You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.18 | শরণার্থী সমস্যা সমাধানে মর্মান্তিক অবহেলা | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

শরণার্থী সমস্যা সমাধানে মর্মান্তিক অবহেলা

কৃত্তিবাস ওঝা হাজার হাজার আশ্রয়প্রার্থী জীবিত মানুষের বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা এমনকি একটু পানীয় জলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা রাজ্য সরকার গত দুই মাসে করে উঠতে পারেনি ; কিন্তু তার চেয়েও বিয়ােগান্ত হলাে— বাঙলাদেশ থেকে প্রাণভয়ে প্রাণ রক্ষার তাগিদে পশ্চিম বাঙলায় আশ্রয়প্রার্থী শত শত মানুষ যারা মারা যাচ্ছে তাদের মৃতদেহগুলাে পথ থেকে সরিয়ে নেবার নূন্যতম ব্যবস্থাও সরকার গত এক মাস করতে পারলাে না।
নিঃসন্দেহে সত্য, লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয় কিন্তু যুদ্ধ বা জরুরি অবস্থার মােকাবিলা কোন রুটিনমাফিক কাজের দ্বারা সম্ভব নয়— যুদ্ধের মােকাবিলা করতে হলে যুদ্ধকালীন দ্রুত ও জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। সরকারের প্রয়ােজনীয়তা, কার্যকারিতা এইসব কঠিন মুহূর্তে পরখ করা সম্ভব হয়। কিন্তু অত্যধিক দুঃখের ব্যাপার পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার লক্ষ লক্ষ আশ্রয়প্রার্থীর আগমনসমস্যার মােকাবিলায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন।
বয়ড়া, বনগ্রাম, হাসনাবাদ, বসিরহাট, শিকারপুর, করিমপুর, মালদা, পশ্চিম দিনাজপুর, মেখলিগঞ্জ, দিনহাটা প্রভৃতি অঞ্চলে অবিরাম স্রোতে বাঙলাদেশের মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসছে। একখানা কাপড় সম্বল করে, এমনকি বহু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করেও রুডলফ হেসের বেজন্মারা যে মানুষগুলােকে বাঙলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে তারা শুধু মৃতপ্রায় দেহটিকে নিয়ে আছড়ে পড়ছে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। পাঁচদিন সাতদিন এমনকি তারও বেশিদিন পায়ে হেঁটে মানুষগুলাে ভারত সীমান্তে এসে আক্রান্ত হচ্ছে কলেরা মহামারীতে। নদীয়া, মালদা, ২৪ পরগনা জেলার আশ্রয়প্রার্থী আগমনের প্রতিটি পথেই স্রোতােধারায় মানুষ পশ্চিমবাংলায় প্রবেশ করে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পথে, ঘাটে, মাঠে, গাছতলায় আশ্রয় নিচ্ছে। কোথায় আশ্রয়, কোথায় খাদ্য, কোথায় পানীয়? এই সব কিছুই হয়তাে আছে কিন্তু সেই সবই দূর পথ। কিন্তু সেই দুরস্ত অতিক্রমের ক্ষমতা কার আছে? আছে ঐ মার- যে মা গত সাত দিন দশদিন পায়ে হেঁটে একটি বাচ্ছাকে বুকে জড়িয়ে, আর-একটি বাচ্ছাকে কাঁখে নিয়ে অনাহারে অনিন্দ্রায় এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেছে? বুকের বাচ্চারা মায়ের বুকের শুকননা স্তনটি চুষে চুষে ক্ষত করে দিয়েছে, দুধ না পেয়ে মায়ের স্তন দাঁতে কেটে রক্ত চুষে খেয়েছে ; সাধ্য কি আছে ঐ বাপের যে দুই কাধে দুইটি বাচ্ছা আর রুগ্ন অথবা আসন্নপ্রসবা স্ত্রীকে হাতে ধরে টেনে এনেছে এই দীর্ঘ পথ? সীমান্ত পার হবার মুখে শুরু হয়েছে রােগের আক্রমণ। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এইভাবে পথে পথে। সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের এমন অপমৃত্যুর নজির খুবই কম আছে।
কিন্তু সরকার অথবা দেশবাসী এই অবস্থার কথা জানতেন, তারা জানতেন বাঙলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসবে, জানতেন তারা খুশিতে অথবা নারাজ হয়ে যেভাবেই হােক এই মানুষের দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। রাজনীতি-সচেতন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, পশ্চিমবঙ্গের অগণিত রাজনৈতিক দল শুধু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন।
বাঙলাদেশে মুক্তিসগ্রাম সহায়ক কমিটি সহ ডজন খানেক কমিটি গঠিত হয়েছে কিন্তু তার মধ্যে একমাত্র ইন্ডিয়ান মিরর স্ট্রীটের একটি সংস্থা ছাড়া কোন সংস্থাই জীবিত আছে এমন প্রমাণ দুই একটি দলীয় মুখপাত্র ছাড়া ঘটনাস্থলে পাওয়া যায় না। কটা দল, কটা সমাজ সংস্থা, কটা ক্লাব আজ পর্যন্ত কতটুকু ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে সীমান্তে পাঠিয়েছেন? অন্যান্য যে কোন সময়ে কত সাহিত্যিক কত বুদ্ধিজীবী কত চিত্রতারকা কতভাবে ত্রাণ-কাজের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। কিন্তু এবার? কেউ নেই, কোথাও নেই কোন উদ্যেগ।
হ্যা, আর আছে আমাদের সরকার। কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার, প্রশ্নাতীত সংখ্যাদিকে গঠিত সরকার। যারা তিন মাস ধরে ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারলাে না তারা কী করবে? উদ্বাস্তু আগমনই তাদের কাছে শেষ কথা না উদ্বাস্তু আগমন বন্ধ করা বা যারা এসেছে তাদের ফিরে যাবার পথ পরিষ্কার করাই শেষ কথা। যা শুধু তাই নয়। এই সময়ের মধ্যে আর এক সর্বনাশের চিত্র ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। আসামে আশ্রয়প্রার্থীদের ঠাঁই হবে না, জয় বাঙলা লেখা কোন ফেস্টুনের আসামে প্রবেশ নিষেধ।
আশ্রয় দিতে অক্ষমতা ও অনিচ্ছা প্রকাশ করছে মেঘালয়, উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ। দুইদিন পরে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানও এই কথা বলবে। এইসব রাজ্যগুলাে জন-গণ-মন অধিনায়ক গানের ভাবমূর্তিকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়েছে। এক কথায় শয়তান জাগছে—সাধু সাবধান। প্রশ্ন, সর্বভারতীয় দলগুলাে কোথায়? জাতীয় সংহতির মৃত্যুরােধে তারা কী করছেন?
এবার আমাদের রাজ্য সরকারের কথায় আসা যাক। সর্বনাশের শিয়রে কি, – সর্বনাশের বধ্যভূমিতে দাঁড়ানাে রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, তার মন্ত্রি ও পারিষদদের কিন্তু বড় বেশি চাঞ্চল্য নেই। যদি বলেন, মন্ত্রিরা আহার নিদ্রা বন্ধ করে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সমস্যা নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন, তবে নিতান্তই অপবাদ দেওয়া হবে। তার পুরণাে নিয়মেই ফাইল ও আমলা-কুলের তৈলমর্দনের মধ্যে অবগাহন করে চলেছেন। শুধু গােপনে মন্ত্রিদের টুর প্রােগ্রামটা দেখুন, তাহলে বুঝতে পারবেন কত রকমের নগণ্য ছুতা উপলক্ষ করে কতজন মন্ত্রি এই ৭৫ দিনে হিমালয়ের শান্ত নীড়ে ক্ষণিকের বিশ্রাম নিয়ে এসেছেন। দেখুন, কতজন দীঘার সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে এই লক্ষ লক্ষ আশ্রয়প্রার্থীর আগমনে বিষাক্ত আবহাওয়া থেকে একটু মুক্ত বায়ু সেবন করে এসেছেন। | শুধু মন্ত্রিদের কথা নয়— এই সব দপ্তরে যেসব ঘুঘুর বাসা আছে সেইগুলাের কথাও মনে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু কী হলাে? উদ্বাস্তু সমস্যা মােকাবেলার দায়িত্ব দেওয়া হলাে একটি বালকের হাতে। আমি কোন প্রকার যােগ্যতা ও অযােগ্যতার প্রশ্ন তুলছি না, কিন্তু একজন রাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে শত সদিচ্ছা থাকলেও পরিস্থিতির মােকাবেলা সম্ভব নয়। তবু যদি তাঁর দপ্তরে একজন সত্যকার করিঃকর্মা, মানুষের দুঃখে কাতর হবার মতাে দরদী মনের অফিসার থাকতাে। রাজ্যের ত্রাণ দপ্তরসহ প্রধান দপ্তরগুলাে পরিচালনার ভার যাদের উপর ন্যস্ত তাঁদের অনেকের চরিত্রেই কুখ্যাত বােটানিক্যাল গার্ডেনের কেলেঙ্কারির কালিমা রয়েছে।
মন্ত্রিসভায় উদ্বাস্তু-ত্রাণ ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য একটা তিনজন মন্ত্রির সাব-কমিটি করা হয়েছে। এমন হাস্যকর প্রচেষ্টা আর কী হতে পারে। যে কাজ করতে সমগ্র মন্ত্রিসভার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তিনজন মন্ত্রি কী করবে। এ কেন কেন্দ্রের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের মন্ত্রি সহ কয়েকজন মন্ত্রি তাদের দপ্তর নিয়ে কলকাতা এসে বসেন ? সব দায়িত্ব যখন কেন্দ্রের তখন দিল্লি থেকে একজন মাত্র অফিসার পাঠিয়ে কেন দায়িত্ব শেষ করা হলাে?
সূত্র: সপ্তাহ, ১৮ জুন ১৯৭১