ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা
পাকিস্তানি জঙ্গী উপরওয়ালারা হুকুম করেছিল অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হবে এবং সেখানে দস্তুর মুতবেক পড়াশােনা আরম্ভ করে দিতে হবে। সুতরাং ছাএছাত্রী অবিলম্বে বই খাতা নিয়ে ক্লাশে বসে যাও, লেকচারার প্রফেসাররা আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে এখনি পড়ান শুরু করে দিন। বেশ কথ! কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কি বা কতটুকু অবশিষ্ট আছে ঢাকায়? পাকিস্তানি ফৌজের গােলাগুলীতে তার ভবনই ত বিধ্বস্ত হয়নি শুধু শিক্ষক এবং পড়ুয়াদের বৃহৎ একাংশও প্রাণ হারিয়েছেন। ছাত্রীদের বেশ বড় একটা দল আবার অগ্রসরমান দানবদের হাতে মর্যাদা হারানর ভয়ে ছাত্রী নিবাস থেকে লাফ দিয়ে পড়েও স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু বেশীর ভাগ ছাত্রছাত্রীই মুক্তিফৌজের দল পুষ্ট করেছেন। সুতরাং পড়বেন কে? তাদের পড়াবেনই বা কে?
অনেকেই জেনেছেন আশা করি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপকদের বেশ কয়েকজনকে বাড়ী থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে গুলী করা হয়েছে। কি তাদের অপরাধ, কেনা এইভাবে সমাজের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞজনকে নির্বিচারে খুন করা হল, তা কেউই বলতে পারবেন না। তবে অনুমান করা কঠিন নয় যে সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করা এবং সেই সঙ্গেই লেখাপড়ার দুনিয়াটা তছনছ করে স্বাধীন চিন্তার কণ্ঠরােধ করা এর প্রধান উদ্দেশ্য। দেশের সংস্কৃতি-মানসদের তাবেদার বানাতে পারলে তবেই ত সর্বসাধারণকে অনায়াসে নতজানু। করান সম্ভব হয়। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয় খতম করার পিছনে পাকিস্তানি জঙ্গী সর্দারদের একটি সুপরিকল্পিত মতলবই নিহিত আছে বুঝতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সলর ড. আবু সৈয়দ চৌধুরী সম্প্রতি লন্ডনে আছেন। তিনি বলেছেন আমার ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের যে রকম পাইকারী হারে নিধন করা হয়েছে, তারপর আর আমি কোন মুখে ঢাকায় ফিরে যাব? তাছাড়া গিয়েই বা কি করব আমি? বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে কি? পাকিস্তানি দস্যুদের হামলায় তার ঘরবাড়ী, পাঠাগার, গবেষণাগার, ছাত্রাবাস সব ধ্বংস হয়েছে। দলে দলে প্রাণ হারিয়েছে কর্মী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সমগ্র রাজনীতিক কাঠামাে যেদিন বদলাবে পূর্ব বাংলার, ফিরবে স্বাভাবিক শান্তির আবহাওয়া, সেদিনই আবার আসবে সহজভাবে স্কুল,কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ার সুযােগ। তার আগে নয়। ভাইস চ্যান্সলর ড: চৌধুরী ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতিও। তার বক্তব্য শুধু সমীচীন নয়, আজকের পরিবেশে এছাড়া আর কি বা বলতে পারেন তিনি? গ্রাম নগর সর্বত্র আজ জ্বলছে আগুন। নরঘাতী হিংস্র পিশাচরা নিরস্ত্র মানুষদের ঘর থেকে টেনে এনে এনে হত্যা করছে, সম্রম বিনষ্ট করছে গৃহস্থ বধূর, কণ্যার। এমন দিনে নিশ্চিন্তভাবে লেখাপড়ার অবকাশ কোথায়? করবেন কে? দেশের সাহসী যুবশক্তিকে ত আজ সর্বাগ্রে সংহ বিক্ৰমে মােকাবিলা করতে হবে এই দুবৃত্ততার। ঢাকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আজ তাই করছেন। তারা হয়েছেন যুযুধান মুক্তিবাহিনীর অন্তর্ভূক্ত।
তারা ভেবেছেন, ছাত্রসমাজকে যদি প্রতিরােধের যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে তার জোর বেশী দিন স্থায়ী হবে না। মধ্যবিত্তের স্বাভাবিক শান্তিকামিতা ও কেরিয়ার প্রীতির ওপর ভরসা রেখেই তারা অবশ্য এই ফাঁদ বিছিয়েছেন। তাছাড়া নিছক গোঁয়ার্তুমি বশে বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মায়তন, হাসপাতাল ইত্যাদি ধ্বংস করা যে ধরনের ঘৃণ্য আচরণ পৃতিবীর অতি বড় জঘন্য দানবও তার সমর্থন করবেন না, এ তারা জানেন। তাই যেন কিছুই হয়নি, সামরিক গন্ডগােলের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল এখন আবার খুলবে, এমনি একটা ধোকা দিয়ে দুনিয়াকে বােকা বােঝানর চেষ্টা করছেন তারা। যদিও এ চেষ্টায় লাভ হবে না কিছু।
বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের গতিমতির আসল স্বরূপ ঠিকই বুঝেছেন। শিক্ষার। জন্যে যে তাঁদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, শিক্ষা সংহরই যে তাঁদেরই প্রকৃত লক্ষ্য, এ বুঝেছেন পূর্ববাংলার আত্মশক্তিকে প্রত্যয়শীল তরুণরাও। তাঁরা তাই দুঃখ ও মৃত্যুর মূল্যে চরম জয়ের জন্যেই হাতিয়ার তুলেছেন। সেই বিজয়ী বীজয়ী বীরদের হাতেই নূতন করে আবার হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারােঘাটন।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২১ এপ্রিল ১৯৭১