ভুল করেছেন নয়াদিল্লী
ভুল করলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। লােকসভার বিরােধী দলগুলাের নেতাদের তিনি বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশকে আপাতত কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেবেন না নয়াদিল্লী। আরও কিছুদিন সংগ্রামের গতি তারা লক্ষ করবেন। বাইরের সক্রিয় উৎসাহ ছাড়া নিরস্ত্র জনতা কি করে সগ্রামের গতি নিজেদের অনুকূলে টেনে আনবেন? এই সহজ সত্য অনুধাবন করতে পারেন নি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী। অন্যান্য রাষ্ট্র হয়ত এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে রাজী নয়। তাদের মুখ চেয়ে অপেক্ষা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই কেন্দ্রীয় সরকারের। বৃহৎ শক্তিগুলাের ঘাড়ে এসে পড়ে নি লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর অসহনীয় বােঝা। তাদের সীমান্ত অঞ্চলে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে না পাকিস্তানের কামানের গােলা। বৃহৎ শক্তিগুলাের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা জড়িত নয় বাংলাদেশের ঘটনাবলীর সঙ্গে। বাংলাদেশের সমস্যা তাদের দুনিয়া জোড়া রাজনৈতিক পাঁয়তারার অঙ্গ। ভারতের কাছে এটা জীবন-মরণের প্রশ্ন। শ্রীমতী গান্ধী নিজেই বলেছেন, যুদ্ধ থামলেই শরণার্থীরা নিজেদের বাড়ীঘরে ফিরে যাবেন। একথা সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার এবং ইসলামাবাদের স্বৈরাচারী শাসকদল—এ দুইয়ের মধ্যে এক পক্ষের চূড়ান্ত জয় ছাড়া যুদ্ধ থামবে না। ভারত যদি কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক দরবারে প্রতিষ্ঠিত করত তবে মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় ত্বরান্বিত হত। শরণার্থীরাও তাড়াতাড়ি নিজেদের বাড়ীঘরে ফিরে যেতে পারতেন। নয়াদিল্লীর দ্বিধাসঙ্কোচ বিলম্বিত করবে বাংলাদেশের লড়াই। শরণার্থীর চাপ বাড়বে ভারতে। তৈরী হবে এক অগ্নিগর্ভ অবস্থা। তাতে হাবুডুবু খাবেন নয়াদিল্লী।
চীন কিম্বা পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকীতে ভয় পান না নয়াদিল্লী। সদম্ভে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। এ ভয় যদি নাই থেকে থাকে তবে এত ইতস্ততঃ কেন? বাংলাদেশে মুজিব বাহিনী যদি পর্যুদস্ত হয়। তবে যুদ্ধ এড়াতে পারবেন না কেন্দ্রীয় সরকার। নিজেদের ঘর গুছিয়ে নির্মম আঘাত হানবেন ইসলামাবাদ। তাঁদের সঙ্গে তান্ডব নৃত্য শুরু করবে চীন। কোন বৃহৎ রাষ্ট্র আসবে না ভারতের সক্রিয় সাহায্যে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত লড়াই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। দুর্বিনীত পাক-দস্যুদের বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলার সুবর্ণ সুযােগ। এসেছে ভারতের সামনে। এ সুযােগ নষ্ট করছেন নয়াদিল্লী। বন্ধু হিসাবে তারা কোনদিনই পাবেন না ইসলামাবাদকে। বেশীদিন গড়িমসী করলে ভারত হারাবে বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা। এ অবস্থায় লাভবান হবে ভুট্টো-ইয়াহিয়া চক্রান্ত। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংগ্রামের নেতৃত্ব চলে যাবে চরমপন্থীদের হাতে। ঘরের পাশে তৈরী হবে আর একটি ভিয়েনাম। টাল সামলাতে পারবেন না কেন্দ্রীয় সরকার। শরণার্থীর ভারে নুইয়ে পড়বে ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামাে। যে শাস্তি ইয়াহিয়ার পাওনা তা পাবেন নয়াদিল্লী। গত ৩১ শে মার্চ সংসদে গৃহীত হয়েছিল সর্বসম্মত প্রস্তাব। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি তাতে ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন এবং তাদের বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস। এ-প্রস্তাবের মর্মবাণীর মধ্যে আন্তরিকতার কোন অভাব যদি না থেকে থাকে তবে তাকে কার্যকর করার পদ্ধতিতে এত দ্বিধা সঙ্কোচ কেন? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বহু নূতন সরকারকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলাে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা কি ভারতের মুখ চেয়ে বসে ছিল? কেউ কি নয়াদিল্লীর পরামর্শ নিয়ে মনঃস্থিন করেছে? এতে নেই বুদ্ধির লক্ষণ। আছে ক্ষমাহীন অপরিণামদর্শিতা।
নয়াদিল্লী একবার ভেবে দেখেছেন কি ভারতের জনসাধারণের বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার প্রতিক্রিয়া? বিধানসভা সর্বসম্মতিক্রমে নিচ্ছেন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের এবং মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র সাহায্যের দাবী সম্বলিত প্রস্তাব। আর নয়াদিল্লী ধরছেন উল্টো পথ। দেখি কি হয়’ নীতির নীচে চাপা দিতে চাচ্ছেন তারা জনতার অন্তরের আবেগ। কিন্তু ওটা চাপা পড়বে না। বিরােধী দলগুলাে হাতে নেবেন প্রচারের হাতিয়ার। এলােপাথাড়ী কশাঘাত করবেন আরও বিক্ষুব্ধ। তার ধাক্কা লাগবে প্রশাসনে। প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বােঝান হয়েছে এবং তিনি নিজেও ভুল বুঝেছেন। এই ভুলের মাশুল দিতে হবে কড়ায় গন্ডায়। বিবেচনার সময় যথেষ্ট পেয়েছেন নয়াদিল্লী। পরমুখপেক্ষিতার সময় চলে গেছে। ওপারের মানবাত্মা আজ ধর্ষিত, লাঞ্ছিত এবং মৃত্যু পথযাত্রী। তাকে বাঁচাতে হলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা দরকার। দেরী হলে মহাশ্মশানে পরিণত হবে সােনার বাংলা। পরে একটা প্রেতভূমিকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে লাভ কি? তাতে বাঁচবে না বাংলাশে, বাঁচবে না গণতন্ত্র এবং বাঁচবে না ভারত। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বিরােধী দলগুলাের নেতাদের ডেকে যা বলেছেন তাতে নিরাশ হয়েছেন ভারতের সাধারণ মানুষ এবং হতাশ হয়েছেন মুক্তিযােদ্ধারা। খুশীতে অবশ্যই বগল বাজাচ্ছেন সিন্ধুর শকুনী ভুট্টো এবং ইসলামাবাদের নরঘাতী দস্যু ইয়াহিয়া খান।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৮ মে ১৯৭১