মধু মিয়ার যুদ্ধগাথা
নিজামউদ্দিন লস্কর
বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব রণাঙ্গনের ৫ নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত বালাট সাব-সেক্টরের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক মহানায়কের নাম মধু মিয়া। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক বিরাট উপকরণ মধু মিয়া। ইতিহাস তৈরি হয়, লেখা হয় না। মধু মিয়া একদিকে ইতিহাস তৈরি করেছেন এবং অপরদিকে নিজেই তা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আর কেউ সেটা করেছেন কী না আমার জানা নেই। তবে আমাদের ইতিহাসের পাতায় মধু মিয়ার স্থান মহানায়ক হিসেবে তো দূরের কথা, নায়কের পার্শ্চৰ্চরিত্র হিসেবেও নেই। স্বাধীনতা প্ৰাপ্তির পর দিন থেকে আমরা আমাদের সন্তান সন্ততিকে কাল্পনিক যুদ্ধ করা শুনিয়ে আসছি, রেডিও টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কাল্পনিক নাটক দেখিয়ে আসছি, একেকবার একেক রকমের ইতিহাস তৈরি করে তুলে দিচ্ছি তাদের হাতে, আবার যখন আজকের প্রজন্মের কেউ প্রশ্ন-করে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে সত্যিই কি আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা লড়েছিল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে, নাকি ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলা?” তখন আবার ক্ষেপে উঠছি। তবুও মধুর মিয়াদের যুদ্ধগাথা, যুদ্ধকথা তুলে ধরছি না তাদের সমান।
কে এই মধু মিয়া? গণযোদ্ধা মধু মিয়া। একাত্তরের ডাক যাকে ঘর থেকে টেনে বের করেছিল, তার স্ত্রীর মুখের ভাষায় যুদ্ধে যাবার সময় স্বামী তাকে বলেছিলেন-‘দেশের উপর এত বড় বিপদ, যাওন তো লাগবো, চিন্তা কইরো না, আল্লায় তুমরার হেফাজত করব।’ স্ত্রী-পুত্র-দোকানপাট সবকিছু স্রষ্ঠার হেফাজতে রেখে ঘর-সংসার ছেড়ে দেশের হেফাজত করার উপদেশ বেরিয়ে যাবার মতো বুকের পাটা ছিল যার আমি সেই মধু মিয়ার কথা লিখছি।
জন্ম ইতিহাস ঘটলে দেখা যায় ১৩৪৪ বাংলায় অর্থাৎ ১৯৩৭ ইংরেজীতে ভারতের নওগাঁ জেলার গিলানী গ্রামে আবুল কালাম ওরফে মধুমিয়ার জন্ম হয়। পিতা-মৃত আব্দুল বারীক, মাতা-মৃত সাকেরা বেগম। মধু মিয়ার বয়স যখন ১০ বছর তখন তাদের ৩ ছেলে আর ২ মেয়েকে নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং বালাটের সীমান্তবর্তী এলাকাস্থ বাংলাদেশের ডলুরা গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। মধু মিয়া পরবর্তী সময়ে আনসার বাহিনীতে যোগ দেন, উত্তর ডলুরা নিবাসী মৃত সাহেদ আলীর বড় মেয়ে হেলিনাকে বিয়ে করে সুনামগঞ্জ শহরে বসবাস শুরু করেন। পাঠশালা পাশ মধুমিয়া সুনামগঞ্জ শহরে মাইকের ব্যাটারি চার্জের ও মাইক ভাড়া দেওয়ার একটি দোকান খুলেন। এটাই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এবং পরে তার রুটি-রুজির একমাত্র মাধ্যম। মধুমিয়া যখন ঘর সংসার-ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখন ডাক এল স্বাধীনতা সংগ্রামের। বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ালেন আনসার কামান্ডার মধু মিয়া।
জুন মাসের পহেলা সপ্তাহে মেঘালয়ের ট্রেনিং সেন্টার, সাঙ্কেতিক নাম ইকো-১ এর ১নং ব্যাচের ট্রেনিং শেষ হবার পর পাঠানো হলো আমাদের একটি দলকে বালাট সাব-সেক্টর। আমি, এনামুল হক চৌধুরী বীর প্রতীক, সিরাজ উদ্দিন আহমদ বীর প্রতীক, আকিল চৌধুরী, কাশেম এই কজন আমরা সিলেটের এবং বাকি সবাই সুনামগঞ্জ ও আশেপাশের এলাকার দলটিতে ছিল। আজন্ম শহরে বেড়ে ওঠা কেউ যদি হাওড়-বাওড়, পাহাড়-টিলা, নদী-নালায় পরিবেষ্টিত কোনো প্ৰাকৃতিক পরিবেশে হঠাৎ ছিটকে পড়ে তাহলে তার অবস্থা যেমন হবে মিলিটারি ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে নামার পর আমাদের কয়েকজনার অবস্থাও ঠিক তেমন হলো। প্রকৃতির এই মনকড়া দৃশ্য যে কোনো কাউকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য। কিন্তু যুদ্ধভূমি হিসেবে এরকম অঞ্চল ভীষণ দুৰ্গম এবং কষ্টকর টের পেলাম তিনদিন যাবার আগেই জয়বাংলা বাজারে মধু মিয়ার সাক্ষাৎ পাবার পরমুহুর্তেই।
ভারতের বালাট সীমান্তের শেষ মাথায় নোম্যান্স ল্যান্ডের (No Man’s Land) পর থেকে যেখানে বাংলাদেশের শুরু সেই গ্রামটির নাম ডলুরা। সেখানেই সীমান্তের কোল ঘেঁষে যুদ্ধকালীন মানুষের সুবিধার জন্য স্থাপিত হয়েছে স্বাধীন মাটিতে জয়বাংলা বাজার। দুদেশের পণ্য বিক্রি হয়, দুদেশের টাকাই চলে এই বাজারে। দেখা হলো মধু মিয়ার সাথে। বাজারের মালিক না পাহারাদার মধুমিয়া টের পেলাম না মোটেই। ছিপছিপে হালকা পাতলা গড়নের মেদহীন শরীরের মানুষটির পরনে আনসারের খাকি পোষাক, মাথায় সামনের দিকে বাড়ানো কাপড়ের টুপি পায়ে জঙ্গল বুট। খটাশ করে সামরিক কায়াদায় স্যালুট দিলেন। তার পেছন পেছন গিয়ে বসলাম চায়ের দোকানে আমার সাথের গাইড মজলিশ (পরে শহীদ) কে নিয়ে ওর্ডার দেবার আগেই চা-বিস্কুট চলে এল। আমাদের আসার খবর পেয়ে ভীষণ আনন্দিত তিনি। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম সুবেদার গিয়াস উদ্দিনের (বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার) এর নেতৃত্বে ইপিআর, আনসার এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈনিক নিয়ে এ যাবত তারা লড়াই চালিয়ে এসেছেন। মধুমিয়াও সরাসরি এ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসাতে কয়েকদিন যাবত কোনো যুদ্ধ নেই এলাকাতে। গোলা-বারুদ হাতিয়ার নিয়ে আমরা এসেছি, পেছনে আরো আসছে অনেকে এবং এখন থেকে একের পর একটা ব্যাচ আসতে থাকবে প্ৰশিক্ষণ শেষ হবার সাথে সাথে; আমাদের সেক্টর কমান্ডার, সাব-সেক্টর কমান্ডার আসবেন, সরাসরি তাদের কমান্ডে যুদ্ধ পরিচালিত হবে-এসব জেনেই তার এতো আনন্দ। বললেন- ‘আপনেরা উচিত সময় আইছইন। এই যে দেখতাছইন পানি আর পানি, কুন যেগাত বুক সমান, আবার কুন যোগাত মাতা সমান, এর মাইজে শাপ কোপ, পাহাড়ি জোকে ধরলে ছয়মাস লাগে শুকাইতে, ধান ক্ষেতর আরলিও আছে পানির নিচে, হামুখ আর কাপনার মতো বাদ অই দিলাম, এক গেরাম থাইক্যা আরেক গোরামে যাওন লাগে নৌকা দিয়া, মার্চ এপ্রিল মাসে ইকান আছিল ফসলর ক্ষেত, আল্লার আজব লিলা দেখইন, আইজ ই জাগাতে পানি আর পানি। আপনেরার কষ্টের কতা চিন্তা করলে কিছুডা খারাপ লাগলেও শত্রুপক্ষার অবস্থা এক্কেরে টাইট, হাতার যানে না শালার বেটাইনতে, পানিত লামতে ডরায়, এই সুযোগে যাইত্যা ধরুম আমরা।’ তন্ময় হয়ে শুনছিলাম আমরা তার কথা। যেন যুদ্ধের শেষ পরিণতিটাও ধরা ছিল তার চোখের সামনে অভিজ্ঞ সমর নায়কদের মতো। কথা বলার সময় মধু ঝরে মধুমিয়ার মুখে। প্ৰথম দর্শনেই কাছে টেনে নিলেন আমাদের। বয়সে আমাদের চেয়ে চার পাঁচ বছরের বড় হবে মানুষটি। বললাম-আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আপনি বলার সাথে সাথে ক্ষেপে উঠলেন- ‘আপনারা স্যার শিক্ষিত মানুষ, অফিসার মানুষ, তুমি না বললে দুঃখ পাই আমি।’ তুমি না বললে দুঃখ পায় মধু মিয়া। আরেকটি কথা বলেছিল, তুমি নাকি আপন মানুষের সম্বোধন। তার তুলনায় অনেক বেশি লেখাপড়া জানা হলেও অনেক দিন পর কথাটির মর্ম বুঝতে শিখেছি। সেই থেকেই তুমি বলা শুরু করেছি তাকে অর্থাৎ তার ভাষায় আপনজন।
এরপর থেকে দেখা হয়েছে প্রায়ই তার সাথে। যতবার দেখা হয়েছে ততবারই যুৎসই একটা স্যালুট উপহার পেয়েছি তার কাছ থেকে। সবসময়ই ব্যস্ত মধু মিয়া। জয় বাংলা বাজারে তাবু খাটিয়ে একটি রেডক্রস সেন্টার খুলেছে। আরেকদিন জানালেন দেওয়ান ওবায়দুর রাজা তৎকালীন এমএনএ, তার সাথে আলাপ করেছেন একটি গোরস্থানের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্থান নির্বাচন করার জন্য এবং রাজা সাহেব তাকে নাকি কথা দিয়েছেন সেটা করে দেবেন। তারপর তিনি তার যুদ্ধে, আমি আমার যুদ্ধে, যুদ্ধের ক্ষেত্র বেড়েছে। আমাকে আসতে হয়েছে সুনামগঞ্জ, আহছান মারা, জয়কলশ, উজানি গাউ, দরিয়াবাজ, আমবাড়ি, বইয়াখউরি, মুক্তখাই, জিবদারা, কাংলার হাওর, করচার হাওর, বেজবাড়ি, হুরুয়াকান্দা, বাদেরটেখ, সদরপুর, পাগলা অপারেশনে চলে এসেছি এবং আহত হয়ে বালাট ফিরে এসেছি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে স্থাপিত অস্থায়ী হাসপাতালে। শিলং মিলিটারি হাসপাতালে যাবার আগে একদিন একরাত ছিলাম আমি সেখানে। রাজা সাহেবসহ সবাই দেখতে আসেন আমাকে। মধুমিয়াও আসে। তার কাছ থেকে জানতে পারি শহীদদের জন্য যোদ্ধাদের গোরস্থান হয়েছে। এরপর আর মনে নেই তাকে…..।
স্বাধীনতার দু’মাস পর সুনামগঞ্জ গিয়েছি। খবর পেয়ে ছুটে এসেছে মধু মিয়া, এসেই চিরাচরিত সেই স্যালুট। লাঠির সাহায্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমাকে হাঁটতে দেখে ভীষণ আফসোস করল প্রথমে, তারপরই মধুর হেসে মধু মিয়ার আবদার-‘স্যার, লাইন যাই ডলুরা আমার সাথে।’ বলেছি আজ না, আবার আসছি, এলেই যাবো। ডাহা মিথ্যে বলে এসেছি, যাইনি ফিরে, পাছে নতুন কোনো দায়িত্ব বেড়ে যায় এই ভয়ে জিজ্ঞেস করিনি, মধু মিয়া কী রয়েছে সেখানে।
৯০ সালে আরেকবার সুনামগঞ্জ টাউন হলে সেক্টর কমান্ডার লে. জেনারেল মীর শওকত আলী, অন্য আরো দুজন সাব-সেক্টর কমান্ডারের সাথে আমিও গিয়েছিলাম বালাট সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে মধু মিয়ার সাথে দেখা। পরণে সাফারি, মাথায় বারান্দাওলা টুপি, স্যালুটের পর একখানা খাতা বাড়িয়ে দিল আমার হাতে-‘স্যার দেখইন চাইন আপনার নামডা আছেনি ইখান।’ বিস্ময়ে হতবাক আমি৷ পাতা উল্টিয়ে খুঁজে পেলাম আমার নাম বাবার নামসহ আমার সিলেটের ঠিকানা রয়েছে সেখানে, আমি যে আহত হয়েছিলাম সেটারও উল্লেখ আছে। আঠার মতো লেপ্টে আছে আমার চোখ তার ডায়রির পাতায়। আহত, শহীদ কারো নাম বাদ পড়েনি। মধু মিয়ার কণ্ঠস্বরে সন্বিত ফিরে পেলাম- ‘স্যার লইন যাই ডলুরা। গোরস্থানটা দেইখ্যা আইবা।’ যাবো মধু মিয়া তবে আজ নয়, বলে এসেছি। যাইনি। মূলত যাবার দায় ছিল না আমার। সংসারের টানাপোড়েন মানবিক অনুভূতিগুলোকে ভোঁতা করে দিয়েছিল তাই যাওয়া হয়নি।
২০০৪ সালে সিলেট মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ড থেকে ৩/৪ জন পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলেন একদিন। চা নাস্তা শেষ করার পর মনে হলো কিছু বলার জন্য উসখুস করছেন তারা। আমিই জানতে চাইলাম বিষয়টা কী। নেহাত বাধ্য হয়ে তারা জানালেন, আগামীকাল আমাকে সিলেট মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডে একটু যেতে হবে, ভুলক্রমে আমার নাম নাকি মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকাতে ওঠেনি, ঢাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা সেন্ট্রাল কমান্ড কাউন্সিলের একজন কর্মকর্তা আসবেন এবং সিলেটের তিনজন মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত থাকবেন যাচাই বাছাই কমিটির সদস্য হিসেবে। আমাকে সেখানে উপস্থিত হয়ে প্রমাণ করতে হবে আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম কী না। তবে এও জানালেন তারা, আমি একা নই আরো বেশ কয়েকজনের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে এবং আমার বন্ধু ইফতেখার শামিম ও বড়ভাই সদর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী থাকবেন যাচাই বাছাই কমিটির সদস্য হিসেবে। তাদের মুখের কথা শেষ হবার আগেই ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলাম আমি। বললাম যাবো না আমি এবং এও বললাম-‘তোমাদের যাচাই বাছাই কমিটিকে বলে দিও আমার নাম তালিকা থেকে বাদ দিতে।’ যদিও তাদের কোনো দোষ ছিল না, তবুও অযাচিতভাবে দুর্ব্যবহার করে বিদায় করলাম তাদের। তারাও আমার তাৎক্ষণিক আবেগের কারণ বুঝতে পেরে চলে গেল। মনে পড়ল মধু-মিয়ার কথা। পাঠশালা পাশ করা মধু-মিয়া যখন যাকে পেয়েছে তাকে দিয়ে ডায়রিতে নাম লিখে রেখেছে মুক্তিযোদ্ধাদের। মধু মিয়ার ইতিহাসে আমার নাম আছে অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে নেই। সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হক জানালেন ঐতিহাসিক মধু মিয়া পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন মাত্র কয়েক মাস আগে।
২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথামূলক আমার লেখা বই একাত্তরে রণাঙ্গনে প্রকাশিত হলো একুশের বই মেলাতে। নিজের যুদ্ধকথা লিখতে গিয়ে মধু মিয়ার কথা এসেছে সেখানে। তাতেই দায়সারা ভেবেছি নিজেকে। কিন্তু বইখানি পড়ার পর সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু এডভোকেট বজলুল মজিদ খসরু হঠাৎ একখানা চিঠি পাঠালো। প্ৰশংসায় ভর্তি চিঠি। আনন্দে নেচে উঠলাম। আমি। নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে। খসরুর চিঠিতে আরো ছিল-‘মধু মিয়ার উপর দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ৭ই জানুয়ারি ২০০৫ ইংরেজীতে প্ৰকাশিত আমার লেখার কপি পাঠালাম। মধু মিয়াকে আলোতে নিয়ে আসা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তোমার পক্ষ থেকে কী করতে পার দেখবে।’ চিঠি পড়া শেষ করেছি কিন্তু মধু মিয়ার ওপর লেখা পেপার কাটিং পড়িনি সময়ের অভাবে। জড়িয়ে পড়েছি নিজের জীবনযুদ্ধে।
২০০৮ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মেজর কামরুল হাসান ভুইয়ার কণ্ঠ ভেসে এল মোবাইল ফোনে। জিজ্ঞেস করলেন কিছু লিখছি কী না। উত্তরে জানালাম একটি বইয়ের অনুবাদ করেছি আরেকটি উপন্যাসের রূপান্তরও করেছি। ক্ষেপে উঠলেন ভদ্রলোক। বললেন-ওগুলো করার মতো বহু লোক আছে বাংলাদেশে এবং আপনার চেয়ে অনেক ভালো লিখে তারা, মুক্তিযোদ্ধের ওপর লিখছেন না কেন? সাথে সাথে উত্তর দিলাম-কেন লিখে ফেলেছি তো আমার স্মৃতিকথা। আরো বেশি ক্ষেপলেন তিনি-‘কেন আপনি ছাড়া আর কেউ যুদ্ধ করেনি? আপনি একাই দেশটাকে স্বাধীন করেছেন নাকি? ওদের কথা লিখতে পারেন না? আর ক’দিন পর বলার মতো কেউ আর বেঁচে থাকবে না। ওসব বাদ দিয়ে যাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন ওদের কথা লিখুন।’ কেটে দিলেন ফোন তারপর।
মেজর কামরুল হাসান ভুইয়ার মতে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের উপকরণ। ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন তার ‘একাত্তরের বিজয়গাথা গ্রন্থে’র ভূমিকাতে লিখেছেন- ‘এখন তো আংশিকা হয়, ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা ও যুদ্ধের ভুল ব্যাখ্যা প্ৰদান করা হবে। কারণ উপাদান বিনষ্ট হলে কীভাবে রচনা করা যাবে ইতিহাস?’ মধু মিয়া কী তাহলে আন্দাজ করতে পেরেছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে যাবে….? বদলে যাবে….? বিকৃত হবে……? হারিয়ে যাবে ইতিহাসের সকল উপকরণ। এবং সে জন্যেই ডায়রির পাতায় লিখিয়ে রাখছিল সব কিছু।
বজলুল মজিদ খসরুর পাঠানো পেপার কাটিং খুঁজে বের করলাম। পড়লাম মধু মিয়ার কীর্তিগাথা। সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা খসরু আর আমি একসাথে ট্রেনিং করি কিন্তু তাকে যেতে হয় দোয়ারা বাজার-ছাতক সাব-সেক্টরের যুদ্ধে। মধু মিয়ার সাথে তার পরিচয় স্বাধীনতার পর। ২০০৫ সালের দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার ৭ই জানুয়ারি সংখ্যাতে মধু-মিয়াকে নিয়ে তার লেখার শিরোনাম ছিল-‘আত্মনিবেদিত মধু মিয়া, তার স্বপ্নের ডলুরা স্মৃতি সৌধ।’ প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ পড়ার পর খসরুকে টেলিফোন করে পরদিনই সকালে গিয়ে উপস্থিত হলাম সুনামগঞ্জ ১৮ই মার্চ মঙ্গলবার ২০০৮ তারিখ সকাল দশটার সময় আরেক সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা সালেহ এর বাসায়। একসাথে ট্রেনিং নেবার পর সে চলে গিয়েছিল ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমি গিয়ে পৌছার সাথে সাথে মধু-মিয়ার স্ত্রী হেলিনা বেগম এসে উপস্থিত হলেন। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ছেলেটা মারা গেছে প্ৰায় বছর খানেক তাই দোকানটাও এখন তাকে চালাতে হয়। একমাত্র মেয়ে মমতাও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে অনেক আগে। শাহাব উদ্দিন আফিন্দীর লেখা আরেকটি পেপার কাটিং দিলেন মধু-মিয়ার স্ত্রী আমাকে। বললেন-এখানেই সব পাবেন তার সম্পর্কে। মধু মিয়া স্মরণে আফিন্দীর লেখার শিরোনাম-‘আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মধু ভাই।’ লেখাটি পড়া শেষ করার আগেই সুনামগঞ্জ জেলা কমান্ডের আব্দুর রশীদ এসে উপস্থিত হলেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ছিলেন। দলছুট হয়ে পরবর্তীতে যোগ দিয়েছিলেন আমাদের সাথে যুদ্ধে। আমার সাথে শিলং মিলিটারি হসপিটালে ছিলেন আহত অবস্থায়। অনেক দিন পর দেখা হতে দুজনেই আমরা বেজায় খুশি। তার ছেলে আলম, একটি স্থানীয় দৈনিকের স্টাফ রিপোর্টার তাকে নিয়ে রওয়ানা হলাম মধু মিয়ার স্বপ্নের ডলুরা শহীদ স্মৃতিসৌধের উদ্দেশ্যে। আমার সাথে সিলেটের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সুপরিচিত মুখ আমিরুল ইসলাম বাবু।
হালুয়াঘাট এসে ইঞ্জিন নৌকায় সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে বেবিটেক্সি রিজার্ভ করে ডলুরার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। রিক্সাও রয়েছে প্রচুর, তাছাড়া মোটর সাইকেল নিয়ে তরুণরাও অপেক্ষমান। সবচেয়ে দ্রুততম এবং অপেক্ষাকৃত কম ভাড়াতে মোটর সাইকেলে যেতে পারবেন আপনি সেখানে। আমরা তিনজন থাকাতে বেবিটেক্সি নিলাম। সিমেন্ট বাঁধানো সরু পাকা রাস্তা নদীর ঘাট থেকে শুরু হয়েছে। বাড়ি ঘর, বাঁশের ঝাড়, ধানের ক্ষেত, ফসলের মাঠ, পুকুর ডোবা, হাওর নদী ছায়াছবির দৃশ্যের মতো সরে যাচ্ছে চোখজোড়া আটকালো হঠাৎ। ড্রাইভারের ঘাড়ে হাত দিয়ে বেবিটেক্সি থামালাম। ভীষণ চেনা লাগছে জায়গাটি। ড্রাইভার জানাল গ্রামটির নাম ঢালার পাড়। মনে পড়ল, মদন হাবিলদারকে হারিয়েছিলাম ঐ গ্রামে। আহত হয়ে মদন চলে যায় শিলং হাসপাতালে, ফিরে আসেনি, মারা যাবার পর এসেছে, তবে কোনো মধু মিয়া সেখানে না থাকায় কবর কোথায় আজো কেউ জানে না। ইপিআর এর অকুতোভয় একজন সৈনিক মদন হাবিলদার সেদিনকার যুদ্ধে নিজের প্রাণের বিনিময়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। আবার চলতে শুরু করেছি, একে একে বেরিগাউ, ষোলঘর, কৃষ্ণনগর, নারায়নতলা চার্চ সব এসে উপস্থিত হতে শুরু হলো আমার চোখের সামনে, একই সাথে স্মৃতিগুলোও সব ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফেরা-বর্তমান থেকে অতীতে…মজলিশ, মধুমিয়া, কালাম, শামছুল হক, কবীন্দ্র, সিরাজ, মরম আলী, আরশ আলী, রশীদ, হাবিলদার হিরা মিয়া…… সবাই জীবন্ত রক্তমাংসের সৈনিক…রাইফেল, এলএমজি, স্টেনগান, টু-ইঞ্চি মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড সেই আগের মতোই…সেন্ট্রির চিৎকার…হল্ট, পাসওয়ার্ড…হিরা মিয়ার কণ্ঠস্বর…বানচুতের বাচ্চারা…। আমার মস্তিষ্কের পেছনে বসানো কোনো এক অদৃশ্য প্রজেক্টর থেকে কে যেন দৃশ্যগুলোকে নিক্ষেপ করছে আকাশের গায়ে। ঐ-তো হাওয়ায় ভেসে আসছে লাগামহীন আমার প্রিয় সেই লাল ঘোড়াটি। যাকে নিয়ে রাংপানির ব্রিজ পার হয়ে বিএসএফ এর ক্যাম্প থেকে গোলাবারুদ আর হাতিয়ার আনতে যেতাম। ঘাড়ে হাত পড়লো-ঐ যে আপনার নারায়নতলা চার্চ, আরো দুই কিলোমিটার পর ডলুরা। বাবুর ডাকে চোখের ঘুম পালালো। চোখের পলকে পার হলাম দুই কিলোমিটার পথ দুপাশে ছড়িয়ে থাকা আমার প্রতি পরিচিত যুদ্ধভূমি দেখতে দেখতে, যার প্রতিটি ইঞ্চি ভূমি চষে বেড়িয়েছি আজ থেকে সাঁইত্রিশ বছর আগে।
ডলুরার শহীদ স্মৃতিসৌধের গেটে এসে থামলাম। নদীর ঘাট থেকে এগারো কিলোমিটার পাকা রাস্তা এবং ডলুরা গ্রামের শেষও এখানেই। তারপর নো ম্যান্স ল্যান্ড। দেশ ও জাতির অতন্দ্র প্রহরী মধু মিয়া সীমান্ত পাহারার দায়িত্ব কারো হাতে ছাড়তে মোটেই রাজি নন আজ অব্দি। ৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করেছেন তিনি এখানে, সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ঘেঁষে। পাহারা দিচ্ছে আজও তারা, তিনিও সাথে রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪২ জনকে কবর দেওয়া হয় এবং ৬ জন হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাকে দাহ করা হয়। আলাদাভাবে চিহ্নিত করে মার্বেল পাথরের ওপর নাম লেখা আছে তাদেরও। লোহার গেট পার হয়ে স্মৃতিসৌধের মূল পাকা গেইট। গেটের লোহার গ্রিলে বসানো সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের ছবি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ফটকের দরজা। লম্বায় ৮২ ফুট, প্রস্থে ৮১ ফুট এবং উচ্চতায় ৫ ফুট উচু পাকা দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে কবরস্থানকে। ভর দুপুরের রোদ্দুরও গাছের পাতার ডিফেন্স লাইন অতিক্রম সরাসরি মাটিকে স্পর্শ করতে পারে না, তবে ছায়াকে জড়িয়ে রোদের চিরন্তন বিকিমিকি খেলায় কোনো বাঁধা নেই সেখানে। নানান প্ৰজাতির গাছের সমারোহ এক অপূর্ব শান্ত প্রকৃতি রচনা করেছে। যে দুটি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতিসৌধের ফটিক সেখানে মার্বেল পাথরের ওপর কালো অক্ষরে লেখা রয়েছে ৪২ জন সমাহিত মুক্তিযোদ্ধা এবং ৬ জন দাহ করা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। প্রতিটি কবরের মাথার দিকে পাথরের ওপর ক্রম অনুযায়ী নম্বর বসিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে একেকটি কবরকে। এই তালিকা থেকে কোনো নাম বাদ পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই যেমন ঠিক তেমনি নতুন কোনো নাম অন্তর্ভুক্ত করার কোনো উপায়ও সেখানে নেই। শুধু একটি নাম আছে তালিকার বাইরে, নম্বর নেই, নামটি কবরের মাথার দিকে পাথরের ওপরে লাল পেইন্ট দিয়ে লেখা-‘মধু মিয়া।’ পাশেই রয়েছে বিস্তৃত সবুজ মাঠ, মাঠ ঘিরে সারিবদ্ধ গাছের সমারোহ, লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আসা ক্লান্ত শ্ৰান্ত পথিকের কিংবা দর্শনার্থীদের জন্যে একপ্রান্তে বিশ্রামাগার। স্মৃতিসৌধের ঠিক উল্টেদিকে মাঠের সবুজের সীমানাতে সেন্ট্রি পোস্টের মতো একটি টংঘর। এগুলাম সেদিকে। চা-বিস্কুট পানসহ আরো টুকটাক অনেক কিছু রয়েছে দোকানটিতে। বয়স্ক একজন লোক বসে আছেন দোকানের ভেতরে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আছেন কী না? বিস্ময় এবং বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলেন-‘আমিইতো মুক্তিযোদ্ধা।’ উত্তরটি দিয়ে পিটপিট করে তাকালেন চশমাহীন চোখে আমার মুখের দিকে, মুখের আদল চেনা লাগছে আমারও, লাফ দিয়ে নেমে এলেন টংগরের ভেতর থেকে। মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন, ডলুরার মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধ করেছি একসাথে, বর্তমানে স্মৃতিসৌধের অতন্দ্র আরেক প্রহরী। জাসিমের পাঠানো খবর পেয়ে ছুটে এল মধু মিয়ার ভাই, সেও আমাদের সহযোদ্ধা। চা খাচ্ছিলাম জসিমের দোকানে তখন আরেকজন এল, আরো কিছুক্ষণ থাকলে বিরাট একটি মিলন মেলা জমে উঠতো সেখানে। ফেরার পথে জসিমকে সাথে নিয়ে স্মৃতিসৌধ থেকে কয়েকশো গজ দূরে ছোট্ট বাজারে মধু মিয়ার ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসে শর্ষে ভর্তা দিয়ে গরম গরম চিতই পিঠা খেলাম সবাই।
সিলেটে ফিরে আসার পথে ভাবছিলাম খসরু এবং অফিন্দীর লেখা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যসহ ডলুরার শহীদ স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলার সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখবো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই পরিচিত দৃশ্য নজরে পড়ল। আহসানমারা ব্রিজ অতিক্রম করছিলাম আমরা, যুদ্ধকালীন সময়ে ফেরি ছিল। আরো কিছু সামনে এগুতেই থামালাম গাড়ি, এখানেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম আমি, একই দিনে একাত্তরের ১৬ই আগস্ট আমার সহযোদ্ধা মরম আলী শহীদ হয়েছিল। এখানেই কুখ্যাত রাজাকার সত্তার ও পাকিস্তানি মিলেশিয়া বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে এবং এখানেই বহাল তবিয়েতে ২০৫টি মামলার আসামী ঐ সাত্তার আজও বিরাজমান। যুগভেরীতে এ ব্যাপারে কিছু লেখা বেরিয়েছিল শুনেছিলাম কারো মুখ থেকে। টেলিফোন করলাম হ্যারল্ড রশীদকে। হ্যারন্ড জানালেন তিনি ঢাকায় আছেন তবে ব্যবস্থা করছেন আমার জন্য। পাঁচ মিনিট পর আবার ফোন পেলাম তার কাছ থেকে, বললেন রাত আটটার দিকে অপূর্বের কাছে গেলেই পেয়ে যাবো আমার কাঙ্খিত কাগজ। আটটায় অপূর্ব আমার হাতে যুগভেরীর সংখ্যাগুলো তুলে দিল। মধু মিয়ার ওপর কোনো কিছু আছে কী না জানতে চাইলে সে ২০০৭ এর ১৬ই ডিসেম্বরের যুগভেরীতে প্ৰকাশিত দীপংকর মোহান্তের লেখা—‘একজন মধু মিয়া ও ডলুরা সমাধীস্থল’ এই শিরোনামের লেখাটি দিল। তাদের অফিসে বসেই লেখাটি পড়ে শেষ করলাম। অপূর্বের কাছ থেকে জানতে পারলাম দীপংকর মোহান্তের কাছে আরো অনেক তথ্য ও প্রমাণ আছে মধু মিয়ার ব্যাপারে। সে মোহান্তের সাথে ফোনে আমাকে যোগাযোগ করিয়ে দিল। মোহান্ত প্রশ্ন করলেন আমি কী জানতে চাই? আমি তাকে উত্তরে বললাম- ‘আমি আপনার, বজলুল মজিদ খসরু ও শাহাব উদ্দিন আফিব্দীর লেখা সব পড়েছি, তা ছাড়া যুদ্ধকালীন সময় থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনতাম কিন্তু এখন আমি তাকে আবিষ্কার করতে চাই।’ মোহান্ত হয়তো আঁচ করলেন আমার কথা, বললেন শুক্রবার সকালে আপনি আসুন আমার বাসায়, মনে হয় আপনাকে আমি সন্তুষ্ঠ করতে পারব এবং শুক্রবার অর্থাৎ ২১শে মার্চ তার বাসায় যেতেই আমাকে তিনি মধু মিয়ার সেই মূল্যবান ডায়রির ফটোকপি হস্তান্তর করলেন, সাথে আরো বেশ কিছু অপ্রকাশিত তথ্যের কপি দিলেন। শহীদ স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলার নেপথ্য কাহিনী থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি পদক্ষেপে চুড়ান্ত সাংগঠনিক নিরপেক্ষতার এবং স্বদেশপ্রেমের এক অত্যাশ্চর্য উপাখ্যানের নায়ক মধু মিয়ার প্রতিচ্ছবি উন্মোচিত হলো আমার চোখের সামনে এগুলো পড়ার পর।
যুদ্ধের প্রারম্ভে যখন মুক্তিযোদ্ধারা আহত হতে লাগলো এবং বিভিন্ন পর্যায়ে শহীদদের জন্য করের কোনো নির্দিষ্ট জায়গা না থাকাতে মধু মিয়া খুঁজতে লাগলেন। কোথাও পৰ্যাপ্ত জায়গা না পাওয়াতে শেষ পর্যন্ত তার আপনি চাচাতো ভাইগণের এবং নিজের নামের বন্দোবস্ত সরকারি খাসভূমি, কিতাব আলী, হযরত আলী ও সিকান্দর আলীর কাছ থেকে দান হিসেবে গ্রহণ করেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য এমএনএ দেওয়ান ওবায়দুর রাজা সাহেবের বরাবরে অনুমতি চেয়ে এই মর্মে লিখিত আবেদন করেন। প্রতি উত্তরে তার দরখাস্ত মঞ্জুর করে সরকারিভাবে ডলুরা নিবাসী মধু মিয়াকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয় এবং একই সাথে একটি বাড়তি দায়িত্ব উক্ত কমিটিকে প্রথম করা হয়।
প্রথম- আহত মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতালে প্রেরণ ও তাদের প্রারম্ভিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
দ্বিতীয়- জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক শহিদকে তার নিজস্ব ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা ও দাহ করার ব্যবস্থা করা। তার কমিটিতে ছিলেন মুন্সী তারু মিয়া, যিনি মাওলানা হিসেবে জানাজার নামাজ ও গোছল কাফনে সাহায্য করতেন, কবর দিতে সাহায্য করতেন। আফসার উদ্দিন, কিতাব আলী, আব্দুর রহিম, মগল মিয়া, হযরত আলী ও মফিজ উদ্দিন। হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাদের দাহ করার কাজে তিনি নিপু ঠাকুরকে নিয়োগ দেন। নিপু ঠাকুরের ঠিকানা যেভাবে তিনি তার ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করিয়ে রেখেছিলেন- নিপু ঠাকুর, পিতা মৃত্যু মনমোহন ঠাকুর, লাল পানি, বালাট, মেঘালয়। তার বাংলাদেশি কাউকে এ কাজের উপযুক্ত না পেয়ে উপরোক্ত ভারতীয় নাগরিককে দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করেছেন। এরাই ছিলেন তৎকালীন প্ৰবাসী সরকারের ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সদস্য।
মন্তাজ মিয়াঃ প্রথমেই যাকে কবর দেওয়া হয় তার নাম মন্তাজ মিয়া। সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ থাকার কমলাবাজ গ্রামে বাড়ি ছিল তার। আনসার ট্রেনিং নেওয়া মন্তাজ মিয়া শুরু থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবার কিছুদিন আগে মীরের চর গ্রামের কাঁচা মিয়াকে নিজের পাঞ্জাবী আর চশমা দিয়ে অনুরোধ করেছিলেন- ‘চাচা আমি যদি মারা যাই, এগুলো আমার মায়ের কাছে পৌছে দেবেন।’ কাচা মিয়া শহিদ মন্তাজের অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পর মা যখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন তার একমাত্র সন্তানের প্রিয় মুখটি দেখার জন্য মায়ের হাতে সন্তানের এমন একটি স্মৃতিচিহ্ন পৌছালো যে চশমা দিয়ে ছেলে তার মায়ের মুখটি দেখ। একাত্তরের ১৮ই জুলাই শহীদ হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মন্তাজ। তার পিতার নাম আব্দুল গনী।
রহিম বক্সঃ ইপিআর এর হাবিলদার রহিম বক্স। চাকরি করতেন সীমান্তে। বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া থানার এওকিয়া গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে দেশমাতৃকার টানে যুদ্ধে অংশ গ্ৰহণ করে। রহিমবক্স তার প্রিয়জনকে দেখতে পারেনি। একাত্তরের ২৭ শে আগস্ট শহীদ হন তিনি। বেরিগাঁওয়ের একটানা কয়েকদিনের একটি যুদ্ধে রহিমবক্সের প্লাটুন আমাদের সাথে কাজ করেছিল, যুদ্ধভূমিতে তার সাহসের কথা চিরজীবন মনে থাকবে আমার।
জনাব আলীঃ জন্ম সুনামগঞ্জ থানার মাছিমপুর গ্রামে। পিতার নাম কেরামত আলী। মুক্তাঞ্চলেই প্রশিক্ষণ গ্ৰহণ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ৯ সেপ্টেম্বর শহীদ হন।
সুরুজ মিয়াঃ সুনামগঞ্জ সদর থানার মঙ্গলকাটা গ্রামে ১৯৫০ সালে জন্ম। পিতার নাম মছমত আলী। ১০ অক্টোবর শহীদ হন।
ওয়াছিদ আলীঃ হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার দেওতৈল গ্রামে ১৯৪৮ সালে জন্ম। পিতার নাম হরকুম উল্লা। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ শেষে বালাট সাব-সেক্টরে যুদ্ধে এস যোদগান করেন ১০ অক্টোবর পাক বাহিনীর এক অতর্কিত হামলা প্রতিহত করার মুখে ওয়াছীদ আলী শহীদ হন।
জয়নাল আবেদিনঃ ১৯৫৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার ঝরঝরিয়া গ্রামে জন্ম গ্ৰহণ করেন। পিতার নাম লস্কর মাহমুদ। ট্রেনিং মেষে যুদ্ধে এসে যোগাদন করেন। অসমসাহসিকতার সাথে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করেন। ১লা আগষ্ট শহীদ হন।
মহরম আলীঃ সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারা বাজার থানার রামপুর গ্রামে ১৯৫৩ সালে মহরম আলীর জন্ম। পিতার নাম আজিজ উল্লা। ২৭শে নভেম্বর শত্রু বাহিনীর আক্রমণ প্ৰতিহত করার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
মো: আব্দুর রহমানঃ ১৯৪০ সালে সুনামগঞ্জ থানার সুরেশ নগর গ্রামে জন্ম। পিতার নাম হাজী আকিব আলী। মুক্তাঞ্চলে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন। ২২ শে আগস্ট পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হন।
মোস্তাফা মিয়াঃ ১৯৪৬ সালে মৌলভী বাজার জেলার সাধহাটি গ্রামে জন্ম। পিতার নাম কুদরত উল্লা। ট্রেনিং সেন্টার থেকে আসেন বালাট সাব-সেক্টর। ৪ঠা নভেম্বর পাকবাহিনীর হাতে যুদ্ধে শহীদ হন।
আব্দুছ ছাত্তারঃ মূল বাড়ি সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট থানার ভিতরগুল গ্রামে। প্ৰশিক্ষণ নেবার পর আসেন বরাটা সাব-সেক্টরে । ২৭শে নভেম্বর পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন।
আজমান আলীঃ বাড়ি সিলেট জেলার ডাকরি গ্রামে। ২৭শে নভেম্বর মঙ্গলকাটা এলাকায় যুদ্ধে শহীদ হন।
আবেদ আলীঃ ১৯৪৯ সনে সুনামগঞ্জ সদর থানার নওরজপুর গ্রামে তার জন্ম। পিতার নাম নিজাম উদ্দিন। আধা সামরিক ট্রেনিং নিয়ে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। ২৭শে জুলাই পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন।
আতাহার আলীঃ রাজবাড়ি জেলার পাংশা থানার বিরামপুর গ্রামে জন্ম। তিনি আনসার বাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। সুনামগঞ্জ থাকার সময় শুরু থেকেই তিনি জড়িয়ে পড়েন যুদ্ধে এবং ২৭শে জুলাই পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।
লাল মিয়াঃ ১৯৪১ সালে সুনামগঞ্জ সদর থানার ছাতারকোনা গ্রামে তার জন্ম। পিতার নাম নেকবার আলী। মুক্তাঞ্চলে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। ১লা আগস্ট পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে শহীদ হন।
চান্দ মিয়াঃ কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার কুড়িশাই গ্রামে ১৯৫১ সালে তার জন্ম। পিতার নাম ওয়াজ হোসেন । অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ১০ই অক্টোবর পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হন।
মোঃ ছিদিক মিয়াঃ সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট থানার বিতরখাল হাওড় গ্রামে জন্ম। পিতার নাম শমশের মিয়া। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে শহীদ হন।
আবুবকর ছিদ্দিকঃ কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার গুজারিয়া গ্রামে ১৯৫২ সালে তার জন্ম। পিতার নাম মো: কমর উদ্দিন। একাত্তরে তিনি এসএসসি পরিক্ষার্থী ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে গোপনে গৃহত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ২৭ শে নভেম্বর পাকবাহিনীর হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ হন।
সায়েদুর রহমানঃ সুনামগঞ্জ সদর থানার গামাইরতলা গ্রামে জন্ম। মুক্ত এলাকায় প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। ১২ই অক্টোবর যুদ্ধে শহীদ হন।
আব্দুল হামিদ খানঃ সিলেট জেলার পাঠানচক গ্রামে ১৮৪৭ সালে জন্ম। পিতার নাম এমদাদ খান। লেখাপড়া শেষ করে ইপিআর বাহিনীতে যোগ দেন। ৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি হন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জনৈক বাঙালি কর্নেলের সহায়তায় মুক্তিলাভ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি পাকবাহিনীকে নাজেহাল করেন। ২৭শে নভেম্বর এই সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হন।
আব্দুল খালেক বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার করিমগঞ্জ বাজারে ১৯৫২ সালে জন্ম। পিতার নাম সৈয়দ আলী। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। প্ৰশিক্ষণ গ্ৰহণ করে তিনি বালাটে আসেন। ২৭ নভেম্বর পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হন।
যোগেন্দ্ৰ দাসঃ সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানার মজলিসপুর গ্রামে জন্ম। ট্রেনিং সমাপ্ত করে বালাট সাব-সেক্টরে এসে যোগ দেন। তাকে শহীদ মাজারের অনতিদূরে দাহ করা হয়।
শ্ৰীকান্ত দাসঃ হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ থানার পাহাড়পুর গ্রামে জন্ম। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিভিন্ন যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন। ২৭শে নভেম্বর পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। একই স্থানে তাকে দাহ করা হয়। তারই স্মরণে সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজের পাশে সেনপাড়াতে শহীদ শ্ৰীকান্ত দাস ছাত্রাবাস নামে একটি হোস্টেল আছে।
অরবিন্দ রায়ঃ সুনামগঞ্জ সদর থানার নয়াবাজার গ্রামে ১৯৪৩ সালে জন্ম। ট্রেনিং সমাপ্ত করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ২৮শে জুলাই পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে শহীদ হন। তাকেও শহীদ মাজারে দাহ করা হয়।
কবীন্দ্ৰ দাসঃ সুনামগঞ্জ সদর থানার পাগলা গ্রামে তার জন্ম বলেই জানা যায় কারো কারো মতে যুদ্ধের আগে মোটরগাড়ির কন্ডাক্টর ছিলেন। ২৮শে জুলাই পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। তাকেও ডলুরাতে দাহ করা হয়।
এ ছাড়া যে সকল শহীদের নাম মধু মিয়ার ডায়েরি থেকে পাওয়া গেছে তারা হচ্ছেন-সালাহ উদ্দিন, তাহের মিয়া, আব্দুল হক, মুজিবুর রহমান, নুরুল হক, আব্দুল করিম, সুরুজ মিয়া, সাজু মিয়া, ধনু মিয়া, ফজলুল হক, শামছুল ইসলাম, কেন্ত মিয়া, সিরাজ মিয়া, সমছু মিয়া, দানু মিয়া, মন্নাফ মিয়া, রহিম মিয়া, আলি আহমদ, মো. সমুজ আলী, মোঃ সিদ্দিকুর রহমান, মো. আ. সিদ্দিক, মো. রহমত আলী, হরলালদাস এবং অধর দাস।
মধু মিয়া তার ডায়েরিতে যার সম্পর্কে যতটুকু জানতে পেরেছেন ততটুকুই লিখিয়েছেন। কোথাও কোথাও কালির কারণে অস্পষ্ট হয়েছে কোথাওবা কাগজের কারণে আবার বিভিন্ন লেখকের হাতের লেখার সাথে তাদের ব্যবহৃত কলামের কারণে ও কিছু কিছু যায়গার অস্পষ্টতা রয়েছে। তবে তথ্য সংরক্ষণের ফলে শহীদ পরিবারগুলো অন্তত জানতে পেরেছে তাদের সন্তানদের মহান আত্মত্যাগের কথা। তথ্য সংরক্ষিত না থাকলে শহীদ শ্ৰীকান্তের নামে আজ সিলেটে শ্ৰীকান্ত ছাত্রাবাস হতো না। শহীদ আব্দুল হামিদ খানের শেষ আত্মত্যাগের খবরও জানতে পারতো না বাংলাদেশের মানুষ। কেউ আহত হলে সেটাও লিখে রেখেছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার খেয়াল করার মতো, ডায়েরির বেশ কয়েকিট স্থানে বেশ কিছু আহত মানুষের নাম আছে, কিন্তু পাশে লেখা রয়েছে- পাবলিক। অর্থাৎ এরা যোদ্ধা ছিলেন না, কিন্তু যে কোনোভাবে যুদ্ধাহত হয়েছিলেন, অতএব মধু মিয়া তাদের নামের পাশে পাবলিক লিখে রেখেছেন, যাতে করে পরবর্তী সময়ে কেউ তাদের কে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত না করেন। সামরিক বাহিনীর নামের পাশে-এমএফ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামের পাশে-এফএফ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামের পাশে-এফএফ আনসার, এভাবে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা আছে।
সমগ্র সাব-সেক্টরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন তিনি। যেখানেই খবর পেতেন সহযোদ্ধারা আহত বা নিহত হয়েছেন সেখানেই ছুটে যেতেন।
স্বাধীনতার পর মধু মিয়া একটি লিখিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেন। এই প্রতিবেদনের নমুনাটি দেখলে অতি সহজে অনুমান করা যায় কতটুকু দেশপ্রেম থাকলে একজন মানুষ উর্ধ্বে তার নিজেকে উন্নীত করতে সক্ষম হয়।
প্ৰথমে বড় করে লেখা আছে-যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ। ডাবল ইনভার্টেড কমা দিয়ে লাইনটি চিহ্নিত করা। ডান পাশে তার ছবি লাগিয়েছেন। ছবির সিল মেরেছেন। আহ্বায়ক মো. মধু মিয়া। পরের লাইন-মধু মিয়া কমান্ডার প্রদত্ত। তত্ত্বাবধায়ক ডলুরা কবরস্থান। তারপর ৪৮ জন শহীদের নামের তালিকা। নিচে এসে লিখেছেন-উপরোক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে আজ এই দেশ মুক্ত। তাই আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক বটে। স্বাক্ষর করেছেন তার নিচে। আবার আরেকটি সিল মেরেছেন। এই সিলে লেখা আছে-মো. মধু মিয়া, সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মাজার। ডলুরা সুনামগঞ্জ। আবার তালিকার ওপরে আরেকটি গোল সিলও মেরেছেন। বাম পাশে নম্বর অনুযায়ী কবরের নকশা এঁকে দিয়েছেন। এতো সিল মারার কারণ বোধহয় এই ছিল যে তিনি কাগজটিকে পোক্ত করতে চাইছিলেন সর্বাবস্থায়। তথ্যবিকৃতির ভয়টা কাজ করছিল শুরু থেকে তার মনে।
২০০৪ সালের ১৫ই মার্চ সোমবার দিবাগত রাত বারোটায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই নিবেদিত প্ৰাণ দেশপ্রেমিক মৃত্যু ঘটে। রাষ্ট্ৰীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়। তারই স্বপ্নে গড়া স্মৃতিসৌধে তাকে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুর পর মুল্যবান এই ডায়েরিখানা বজলুল মজিদ খসরু ঢাকাস্থ মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরে জমা দিয়েছেন।