You dont have javascript enabled! Please enable it! দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় | লে. কর্ণেল এম. এ. মজুর, বীর উত্তম - সংগ্রামের নোটবুক

দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়

লে. কর্ণেল এম. এ. মজুর, বীর উত্তম

বাংলাদেশ সশস্ত্ৰ বাহিনী যা মুক্তিবাহিনী হিসেবেই বেশি পরিচিত তা গঠিত হয়েছিল প্রাক্তন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, সেনাবাহিনী, নৌ, বিমানবাহিনী, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ সদস্যদের দ্বারা গড়ে তোলা নিয়মিত বাহিনী এবং ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবী কৃষকদের নিয়ে গঠিত গণবাহিনীর দ্বারা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ছিল ৩,০০০ নিয়মিত বাহিনী ও ২৫,০০০-য়ের উপরে গণবাহিনীর যোদ্ধা। এছাড়া ছিল, স্থানীয়ভাবে সংগঠিত এবং পরিচালিত অসংখ্য প্রতিরোধ গ্রুপ। ৪ মাউন্টেন ডিভিশন, ৯ পদাতিক ডিভিশন, একটি প্যারাসুট ব্যাটালিয়ন এবং বেঙ্গল এরিয়ার এক ব্রিগেড শক্তিসম্পন্ন একটি বাহিনী নিয়ে ভারতীয় ২ কোর চূড়ান্ত আক্রমনে অংশ নেয়।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যৌথবাহিনীর (ভারতীয় সেনাবাহিনীর ও বাংলাদেশ বাহিনীর) রণকৌশল ছিল যত দ্রুত সম্ভব এবং সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদের সবচে কম ক্ষতিসাধন করে পাকিস্তানি বাহিনীকে ধ্বংস করা। যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তা ছিল;

(ক) নিয়মিত বাহিনী দ্বারা যত দ্রুত সম্ভব কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর ও খুলনা দখল করা।

(খ) শত্রুপক্ষের অবস্থানগুলিকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে একই সময় গেরিলা আক্রমণ তীব্র করা।

(গ) গোয়ালন্দ ও আরিচা ঘাটের মাঝ দিয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্যে প্রস্তুত থাকা।

একাত্তরের ২০ শে নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্ৰ বাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে যৌথভাবে কার্যক্রম শুরু করে। এর আগে মুক্তিবাহিনী নিজেদের মতো করে কাজ করে এবং ছয়টা জেলাতেই নিজেদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে। নিয়মিত বাহিনী দেশের ভেতরের মুক্তাঞ্চলে ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে, যেখন থেকে তারা গণবাহিনীর গেরিলা অপারেশনসমূহ পরিচালনা করত। এসব ঘাঁটিগুলোর অধিকাংশ নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হতো; চুয়াডাঙ্গায় ক্যাপ্টেন তৌফিক, মাগুরায় ক্যাপ্টেন ওয়াহাব, নড়াইলে লেফটেন্যান্ট সিদ্দিকী ও সার্জেন্ট নজরুল ইসলাম, গোপালগঞ্জে হাবিলদার হেমায়েতউদ্দীন, মাদারীপুরে স্টুয়ার্ড মুজিব ও ফরিদপুরে জনাব নূর মোহাম্মদ (যার সঙ্গে পরে যোগ দেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামাল উদ্দিন চৌধুরী এমসিএ,) মণিরামপুরে সফিকউল্লাহ ও ফ্লাইং অফিসার ফজলুর রহমান, সাতক্ষীরায় চিফ পেটি অফিসার রহমাতুল্লাহ ও লেফটেন্যান্ট আরেফিন, বাগেরহাটে তাজুল ইসলাম (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাক্তন জুনিয়র কমিশনড্‌ অফিসার), সুন্দরবনে লেফটেন্যান্ট জিয়া, পটুয়াখালিতে লেফটেন্যান্ট মেহেদী বরিশালের ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর এবং ভোলায় হাবিলদার সিদিক। নিয়মিত বাহিনীর একটা বড় অংশ বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তজুড়ে মুক্ত এলাকায় বেশ কয়েকটি ঘাঁটি গড়ে তোলে যেখানে গণবাহিনীর তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের ভেতরে গেরিলা অপারেশনসমূহ চালানোর জন্যে নিয়োজিত করা হতো। এসব ঘাঁটি থেকে সরবরাহসমূহ প্ৰদান করা হতো। এসব ঘাঁটিগুলা ছিল সাব-সেক্টর কমান্ডারদের অধীনে যারা দেশের গভীরে অবস্থিত যেসব কমান্ডারদের কথা আগে বলা হয়েছ তাদের মাধ্যমে নিজ নিজ অঞ্চলের গণবাহিনীর অপারেশনসমূহ নিয়ন্ত্রণ করতেন। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে পরিচালিত নৌ-কমান্ডোর অপারেশনসমূহও এসব ঘাঁটি থেকে পরিচালনা করা হতো।

চূড়ান্ত যুদ্ধের সময়টাতে পুরো রণক্ষেত্রটাতে নিয়মিত বাহিনীর জন্যে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়। বিভাজনরেখাটা ছিল পশ্চিমে চৌগাছার উত্তর পর্যন্ত এবং পূর্বে মধুমতী নদী পর্যন্ত। উত্তরে ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪ মাউন্টেন ডিভিশন এবং ৯ পদাতিক ডিভিশন ছিল দক্ষিণে। বেঙ্গল এরিয়ার সৈন্যরা সাতক্ষীরা ও আরো দক্ষিণের অপারেশনসমূহের দায়িত্বে ছিলেন।

দক্ষিণাঞ্চলের আক্রমণ শুরু হয় চৌগাছার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই যুদ্ধটি, যা আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল, ২০ শে নভেম্বর ১৯৭১ শুরু হয়ে ২৫ শে নভেম্বর শেষ হয় যখন গরীবপুরে পাকিস্তানিদের শেষ পাল্টা আক্রমণকে মোকাবেলা ও প্রতিহত করা হয়। উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে চালিত এক দ্বিমুখী আক্রমণে চুয়াডাঙ্গারও পতন ঘটে ১৯৭১-য়ের ২৪শে নভেম্বর। এই যুদ্ধে পাকিস্তানিরা ১২ টি শ্যালো ট্যাঙ্ক হারায়। আমরা যখন চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করলাম তখন এক করুণ দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। কপোতাক্ষের উপর ব্রিজটা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বাজারে আগুন জ্বলছে, স্থানীয় ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক লুট করা হয়েছে এবং চার-পাঁচটা পরিত্যক্ত বাসের ইঞ্জিন খুলে নেয়া হয়েছে। বাজারের পশ্চিম দিকের একমাত্ৰ দোতলা বাড়িটার উপরের তলাটি ট্যাঙ্ক ও কামানের গোলায় উড়ে গেছে। পুরো এলাকাটা যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষত বহন করছিল। মনে হচ্ছিল এটা যেন এক ভৌতিক শহর। কেবল দূরে দূরে কিছু তরুণ মুখ দেখা যাচ্ছিল যারা মিত্রবাহিনীকে পর্যবেক্ষণ করছিল। হয়তো তারা ভাবছিল গত নয়মাসে তাদের গ্রামবাসীরা দখলদার বাহিনীর হাতে যে দুঃস্বপ্নময় আচরণ পেয়েছে। এরপরে এই তাদের জীবন নতুন কোন্‌ পথ খুলে দেয়।

আমরা চুয়াডাঙ্গা থেকে যশোরের পথে চার মাইল এগিয়ে সিংহজুলিতে এসে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত রইলাম যতক্ষণ না বেনাপোল রোডের ঝিকরগাছার পতন ঘটল এবং যশোরের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালানো হলো। উত্তর দিকের বাহিনীটি ৫ তারিখ রাতে যশোর-ঝিনাইদহের রাস্তায়-পেীছল এবং এই আক্রমণের ফলে পাকিস্তানের ৯ম ডিভিশন দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। মাঝের বাহিনীটি আর্মড গাড়িতে চেপে ‘চিত্তের বিলে’র জলাভূমির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেল এবং দক্ষিণের বাহিনীটি যশোর- বেনাপোল রোডের দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হলো। পাকিস্তানের ১০৭ ব্রিগেড যশোর পরিত্যাগ করল এবং অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে খুলনার দিকে পালিয়ে গেল। কোনো গুলি খরচ ছাড়াই ৭ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর হাতে যশোর শহরের পতন ঘটল। এটা ছিল এক বিরাট বিজয়। যশোর ক্যান্টনমেন্ট, যা ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল ঘাঁটি, তা এখন আমাদের দখলে। জীবন নিয়ে পালাতে নিয়ে পাকিস্তানিরা প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ এবং বেশ কিছু অস্ত্ৰও ফেলে রেখে গিয়েছিল। কিছু কিছু ব্যারাকে সৈন্যদের জন্যে বিছানা সাজানো ছিল এবং সৈন্যদের ব্যক্তিগত জিনিষপত্রও রাখা ছিল অক্ষতভাবে, যেসব সৈন্যরা আর কখনোই ফিরে আসেনি। ৯ম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারের অপারেশন রুমের (দাউদ পাবলিক স্কুলে) ম্যাপগুলো পর্যন্ত যুদ্ধের পরিস্থিতির নানা চিহ্নসম্বলিত অবস্থায় দেয়ালে ঝুলানো ছিল। কিন্তু কিছু গুদাম পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। বিমানবন্দরটিকে খুঁড়ে রাখা হয়েছিল যাতে মিত্ৰশক্তির বিমানবাহিনী তার ব্যবহার করতে না পারে (সেটা অবশ্যই খুব দ্রুতই সারানো হয় এবং ওখান থেকে বিমান ওঠানামা শুরু করে)। ওরা কোনো যুদ্ধ ছাড়াই কেন যশোর ত্যাগ করল তা আমি বুঝতে পারিনি। কারণ গোটা ক্যান্টনমেন্টের চারধার জুড়েই তো ওদের বাঙ্কারসহ প্রতিরক্ষাব্যুহ ছিল।

যশোর শহরে উৎফুল্ল জনতা আমাদেরকে বরণ করে নিল যাদের অনেকেই সে সময় অস্ত্ৰ বহন করছিল। আমরা যেখানেই গেছি সেখানেই আমাদেরকে স্বাগত জানানো হয়েছে। আমি আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেলাম এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওর সাংবাদিক যখন আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইল আমি বললাম যে ৭ই ডিসেম্বরই হচ্ছে তখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচে আনন্দময় দিন ।

ওই দিনটাতে আমার সবচে চিন্তার বিষয় ছিল যতটা দ্রুত সম্ভব কোনোরকমে একটা বেসামরিক প্ৰশাসন শুরু করানো। আমি তৎক্ষণাৎ সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর কে. এন. হুদাকে আদেশ করলাম যেন উনি সার্কিট হাউজে তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন এবং বেসামরিক প্রশাসনকে সংগঠিত করেন। আমরা কেন্দ্রীয় জেলখানা থেকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে ও একজন পুলিশ ইনস্টেক্টরকে পেলাম (যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহায়তা না করার কারণে জেলে ছিলেন) এবং ওদেরকে বললাম শহরে এবং তার চারপাশের এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে মেজর হুদাকে সাহায্য করতে। (এর কিছু পরেই সরকার জনাব ওয়ালিউল ইসলামকে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করে)। লেফটেন্যান্ট আখতারকে কালিগঞ্জে এবং লেফটেন্যান্ট অলীককুমার গুপ্তকে ঝিনাইদহে পাঠানো হলো। অপারেশন ওমেগা-র দু’জন স্বেচ্ছাসেবক, একজন পুরুষ ও একজন ভদ্রমহিলা, যাদেরকে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্যে পাকিস্তানিরা জেলে পুরেছিল তাদেরকে আমার আদেশে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হলো।

মিত্রবাহিনী খুলনার দিকে এগিয়ে এবং রূপদিয়া ও নোয়াপাড়ায় দুটো বাঁধাদানকারী প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে শিরোমণিতে (খুলনার উত্তরে) পাকিস্তানি ডিফেন্সের মুখোমুখি হলো। শিরোমণির যুদ্ধ ছিল একটা কঠিন যুদ্ধ যা চার-পাঁচদিন স্থায়ী হয়েছিল। পাকিস্তানের ১৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট যে অবস্থায়টায় ছিল তা ছিল খুবই সুবিধাজনক-পশ্চিমে জলাভূমি আর পূর্বে নদী। এই অবস্থানকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। এই যুদ্ধে শত্রুরা তাদের ট্রেঞ্চগুলিতেই রয়ে গিয়েছিল এবং ওখানেই মারা পড়ছিল। অবস্থানটা দখলে নেয়ার পর ওদের অফিসারদের সঙ্গে দেখা হলো। সবচে সিনিয়র অফিসারাটি, একজন মেজর, আমার পূর্বপরিচিত ছিল। শিরোমণির পতন হলো ১৬ই ডিসেম্বর সকালে (আত্মসমর্পণের ঘোষণার চার ঘন্টা আগে)। ইতোমধ্যে, ১১ই ডিসেম্বর থেকে খুলনা শহর দক্ষিণ দিক থেকে মেজর জয়নাল আবেদীনের ৯ নম্বর সেক্টরের বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছিল। তারা দক্ষিন দিক থেকে রূপসা নদী দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন।

সাতক্ষীরার পতন ঘটল ৭ই ডিসেম্বর অগ্রসরমান দুটো সৈন্যদলের দ্বারা, লেফটেন্যান্ট হুদার অধীনে কালীগঞ্জের ৯ নম্বর সেক্টরের বাহিনী এবং পশ্চিম দিক থেকে ক্যাপ্টেন মাহবুবের ৮ নম্বর সেক্টরের সেনাদের দ্বারা। ক্যাপ্টেন মাহবুবের বাহিনীর একটা অংশ কলারোয়ার গেল। লেফটেন্যান্ট হুদা আগেই কালিগঞ্জ দখল করে ফেলেছিলেন। ৭ই ডিসেম্বর বরিশাল ও পুটিয়াখালীতে আড়ম্বরের সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলো। ভাটিয়াপাড়ার (ফরিদপুর) প্রতিরক্ষার একটা ছোট অবস্থান আমাদের বেশ ভোগাচ্ছিল। শেষমেষ তারা ১৭ই ডিসেম্বর মেজর কে.এন. হুদার কাছে আত্মসমৰ্পণ করে। লেফটেন্যান্ট এম. এইচ. সিদ্দিকী এই যুদ্ধে তার একটা চোখ হারান।

উত্তরে জীবননগরের পতন হয় ২৭শে নভেম্বর এবং দর্শনার ৪ঠা ডিসেম্বর (এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেজর মুস্তাফিজুর রহমান পাকিস্তানি পজিশনের উপর হামলা করতে যেয়ে আহত হন)। একটি পদাতিক ব্যাটেলিয়ন ও একটি আর্মার্ড স্কোয়াড্রনের সাহসী এক হামলায় ঝিনাইদহ দখল করা হয় ৬ই ডিসেম্বর সকালে। ঝিনাইদহ দখল ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিজয়। এটা পাকিস্তানের ৫৭ ব্রিগেডের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করে ওদেরকে একদম বিপর্যন্ত করে দেয় এবং কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের দিকে পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ ওদের সামনে খোলা থাকে না। ঝিনাইদহে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুর্গের মতো প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে এবং এক মাসের বেশি চলার মতো যথেষ্ট পরিমাণ গোলাবারুদ, জ্বালানী ও অন্যান্য সরবরাহ মজুদ করে রাখে। কিন্তু অবস্থানটা ধরে রাখার মতো যথেষ্ট শক্তি এদের ছিল না। এটা ছিল এক মারাত্মক ভুল। ঝিনাইদহের পতন ওদের মানসিকভাবে বিপর্যন্ত করে ফেলল। ঝিনাইদহ থেকে একটা বাহিনী কুষ্টিয়ার দিকে, আরেকটা মাগুরার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ৮ই ডিসেম্বর দুপুরে কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল টি. এন. রায়না এবং আমি অগ্রবর্তী ট্যাঙ্ক বাহিনীর সঙ্গে মাগুরায় প্রবেশ করলাম। কয়েক মাইল দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল বিমান আক্রমণের শিকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পেট্টল পাম্পের আগুনের ঘন ধোঁয়া। (এই বিমান আক্রমণটা ক্যাপ্টেন ওয়াহাব চেয়েছিলেন যিনি কাছেই ঘাঁটি গেড়েছিলেন)। চারিদিকে ছিল আনন্দমুখর জনতা। আমাকে ক্রমাগত থাকতে এবং রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের কাছে বক্তৃতা করতে হচ্ছিল। তাদেরকে আশ্বস্ত করছিলাম যে তাদের জীবন ও সম্পদ এখন নিরাপদ এবং তাদের এলাকায় শান্তি এসেছে যা চিরকাল রইবে। মাগুরা শহরে আমার বক্তৃতার সময় একজন বৃদ্ধ মানুষ দৌড়ে কাছে এলেন এবং জেনারেল রায়না ও আমাকে ছুয়ে আশীৰ্বাদ করলেন। তার দু’চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। তিনি ১৯৭১-য়ের মার্চ মাস থেকেই পালিয়ে পালিয়ে থেকেছেন এবং ওদিনেই প্ৰথম বাইরে এসে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিলেন।

কুষ্টিয়ায় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় এবং তা ৯ই থেকে ১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। ভারতীয় অগ্রবর্তী বাহিনীর ট্যাঙ্কসমূহ শহরের কিছুটা দূরেই গোলাগুলির মুখোমুখি হয়। ১১ই ডিসেম্বর আমি কুষ্টিয়া গিয়ে দেখলাম যে যুদ্ধ ভেড়ামারার দিকে সরে গেছে। কিছুটা দূরে থেকে আমি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানমূহ দেখলাম। আমি দাড়িয়ে পড়লাম, ব্রিজটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম এবং আমার মনটা ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চলাচলকে বাধাগ্ৰস্থ করতে, আমার হৃদয়ের গভীরে এক দীর্ঘ তর্কবিতর্কের পর অক্টোবর মাসে আমরা ব্রিজটা উড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি জানতাম এই গুরুত্বপূর্ণ সংযোগটি ধ্বংস করলে স্বাধীনতার পরে আমাদের দেশের পুনঃনির্মাণ বাধাগ্ৰস্থ হবে। তবে যুদ্ধের সময় সামরিক বিবেচনা অনেক সময়ই একজনের ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতিকে ছাপিয়ে যায়। এই লক্ষ্যে, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মিশন পাঠানো হয়েছিল। তবে যেহেতু ব্রিজটি খুব সুরক্ষিত ছিল ফলে তারা সবাই অসফল হয়ে ফিরে এসেছিল। যখনই কোনো মিশন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসত আমি মনের ভেতরে সুখী হয়ে উঠতাম। আর এখন আমাকে দেখতে হলো যে শত্রুরা পশ্চাদপসরণের সময় ব্রিজটা ধ্বংস করে গেছে। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে যে দূর্ভোগ নেমে আসবে তা ভেবে আমি বিচলিত হলাম।

কুষ্টিয়াতে ক্যাপ্টেন তৌফিক-এ-এলাহী, ফ্লাইং অফিসার কালাম ও লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীর সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেন। খুব শীগগিরই ডেপুটি কমিশনারে হিসেবে জনাব শামসুল হক ওর সঙ্গে যোগ দিলেন (শামসুল হক ১৯৭১-য়ের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার ডেপুটি কমিশনার ছিলেন যখন ২৭ বালুচের একটা কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর হাতে নির্মুল হয়ে যায়)।

দুই কোম্পানি শক্তি নিয়ে মেজর আজম চৌধুরী ৬ই ডিসেম্বর মেহেরপুরে প্রবেশ করলেন এবং পরের দিন চৌগাছায় পৌঁছে গেলেন। মেহেরপুরে পাকিস্তানি বাহিনী বিদ্যুৎ জেনারেটিং স্টেশনটা পুড়িয়ে দিয়েছিল। যেখানে ১৮ পাঞ্জাব দখলদারির দিনগুলোতে তাদের হেডকোর্য়াটার স্থাপন করেছিল সেই ভোকেশনাল স্কুলের উল্টোদিকের গণকবরে আমি গলায় দড়ি বাঁধা কঙ্কাল দেখেছি।

ফরিদপুরের দিকে আমাদের অগ্রযাত্রা ৮ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ব্যাহত হয় মধুমতীর পশ্চিম পারে কামারখালি ঘাটে পাকিস্তানী বাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষার কারণে। নদী এখানে ছিল ৩০০ ফুট দীর্ঘ এবং নদী পার হওয়ার সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে পাকিস্তানিরা প্রহরা বসিয়েছিল। তাদের সেসময় উন্মত্ত অবস্থায় তখন এ অঞ্চলে কোনো বেসামরিক লোককে দেখলেই তারা তাকে গুলি করত। ফলে ওদের প্রতিরক্ষা অবস্থাসমূহ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারা কঠিন হচ্ছিল। মুক্তিবাহিনীর যেসব স্বেচ্ছাসেবকেরা তথ্য সংগ্রহে গিয়েছিল তাদের মধ্যে আমি দুজন তরুণকে জানি যারা তথ্য সংগ্ৰহ করতে গিয়ে ফিরে আসার পথে বন্দি হয়। একজনকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হয় এবং আরেকজন আংশিক গলা কাটা অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়। ও যখন মিত্রবাহিনীর পজিশনে ফিরল। তখন ও কথা বলতে পারছিল না। একটা পেন্সিল ও কাগজ নিয়ে ও ওর সংগৃহিত তথ্যগুলি লিখে দেখাল। পরে ও মারা যায়-দেশমাতৃকার প্রতি উৎসর্গীকৃত আরো আরেকজন শহীদ। লেফটেন্যান্ট মুস্তাফার অধীনস্থ স্থানীয় মুক্তিবাহিনী এই অঞ্চল থেকে কিছু ছোট জেলে নৌকা সংগ্ৰহ করে এবং ১৪ই ডিসেম্বর রাতে দুই ব্যাটেলিয়ন শক্তি নিয়ে কিছুটা উপরে মধুমতী নদী অতিক্রম করাটা সম্ভব হয়। ১৫ তারিখের মধ্যে পাকিস্তানিদের কামারখালি প্রতিরক্ষার পতন ঘটে যায়। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানীরা আত্মসমৰ্পণ করে। আমাদের ঢাকা পর্যন্ত আর মার্চ করতে হয়নি। সবকিছু শেষ হয়ে এসেছিল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এবং দেশের সর্বত্র যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। আমরা স্বাধীন হলাম।

১৯৭১-য়ের ডিসেম্বরে এবং তারপরেও কয়েক মাস ধরে আমার চিন্তার প্রধান অংশ জুড়ে ছিল কী করে আর রক্তপাত বন্ধ করা যায়। বাংলাদেশে যথেষ্ঠই রক্ত ঝরেছে এবং আমরা আর রক্তপাত চাই না। আমি যেখানেই গেছি সেখানেই সবাইকে সংযত থাকার আবেদন করেছি এবং বলেছি যে রাজাকার এবং দালালদের ধরে বেসামরিক প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে এবং তাদের হত্যা করা যাবে না। যেসব বেসামরিক কর্মচারী ও পুলিশ তাদের পাকিস্তানী প্ৰভুদের সেবা করেছিল তাদেরকে ক্ষমা করা দেয়া হলো। আমাদের বিজয়ের পরে আমরা উদারহৃদয় হতে চেয়েছি। আমরা বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রচেষ্টাকে পূর্ণসমর্থন জানাই। পুলিশকে পুনর্গঠন করা হলো এবং আমরা তাদের প্রয়োজনীয় অন্ত্র ও গুলিগোলা সরবরাহ করি। চারিদিকে ছড়ানো যে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাওয়া যাচ্ছিল তা সংগ্ৰহ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। বেশ কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিক চেষ্টার পর আমরা প্ৰায় ৩০,০০০ অস্ত্র ও ৩৬ লক্ষ গুলি উদ্ধার করতে সক্ষম হই। গণবাহিনী ভেঙে দেওয়া হলো। তাদের কেউ কেউ তাদের লেখাপড়ায় বা পূর্বতন পেশায় স্বেচ্ছায় ফিরে গেল। কাউকে কাউকে সেনাবাহিনী ও পুলিশে নিয়ে নেয়া হলো। কিন্তু অধিকাংশই জানত না তারা কী করবে। আমার ভালো লাগত যদি ওদের জন্যে আরো কিছু করা যেত। সরকারের নীতি এ ব্যাপারে খুব পরিষ্কার ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে জাতি গঠনের কর্মসূচিতে এসব যুবকদেরকে সম্পৃক্ত করার একটা সুবর্ণ সুযোগ আমরা হারিয়েছি।

আমাদের সৈনিকদের কাছে স্বাধীনতা মানে সংগ্রামের শেষ নয়, বরং আরো বেশি বেশি করে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহ চালিয়ে চাওয়া। স্বাধীনতাটা কেবল শুরু মাত্র। 

[নোটঃ লে. কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) এম এ মজুর, বীর উত্তম এ লেখাটি ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দি মনিং নিউজ পত্রিকায় ছাপা হয়। ইংরেজী থেকে অনুবাদ করেছেন মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)।