You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.09 | সাপ্তাহিক সপ্তাহ-এর সম্পাদকীয়: মুজিবের ডাক | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিবের ডাক

“যা অস্ত্র আছে তাই নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন। শেষ শত্রুসৈন্য পরাস্ত না হওয়া পর্যন্ত… যেকোন মূল্যে শত্রুসৈন্যের প্রতিরােধ করুন এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের নির্মম একনায়কত্ব থেকে দেশকে বাঁচান।”
কৃষক। বাকিদের পােশাক এবং চালচলন দেখলেই বােঝা যায় ছাত্র।
পঞ্চাশােত্তীর্ণ এক মুসলিম কৃষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এই গ্রামেই থাকেন। শক্ত সমর্থ চেহারা, কাজ কর্মের তদারক করেছেন। তিনি বললেন সেদিন সকাল থেকে বেলা দশটা পর্যন্ত যশােহর শহরের দিক থেকে ক্রমাগত গােলাগুলাে চলার আওয়াজ শােনা গেছে। হয়তাে ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ পাকি সৈন্য অবরােধ ভেঙ্গে বেরােবার চেষ্টা করছে। তখন পর্যন্ত এরা স্পষ্ট কোন সংবাদ পাননি। এখান থেকে নিকটবর্তী রণাঙ্গন যশােহর শহর। যে সময় কথা হচ্ছিল সেই সময় পর্যন্ত লড়াইয়ের অবস্থা হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ পাকি সৈন্যকে ঘিরে রেখেছে মুক্তি ফৌজ। যশােহর শহরের বাকি অংশ তখনও মুক্তি ফেওজের অধিকারে।
“রেল লাইনটা কাদের দখলে” সংক্ষিপ্ত জবাব “আমাদের।” “ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ পাকি সৈন্যদের খাবারের যােগান আসছে কোথা থেকে?” “আসছে না। গত শুক্রবার পর্যন্ত ওরা চেষ্টা করেছিল হেলিকপ্টার আর প্লেনে রসদ নামাতে কিন্তু পারেনি। আমরা একটা প্লেন ফেলে দিয়েছি। হেলিকপটার তাড়া খেয়ে চলে গেছে।”
পাক ভারত যুদ্ধের সময়ে যশােহর ক্যান্টনমেন্টকে বৃহদাকারে গড়া হয়েছিল। এয়ারস্ট্রিপটা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। এটা অকেজো করে দিতে পারলে অবরুদ্ধ খানদের ইঁদুরের মতাে মারা যেতে হবে।
মুক্তি ফৌজের মূল লড়াইটা চলছে ই পি আর। কোথাও ট্রেঞ্চে পজিশন নিয়ে বসে আছে, কোথাও বনের আড়ালে এগােচ্ছে। এই সেনা বাহিনীর পেছনে যে সাধারণ মানুষ, তারা তখনাে পর্যন্ত মুক্তিফৌজের রসদ খাদ্য, অস্ত্র ও সংবাদ যােগান দিয়ে চলেছে। আর পিছনের দিকে সেতু ও রাস্তা কেটে দিয়ে ভিতরের দিকে শত্রুর প্রবেশের সম্ভাবনাকে ব্যাহত রাখছে। কিন্তু বাঙলাদেশের এ লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হবে। এবং তা যদি হয় তাহলে মূল বাহিনীর পিছনের এই মানুষদের সক্রিয় গেরিলা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতেই হবে। তার জন্য দ্রুত শিক্ষণ চাই, উপকরণ চাই, সাহায্য চাই।
বটতলায় সংগ্রাম পরিষদের টেবিল ঘিরে ছেলে বুড়াে নিয়ে সাকুল্যে গ্রামের যারা কাজ করছিলেন। তাদের সংখা জনা পঞ্চাশেকের বেশি নয়। এবং তারাও বালক অথবা তরুণ কিংবা সমর্থ পুরুষ। একটিও মেয়ে নেই।
সেই পঞ্চাশােত্তর কর্মকর্তাটিকে প্রশ্ন করলাম “আপনারা এখানে কতক্ষণ কাজ করেন?” জানালেন রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত। জিজ্ঞেস করলাম এ গ্রামের জনসংখ্যা তাে হাজার কয়েক তার মধ্যে জনা পঞ্চাশেককে এখানে কাজ করতে দেখছি। গ্রামের বাকি সকলে, বিশেষ করে মেয়েরা কিভাবে সাহায্য করছে মুক্তি সংগ্রামে? | জবাব পেলাম গ্রামের প্রত্যেক ঘরে যদি যান তাহলে দেখতে পাবেন ঘরে ঘরে মেয়েরা রােজ রুটি তৈরি করছে আর মাংস কিংবা অন্য কোন শুকননা তরকারি রান্না হচ্ছে। আমরা মুক্তি ফৌজের খাবার তৈরি করি। রুটির প্যাকেট তৈরি করে রাখি। রাতে ট্রাক আসবে। সেই ট্রাকে আমাদের গ্রামের রুটি মাংস যাবে লড়াইয়ের ফ্রন্টে। [ফেরার সময় দ্রলােক বললেন- আপনারা অনেক সাহায্য করছেন। আপনাদেরে সাহায্যে আমরা নিশ্চয়ই জিতব। জয় বাঙলা ।
এতক্ষণ বেশ ছিলাম- এবার লজ্জা পেলাম। ওপারের লড়াইকে উপলক্ষ করে এবার বাঙলার সংহতির নামে প্রত্যহ যে চ্যাংড়ামি দেখছি সেই কথা মনে পড়ে লজ্জা পেলাম। এর আগেও একদিন বনগাঁ সীমান্তে গিয়েছিলাম। সংহতির নামে ‘হাইস্ট্রাং’ কিছু ছেলে মেয়ের হাত পা ছুড়ে চিৎকার এবং মাস্তানদের মাস্তানি অসভ্যতা, অভদ্রতা দেখে ফিরে এসেছিলাম চুপ করে। যাবার পথে দেখেছি ওরা টিকেট দেয় না। শশাওয়ালার কাছে শশা খেয়ে পয়সা দেয় না। ফেরার পথে হাঁড়ি করে কাঁচা গােল্লা আর মিষ্টি কিনে হল্লা করতে করতে ফেরে। এই সংহতি যদি বন্ধ না হয় তাহলে বিপদ শুধু আমাদের নয় ওপারেরও।
সূত্র: সপ্তাহ, ৯ এপ্রিল ১৯৭১