করতে বেশী দেরী হলে ক’লক্ষ শরণার্থীর পুণর্বাসনের সমস্যা অবশ্যই। দেখা দিবে ভারতে। রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হবে পদে পদে। তাকে ঘােরাল করে তুলবে সম্ভাব্য অর্থসঙ্কট। গণহত্যা এবং ব্যাপক ধ্বংসলীলার মধ্যে দিয়ে নয়াদিল্লীকে ফাঁদে ফেলেছেন ইসলামাবাদের শয়তানী চক্র। তাদের ফাদ থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ, মুজিব বাহিনীকে জোরদার করে তােলা। তাদের বিজয় নিশ্চিত এবং ত্বরান্বিত করে ফেলা। একাজের প্রাথমিক পদক্ষেপ স্বাধীন বাংলা সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং তাদের ন্যায্য সংগ্রামের সক্রিয় সাহায্যে এগিয়ে আসা। বাঙলাদেশ থেকে পাক-সৈন্যদের অপসারণ ঘটলেই শরণার্থীরা নিজেদের ঘরে ফিরবেন। ভারতেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাচবে। আর বন্ধু হিসাবে পাবে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাঙলাদেশকে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ এপ্রিল ১৯৭১