মুক্তিযুদ্ধে বাঙলাদেশ
এ এক অভিনব এবং অভুতপূর্ব স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাঙলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধ সারা বিশ্বে আলােড়ন এনেছে, পাকিস্তানি বর্বরতা পৃথিবীর মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। এ যুদ্ধ যে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয় তা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। অত্যাচারে অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত শােষণক্লিষ্ট বাংলাদেশের মানুষ তাদের মন থেকে মুছে ফেলেছে পাকিস্তানকে, তাই এবার তারা স্বাধীনতা ঘােষণা করে স্বদেশ ভূমি থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের অপসারণে অসম যুদ্ধে নেমে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। কবে শেষ হবে এই যুদ্ধ কেউ বলতে পারবে না আজ কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সীমান্ত গান্ধী বাদশা খান চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠরা কখনাে একটা দেশকে ভাঙ্গতে চায় না, ভাঙ্গে সংখ্যালঘিষ্টরা। বাদশা খান তাই বলেছেন পাকিস্তান যদি ধ্বংস হয়, তা হলে হবে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো আর মুসলীম লীগ নেতা কাইয়ুমের ভুল নীতির জন্য। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, ভুট্টো-কাইয়ুম জাতীয় রাজনৈতিক নেতা এবং আইয়ুব -ইয়াহিয়ার মতাে অপরিণামদর্শী সামরিক শাসকদের কার্যকলাপের ফলেই বাঙলাদেশ স্বাধীনতা ঘােষণায় বাধ্য হয়েছে এবং পাকিস্তান আজ অতি দ্রুত ভাঙ্গনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আজকের বাঙলাদেশের যুদ্ধ তারই রেড সিগন্যাল বা লাল সঙ্কেত।
প্রশ্ন এই, সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাঙলাকে গােড়া থেকেই উপেক্ষা করার এবং শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পশ্চিম পাকিস্তান পেল কোথ থেকে?
প্রশ্নের সবিস্তার উত্তর পাওয়া যায় সম্প্রতি প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ গ্রন্থখানিতে। পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালীদের এই মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে গ্রন্থকার কবি-সাংবাদিক কৃষ্ণধর যথার্থই লিখেছেন, ‘বাঙ্গালীদের সম্পর্কে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর মনােভাব গােড়া থেকেই ছিল অভিভাবকত্বের। দূরের প্রজাদের যে চোখে দেখা হয় বাঙ্গালীদের ভাগ্যেও জুটল সেই বিড়ম্বনা। এর কারণ পূর্ব বাঙলায় তখন কোনাে নেতা ছিলেন না যিনি জিন্নাহ বা লিয়াকতের মুখােমুখি হতে পারেন। সুরাওয়ার্দির বুদ্ধিও ছিল, ক্ষমতাও ছিল। কিন্তু ভারত বিভাগের পর তিনি কলকাতাতই রয়ে গেলেন কিছুকাল। কারণ, জিন্নার সঙ্গে তার বনিবনা ছিল না। ফজলুল হক তখন নেপথ্যে। মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে তাঁর তখন যােগ ছিল না।
এই অবস্থায় কানাডীয় রাজনৈতিক ইতিহাসকার কে-কালার্ড তাঁর ‘পাকিস্তান’ নামক বইতে প্রথম যুগের পাকিস্তানি রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালােচনা করে যা লিখেছেন তাতে দেখা যায়, একটি ছােট সুসংবদ্ধ গােষ্ঠীই পাকিস্তানের সমস্ত ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। ২০ জনের একটি গােষ্ঠীই সর্বস্তরে সমস্ত রাজনৈতিক ও সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত।
লেখন কৃষ্ণধর তার সুনিপুণ বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, এই কুড়িজনের মধ্যে বাঙলার মুসলিম লীগের কোনাে নেতা ছিলেন না। কারণ, জিন্নাহ বাঙ্গালী নেতাদের পছন্দ করতেন না। পূর্ব পাকিস্তানকে দেখা হতে লাগল একটি অনুন্নত, কাঁচামাল উৎপাদনকারী উপনিবেশ হিসেবে। পাকিস্তানের জোট তরফ হল পূর্ব পাকিস্তান যদিও সংখ্যার দিক দিয়ে সারা পাকিস্তানে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। পশ্চিম পাঞ্জাবের বিত্তশালী জমিদারেরা এভাবেই পাকিস্তানের আসল কর্তৃত্ব করায়ত্ত করে নেয় এবং পূর্ব বঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে বালুচিস্তান, সিন্দুদেশ ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও শােষণ চালিয়ে যেতে থাকে। তারই তীব্র প্রতিক্রিয়া আজ দেখা দিয়েছে বাঙলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে যার তরঙ্গ পশ্চিমের প্রদেশগুলিতেও। উদ্বেল হয়ে ওঠবার লক্ষণ স্পষ্ট।
পূর্ব বাঙলার স্বায়ত্ত শাসনের দাবীকে নস্যাৎ করার জন্য কোনাে কিছুই বাকি রাখেন নি আইয়ুব খান। সেই দাবীকে বিদেশী রাষ্ট্রের চক্রান্ত বলে প্রচার করে বাঙলাদেশের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে এবং তাঁর সহযােগীদের তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু চতুর্দিকের গণবিক্ষোভে জাদরেল ডিকটেটর আইয়ুব খান নিজেই যখন প্রায় পর্যুদস্ত তখন সেই ষড়যন্ত্র মামলা তাঁকে প্রত্যাহার করে নিতে হল। জনগণকে শান্ত করবার জন্য কিছু ভালাে কথাও তিনি বলেছিলেন তখন। সত্তর সালে নির্বাচন হবে ঘােষিত হল, আইয়ুব খান নির্বাচনে দাঁড়াবেন না রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করবেন, সাড়ম্বরে এ সংবাদও প্রচারিত হল। যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাতে অবসর গ্রহণের কথা ঘােষণা করা ছাড়া কিইবা উপায় ছিল তার? কিন্তু নির্বাচন হতে দেওয়া এবং তারপর জনপ্রতিনিধিদের হাতে শাসনভার তুলে দেওয়া তার পক্ষে কখনাে অভিপ্রেত হতে পারে? পারে না। কারণ তিনি ভালাে করেই জানতেন তা হলে তাকে দশ বছরে দশকোটি টাকার মালিকানার জবাবদিহি করতে হবে। আরাে অনেক অপরাধের বিচার হবে তার। তাই বুদ্ধিমানের মতাে আইয়ুব ১৯৬৯ সালে ২৫শে মার্চ তাঁরই জাতভাই আরেক পাঠান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আগা মহম্মদ ইয়াহিয়া খানের হাতে শাসনভার তুলে দিল। তার পরের ইতিহাস সাম্প্রতিক। বিধ্বংসী ঝঞাবত্যায় পূর্ববঙ্গে কয়েক লক্ষ লােকের মৃত্যুতে এবং আরাে লক্ষ লক্ষ লােক আশ্রয়হীন হয়ে পড়ায় সাধারণ নির্বাচনের দিন কিছুটা পিছিয়ে দিতে হলেও সত্তর সালের ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ফলাফলে পাকিস্তানের দ্বিধাবিভক্ত রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পশ্চিম পাকিস্তানে এই দল একটি আসনও লাভ করতে পারেনি। ঠিক তেমনিভাবেই দেখানাে চলে, পশ্চিম পাকিস্তানেরও কোনাে দল পূর্ব বাঙলায় কোনাে পাত্তাই পায়নি।
কিন্তু নির্বাচন হলে কি হবে, পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর ইচ্ছে নয় এই নির্বাচনের ফলের ওপর জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা পাঞ্জাবী চক্র অর্থাৎ ভুট্টোচক্রও তা কখনাে হতে দিতে পারে না। তা হলে যে বাঙালীদের হাতেই পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা চলে যাবে। সেই অবস্থানকে প্রতিরােধ করার জন্যই চললাে নানা টালবাহানা, ষড়যন্ত্র। ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া-ভুট্টো প্রভৃতির মুজিবরের সঙ্গে আলােচনার সুদীর্ঘ অভিনয়। সারা বাঙলাদেশ তখন শেখ মুজিবরের নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রীয় পাক শাসনের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসহযােগিতা চলছে তখন। এ অবস্থা অসহ্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে। মুজিবরের সঙ্গে একাদশ দিবসব্যাপী চতুর আলােচনর সুযােগে তিনি প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও সৈনিক আমদানী করলেন রাওয়ালপিন্ডি থেকে এবং ২৫ শে মার্চ মধ্য রাত্রির পর থেকে বাঙলাদেশের ওপর বীভৎস আক্রমণ ও নির্বিচার হত্যাকান্ড শুরু হয়ে গেল। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশও ঘােষিত হল অবিলম্বে।
কী উত্তেজনা কী অলােড়ন তখন বুদ্ধিজীবী বাঙ্গালী মাত্রই এনিয়ে কিছু না কিছু বলেছেন বা লিখেছেন। কিন্তু কুশলী শিল্পীর মতাে অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমার সহকর্মী কবি-সাংবাদিক কৃষ্ণধর দু’শ পৃষ্ঠার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ রচনায় যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা বিশেষ প্রশংসার অপেক্ষা রাখে। লেখকের ইতিহাসনিষ্ঠা ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি বইখানিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে এবং সাবলীল ভাষার জন্য বইখানি হয়েছে সুখপাঠ্য। পাকিস্তান ও বাঙলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমিকার একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি এই গ্রন্থখানি, সেজন্যই এর বহুল প্রচার প্রত্যাশিত। প্রচ্ছদ রুচিশীল এবং ছাপাও। ভালাে। শ্রীযুক্ত বিবেকানন্দ মুখােপাধ্যায় লিখিত সুদীর্ঘ ভূমিকা গ্রন্থটির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৭ মে ১৯৭১