You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.15 | জয় বাংলা ১৫ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা (এবং ইউনিকোড ভার্সন) - সংগ্রামের নোটবুক

জয় বাংলা ১৫ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

জয় বাংলা
শুক্রবার, ২৮শে আশ্বিন, ১৩৭৮ ১৫ই অক্টোবর ১৯৭১
‘সেদিন দূরে নয় যেদিন বঙ্গবন্ধু ঢাকায় মুক্তি বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করবেন’—সৈয়দ নজরুল
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় সর্বাত্মক মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি
[ জয় বাংলা প্রতিনিধি ]
বর্ষা মৌসুম অবসান প্রায়। বাংলাদেশের প্লাবিত অঞ্চলগুলো এখন শুকনো হয়ে উঠছে। মুক্তি বাহিনীও তাই বর্ষা মৌসুমের গেরিলা যুদ্ধ—‘হিট, ডেসট্রয় এ্যাণ্ড রান’, ‘আঘাত কর, ধ্বংস কর এবং নিরাপদ ঘাটিতে ফিরে যাও’ এই নীতি ত্যাগ করে সকল রণাঙ্গনে সর্বাত্মক সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এক বৈদেশিক সংবাদ সূত্রে বলা হয়েছে, ট্রেনিং প্রাপ্ত প্রায় এক লাখ সেনার একটি দক্ষ বাহিনী—(৩০ হাজার নিয়মিত সৈন্য সহ) অবিলম্বে সকল রণাঙ্গনে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ঘোষণা
সম্প্রতি মুক্তি বাহিনীর এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘সেদিনের আর বেশী দেরী নেই, যেদিন শত্রুর জেল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসে আমাদের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকায় মুক্তি বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করবেন। মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধারা শীঘ্রই হানাদারদের বঙোপসাগরে নিক্ষেপ করবে।’
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আরো জোর দিয়ে বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কোন আপস নয়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে উপলব্ধি করতে হবে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আর কোনদিন পাকিস্তানীদের সঙ্গে বাস করবে না। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলা তার নিজের শক্তিতেই রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত আছে এবং থাকবে।
০০০০

প্রধান সেনাপতির বিবরণ
বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ও পার্লামেণ্ট সদস্যগণ এখন মুক্তাঞ্চল সফর করছেন। মুক্তাঞ্চলে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় তারা যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কঃ এ, জি, ওসমানী মন্ত্রিসভাকে যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করান।
০০০০

ঢাকা-চাটগা রোডের গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংস
গত এক পক্ষকালে স্বাধীনতাকামী বীর যোদ্ধারা ময়মনসিংহ সেক্টরের জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের নিকট একটি গ্রামে প্রায় এক’শ রাজাকারকে খতম করেছেন। এই আক্রমণে কয়েকজন ভীত বিহ্বল রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র সমেত মুক্তি বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করে।

ঢাকা-চাটগা রোডে তৎপরতা
গত ৩রা অক্টোবর ঢাকা-চাটগার গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের শ্রীগরের নিকট সেতুটি মুক্তিযোদ্ধারা সাফল্যের সাথে ধ্বংস করে দিয়েছেন। ফলে শত্রু চলাচলের পথে দারুণভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে।

নোয়াখালী
নোয়াখালীর ফেনী অঞ্চলে এ মাসের গোড়ার দিকে মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা নতুন কৌশল অবলম্বন করে শত্রু সৈন্যের ওপর মারাত্মক হামলা চালান। গত ৩রা অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর দুঃসাহসী যোদ্ধারা ফেনীর কাচে মুহুরী নদী পেরিয়ে পরশুরাম ও অনন্তপুরে ছাউনি ফেলেন। পাকিস্তানী বাহিনী এ অবস্থায় মরিয়া হয়ে নিকট থেকে মুক্তি বাহিনীর ওপর আক্রমণের দুঃসাহস দেখায়। গেরিলা যোদ্ধারা অত্যন্ত ক্ষিপ্ততার সাথে নিজেদের মধ্যে আশ্চর্য সমন্বয় সাধন করে বীর মুক্তি সেনানীরা মর্টারসহ ছোট ভারী অস্ত্র দিয়ে প্রবল আক্রমণ হানে। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ১৯ জন শত্রু সেনা খতম হয়।
নোয়াখালীর অনন্তপুরে মুক্তি বাহিনীর ৩টি ঘাটিতে হানাদার সৈন্যেরা আক্রমণের দুঃসাহস দেখালে আমাদের অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা তা প্রতিহত করতে এগিয়ে গেলে দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ বাধে। পরে এ আক্রমণে শত্রুপক্ষের ৩০ জন সৈন্য খতম হয়।
০০০০

শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন দ্বারা জঙ্গীচক্র নিজেদের অপরাধ ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে—প্রাভদা
সোভিয়েট কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপত্র ‘প্রাভদা’ পত্রিকার সাম্প্রতিক এক সংখ্যায় খোলাখুলিভাবে ও বিস্তারিতভাবে পাকিস্তানের ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করা হয়। এই পত্রিকায় পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র অভিযোগ করে বলা হয়, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার তাদের অসৎ কাজগুলির সমর্থন করবার চেষ্টা করছেন।
প্রাভদা বলেন, “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ‘পূর্ববঙ্গে’ যে ব্যাপক ও নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবর রহমানের বিচারের দ্বারা তারা নিজেদের ঘৃণ্য অপরাধ ঢাকা দিতে চাচ্ছে।”
প্রাভদা বলেন, ন্যায় বিচার লঙ্ঘিত হওয়ায় সোভিয়েট জনসাধারণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে এর প্রতিবাদ করছে এবং তারা অবিলম্বে শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি এবং পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দাবী করছে। তারা উদ্বাস্তুদের নিরাপদে দেশে প্রত্যাবর্তনও দাবী করে।
প্রাভদা পাকিস্তানের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বলেন, ১৯৪৭ সনে পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর থেকে একচেটিয়া পুজিবাদীরা, সামন্তগণ এবং উচ্চ শ্রেণীর সরকারী আমলারা মিলে এক প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্র গঠন করেছে। এই শাসকচক্র শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থই দেখেছে এবং দেশের ক্রমবর্দ্ধমান গণতান্ত্রিক শক্তিকে দমন করতে চেষ্টা করেছে। এর ফলে উপেক্ষিত পূর্ববঙ্গে দারুণ অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।
পত্রিকার উক্ত পর্যালোচনায় পাকিস্তানের একচেটিয়া ব্যবসায়ের শ্রীবৃদ্ধি এবং দেশের দুই অংশের মধ্যে একান্ত বৈষম্যের কথা উল্লেখ করা হয়।
প্রাভদা শেখ মুজিবর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচী নিয়েও আলোচনা করেন এবং তার দল যে ১৯৭০ সনের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতায় জয়লাভ করেছে সে কথা উল্লেখ করেন। ‘পাকিস্তানে এই ধরণের নির্বাচন এই প্রথম’ বলে প্রাভদা মন্তব্য করেন।
প্রাভদা বলেন, পাকিস্তানী প্রশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃবৃন্দ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হতে দেন নি। পূর্ববঙে এর জন্য প্রতিবাদ জানানো হয়। তারপর পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষের আদেশে পাকিস্তানী সৈন্যরা বাঙালীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে।
এ সব বিষয় প্রাভদায় এর আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কূটনীতিক পর্যবেক্ষকগণ মনে করেন এর পূর্বে এমন সরাসরি ভাবে পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে এসব কথা প্রাভদায় বলা হয়নি।
০০০০

‘বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রাম জয়যুক্ত হবেই’—রাশেদ সোহরাওয়ার্দী
বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এবং সংগ্রামের সাফল্য কামনা করে জনাব রাশেদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একমাত্র পুত্র জনাব রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর দৃঢ় বিশ্বাস ‘এই সংগ্রাম জয়যুক্ত হবেই’।
উক্ত বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতিতে না থাকার দরুন ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন বিবৃতির দরকার আছে বলে আমি মনে করিনি। কিন্তু যেহেতু আমার বোন আখতার সোলায়মান তার এক সাম্প্রতিক বিবৃতিতে আমার প্রিয় জনকের ভাবমূর্তি ও স্মৃতি কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছেন তাই আমি কিছু বলা কর্তব্য মনে করছি।’
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের জনগণের শ্রদ্ধেয় নেতা মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সোলায়মান নির্লজ্জভাবে খুনী ইয়াহিয়া সরকারকে সমর্থন করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি পিতার পরিচয়ের সূত্রে জঙ্গী-শাহীর সপক্ষে প্রভাব বিস্তার করতেও চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি এখনও বেগম আখতার সোলায়মান ও তার স্বামী ইয়াহিয়া সরকারের অর্থে বৃটেনে থেকে পাক জঙ্গী শাহীর দালালী করছেন।
০০০০

রাজশাহীতে ৩৫ জন শত্রু সৈন্য খতম
মুক্তি যোদ্ধারা গত ৫ই অক্টোবর রাজশাহীর বেরিলাবাড়ীতে একটি শত্রু শিবিরে সফল আক্রমণ চালিয়ে ৩৫ জন দখলদার সৈন্যকে খতম করেছেন। এ ছাড়া ৪ জন সৈন্য গুরুতররূপে আহত হয়।
পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ দিশেহারা হয়ে সকল বিদ্যুৎ সাব-ষ্টেশনে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। ঐ সকল কেন্দ্রে উচু দেয়াল তৈরী করে সেগুলোকে কাটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে এবং আধা সামরিক সশস্ত্র বাহিনীকে প্রহরায় নিয়োগ করা হয়েছে।
০০০০

কুকুরে স্পর্ধা
বৈদেশিক সূত্রের খবরে প্রকাশ, ইয়াহিয়ার তাবেদার জঙ্গী-ট্রাইবুনাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিচার প্রহসন-শেষে তাকে মৃত্যুদণ্ড দানের সুপারিশ করেছে।
০০০০

খতিয়ান
গত মাসে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ২২ জন অফিসার ও চার হাজারেরও বেশী সৈন্য, রাজাকার ও বদর বাহিনীর লোক নিহত হয়েছে। বীর মুক্তি যোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রায় আড়াই হাজার কমাণ্ডো আক্রমণে উক্ত শত্রুদের খতম করেছে। এখানে মুক্তিবাহিনীর সদর কার্যালয়ের মাসিক হিসাবে একথা জানা যায়। এছাড়া রসদ ও অস্ত্রের অভাবে অগ্রবর্তী ঘাটিতে পাকিস্তানী সৈন্যদের মনোবল ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
প্রাথমিক খবরে জানা যায় যে গেরিলা যোদ্ধারা ঐ সময়ের মধ্যে ৯৩টি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেল সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন এবং ৪৯টি ট্রাক ও জীপ ধ্বংস অথবা অকেজো করেছেন। ৯টি বিভিন্ন স্থানে সৈন্যবাহী ট্রেনগুলোকে লাইনচ্যুত করেছেন।
চাটগা ও চালনা বন্দরে মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা ৩টি বড় জাহাজ ও ১টি ট্যাঙ্কার হয় ডুবিয়ে দিয়েছেন অথবা ক্ষতি করেছেন। সৈন্যবাহী একটি বড় ষ্টীমার, ১১টি লঞ্চ ও কয়েকটি গানবোটের ক্ষতি করা হয়েছে অথবা অকেজো করে দেওয়া হয়েছে।
ব্যাপক অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা রেলওয়ে ব্যবস্থা ও টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।
এ সব অপারেশনের সময় মুক্তিবাহিনী ৯১৮টি রাইফেলসহ প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ও গোলাবারুদ শত্রুদের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছেন।
রেশন ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের অভাবে ময়মনসিংহ জেলার অগ্রবর্তী ঘাটির খান সেনাদের মনোবল উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
০০০০

মুক্তি বাহিনীর ক্যাডেট অফিসারদের গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
০০০০

যুদ্ধক্ষেত্রেই সমাধান নিহিত
বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র নায়কদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। মুক্তি সংগ্রামের আশু লক্ষ্যও হচ্ছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্থাৎ জনগণের জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেই রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে পৌছোনো যাবে কোন পথে? সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা চূড়ান্ত বিজয়ের পথে, না আলাপ-আলোচনার পথে?
স্বভাবতঃই যারা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেন, তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে অর্থাৎ আলাপ-আলোচনার পথে সমাধানের কথাই বোঝাতে চান। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৬৯ সালের গোল টেবিল বৈঠক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত এই শান্তিপূর্ণ উপায় ও আলাপ-আলোচনার পথই অনুসরণ করেছিল। পাকিস্তানী জঙ্গী শাহীই সেই পথ বন্ধ করে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ফলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়া ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ ও নির্বাচিত জাতীয় নেতৃত্বের কাছে আর কোন বিকল্প পথ খোলা থাকেনি। এরই ফলে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী।
সামরিক জান্তা একটা ভাষাই বোঝে। সে ভাষা অস্ত্রের ভাষা। তাই সেই ভাষাতেই তাদের জবাব দেয়া হচ্ছে। সামরিক জান্তা তখনই রাজনৈতিক সমাধানের জন্যে পথে আসতে বাধ্য হবে, যখন তাদের অস্ত্রের ভাষা ফুরিয়ে যাবে। যদি রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগ তাদের আয়ত্তে থাকে তাহলে কেন তারা নিজেদের বাড়া ভাতে ছাই দেবে? ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’ বলে এদেশে যে প্রবাদটা চালু আছে, অনেকের বেলায় যদি নাও খাটে, সামরিক জান্তার বেলায় তা অবশ্যই খাটে। কাজেই সামরিক জান্তাকে রাজনৈতিক সমাধানের পথে আসতে বাধ্য করার জন্যেও আমাদেরকে পাক হানাদার বাহিনীর ওপর আঘাতের পর আঘাত হানতেই হবে। এটা আমরা ভাল করেই বুঝি। তাই রাজনৈতিক সমাধানের শিখণ্ডী দাড় করিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে নিবৃত্ত বা বিভ্রান্ত করা যাবে না।
আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদও তাই মন্তব্য করেছেন “যুদ্ধক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধান নিহিত।” বিশ্বের প্রতিটি গণতন্ত্রকামী ও মানবতাবাদী শক্তি এবং রাজনৈতিক সমাধানের বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ এই সত্যটি যত শীঘ্রই উপলব্ধি করেন, সমস্যার সমাধানও তত ত্বরান্বিত হবে।
০০০০

শিল্প-সংস্কৃতি
দুইটি ডানা ও পাকিস্তান—সেতাবউদ্দিন বিশ্বাস
টু উইংস অব পাকিস্তান অর্থাৎ পাকিস্তানের দুইটি ডানা—কথাটা মাঝে মাঝেই শোনা যায়। এদের একটি তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তান এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। এদের মাঝখানে বিরাট এবং দুর্লঙ্ঘ ব্যবধান—প্রায় বারোশো মাইল। আর এই বারোশো মাইল জুড়ে বিরাজ করছে জাগ্রত স্বাধীন সার্বভৌম ভারতবর্ষ। তাহলে দেখতে পাচ্ছি, এরা দুয়ে মিলে এক ও অখণ্ড নয় বরং খণ্ড ও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন।
চোখ মেলে না তাকালেও দেখতে পাই, প্রাণী জগৎ বা বস্তু জগতে ডানা থাকে দেহের সঙ্গে সংযুক্ত—দেহের দুই পাশে। আর এই দেহকে অবলম্বন করেই এদের বিস্তার ও সংকোচন, নড়াচড়া, উঠানামা এবং অবস্থান। তাহলে দেখতে পাচ্ছি, এদের মাঝখানে থাকে একটা দেহ যার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এরা ডানা বলে হয় পরিচিত। এখন দেখা যাক্, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামক ডানা দুইটির মাঝখানে বারোশো মাইল জুড়ে ভারতবর্ষ। আর এই ভারতবর্ষের গায়ে গায়ে মিশে এরই দুই পাশে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান—দুইটি ডানার মত। তাহলে ভারতবর্ষ কি দেহ এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এরা কি ভারতবর্ষের ডানা? বস্তুগত দিক থেকে বিচার করলে এরা তাই, কিন্তু, না এরা স্বীকৃত নয় ভারতবর্ষের ডানা বলে। এরা নাকি পাকিস্তানের ডানা। অথচ, মজার ব্যাপার এই যে, ডানা দুইটির মাঝখানে পাকিস্তান রূপ দেহ কোনদিন ছিলনা এবং আজও নাই এবং দেহের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে কোন কিছুরই ডানা বলে পরিচিত হবার জো নেই, তাহলে দেখতে পাচ্ছি, এরা ভারতবর্ষেরও নয় পাকিস্তানেরও নয়। এরা এক এবং অখণ্ডও নয়, কারণ, এদের মাঝখানে বারোশো মাইলের ব্যবধান। তাহলে এরা কী? এর সহজ এবং সঠিক উত্তর এরা দুইটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। একটি পাকিস্তান (যাকে বলা হয় পশ্চিম পাকিস্তান) এবং অপরটি বাংলাদেশ। এছাড়া এদের জন্য যে কোন পরিচয় অবাস্তব, সত্যের অপলাপ এবং অসম্ভব (অবশ্য) একটা আর একটার উপনিবেশ হিসেবে অস্বীকৃত হওয়ার জন্য।
এত গেল একটা দিক অর্থাৎ ভৌগলিক বা বস্তুগত দিক। আরও অনেক দিক আছে যেগুলি কষ্টি পাথরে যাচাই হয়ে ঠিক হয়েছে, বাঙ্গলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান তথা পাকিস্তান পরস্পর সম্পূর্ণ আলাদা পৃথক এবং বিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশের মানুষের ভাষা বাংলা; পাকিস্তানের মানুষের ভাষা উর্দ্দূ, পশতু, সিন্দি ইত্যাদি—বাংলা নয়। বাঙ্গলাদেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ধারা প্রকৃতির সঙ্গে পাকিস্তানের সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ধারা প্রকৃতির মিল নেই কোন রকম। বাঙ্গলাদেশের মানুষের চেহারা, তার দৈহিক এবং মানসিক গঠন প্রকৃতির সঙ্গে পাকিস্তানের মানুষের চেহারা, তার দৈহিক এবং মানসিক গঠন প্রকৃতির বৈশাদৃশ্য অত্যন্ত প্রকট। বাঙ্গলাদেশের প্রাকৃতিক গঠন এবং আবহাওয়ার সঙ্গে মিল নেই পাকিস্তানের প্রাকৃতিক গঠন এবং আবহাওয়ার। বাঙ্গলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের অমিল পার্থক্য বৈশাদৃশ্য এবং ভৌগোলিক তথা বস্তুগত বিচ্ছিন্নতা ব্যাপক এবং অলঙ্ঘনীয়। বস্তুতঃ এগুলোর পটভূমিতে ইং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে দুইটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান। প্রকৃত পক্ষে পাকিস্তানের রূপরেখা যখন অঙ্কিত হয় তখন বাঙ্গলাদেশকে বাদ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তান থেকে এই সব কারণে। অতএব বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না যে বাঙ্গলাদেশ ও পাকিস্তান দুইটি পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র।
লাহোর প্রস্তাবের পর পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী—বিশেষ করে পাঞ্জাবীদের মগজে দুষ্ট বুদ্ধি চাড়া দিয়ে উঠল—শুরু করল মাদারীর খেল। তারা বুঝে ফেলল, বাঙ্গলাদেশকে বাদ দিয়ে যে পাকিস্তান সেটা হচ্ছে একটা ঠুটো জগন্নাথ মাত্র। এর এমন কোন সম্পদ নেই যার উপর নির্ভর করে সে চলতে পারে এবং মানুষের সম্পদ দু’হাত দিয়ে লুটপাট করে তারা হতে পারে এক একটা জগৎ শেঠ। তাদের নিজেদেরই যদি কিছু না হল তাহলে এ পাকিস্তানের দরকারটা কী? বাঙ্গলাদেশের সম্পদ অঢেল, তার মাটিতে ফলে সোনা। বাঙ্গলার সম্পদের উপর তাদের দুটি লোলুপ—জিভে জল। যেমন করেই হউক বাঙ্গলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করে পাকিস্তান বাঙ্গলাদেশকে এক ও অখণ্ড পাকিস্তান রূপে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে, তাহলেই সম্ভব হবে বাঙ্গলার বুকের উপর তাদের নির্ম্মম পদচারণা এবং তার সম্পদ লুণ্ঠন। সৃষ্টির উদ্দেশ্য অতীত মহৎ।
বাঙ্গলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের মিল নেই কোন দিক দিয়েই এতটুকুও; তাদের মধ্যে ভৌগোলিক দুরত্ব বারোশো মাইল; সাংস্কৃতিক এবং মানসিক দুরত্ব অপরিমেয় এবং অলঙ্ঘনীয়। তাদের চিন্তা হল, কী করে বাঙ্গালীদের মন থেকে দুর করা যায় এই অমিল এবং দুরত্ব বোধকে। মাথায় তাদের একটা জব্বড় প্ল্যান এসে হাজির হল। মস্তিষ্ক ‘উর্ব্বর’ কিনা! বাঙ্গলাদেশের মানুষ খুব সহজ এবং সরল, ধর্ম্মের প্রতি তাদের প্রীতি এবং অনুরাগ অকৃত্রিম এবং অপরিসীম। ধর্ম্মের নামে তারা পাগল এবং উন্মাদ হয়ে উঠে। ধর্ম্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করল এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে—সাময়িকভাবে হলেও। তারা বুঝাতে চাইল, আমরাও মুছলমান এবং তোমরাও মুছলমান; আমাদের উভয়েরই ধর্ম্ম হচ্ছে ইসলাম। আর ইসলাম বলছে, এক মুছলমান আর এক মুছলমানের ভাই; অতএব, আমরা পরস্পর ভাই ভাই। আমরা এক, আমাদের দেশ এক ও অখণ্ড। যদি আমরা উভয়ে এক ও অখণ্ড থাকি তাহলে আমাদের উভয়ের মিলনে যে সাংঘাতিক শক্তি জন্ম নিবে তা দিয়ে আমরা ভয়ঙ্কর রূপে ইছলামের ‘আবাদ’ করতে পারব—আর ইছলামের ‘আবাদের’ জন্যই-ত পাকিস্তানের জন্ম।
বাঙ্গারী তখন ধর্ম্মোন্মাদ। তাদের এই প্রচার প্রতারণাকে সত্য বলে মেনে নিল। পশ্চিম পাকিস্তানী তথা পাঞ্জাবীরা বাঙ্গালীর এই ধর্ম্মীয় উন্মাদনার সুযোগ গ্রহণ করল পুরাপুরি ভাবে তাদের দুরভিসন্ধিকে বাস্তবে রূপ দান করতে। তাদের সাহায্য করল কতিপয় বাঙ্গালী মীরজাফর—তাদের পা-চাটা উচ্ছিষ্ট ভোজনের লোভে। পা-চাটার এমনই মোহ, উচ্ছিষ্ট ভোজনের এমনই ‘সুখ’।
সাধারণ বাঙ্গালী তখন ধর্মীয় উন্মাদনায় আচ্ছন্ন। তাদের এই দুরভিসন্ধিকে ধরতে পারেনি। বাঙ্গালীদের কেহই যে তাদের এই দুরভিসন্ধিকে ধরতে পারেনি তা নয়। পেরেছিল, কিন্তু তাদের সংখ্যা তখন নিতান্তই নগন্য এবং কণ্ঠ অত্যন্ত ক্ষীণ। তাদের এই ক্ষীণ-কণ্ঠ ধর্মীয় উন্মাদনার ঢাক ঢাক গুড় গুড়ের মাঝে একদম চাপা পড়ে গেল। পশ্চিমা—তথা পাঞ্জাবী এবং তাদের পা-চাটা, উচ্ছিষ্ট-ভোজন লোভী কতিপয় বাঙ্গালী মীরজাফরের জয় সুচিত হল।
বাঙ্গালীর ধর্মীয় উন্মাদনার এই গাঢ় কুয়াশাকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ফাকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মাঝে সেতু হিসেবে নিবিড় ও ঘন করে বসিয়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যোগসূত্র ঘটাল। নাম দিল পাকিস্তান। মাঝখানে ধর্মীয় উন্মাদনার গাঢ় কুয়াশা। আর এই কুয়াশার দুই প্রান্তে বাংলাদেশ (তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান (যাহা প্রকৃত পক্ষে পাকিস্তান) এবং এই কুয়াশার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পাকিস্তানের ডানা নামে হল অভিহিত হল। তা হলে দেকা যাচ্ছে ধর্মীয় উন্মাদনার কুয়াশাই হচ্ছে পাকিস্তান এবং তার দুই প্রান্তে দুইটি ডানা। (চলবে)
০০০০

জঙ্গী শাহীর সামরিক পায়তারা
পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিরোধকে সশস্ত্র পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার জন্য মরীয়া হয়ে উঠেছে। অবশ্য তাদের এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন পূর্বেই। তবে এতদিন তা প্রধানতঃ সীমাবদ্ধ চিল কূটনৈতিক ক্ষেত্রে। কিন্তু কূটনৈতিক ব্যর্থতা, জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তীব্র ধিক্কার, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে দিশেহারা ও পাগলা কুকুরের মতই ক্ষিপ্ত এবং হিতাহিত জ্ঞান শূন্য পিণ্ডি-ইসলামাবাদের জ্ঙ্গীশাহী এখন ভারতের সঙ্গে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা এবং পাকিস্তান থেকে মুক্ত অঞ্চলে পাকিস্তানী জঙ্গী শাহীর ব্যাপক সমর প্রস্তুতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। শতদ্রু নদীর দক্ষিণ-তীর বরাবর পাকিস্তানের ব্যাপক সামরিক সমাবেশ লক্ষ্য করা গেছে। চাম্ব সীমান্তের কয়েকটি পাকিস্তানী গ্রাম থেকে অসামরিক অধিবাসীরা চলে গিয়েছে। মুক্ত অঞ্চল ও ভারতের সীমান্ত বরাবর দখলীকৃত বাংলাদেশে ব্যাপক সামরিক সমাবেশ, ভারী কামান ও অন্যান্য সমরাস্ত্র স্থাপনের খবর পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া ভারতের নদীয়া জেলার সীমান্তে বিনা প্ররোচনায় পাকিস্তানী সেনারা গোলগুলী বর্ষণ করেছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোন রকমে ভারতের সঙ্গে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে পাক-ভারত বিরোধের আবরণে বাংলাদেশ সমস্যাকে চাপা দেয়া এবং এই উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের অজুহাতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তদারকীর ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা বন্ধ করে পাক জঙ্গী শাহীর আত্মরক্ষার চেষ্টা।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম যে জয়যুক্ত হবেই এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পাততাড়ি ঘটি বাটি গুটোতে হবেই এটা জঙ্গীশাহী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছে। অথচ তাদের দেশবাশীকে কিম্বা মুক্তি বাহিনীর হাতে নিহত সৈনিকদের পরিবার পরিজনকে বাংলাদেশে সামরিক এ্যাডভেঞ্চারের ব্যর্থতার কৈফিয়ত দেয়া সহজ নয়। তাই একান্ত পক্ষে তাদের নিজ দেশের অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের কাছে মুখ রক্ষার জন্যে পাক-ভারত বিরোধের মতো আর একটা সামরিক এ্যাডভেঞ্চারের ঝুকি নেবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের ঘটনায় পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বিশ্বের কাছে মুখ পায়নি। এখন তাকে পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করলে বিশ্বে কিম্বা নিজদেশের জনগণের কাছে মুখ থাকবে কিনা তা আমাদের গবেষণার বিষয় নয়। তবে সূত্র ধরে যদি এদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলের আগমন ঘটে এবং তারা যদি জঙ্গী শাহীকে ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মুক্তিবাহিনীর জাতীয় কর্তব্যের অন্তরায় হতে চান তা হলে বাংলাদেশের জনগণ, গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ও দেশপ্রেমিক বীর মুক্তি যোদ্ধারা তা সহ্য করবে না। পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী যখন বাংলাদেশে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে, মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে, ধন সম্পদ লুণ্ঠন করেছে ও ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে, নব্বই লক্ষাধিক মানুষকে দেশছাড়া করেছে এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের অধিকার হরণ করেছে তখন জাতিপুঞ্জ কোন মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করেনি। এখন এই উপমহাদেশে শান্তির নামে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের পথে কোন অন্তরায় সৃষ্টির চেষ্টাকেই তারা মানবে না। তবে তারা সত্যই যদি এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি চান তাহলে, বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে চলে যেতে বাধ্য করুণ। বাধ্য করুণ বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে এবং স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে মেনে নিতে। এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির এটাই পথ, পাক জঙ্গী শাহীর সামরিক এ্যাডভেঞ্চারিজম নয়।
০০০০

সংগ্রামী অভিনন্দন
দালালদের থোতা মুখ ভোতা হচ্ছে
সংগ্রামী অভিনন্দন। ঢাকার হামিদুল হক ওরফে হরিবল (Horrible) হক চৌধুরীর ‘পাকিস্তান অবজারভার’ কাগজ খানা শীঘ্রই আপনাদের চোখে পড়েছে কিনা জানিনা। এই পত্রিকায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে মুক্তি বাহিনীর গেরিলা ইউনিটের গুলিতে নিহত তিনজন অবাঙালী রাজাকারের মৃতদেহের ছবি ছেপে বলা হয়েছে, এরা ‘দুস্কৃতিকারীদের’ হাতে নিহত হয়েছে। বাংলাদেশে ‘দুস্কৃতিকারী’ কারা হরিবল হক চৌধুরীর কাগজ খানা তা ভালভাবেই জানে। হরিবল হক চৌধুরী এবং তার স্যাঙাত দালালেরাও জানে, শীঘ্রই তাদের ওই মৃত রাজাকারদের অনুগমন করতে হবে। হরিবল হক তাই দেশে থাকতেও এখন ভরসা পায় না।
–মুজিবুল হক, গঙ্গাসাগর, কুমিল্লা
০০০০

যে জাতির আমিনুলদের মত সৈনিক রয়েছে সে জাতির মৃত্যু নেই
ইলিয়াস আহমদ
আমার সাথে আমিনুল হকে পরিচয় আকস্মিক হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। যুগ যুগ ধরে যেন এ পরিচয়। সুদূর অতীতের পাখায় ভর করে কত দিন, কত রাত, কত শীত, কত গ্রীষ্ম, কত বর্ষার পরিচয় যেন আমাদের। এ পরিচয়ের পরতে পরতে কত স্মৃতির শ্যাওলা যেন জমেছে। কত আবেগ দিয়ে মোড়ানো যেন এ পরিচয়ের প্রতিটি ক্ষণ মুহূর্ত। আমার ছোট্ট আড়াই বছরের মেয়ে লোপা দূরন্ত উল্লাসে আমার কোলে বাবা বলে ঝাপিয়ে পড়ার পর আমার পিতৃ হৃদয় যেমন আনন্দের বন্যায় কূল ছাপিয়ে উঠে; আমাকে অনেক অনেক দিন বেচে থাকার আনন্দের প্রেরণা যোগায়—আমিনুল হককে দেখেও তেমনি আবার আমরা বেচে উঠবো বলে দৃঢ় প্রতীতি জন্মে।
আমি মরেই গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্যহীন একটি ভারবাহী জীবনের বোঝা হেচড়ে চলার নাম যদি জীবন হয় তা’হলে আমি বেচে ছিলাম। ত্রাসের বিভীষিকায় আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমার সহজাত কোন সত্ত্বা আছে, আমার প্রাণ আছে, আমার চাহিদা আছে, আমার আবেগ আছে, ভালবাসা আছে। আমার মনে হয়েছিল আমার কিছুই নেই। আমার বোধশক্তি নেই, আমার ভালবাসার হৃদয় নেই। আমার মায়ের স্নেহের মতো পেলক আমার মাতৃভূমিকে চুমো খাওয়ার মতো সাহস নেই। আমি মরে গেছি, পচে গেছি, হারিয়ে গেছি। আমি এক শৃঙ্খলিত জীব।
কিন্তু আমিনুল হককে দেখে আমার মনে হলো, না আমি মরে যাইনি। এখনও মরে যাইনি। আমিনুল হককে দেখে মনে হলো, না—শুধু আমি নই, আমরা কেউই মরে যাইনি। পচে যাইনি আমরা। আমাদের কারুরই জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়েনি। এ প্রচণ্ড দানবীয় ফুৎকারের পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম হয়তো সাময়িকভাবে; কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তা সামলে নিয়ে ইতিহাসের চিহ্নিত পথে চলতে আমাদের ভুল হয়নি। এক শতাব্দী পরে একশ’ শতাব্দী পরেও ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে যে, বাঙ্গালী জাতি তার পথ বেছে নিতে ভুল করেনি। বাচার নিবিড়তায় মৃত্যুকেও সে আলিঙ্গন করতে পারে। মৃত্যু আর জীবনের মধ্যকার ব্যবধান ক্ষীণ ছিল, এখন তা ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে।
আমিনুল হককে দেখে আমার তাই মনে হয়েছে। আমার বার বার মনে হয়েছে কবিতার সেই লাইনটি ‘বীর যুবকেরা কি মন্ত্রে ভুলেছে মৃত্যুর ভয়।’
এপ্রিলের মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ঢাকা শহর। রক্তাক্ত, লাঞ্চিত, ধর্ষিত তার রূপ। চারদিকে বারুদের আর পোড়া মাংসের বিকট গন্ধ। বাতাসে বাতাসে কান্না। হাসি নেই, যৌবনের গুঞ্জন নেই, শিশুর কান্না নেই, সেতারের মিঠে বোল নেই, বাঙ্গালী বলে পরিচয় দেওয়ার সাহস নেই। সে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির বর্ণনা দান মানববোধ্য কোন ভাষায় সম্ভব নয়। কি দারুণ যন্ত্রনায় শরবিদ্ধ পাখীর মতো বেচে থাকা লাখো বাঙ্গালী প্রাণ ছটফট করছিলো। ঢাকায় সেদিন শব্দ ছিল শুধু বুটের শব্দ। শব্দ ছিল শুধু মেসিনগানের আর ষ্টেনগানের। শব্দ ছিল ট্যাঙ্কের আর কামানের। রং ছিল শুধু খাকী রং। ভাষা ছিল শুধু ফৌজীক ভাষা। বেতারের শব্দ-তরঙ্গ শুধু বহন করেছিল সামরিক ফরমান। রাস্তাঘাট শুধু ছিল টিক্কা, নিয়াজীর, ফরমান আলীদের। আর ছিল গোলাম আজম, খায়েরউদ্দিন, ফরিদ, হামিদুল হক, মাহমুদ আলী, শফিকুল ইসলামদের। আর ছিল কুকুর আর বেড়ালদের। পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর দৃষ্টিকোণ থেকে সবচাইতে সুরক্ষিত ঢাকা শহরের অবস্থার বর্তমানে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। দিনের বেলা যাই হোক, রাতের বেলায় হিংস্র হায়েনারা আর পথে শিকারের সন্ধানে বেরুতে সাহস করে না। তাই রাতে তারা তাদের বিবরে লুকিয়ে থাকে কেচোর মতোন। হাত বোম বা হ্যাণ্ড গ্রিনেডের শব্দ শুনলে ক্যান্টনমেন্টকে পর্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। কিন্তু এপ্রিলে সে রূপ ছিলনা। রাত তো দূরের কথা দিনেও বাঙ্গালী শূন্য ছিল রাস্তাঘাট। ঢাকা ছিল বাঙ্গালী শিশুহীন, নারীহীন, যুবকহীন মৃত শহর। জিন্নার পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রবাষার উদ্ধত অহঙ্কার সরব ছিল সর্বত্র।
সে এপ্রিলের এক সন্ধ্যা। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা মৃত শাপের মতো যেন মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল। রাস্তায় হাটতে গা ছম ছম করতো। হাজারো করিম, বাবুল, পরেশ, কুলসুম, ছন্দা, গোমেজের আত্মা যেন চারদিকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য দুর্বার প্রতিহিংসায় মাথা খুড়ে মরছিলো।
হঠাৎ একটি তরুণ এসে আমার কাছে একটি ঠিকানা চায়। আমি হাত দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পর যুবকটি এক দূরন্ত ক্রোধে ব্যাগ থেকে একটি হ্যাণ্ড গ্রেনেড বের করে লক্ষ্যবস্তুর ওপর ছুড়ে মারে। মুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দ করে গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয় এবং ভবনটির ছাদ, চার দিকের দেওয়াল ছিটকে লুটিয়ে পড়ে। আমি দৌড়ে একটি গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে হানাদার বাহিনীর পরবর্ত্তী ক্রোধের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করি।
পরদিন জিন্না এভিনুর গুলিস্তান সিনেমার সামনে রেলিং-এ ভর করে তরুণটিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখি। ভয় ভীতির কোন চিহ্ন পর্যন্ত মুখে নেই। তরুণটি জানতো, বোমা মারা সময়ে বা পালিয়ে যাওয়ার বেলায় ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। কিন্তু জীবনকে যে ভালবেসেছে হৃদয়ের সব আর্দ্রতা দিয়ে, মাতৃভূমিকে যে ভালবেসেছে জীবনের সব সুষমা দিয়ে, সে মৃত্যুকে ভয় করবে কেন? কারণ যে পাঠশালায় সে পড়েছে সেখানে জন্মভূমি বানানটি সে প্রথম শিখেছে। হঠাৎ তার সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময়ের পর সে একটু মুচকি হাসলো। কাছে যাওয়ার পর আস্তে করে বললো, “আগামী দিন দিনের বেলাতেই বহু ঘটনা দেখতে পাবেন।” তারপর ভিন্ন পথে তরুণটি চলে যায়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে ঢাকা শহরের রূপ পাল্টাতে থাকে। পোড় খাওয়া হাড়ে আগুন জ্বলতে শুরু করলো। বিদ্যুতের চমক লাগতে শুরু করলো একটি জাতির প্রাণে, মনে, হৃদয়ে। আমিনুল হকরা ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। জীবনকে পায়ের ভৃত্য করে এগিয়ে চললো মায়ের, বোনের, ভায়ের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য। আজ আমিনুল হকরা সর্বত্র। শুধু ঢাকায় নয়, বাংলাদেশের সর্বত্র। আমিনুল হকদের দেশপ্রেমের গলিত লাভার নীচে চাপা পড়ে যাবে ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী।
০০০০

জঙ্গীচক্র কত বাঙ্গালীকে তাড়িয়েছে
( কলকাতা প্রতিনিধি )
বাংলাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরুর পর থেকে এই পর্যন্ত (৫ই অক্টোবর) ৯০ লাখ ৯১ হাজার শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে বলে ভারত সরকার হিসেব প্রকাশ করেছেন।
তাদের মধ্যে তিন লাখ ৮৮ হাজার ৫৩২ জন শরণার্থী পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, বিহার মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ক্যাম্পে বাস করছেন।
প্রায় ৬২ লাখ ৫২ হাজার শরণার্থী এই সব রাজ্যের রাজ্য সরকার পরিচালিত ৯৩৫টি ক্যাম্পে রয়েছেন এবং বাকী ২৪ লাখ ৫০ হাজার বাস করছেন ক্যাম্প গুলির বাইরে।
শরণার্থীদের মধ্যে শিশু ও প্রসূতিদের সংখ্যা হলো যথাক্রমে ১৬ লাখ ৬০ হাজার এবং পাচ লাখ ৩১ হাজার।
পশ্চিম বঙ্গে ৬১৫টি, ত্রিপুরায় ২৭৩টি, মেঘালয়ে ১৭টি, আসামে ২৭টি ও বিহারে তিনটি রাজ্য সরকার পরিচালিত ক্যাম্প রয়েছে।
০০০০

শ্যাম চাচার বিবেক!
মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের রিপাব্লিকান দলের সিনেটর মিস্টার পিটার ফ্রেলিংহুয়েসেন সম্প্রতি নয়াদিল্লীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে,‘পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত না হলে এবং ভারতে শরণার্থী প্রবেশ বন্ধ না হলে উপমহাদেশে যুদ্ধের যথার্থ আশঙ্কা রয়েছে।’
তিনি পাকিস্তান এবং পশ্চিম বঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, অধিকৃত বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি ‘একজন শরণার্থীকেও কুমিল্লার অভ্যর্থনা শিবিরে আসতে দেখেননি।’
মিস্টার হুয়েসেন আরো বলেন, ‘মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা উচিৎ এবং একতরফা ভাবেই এই ঘোষণা করা উচিৎ।’ তিনি তার সরকারের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, ‘মার্কিণ অস্ত্র সাহায্য বন্ধ না হলে বাংলাদেশের সমস্যা বৃদ্ধি পেয়ে ভিয়েৎনামের মত আর একটি বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।’ তিনি মন্তব্য করেন, ‘আর একটা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হোক আমরা এটা চাই না।’
সিনেটর হুয়েসেন শরণার্থী সমস্যার মোকাবেলা করার জন্য ভারতের প্রশংসা করেন।
০০০০

৯৩ জন কাশ্মীরী বুদ্ধিজীবীর আবেদন
কাশ্মীরের ৯৩ জন বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের জন্য ভারত সরকারের নিকট আবেদন জানিয়েছেন। ভারতীয় প্রধান মন্ত্রীর নিকট লিখিত এক চিঠিতে তারা পাকিস্তান সরকারকে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।
০০০০

প্রধান সেনাপতির পূর্ব রণাঙ্গন সফর
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীয় প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম, এ, জি, ওসমানী পূর্ব রণাঙ্গনের অগ্রবর্তী অঞ্চল বিভিন্ন হাসপাতাল ও মুক্তিসেনাদের কঠোর মনোবল, অমিত সাহস, দুর্জ্জয় আত্মবিশ্বাস এবং আত্মোৎসর্গের বিপুল প্রেরণা দেখে গর্ববোধ করেন। তিনি তাদেরকে আরও তৎপর হতে এবং ত্যাগ স্বীকারের জন্য আহ্বান জানান। তিনি ভাষণদানকালে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসিকতা ও দেশাত্মবোধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সমগ্র জাতি তাদের এই দুঃসাহসী অভিযানের জন্য গর্বিত বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন যে, আপনারা এই মুক্তিসংগ্রামের ভেতর দিয়ে একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছেন। প্রধান সেনাপতি তাদেরকে একথা স্বরণ করিয়ে দেন,‘বাঙ্গালীরা নাকি যোদ্ধাজাত নয়, এই ভ্রান্ত ধারণা আপনারা একদম পাল্টে দিয়েছেন।’ তিনি তার ভাষণে আরও বলেন যে, ছয় মাসের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন তাতে করে আমাদের জনসাধারণের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অপূর্ব গেরিলা রণকৌশলের প্রশংসা করে তিনি একথা বলেন, ‘আপনারা একটি জাতি হিসেবে বেচে থাকার প্রশ্নেই আজ এ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন।’ কঠোর আত্মপ্রত্যয় ও সাহসিকতা নিয়ে প্রচণ্ড দুর্যোগের মুখে দাড়িয়ে আপনারা রণক্ষেত্রে এক নজীরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন যে, আপনারা যদি শৃঙ্খলার সঙ্গে এভাবে লড়ে যান তাহলে সারা পৃথিবীতে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘সৈন্যবাহিনী’ হিসেবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করতে পারবেন। কর্নেল ওসমানী অগ্রবর্তী হাসপাতালগুলো পরিদর্শনকালে রোগীদের শয্যাপাশে গিয়ে প্রাণ খোলা কথাবার্তা বলেন। তিনি কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সদেরকে হাসপাতালের কর্মতৎপরতা ও রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তিনি তাদেরকে স্বাধীনতার কাজে তাদের নিঃস্বার্থ সেবাও ত্যাগ স্বীকারের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, সমগ্র জাতিই আজ স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত। প্রত্যেককেই এই সংগ্রামে সাধ্যমত দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। তিনি তাদের মনোবল ও সাহসিকতার প্রশংসা করেন। প্রত্যেক মানুষের এমনি সাহসিকতা ও আত্মেৎসর্গ মুক্তিযুদ্ধের জন্য একান্ত অপরিহার্য।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে অগ্রবর্তী হাসপাতালগুলোর চিকিৎসক ও নার্সগণ সকলেই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রী। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে যুদ্ধশেষে তাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে ভবিষ্যত সম্ভাবনা গড়ে তুলতে হবে। তাদের সেবা ও আত্মোৎসর্গ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে দেশ বাসী চিরদিন স্মরণ করবেন এবং আগামী বংশধরগণও বিপুল সম্মান ও গভীর শ্রদ্ধাবোধের সঙ্গে তাদের এই মহান আত্মদানকে নিঃস্বার্থকতা ও স্বাদেশিকতার উজ্জল উদাহরণ হিসেবে অনুসরণ করবেন।
০০০০

বাংলাদেশ অন্য কোনও সমাধান মেনে নেবে না
বৃটিশ পার্লামেন্টারী লেবার পার্টির চেয়ারম্যান এবং বৃটিশ লেবার পার্টির ছায়ামন্ত্রী-সভার সদস্য মিঃ ডগলাস হফটন সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি ত্বরান্বিত করার জন্য অবশ্যই আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
তার মতে, যতদিন শেখ মুজিবকে ‘অপরাধী’ হিসাবে আটক রাখা হবে, ততদিন পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক সমাধানই পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, কেননা, সামরিক স্বেচ্ছাচারিতার জবাবে ১৯৭০ এর নির্বাচনে তাদের মনোভাব অত্যন্ত স্পষ্ট।
মিষ্টার হফটন বলেন যে, শেখ মুজিবের মুক্তি পাকিস্তানের শাসকবর্গের অতীতের ভুলভ্রান্তি সংশোধন করার প্রস্তুতির প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। শ্রমিক দলীয় নেতা মনে করেন, ভারত এবং পাকিস্তান যেহেতু বৃটিশ সরকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অতএব বৃটিশ সরকারের উচিৎ নিজের সম্পূর্ণ প্রভাব প্রয়োগ করে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবার মত নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা। তিনি বলেন. ‘এ সব বিষয়ে বৃটিশ সরকারের জাতিসংঘে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করা দরকার।’
তিনি মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রী শরণ সিং-এর সাথে দেখা করেন এবং ‘আধুনিক ইতিহাসের সর্বাধিক মানবিক বিপর্যয়’ প্রত্যক্ষ করার জন্য কল্যানী এবং লবন হ্রদে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন এবং শরণার্থীদের যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে খুটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি মন্তব্য করেন, পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে যা ঘটে গেছে, তার তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে। তিনি দুঃখ করে বলেন যে, পৃথিবী এই বিপর্যয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। তিনি বলেন যে, স্বল্প সময়ের মধ্যে শরণার্থী সমস্যার বোঝা হাল্কা করার জন্য ভারতের যুক্তিসংগত উদ্যোগকে পৃথিবীর গুরুত্ব দেয়া উচিত।
তিনি মনে করেন যে, লেবার পার্টি আসন্ন পার্লামেন্ট অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করবে।
০০০০

জাতিসংঘের উদাসীনতার নিন্দা
বেলজিয়ামের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিষ্টার পিয়ের হার্সেল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণদান কালে বলেন যে, বেলজিয়াম ‘পূর্ব বাংলা’ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চান, যাতে করে শরণার্থীরা ভবিষ্যতে নিরাপত্তা এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিশ্চয়তা নিয়ে ফিরে যেতে পারেন।
তিনি বলেন, ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের চরম মানবিক বিপর্যয়ের গুরুত্বের ব্যাপারে জাতিসংঘ উদাসীন থাকলে জাতিসংঘের সুনাম বহুলাংশে খর্বিত হবে।
০০০০

শিক্ষক সমিতির প্রদান
শর্তযুক্ত আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করা হবে না
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কার্যকরী সভাপতি জনাব মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (এম,এন,এ) এক বিবৃতিতে বলেন, সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাক জঙ্গী শাহীর কবল মুক্ত করা ও স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করাই আমাদের সকলের সামনে এখন একমাত্র লক্ষ্য। এই মুক্তি সংগ্রামে কোন্ কোন্ রাষ্ট্র আমাদের শত্রুপক্ষের সাথে সহযোগিতা করছে সে সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে পাক জঙ্গী শাহীকে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার কাজে এক কথায় মুক্তি সংগ্রামকে দমন করার কাজে যে-ভাবে এগিয়ে এসেছে এবং জঙ্গী-চক্রকে মদত যোগাচ্ছে আমরা তার তীব্র্র প্রতিবাদ জানাই। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ইয়াহিয়া খানের বন্ধু কোনও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই আমাদের শিক্ষক সমাজের মনে কোন রকম মোহ বিস্তার করতে সক্ষম হবে না। অথবা শিক্ষক সমাজকে মুক্তি সংগ্রামের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।
জনাব কামরুজ্জামান আরও বলেন, বিনা শর্তে কেবল মাত্র রিলিফের উদ্দেশ্য নিয়ে যারা সাহায্য দিতে এগিয়ে আসবেন কেবল মাত্র সেই সব সংস্থা ও দেশ থেকেই আমরা সাহায্য গ্রহণের পক্ষপাতি।
তিনি দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলেন, যদি এই সাহায্য দানের পিছনে কোনরূপ ষড়যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতিকারক কোন শর্ত আরোপিত হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই সাহায্য গ্রহণ অসম্ভব হয়ে দাড়াতে পারে। ক্যাম্পস্কুল প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, ক্যাম্পস্কুল পরিকল্পনা, মুক্তিযুদ্ধেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শরণার্থী ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী দেশপ্রেমিক নাগরিক ও মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলাই সমিতির উদ্দেশ্য।
জনাব কামরুজ্জামান বলেন, আমরা বিশ্বাস করি মুক্তি সংগ্রামের সাফল্যের স্বার্থে বাংলাদেশের সচেতন শিক্ষক সমাজ ক্যাম্পস্কুল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করবেন এবং শিক্ষক সমাজকে বিভ্রান্ত করার যে কোন ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেবেন।
০০০০

বাংলাদেশ ও মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশ সমস্যা প্রসঙ্গে মার্কিণ নীতি খুবই স্ববিরোধিতায় ভরা। বাংলাদেশ সমস্যাকে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র একদিকে বলছে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা, অন্যদিকে আবার বলছে, বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান দরকার। এ ব্যাপারে বিশ্বের সক্রিয় প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করছে যে, বাংলাদেশে এখন অরাজকতা চলছে। পাক ফৌজের সাথে চলেছে বাংলাদেশের জনগণের যুদ্ধ। কিন্তু এ বিরোধে সে পাক সরকারকে দিচ্ছে অস্ত্র সাহায্য, যা ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের বিপক্ষে। ফলে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র যা করছে তা হল কার্যতঃ পাকিস্তানের “আভ্যন্তরীণ” ব্যাপারে হস্তক্ষেপ। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য সরকারীভাবে বলেছিল, পাকিস্তানের অবস্থা শান্ত না হলে তারা পাকিস্তানকে আর গোলাবারুদ ও অস্ত্র সাহায্য দেবে না। কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের নথিপত্র থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় গত এপ্রিল মাসে আমেরিকা পাকিস্তানকে পৌনে ৭ কোটি টাকার সমরাস্ত্র্র সরবরাহ করেছে। অর্থাৎ মার্কিণ সাহায্যপুষ্ট হয়ে জঙ্গীশাহী এখন লড়াই করছে। মার্কিণ সাহায্যের অর্থ জঙ্গীশাহীকে সাহায্য, বাংলাদেশের বিপক্ষে অগণতান্ত্রিক সামরিক সরকারকে সাহায্য।
মার্কিণ কার্যকলাপ, তাদের বহু ঘোষিত গণতান্ত্রিক দর্শনের বিরোধী। কারণ, মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র আজ পাকিস্তানে গণতন্ত্র বিরোধী সামরিক চক্রকে সাহায্য করতে ব্যস্ত। তাদের এই প্রীতি বিশ্বের সত্যিকার গণতন্ত্রকামীদের মনে বিস্ময় না জাগিয়ে পারে না।
নিক্সন সরকার যে পথ অনুসরণ করছেন বৈদেশীক নীতির ব্যাপারে, তাতে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র রক্ষকের ভূমিকা সম্পর্কে সকলের সংশয় জাগছে। মনে হচ্ছে, স্বদেশে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র চাইলেও বাইরের বিশ্বে চায় যেনতেন প্রকারে আপন প্রভাব বজায় রাখতে। আদর্শের চাইতে সঙ্কীর্ণ জাতীয় স্বার্থই আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ, অধিক বিবেচনার বিষয়।
কিন্তু মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র কি এভাবে বিশ্বের এই অঞ্চলে তার প্রভাব বজায় রাখতে পারবে? বাংলাদেশের মানুষের চোখে নিক্সন সরকার আজ অত্যন্ত ছোট হয়ে পড়েছে।
আমেরিকা একদিন বৃটিশের বিপক্ষে যে-সব যুক্তি দেখিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল, ঠিক সেই একই ধরণের কাজ করছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পশ্চাতে। অথচ মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র এই ন্যায় যুদ্ধের ব্যাপারে বাঙ্গালীদের সমর্থন না জানিয়ে করছেন পাকিস্তানের সমর নায়কদের দ্বারা গঠিত সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ দিচ্ছেন এমন সব যুক্তি, যা গ্রেট বৃটেন একদিন ব্যবহার করত আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে।
অনেকে বাংলাদেশের জনসাধারণকে পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর ফৌজের মধ্যে লড়াইকে তুলনা করতে চাচ্ছেন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-৬৫) সাথে। কিন্তু আমেরিকার এই গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় দাস প্রথাকে উঠিয়ে দেওয়া নিয়ে। দাসপ্রথা তুলে দিতে চায় না দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলি। তার বদলে তারা পৃথক হয়ে যেতে চায় আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব থেকে। এ যুদ্ধ ছিল আমেরিকার গৃহযুদ্ধ। ভৌগলিক দিক থেকে এরা ছিল পরস্পরের সাথে যুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন ভৌগলিক যোগাযোগ নাই। বাংলাদেশের মানুষ ভূগোল, ভাষা, সংস্কৃতি—সব দিক থেকেই আলাদা। বাঙ্গালীরা যুদ্ধ করছে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। এ যুদ্ধ তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। একে ঘরোয়া বিবাদ বলে আখ্যা দেওয়া যায় না। দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনিস দেশগুলি যখন সাইমন বোলিভারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করে স্পেনের অধীনতা পাশ থেকে মুক্ত হতে চায়, ম্যাকণ যুক্তরাষ্ট্র তখন ছিল ঐ সব মুক্তিকামী দেশগুলির পক্ষে। স্পেনের পক্ষে নয়। যদিও স্পেন তখন তুলেছিল ওর্ফের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের যুক্তি।
বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার দাবীর বিপক্ষে দাড়িয়ে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র তার সনাতন যুক্তি গুলির বিপক্ষে যাচ্ছে। আর এই জন্যেই বাংলাদেশের মানুষের চোখে আমেরিকার নীতি মনে হচ্ছে নীতিহীন বলে।
কোন জাতির স্বাধীনতাকে শেষ পর্যন্ত আটকে রাখা যায়নি। বিশ্বের ইতিহাসে এর অনেক নজীর আছে। কোন দেশের মানুষ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় আর সঙ্কল্পে থাকে অবিচল, তবে দুদিন আগে হোক আর দুদিন পরে হোক, সে মুক্তি লাভ করেই। বাংলাদেশও করবে। পাকিস্তানে মার্কিণ সাহায্য তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র যা পারবে তা হল, সংগ্রামের দুঃখ-যন্ত্রনা ও রক্তপাতের পরিমাণ বাড়াতে।
০০০০

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি
( অর্থনৈতিক ভাষ্যকার )
বাংলাদেশের বীর মুক্তি যোদ্ধারা জীবন বাজী রেখে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। তাদের সঙ্গে দেশপ্রেমিক, কৃষক, মজুর, ছাত্র বুদ্ধিজীবী শিল্পী, সাহিত্যিক—এক কথায় ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ যার যার নিজের কর্মক্ষেত্রে এই মুক্তি সংগ্রামের অংশভাগী হয়ে দেশ মাতৃকার শৃংখল মোচনের জন্য সর্বস্ব পণ করেছে। অসহ্য দুঃখ-কষ্ট লাঞ্ছনা ও প্রতিমুহূর্তে নিশ্চিত মৃত্যু সম্ভাবনার মুখেও তারা জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে আপোষহীন। মুক্তির প্রভাত সূর্যের সম্ভাবনায় প্রত্যয়শীল।
মাত্র চব্বিশ বছর আগে সাম্প্রদায়িক জাতিতত্বের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভৌগলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামে কাতারবন্দী হয়েছে। শুধু মাঠে ময়দানে শ্লোগান দেয়া নয়,–এক সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে হাতিয়ার হাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে হত্যা করছে, প্রাণ দিচ্ছে। বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ, বাঙালী জাতি হিসেবে প্রাণ নেয়া ও দেয়ার মিলিত রক্ত ধারায় যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে, এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা অনন্য। সাম্প্রদায়িকতাবাদের কবর রচনায় ইতিহাসের এই অনন্য অধ্যায়ের ভূমিকা অপরিসীম এবং সুদূর প্রসারী। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এটি প্রাথমিক সাফল্য। শুধু যারা ঔপনিবেশিক শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ধর্মীয় জিগির তুলে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে বাচিয়ে রাখতে চায়, পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শক্তির সেই সব দালালরা এই জাতীয়তাবাদের অভ্যুদয়কে ভয় করে। শুধু তারাই এই মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে সামরিক জান্তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এই দু’টি বিপরীত ধারার কথা যদি আমরা বিচার করি তা হলে অন্যান্য বিষয় বাদ দিলেও শুধু বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের এই অভ্যুদয়কেই নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক অগ্র্রগতি হিসেবে স্বাগত জানাতে হয়। বাংলাদেশের জাতীয় এবং রাজনৈতিক জীবনে এই জাতীয়তাবাদ ধারার দুর্জয় শক্তি পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে ইয়াহিয়া খানের খসড়া শাসনতন্ত্রে দখলীকৃত বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটাধিকার হরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভেদ জীইয়ে রেখে সাংষ্কৃতিক ও ভৌগলিক জাতীয়তাবাদকে প্রতিহত করা। এটাই সাম্প্রদায়িকতাবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির লক্ষ্য। জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দালাল দলগুলো পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির সেই লক্ষ্য পুরণের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে।
কিন্তু এই দালালরা চিহ্নিত ও ধিকৃত। তাদের শক্তি পুরোপুরি ভাবে সামরিক জান্তার পশুশক্তির পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভরশীল। এরা মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণে এখন নিজেরাই সন্ত্রস্ত। তবে সংখ্যায় একেবারে নগণ্য হলেও স্বদেশে ও বিদেশে প্রগতিবাদী এবং বামপন্থী বলে কিছু কিছু লোক আছেন যারা এই মুক্তি সংগ্রামকে পশ্চিম পাকিস্তানী বুর্জোয়াদের জায়গায় বাঙালী বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ বলে অভিহিত করে এই মুক্তি যুদ্ধের যৌক্তিকতা ও স্বার্থকতার প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে প্রতিটি মানুষই কাতারবন্দী হবে এমন আশা সব সময় করা যায় না। কিন্তু তা সত্বেও বলতে হয় যে, প্রগতিবাদের নাম করে যারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ভূমিকা ও তাৎপর্য সম্পর্কে সংসয়বাদী প্রশ্ন তুলে নিজেদেরকে এই সংগ্রাম থেকে দূরে রাখেন তারা প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামেরই বিরোধীতা করছেন। সেদিক থেকে পরিণামে জামাত বা মুসলিম লীগের ভূমিকা থেকে এদের ভূমিকার আসলে খুব বেশি পার্থক্য নেই। একদল ধর্মের নামে বিরোধীতা করে, অপর দল প্রগতির নামে বিরোধীতা করে।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক—সকল অর্থেই বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী করে রাখা হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—অন্যান্য প্রগতিশীল ও সমাজবাদী অঙ্গিকার যদি অনুপস্থিতও থাকত তা হলে শুধু ঔপনিবেশিক শৃংখল থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে যে মুক্তি সংগ্রাম, সেই সংগ্রাম কি ওই একটি কারণেই উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মহলের সমর্থন লাভের দাবীদার হতো না? তা না হলে বলতে হয় যে, হয় তাদের নির্দেশিত রাষ্ট্র কাঠামোর অঙ্গীকার যদি না থাকে তা হলে দেশ পরাধীনই থাকে। এই নীতি-বাচক ভূমিকা আত্মহননেরই শামিল।
কিন্তু এই ধরণের মনোভাব যদি কেউ পোষণ করেন তা হলে বলতে হবে যে তারা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত। বিশেষ করে বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে। কারণ তা হলে বুঝতে হবে যে, জিন্না সাহেবের দ্বি-জাতিতত্ত্বের মাথায় পদাঘাত করে বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক ক্লেকমুক্ত সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে যে সংগ্রাম চলছে তার সুদূর প্রসারি গুরুত্ব ও প্রভাব তারা হয় অনুধাবন করতে পারেন নি নয়তো হিসেবের মধ্যে আনেন নি। তাছাড়া ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম যে চরিত্রগতভাবে প্রগতিশীল সংগ্রাম হতে বাধ্য, বিশেষ করে বিশ শতকের শেষ পর্যায়ে বিশ্বের সমাজ চেতনার পরিমণ্ডলে অবস্থান করে, তাও হয়তো হিসেবের বাইরে রয়ে গিয়েছে। বিশ শতকের শেষ ভাগে বর্তমান যুগের সমাজ চেতনার পরিচিত পরিমণ্ডলের মধ্যে বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর সমর্থনে ও সক্রিয় সহযোগিতায় যে মুক্তি সংগ্রাম চলছে সেই যুদ্ধের সফল পরিনতি কোন দিনই দেশী বাইশ পরিবার গড়ে উঠতে দেবে না। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত মুক্তি যোদ্ধাদের রক্ত ক্ষরণের ভেতর দিয়ে যে সমাজ শক্তি ও সমাজ চেতনা দৃঢ়মূল হচ্ছে, সেই শক্তি ও চেতনাই তেমন ধরণের সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করবে।
এ কথাও বুঝতে হবে যে, মুক্তি যোদ্ধারা ভাড়াটিয়া সৈন্য নয়। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষও শুধু শুধু জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়নি। এর পেছনে অবশ্যই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সুনিশ্চিত আশ্বাস রয়েছে। বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী ২২ পরিবারের জায়গায় বাঙ্গালী ২২ পরিবার সৃষ্টি করার জন্য তিনি এই মুক্তি সংগ্রাম শুরু করেন নি। শোষণ-মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল তার মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্য।
শুধু বঙ্গ বন্ধুর মৌখিক ঘোষণাই নয়, আওয়ামী লীগের ম্যানিফেষ্টোতেও সামাজিক ন্যায় বিচার ও অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের প্রথম দিকেই সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথায় জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সহ প্রতিটি নাগরিকের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের—এ কথার স্বীকৃতি শাসনতন্ত্রে থাকবে।
রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের বলে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে উক্ত ঘোষণাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে আওয়ামী লীগ ম্যানিফেষ্টোতে অর্থনৈতিক কর্মসূচীর ভিত্তিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, “শোষণমুক্ত একটি ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করাই এই অর্থনৈতিক কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য। এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প—যাতে অর্থনৈতিক অবিচার দূরীকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধির ফল যথাযথভাবে বণ্টনের বিধান থাকবে।”
“শোষণমুক্ত ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক রূপকল্প” বাস্তবায়িত করার জন্যে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেষ্টোতে ভাবী শাসনতন্ত্রে যে ব্যবস্থা সংবিধান সন্নিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সেই সংবিধানটি জনগণের হাতে উপরোক্ত সমাজ গঠন ও অর্থনৈতিক রূপকল্প বাস্তবায়নের দলিল। শাসনতন্ত্রে বিধিবদ্ধ মৌলনীতির ভিত্তিতে উপরোক্ত শোষণমুক্ত ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন নির্ভর করবে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেষ্টোতে উপরোক্ত প্রশাসনিক পদক্ষেপ সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ভাবে পথ নির্দেশ করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত মালিকানাধীন শিল্পের জায়গায় সরকারী খাতের সম্প্রসারণ এবং গুরুত্ব অনুযায়ী অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন শিল্প, ব্যাঙ্ক, বীমা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা ও আমদানী-রফতানী বাণিজ্য জাতীয়করণ, যে পরোক্ষ কর সাধারণ মানুষের কাধে চেপে বসে, কর ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে উপরোক্ত পরোক্ষ করের জায়গায় প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থার মাধ্যমে অধিক পরিমাণ অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি প্রশাসনিক পদক্ষেপের অঙ্গ।

মূলধন ও ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক অংশীদারিত্ব
মূলধনে শ্র্রমিক শ্রেণীর অংশীদারিত্ব সম্পর্কে ম্যানিফেষ্টোতে বলা হয়েছে যে, যে সমস্ত শিল্প কারখানা সত্বর জনগণের মালিকানাধীনে আনা হবে না, সরকার ক্রমবর্ধমান হারে তাদের ইকুইটি মূলধন দখল করবে। সরকার যেটুকু ইকুইটি মূলধন আয়ত্ত করবে, সংশ্লিষ্ট শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকগণ যৌথভাবে সেই পরিমাণ অংশের মালিকানা লাভ করবে এবং সেই পরিমাণ অংশের মুনাফার ভাগ পাবে। শ্রমিকরা কেবল ইকুইটি মূলধনের নয়, শিল্প কারখানার ব্যবস্থাপনায়ও অংশ গ্রহণ করবে। এই ভাবে শ্রমিক সমাজ যেমন ক্রমান্বয়ে অধিক হারে শিল্পে মালিকানা লাভ করবে তেমনি শিল্প পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাতেও দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।

কৃষি ও গ্রামের জনগণ
বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ পল্লী অঞ্চলের অধিবাসী। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ প্রত্যক্ষভাবে কৃষি কর্মের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই শোষণমুক্ত এবং ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সফল রূপায়ণ কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ছাড়া সম্ভব নয়। তাই আওয়ামী লীগের ম্যানিফেষ্টোতে এ সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, “কৃষি ও গ্রামের মানুষের অবস্থার উন্নয়নের উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া না হলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের সমস্ত পরিকল্পনাই অর্থহীন হয়ে পড়বে। এক দিকে আমাদের গোটা সমাজের সর্বত্র দারিদ্র ছড়িয়ে পড়েছে, অন্য দিকে গ্রাম ও শহরের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে গুরুতর বৈষম্য রয়েছে।”
এ প্রসঙ্গে ম্যানিফেস্টোতে আরও বলা হয়েছে যে, “এর পিছনে ঐতিহাসিক কারণ থাকলেও নিকট অতীতে সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির জন্য এই বৈষম্য আরও বেড়ে গিয়েছে, ফলে গরীব চাষীর হাত থেকে সম্পদ ধনী পুজিপতিদের হাতে ব্যাপকভাবে পাচার হয়ে গিয়েছে। আওয়ামী লীগ অবিলম্বে গ্রামাঞ্চলের জনগণকে এই রূপ শোষণের হাত থেকে বাচাবার অঙ্গীকার করছে। আর এটা করতে হলে কৃষিখাতে সুদূর প্রসারী বিপ্লবের প্রয়োজন এই ধরণের বিপ্লবের পূর্ব শর্ত হলো ভূমি ব্যবহারের বর্তমান পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন এবং বহুমূখী সমবায়ের মত নয়া প্রতিষ্ঠান স্থাপন।
কাজেই ঔপনিবেশিক শোষণের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত করার ঐকান্তিক কামনার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ন্যায় নীতি ও অর্থনৈতিক সাম্যের প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষকে একটি শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের বর্তমান রক্তমোক্ষণ নিছক ভাববিলাশের ফলশ্রুতি নয়।
০০০০

এরই নাম হল মার্কিণ নীতি!
একদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংরক্ষণের সংগ্রামকে পাশব শক্তি দ্বারা বিপর্যস্ত করার জন্য নিক্সন সরকার তাদের দেশ সহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জনগণের সোচ্চার বিরোধীতার প্রতি কর্ণপাত না করে জঙ্গী সমর নায়ক ইয়াহিয়া সরকারকে সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে অন্যদিকে নিক্সন সরকারের পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়ম রজার্স বাংলাদেশে “সক্রিয় রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অবশ্যই প্রচেষ্টা” চালাবার পক্ষে নসিহত দান করেছেন।
সক্রীয় রাজনৈতিক সমাধান যদি বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা না বোঝায় তা’হলে এ জাতীয় প্রচেষ্টা বাংলাদেশের জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে বলে বাংলাদেশ সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক বিবৃতিতে ‘লাখো লাশের নীচে পাকিস্তান চাপা পড়ে গেছে’ বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান তার সাম্প্রতিক বেতার বক্তৃতায় ঘোষণা করেছেন যে, বাঙ্গালী জাতি হিসেবে হয় আমরা বাচবো না হয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো—এর মধ্যে মধ্যবর্তী কোন পথ নেই।
এরপরেও ভিয়েৎনামে জনগণের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে বেত্রাহত কুকুরের মতো স্বদেশ পলায়নমুখী মার্কিণ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান মুখপাত্র দীর্ঘ দিন নীরবতার পর অগ্নি গর্ভ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা পরিচালনার ওপর জোর দিয়েছেন।
গুড়ো দুধের নাম করে যে শক্তি বাংলাদেশের মানুষ হত্যার জন্য গোপনে অস্ত্রশস্ত্র পাঠায়, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তপ্ত রক্তে বাংলার শ্যামল মাটি লাল করে দেওয়ার জন্য জাহাজ জাহাজ সমরাস্ত্র পাঠিয়ে আবার মুরুব্বিয়ানা করার কসরত করে তাদের পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার গোপন প্রচেষ্টা জনগণের ঘৃণার নীচে চাপা পড়ে যাবে।
৪ঠা অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দান কালে মার্কিণ পররাষ্ট্র মন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীকে “পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার” বলে মার্কিণ প্রশাসনিক মনোভাবের পুনরুল্লেখ করে বাংলাদেশে “শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি এবং মানব জীবন রক্ষার” আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য এই প্রথম বার তিনি বাংলাদেশের ঘটনা “দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির প্রতি হুমকি স্বরূপ” বলে অভিমত দিয়েছেন।
তিনি বাংলাদেশ সমস্যার ‘কার্য্যকর রাজনৈতিক মীমাংসার’ জন্য তিনটি উদ্দেশ্য সিদ্ধির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। সে গুলো হলো ঃ
(১) উপমহাদেশে অবশ্যই সংযম রক্ষা করে চলতে হবে, (২) দুর্ভিক্ষ প্রতিরোদ করার জন্য এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাগমনের উপযুক্ত অবস্থার সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের কর্মসূচী সম্প্রসারিত করতে হবে এবং (৩) বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অবশ্যই সক্রীয় প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
মিঃ রজার্স বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বলে উল্লেখ করেছেন।
মার্কিণ পররাষ্ট্র সচিব বলেন যে, তার সরকার এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সমাধানের জন্য শুধু মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র কেন পৃথিবীর যে সরকারই চেষ্টা করুন না কেন তাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর একমাত্র বৈধ সরকার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনা করেই ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ সরকার কোন প্রচেষ্টার সাথেই নিজেদের যুক্ত করবেন না।
রজার্স বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ফলাফল—যথা ভারতে শরণার্থী গমন, দুর্ভিক্ষের বিপদাশঙ্কা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা পৃথিবীর সব দেশেরই উদ্বেগের কারণ।
তিনি বলেন, মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক কর্মসূচী সংগঠনের ব্যাপারে রাষ্ট্রসংঘের প্রচেষ্টায় আন্তরিক সমর্থন জানিয়েছে। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের জন্য ২০ কোটি ডলারেরও অধিক সাহায্য মঞ্জুর করেছে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট নিক্সন ত্রাণ বাবদ আরও ২৫ কোটি টাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ
পাকিস্তানকে সাহায্যদান সম্পর্কিত জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেটর মিঃ মরিস উইলিয়মস সিনেট সাব-কমিটিকে বলেছেন যে, এখন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে পূর্ব বঙ্গ ভয়াবহ ধরণের দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হবে।
তিনি বলেন যে, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্যে বাংলাদেশ যখন প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল তখন সে দেশে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
০০০০

বিশ্ব জনমত
রাজনৈতিক সমস্যা থেকে শরণার্থী সমস্যাকে আলাদা করা যায় না
বিলাতের শ্রমিক দলের জাতীয় কার্যকরী পরিষদের সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে ঃ
বাংলাদেশের জনগণ নিদারুণ দুঃখ যন্ত্রনা ভোগ করছে। এজন্য পাকিস্তানকেই নিন্দা করতে হয়। কারণ পাকিস্তানই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে।
শ্রমিক দলের মতে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রয়োজন, (১) বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচার অবিলম্বে বন্ধ করা; (২) শেখ মুজিবর রহমান সহ সকল জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার মুক্তিদান; (৩) এই সব নেতার সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী রাজনৈতিক সমাধানের সূত্র উদ্ভাবন।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ বাংলাদেশে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে। কারণ, পাকিস্তান বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে ও একটি জাতিকে সমুলে ধ্বংস করবার নীতি গ্রহণ করেছে। জাতি-ধ্বংস নীতি বা গণহত্যা রাষ্ট্রসঙ্ঘের কনভেনসন বিরোধী।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দানকারী বিভিন্ন দেশের উচিৎ আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়া। কারণ, এই সাহায্য পাকিস্তান সরকার এখন তার দেশের উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত না করে করবে সামরিক বাহিনীর কাজে।
বৃটিশ শ্রমিক দলের মতে রাষ্ট্রসঙ্ঘ বাংলাদেশের ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী বাংলাদেশ সমস্যার একটা সমাধান খুজে বের করতে সাহায্য করতে পারে।
০০০০

বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়
একজন ডোমেনিকান খৃষ্টিয় গীর্জার বিশপ ফাদার জলিপ প্যারিসে সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশ ঘুরে এসে তার এই ধারণা জন্মেছে যে, বাংলাদেশ সমস্যার কোন রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে না। কারণ, ইয়াহিয়া কোন রাজনৈতিক সমাধান চায়না। ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনায় সম্পূর্ণ ভাবেই অনিচ্ছুক। ফাদার জলিপ আরো বলেছেন, বাংলাদেশের জনসাধারণ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকেই সমর্থন করে। পাকিস্তান সরকারকে নয়। তিনি সারা বাংলাদেশ ঘুরে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তার ভিত্তিতে এ-কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারেন।
ফাদার জলিপ বাংলাদেশে এসেছিলেন, জাতীয় শান্তি আন্দোলন নামক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে।
০০০০

আওয়ামী লীগের সভা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আগামী ২০শে অক্টোবর মুজিবনগরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা আহ্বান করেছেন। সভায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে। সভায় যোগদানের জন্য ব্যক্তিগতভাবে সদস্যদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর এটা হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির দ্বিতীয় সভা। প্রথম সভা বিগত ৫ই ও ৬ই জুলাই মুজিব নগরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
০০০০

ডঃ মজহারুল ইসলামের ব্যক্তিগত মত
সম্প্রতি ভারতের কাজিকোদ নামক স্থানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ‘শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নব-নিযুক্ত ভাইস চ্যান্সলর হিসাবে পরিচয় দানকারী’ ডঃ মজহারুল ইসলাম “যুক্ত বাংলা পরিকল্পনা বাংলাদেশের জনগণ অভিনন্দিত করবে, তবে ভারত তা পছন্দ নাও করতে পারে” বলে যে মন্তব্য করেছেন তৎপ্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ সরকারের জনৈক মুখপাত্র ওটাকে অবান্তর ও ডঃ ইসলামের ব্যক্তিগত মত বলে অভিহিত করেন।
বাংলাদেশ সরকারের সাথে এ ধরণের মতামতের কোনও সম্পর্ক নেই বলে মুখপাত্র জানান।
০০০০

চুয়াডাঙ্গার মুক্তাঞ্চলে জনসভা
চুয়াডাঙ্গা—গত ২৩শে সেপ্টেম্বর বেলা তিনটার সময় চুয়াডাঙ্গার অদূরে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। অত্র এলাকার মুক্তাঞ্চলে প্রকাশ্য জনসভা এই প্রথম। সভা বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব ইউনুস আলী এবং দর্শনা শহর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জনাব মজিবর রহমান।
০০০০

জাতিসংঘে পাক দালাল নাজেহাল
চাবি দেওয়া পুতুলের মতো বাংলাদেশের কীটদ্রংষ্ট দালাল মাহমুদ আলী (জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা) তার প্রভূ ইয়াহিয়া জঙ্গী শাহীর নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানের কদর্য বীভৎস রূপ ঢেকে রাখার জন্য ৯০ লক্ষ শরণার্থীর আশ্রয়দানকারী ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতির অভিযোগ তুলেছেন।
পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম বাঙ্গালী নামধারী এক ব্যক্তিকে জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা মনোনীত করা হয়েছে। ইয়াহিয়া শাহী বাংলাদেশে তার হিংস্রতম ও র্বরতম কার্যকলাপ একজন বাঙ্গালী বেঈমানকে দিয়ে বিশ্বের কাছে চেপে রাখবার মধ্যযুগীয় প্রচেষ্টায় মাহমুদ আলীর মতো ঘৃণ্য কীটকে প্রতিনিধিদলের নেতা করেছে।
মাহমুদ আলীর গুণ অনেক। তার রাজনৈতিক জীবনে কোন দিন সে বাঙ্গালীর আবেগ অনভূতির সাথে নিজেকে একাত্ম করেনি।
এই গুণধর মাহমুদ আলী জাতিসংঘে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করার দুঃসাহস প্রদর্শন করেছিল। মাহমুদ আলী নাকি প্রথমে বিশ্ব সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের মুখোমুখি হতে রাজী হয়নি।
কিন্তু প্রতিনিধিদলের আসল নেতা পাঞ্জাবী আগাশাহী তাকে সাংবাদিক সম্মেলনে চাবি দিয়ে বসিয়ে দেয়।
মাহমুদ আলী কথা বলতে শুরু করতেই সাংবাদিকরা তাকে নানাবিধ প্রশ্নবানে জর্জরিত করে। কি গুণে তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতার পদে মনোনীত হয়েছেন এ প্রশ্ন তাকে করা হয়। তাকে আরও প্রশ্ন করা হয়, যে ব্যক্তি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে তার মতো লোককে কেন নেতা নির্বাচিত করা হয়েছে। অর্থাৎ জনগণ যাকে ঘৃণার আবর্জনার স্তুপে নিক্ষেপ করেছে সে জাতীয় গণ ধিকৃত লোক পদ পায় কিভাবে?
কিন্তু মাহমুদ আলীর চরিত্রই আলাদা। গণিকাদের যেমন লজ্জা থাকতে নেই মাহমুদ আলীদেরও তা থাকতে নেই। এ বস্তু থাকলে কারো পক্ষে মীরজাফর হওয়া যায় না, কুইসলিং হওয়া যায় না।
মাহমুদ আলী কিন্তু এ প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছে। সে বলেছে ঃ “নির্বাচিত হতে হবে এমন কোন ধরা বাধা নিয়ম নেই।”
মাহমুদ আলীকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে অতি পরিচিত কারণেই ওয়াশিংটন এবং পিকিং বাংলাদেশ প্রশ্নে ইয়াহিয়া জান্তাকে সমর্থন করছে। কিন্তু এছাড়া পৃথিবীর আর বিশেষ কোন দেশ ইয়াহিয়াকে সমর্থন করছেনা কেন? মাহমুদ আলী উত্তর-দান থেকে বিরত থাকে। তাকে আরও প্রশ্ন করা হয়, বিশেষভাবে সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য কেন বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের প্রতি কঠোর নীতি গ্রহণ করেছেন এবং কেনই বা এ দু’টি দেশ পাকিস্তানের বক্তব্য বিশ্বাস করছে না। এবার মাহমুদ আলী মুখ খোলে। কুইসলিং কণ্ঠ থেকে একটি বাক্য বেরিয়ে আসে ঃ “এ প্রশ্নের উত্তর তারাই দিতে পারবে।”
মাহমুদ আলী এরপর আগাশাহীর নির্দেশক্রমে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন যে, ভারত সীমান্ত এলাকায় গোলযোগ সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক সমাজ এ ব্যাপারে ভারতকে নিবৃত্ত করতে না পারলে “তৃতীয় মহাসমর” বেধে যেতে পারে।
মাহমুদ আলী তার বক্তব্য শেষ করার আগেই একজন বিদেশী সাংবাদিক উত্তেজিত হয়ে তাকে প্রশ্ন করে বসেন যে, আপনি তো ভারতের গোলযোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলেছেন কিন্তু দয়া করে বলবেন কি যে, কি কারণে ৯০ লাখ বাঙ্গালী দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে?
এ জাতীয় প্রশ্ন অনবরত বর্ষণ হতে শুরু করলে মাহমুদ আলীর সাংবাদিক সম্মেলন ভেঙ্গে যায়।
০০০০

শেখ মুজিবরের বিচার বন্ধ করা হোক
সোভিয়েট সাংবাদিক ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে গণহত্যা বন্ধ ও বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে দাবী জানান।
সোভিয়েট শান্তি কমিটি ও ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থাগুলির পক্ষ থেকেও অনুরূপ দাবী জানান হয়েছে।
শেখ মুজিবরের বিচার প্রসঙ্গে বলতে যেয়ে সংবাদ সংস্থার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, শেখ মুজিব জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, একথা সারা বিশ্বের লোক জানে। তার দল আওয়ামী লীগ বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে, একথা কারো কাছে অবিদিত নয়। পূর্ব বাঙলার আইন সভাতেও তার দল সংখ্যা গরিষ্ঠ। তাই গণহত্যা ও শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ না করলে বিশ্বের এই অঞ্চলের পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে।
সোভিয়েট শান্তি কমিটি ও ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থাগুলি থেকেও অনুরূপ প্রস্তাব পাশ ও মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে।
০০০০

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মার্কিণ নীতি
বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র স্ববিরোধী নীতি গ্রহণ করেছে। একদিকে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র বলছে বাংলাদেশের সমস্যা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। অন্যদিকে আবার বলছে যে, বিশ্বশান্তির জন্য পূর্ব বাঙলার সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান হওয়া দরকার। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দান প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব মিষ্টার উইলিয়াম রজার্স বলেছেন, পূর্ব বাঙলায় উদ্ভূত পরিস্থিতির ফলে এশিয়ার শান্তি বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন বর্তমান মুহূর্তে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে সংযম রক্ষা করে চলতে হবে।
তিনি বলেন মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হল ঃ (১) দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করবার জন্য সাহায্য দান, (২) শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাগমনের জন্য উপযুক্ত অবস্থা সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক কর্মসূচী প্রনয়ণ ও (৩) পূর্ব বাঙলার রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা চালান। তিনি বলেন, ভারতে শরণার্থী আগমন, দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা সমস্ত বিশ্বকে উদ্বিঘ্ন করে তুলেছে।
০০০০

মার্কিণ নীতির প্রতি কেনেডির ধিক্কার
সিনেটর এডোয়ার্ড কেনেডি বলেছেন, পাকিস্তানে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র এখনও অস্ত্র সরবরাহ বজায় রেখেছে। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী মহল ঘোষণা করে পাকিস্তানকে তারা আর অস্ত্র সরবরাহ করবে না। কিন্তু মার্চ মাসের পর এ পর্যন্ত পাকিস্তানকে ৭ কোটি টাকার মারণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহ করেছে। সরকারী অস্ত্র স্থগিতাদেশের ঘোষিত নীতির সাথে এই অস্ত্র সরবরাহ নীতির অসঙ্গতি খুবই ন্যাক্কার-জনকভাবে প্রকটিত। সিনেটর কেনেডি বলেছেন, এইভাবে পাকিস্তান সরকারকে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে মার্কিণ সরকারের দু-মুখ নীতির পরিচয় ফুটে উঠেছে।
তিনি বলেন, জুন মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তান সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করায় স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, মার্কিণ সরকার পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখবার যে নির্দ্দেশ দিয়েছেন বলে প্রচার করা হচ্ছে তা সর্বতোভাবে মিথ্যা।
আগে পাকিস্তান সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্ত্র রপ্তানীর যে লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছিল তা বাতিল না করার জন্যেও সিনেটর কেনেডি নিক্সন সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।
শরণার্থী সমস্যা আলাদা করে দেখা উচিৎ নয়
যুগোস্লাভিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিরকো তেপার্ভার্ফ বলেন, পূর্ব বাঙলার শরণার্থীরা ফিরে যেতে হলে সেখানকার রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। কারণ, বিশেষ রাজনৈতিক সমস্যা থেকেই শরণার্থী সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না হলে শরণার্থীদের পক্ষে স্বদেশে ফেরা সম্ভব নয়। শরণার্থী সমস্যা সমাধানের জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক আবহাওয়া সৃষ্টি একান্ত প্রয়োজন।
০০০০

মোনেম খান খতম
বাংলার বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসের অন্যতম মীরজাফর, যার নির্দেশে বাংলার পথে প্রান্তরে ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত শত সহস্র মুক্তিকামী ছাত্র, তরুণ, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী অকালে প্রাণ হারিয়েছেন, কারাগারের অন্তরালে দুঃসহ বন্দী জীবন যাপন করেছেন সেই কুখ্যাত মোনেম খান গত ১৩ ই অক্টোবর ঢাকার বুকে মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের বুলেটের গুলীতে গুরুতররূপে আহত হয়ে ১৪ই অক্টোবর মারা গিয়েছে—জয় বাংলার মুক্তি বাহিনীর জয়।
০০০০

অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের বেতার ভাষণ
‘সমগ্র বিশ্ব আমাদের সংগ্রামের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করেছে’
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণের কিয়দংশ গত সপ্তাহের ‘জয়বাংলায়’ প্রকাশিত হয়েছে। অবশিষ্টাংশ নীচে দেওয়া হলো।
প্রেসিডেন্ট বলেন—
শত্রু বাহিনীর চলাচল পথ বিকল করে দেওয়ার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। রসদ সরবরাহ পথ রুদ্ধ করার জন্য রেল যোগাযোগ ও সড়ক পথ ও নদী পথে আক্রমণ তীব্রতর করে তুলেছে। আমাদের বিশেষ বাহিনী চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে শত্রুর অস্ত্র ও রসদবাহী জাহাজ ধ্বংস করে দিচ্ছে। মুক্তি বাহিনীর এই সব গেরিলা সৈন্যদের ওপর এ মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, ‘শত্রুর উপর আঘাত হানো এবং সরিয়ে পড়ো’ এই নীতি চালিয়ে যাও। বীর মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর অস্ত্র দখল করে সুদীর্ঘ ছ’মাস কাল ধরে সাহসিকতার সংগে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি আমার সরকার ও বাঙ্গালী জাতির পক্ষ থেকে তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। ইতিহাসের পাতায় এই সংগ্রামী যুদ্ধের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

হানাদার বাহিনী আজ বিপর্যস্ত
সর্বাধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে বাংগালী মুক্তিযোদ্ধাদের এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
আঘাতে আঘাতে হানাদার সৈন্যরা আজ বিপর্যস্ত—তাদের মনোবল নিঃশেষিত। জেনারেল ইয়াহিয়ার সেনাদল এখন সয়িষ্ণু। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তি বাহিনীর শক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলীর বীর সন্তানেরা দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে শামিল হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবি, ছাত্র, যুবক ও আমাদের নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকেরা স্বাধীন বাংলার পতাকার নীচে এক কাতারে শামিল হয়েছে। তাদের ইস্পাত কঠিন ঐক্যই আজ মুক্তি বাহিনীকে আরও দুর্বার ও অজেয় শক্তিতে পরিণত করেছে।

নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রস্তুতি চলছে
পদাতিক বাহিনী ছাড়াও আমাদের নৌ ও বিমান বাহিনীর বীর সৈনিকরা শত্রুর উপর আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
বাংলাদেশের সর্বত্র শহরে, গঞ্জে, বন্দরে গ্রাম বাংলার প্রতি পথে প্রান্তরে আমাদের গেরিলা সৈন্যরা মৃত্যুর সংগে পাঞ্জা লড়ে যেভাবে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে চলেছে, তাতে আমরা বিরাট গর্ব অনুভব করছি। এর মধ্যেই আমাদের মুক্তি বাহিনী ভারী অস্ত্র ব্যবহারেও পারদর্শী হয়ে উঠেছে। ইশা খা, তিতুমীর, কেদার রায়, সূর্য্য সেনের ঐতিহ্য বহনকারী এবং বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবরের আদর্শে অনুপ্রাণিত আমাদের মুক্তি বাহিনীর সম্মুখে একটি মাত্র লক্ষ্য। সেটা হচ্ছে বাংলার বুক থেকে হানাদার সৈন্যদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। আমার স্থির বিশ্বাস, যে আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের জোয়ানরা লড়াই করে চলেছে তাতে সেই সুদিন খুব শীঘ্রই এসে হাজীর হবে। আমি আবার আমাদের মুক্তি বাহিনীকে জানিয়ে দিতে চাই, সাড়ে সাত কোটি বাংগালী সন্তান আজ ইস্পাত কঠিন শপথে আপনাদের পিছনে রয়েছে। বাংগালী আপামর জনসাধারণ চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
(চলবে)
০০০০

সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্ নেই
এইমাত্র প্যারিস থেকে মুজিবনগরে বিনামেঘে বজ্রপাতের মত খবর এসে পৌছেছে, বাংলাদেশের খ্যাতনামা কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্ আকস্মিক ভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পরলোক গমন করেছেন (ইন্নালিল্লাহে…..রাজেউন)।
০০০০

ময়মনসিংহ ও সিলেট রণাঙ্গনে
দুই শতাধিক রাজাকারের আত্মসমর্পণ
বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, আমাদের অসম সাহসী বীর মুক্তি যোদ্ধাদের অব্যাহত আক্রমণের ফলে হানাদার খান সেনাদের তাবেদার রাজাকাররা এক্ষণে প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর হাতে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসর্পণ করছে।
এদিকে দিশেহারা পাক জঙ্গী সরকার রাজাকার ও হানাদারদের ধ্বসে পড়া ও মনোবলকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে আর্তচীৎকার করে বলে চলেছে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা নাকি হানাদারদের কাছে একেবারে অস্ত্রশস্ত্র সহ ‘সারেণ্ডার করছে’।
পাকিস্তানী জঙ্গী সরকারের এমনি অপপ্রচারের প্রমাণ পাওয়া যায় ময়মনসিংহ ও সিলেট রণাঙ্গনে। উক্ত দুটি অঞ্চলে গত এক পক্ষকালে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে সদলবলে ২ শত রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
০০০০

খাকী পোষাক ছেড়ে পুরোহিত
[ জয়বাংলা প্রতিনিধি ]
ইতিহাসের বীভৎসতম হত্যাকাণ্ডের নায়ক ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র বাংলাদেশে দশ লক্ষ নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা, ৯০ লক্ষ নাগরিককে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে বিতাড়ণ এবং প্রায় ৩০ হাজার গ্রামকে ভষ্মীভূত করার পরও সব কিছু যে স্বাভাবিক রয়েছে তা প্রমাণের জন্য মালকোচা বেধে আসরে নেমেছে। মিথ্যে ফাস হয়ে যাওয়ার পরও নিত্য-নতুন মিথ্যার জাল বুনে বিদেশীদের চোখে ধূলো নিক্ষেপের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
লণ্ডনের ‘টাইমস’ পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে, জনৈক বিদেশীকে ঢাকায় যে পূজা পার্বন পর্যন্ত চলছে তা দেখাতে গিয়ে জঙ্গী সরকার হাতে-নাতে ধরা পড়ে যায়।
কিছু দিন আগে বিশ্ব ব্যাঙ্কের একজন ডিরেক্টর ঢাকায় পৌছলে সব যে স্বাভাবিক তা দেখানোর জন্য একজন সামরিক অফিসার তাকে একটি মন্দিরে নিয়ে যান। সেখানে তিনি দেখতে পান যে, পুরোহিত একটি মূর্ত্তির সামনে বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করছে। তার গলায় পৈতাও রয়েছে। কিন্তু বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিনিধির সঙ্গে আগত জনৈক পাঞ্জাবী মেজর কথা বলতে গিয়ে সব ভুণ্ডুল করে দেয়। মেজর পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করে যে, “তোমহারা কোই তকলিফ হো রাহা?”পুরোহিত মেজরের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দাড়িয়ে পড়ে এটেনশন হয়ে ফৌজি স্যালুট দিয়ে বসে।
সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রতিনিধি ব্যাপারটি বুঝে ফেলেন। তবু আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুরোহিতকে চেপে ধরতেই সে স্বীকার করে যে, সে একজন মুসলমান সৈনিক এবং তার আগমন উপলক্ষে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে মন্দিরে পূজোর জন্য বসিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য এরপর নকল পুরোহিতের ভাগ্যে কি ঘটেছে বিদেশী ভদ্রলোক জানেন না।
০০০০

মৃত পাকিস্তানের রাজনৈতিক শনি
পাকিস্তানের রাজনৈতিক গগনে বর্তমানে দুটো শনি বিরাজ করছে। এর একটি হচ্ছে সামরিক জান্তার প্রধান ও পাকিস্তানের স্ব-নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং অপরটি হচ্ছে জুলফিকার আলী ভূটো। দু’জনেই আইয়ুব খানের রাজনৈতিক ভাবশিষ্য। আর সেই জন্যেই গণতন্ত্র সম্পর্কে সামরিক জান্তার প্রধান খা সাহেব এবং রাজনৈতিক দলের নেতা ভূটো সাহেবের মধ্যে অদ্ভূত মিল রয়েছে।
পাকিস্তানের এই জল্লাদ খা সাহেব ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দখলীকৃত বাংলাদেশ জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক সভার শূন্য ঘোষিত আসন সমূহে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ফতোয় জারী করেছেন তার ওপরে গণতন্ত্রের পলস্তারা লাগাবার জন্যে অক্টোবরের শেষ নাগাদ দখলীকৃত বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
ওদিকে শনিগ্রহের অপর রত্ন ভূটো সাহেব অভিযোগ করেছেন যে, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে দেশে সংসদীয় সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ বলে মনে করতে হবে। মন্তব্যটা তিনি করেছেন দখলীকৃত বাংলাদেশে ইয়াহিয়া ঘোষিত শূন্য আসন সমূহের উপনির্বাচনের সময় নবেম্বর থেকে পিছিয়ে ডিসেম্বরে নিয়ে যাওয়ায়। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন যে, ভিয়েৎনামে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে হলে ‘পূর্বপাকিস্তানেও’ হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে দুই রত্নের গণতান্ত্রিক ধারণার মিলটি লক্ষণীয়। নিজের ক্ষমতা অটুট রাখার ষ্ট্র্যাটেজীতে খাপ খায়নি বলে খা সাহেব সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ও নজীরবিহীন নির্বাচনী রায়কে বাতিল করে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাথায় লাথি মেরেছেন আর ভূটো সাহেব সেই ষড়যন্ত্রের হাত মিলিয়ে এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ভেবে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। যে রাজনৈতিক জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও আস্থা অর্জন করেছে, বাংলাদেশের সেই জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগকে বে-আইনী ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং গোপনে সামরিক আদালতে সাজানো অভিযোগে তার বিচার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নির্ব্বাচিত প্রতিনিধি, নেতা ও কর্মীদের হত্যা ও অকথ্য নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিয়ে তাদের আত্মগোপনে বাধ্য করা হয়েছে। এমন কি অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীবৃন্দও এই নির্যাতনের কবল থেকে রেহাই পায়নি। ফলে তারাও হয় আত্মগোপন করতে নয়তো দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
এই ভাবে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শূন্য করে কেবল মাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থ ও সামরিক জান্তার গুটিকতক দালাল প্রতিষ্ঠানের জন্যে ফাকা মাঠের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর পর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেয়া আর না নেয়ার মধ্যে তফাতটা থাকে কোথায়? সত্তুরের যে নির্ব্বাচন সম্পর্কে খা সাহেব নিজেই বলেছিলেন ‘বিশ্বের যে কোন দেশ এ ধরণের নির্ব্বাচনের জন্যে গর্ব করতে পারে’, নিজের গদি নিরংকুশ করার ষ্ট্র্যাটেজীতে খাপ খায়নি বলে সেই নির্বাচনী রায় ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থায় উত্তরণের মাথায় পদাঘাত করার পর কোন ক্রমেই আর খা সাহেবের পক্ষে নিজের বর্বর জঙ্গীশাসনের ওপরে গণতন্ত্রের চুনকাম চড়ানো সম্ভব নয়। তবে গণতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানদের ধারণাটাই অবশ্য ওই রকমের।
ঠিক একই ধারণা ভূটো সাহেবেরও। কারণ তিনিও আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। তাই তার পক্ষে গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে গাটছড়া বাধা সম্ভব হয়েছিল। তার আসল লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার গদিতে উপবেশন করা—গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা একটা উপলক্ষ্য মাত্র। আর সেই জন্যেই জাতীয় সংহতি এবং এক রাষ্ট্র এক জাতির দোহাই পাড়া সত্বেও তার পক্ষে এক রাষ্ট্রে ‘টু মেজরিটি পার্টির’ অভিনব ও মৌলিক তত্ব উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। আর সেই ক্ষমতা লাভের আশাতেই ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার ম্যারেজ অব কনভিনিয়েন্স সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে ক্ষমতার লাগাম যার হাতে থাকে গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্যে সেই ‘ক্ষমতাবানের’ সাথে গাটছড়া বাধলে পরিণামে ঠকতে হয়। কারণ গণতান্ত্রিক নীতিতে হত্যা করার কাজের অংশীদার হবার পর সেই গণতন্ত্রের দোহাই পেড়ে আর ক্ষমতায় আসা যায় না। বড়জোর ক্ষমতার উচ্ছিষ্ঠ জুটতে পারে। কারণ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে ক্ষমতার রজ্জু যার হাতে কার্যোদ্ধারের পর তিনি কেন ক্ষমতাটি সাধ করে অন্যের হাতে তুলে দিতে থাকে? তা হলে নারীঘাতী, শিশুঘাতী ও গণতন্ত্র হত্যাকারীর দুর্ণাম কেন তিনি শিরোধার্য করতে যাবেন?
কিন্তু এতেও ভূটো সাহেবের শিক্ষা হবার নয়। কারণ গণতন্ত্র সম্পর্কে তার ‘ধারণাটাও’ ইয়াহিয়ার মতই। সেই জন্যেই তিনি মন্তব্য করতে পেরেছেন যে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করতে হবে। কিন্তু এই নির্বাচিত প্রতিনিধি কারা সে জবাব ভূটো সাহেব দেন নি। তার মাথাতে এটা আসেনি যে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে যে দল একক ও নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল, সামরিক পশুশক্তির বলে তাদের বাতিল করে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভরাডুবি ঘটানো হয়েছে। এখন তার শবদেহকে সামনে রেখে ভূটো সাহেবদের অশ্রু বিসর্জন বৃথা। মৃতদেহে আর কোন দিনই তার পক্ষে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।
অবশ্য সেই সাধনাও তার নেই। তাই তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ নির্বাচন প্রসঙ্গে ভিয়েৎনামের নজীর টেনেছেন। এর অর্থ হচ্ছে দখলীকৃত বাংলাদেশের নির্বাচনী রায়কে বাতিল করার অধিকার তিনি মেনে নিয়েছেন। সামরিক জান্তা কর্তৃক কোন একটি অঞ্চলের বৈধ নির্বাচনকে বাতিল করার অধিকার মেনে নিলে অন্য সময়ে স্বয়ং ভূটোর দলের নির্বাচনকে বাতিল করার অধিকারকেও মেনে নেয়া হয়। গণতন্ত্রের যে মূলনীতি ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’; সামরিক জান্তার ক্ষমতাকে সেই জনগণের ওপরে স্থান দিলে গণতন্ত্রকে কোন দিনই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
কিন্তু সে প্রশ্ন উত্থাপন করা মৌলিক গণতন্ত্রের শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের বিজয়কে নস্যাৎ করার চক্রান্তের অংশীদার ভূটো সাহেবের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষহীন দখলীকৃত বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিনি বিরোধীতা করেন নি। বিরোধীতা করেছেন নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্বের। কাজেই গণতন্ত্র সম্পর্কে দুই রত্নের কোন বিরোধ নেই। বিরোধ শুধু ক্ষমতার বাটোয়ারার প্রশ্নে।
অবশ্য ইয়াহিয়ার এই নির্বাচনী প্রহসন, রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বা ভূটোর অভিমানে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের কিছুই যায় আসে না। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামই এদের সকল ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত জবাব দিচ্ছে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে একদিন সেখানকার মানুষকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হবে। কারণ তাদের রাজনৈতিক নেতা এটা বোঝেননি যে, গণতান্ত্রিক নীতিকে পদদলিত করে, গণতন্ত্রকে ছাট কাট করে এবং সামরিক জান্তার সাথে গাটছড়া বেধে কোনদিনই পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। গণতন্ত্রের সংগ্রাম খণ্ডিত সংগ্রাম নয়, এটা সর্বাত্মক সংগ্রাম।
০০০০

আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী
বিগত ৪ঠা অক্টোবর মুজিবনগর আওয়ামী লীগ অফিসে আওয়ামী লীগ মহিলা কর্মী ও সদস্যদের এক জরুরী সভায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা বেগম বদরুন্নেসা আহমদের সভানেত্রীত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দেশ মাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের দুর্জয় সংগ্রামে লিপ্ত অকুতোভয় মুক্তি বাহিনীর জন্য শীতের কাপড় যোগাড় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বেগম মাজেদা চৌধুরী, বেগম আইভি রহমান, বেগম রাফেয়া আক্তার ডলি, বেগম নুরুন নাহার রহমান, বেগম হোসনে আরা মান্নান, বেগম জাহানারা হক এবং বেগম হাসিনা আহমদ।
সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশ থেকে আগত যে সব মা-বোন বর্বর ইয়াহিয়ার পশু সৈন্য দ্বারা লাঞ্চিত হয়েছে এবং যারা অভিভাবকহীন অবস্থায় জীবন নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে এসেছে তাদের জন্য প্রতিটি ‘জোন’-এ একটি করে ‘হোম’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ মহিলা সংগঠনের এই জরুরী সভায় বিনা শর্ত্তে বাংলার মুক্তি মন্ত্রের উদগাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃত এবং কসাই ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যদের বাংলার লাখ লাখ মা-বোনদের ওপর পাশব নির্যাতনের নিন্দায় সোচ্চার হওয়ার জন্য বিশ্বের মা-বোনদের প্রতি আকুল আবেদন জানান হয়েছে।
অপর এক প্রস্তাবে বিশ্বের প্রতিটি মা-বোনের কাছে মুক্তি ফৌজের জন্য একটি করে সার্ট ও সোয়েটার দান করার জন্য আবেদন জানান হয়েছে।
০০০০

বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় এবার বৌদ্ধ-নির্যাতন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজধানীগুলোতে বাংলাদেশের বৌদ্ধগণ পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভূক্ত হয়ে জঙ্গী সরকারের পক্ষে সাফাই প্রচার করতে রাজী না হওয়ায় নতুন করে বৌদ্ধদের উপর নির্যাতন শুরু হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বৌদ্ধ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু ধর্মবীর্যু নয়াদিল্লীতে একথা জানান।
তিনি বলেন, বৌদ্ধ ফেলোশিপের পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রী ডি, পি, বড়ুয়াকে পাক সেনারা সম্প্রতি হত্যা করেছে। শ্রী বড়ুয়ার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে।
শ্রী বড়ুয়া ঢাকাস্থ ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের জনসংযোগ অফিসার ছিলেন। শ্রী ধর্মবীর্যু আরো জানান যে, চট্টগ্রামের সাতপাড়িয়া বৌদ্ধ মন্দিরটি অপবিত্র করা হয়েছে।
পাকিস্তান বৌদ্ধপ্রধান একশত বছরের বৃদ্ধ সংঘনায়ক অভয়তিষ্য মহাথেরোকে গত ১৭ই ও ১৮ই সেপ্টেম্ব পাক সৈন্যরা প্রহার করেছে। সংঘের অপরাপর ভ্রমকদের উপরও অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন করা হয়। ভগবান বুদ্ধের মূর্তি, মূল্যবান পুথিপত্র ও অপরাপর সামগ্রীও পাক সেনারা নিয়ে গেছে।
শ্রী ধর্মবীর্যু থাইল্যাণ্ড, সিংহল ও জাপানের বৌদ্ধপ্রধানদেরকে তারবার্তায় অবিলম্বে এক সম্মেলন আহ্বান করার অনুরোধ জানিয়েছেন। সেই সম্মেলনে পাক সেনাবাহিনীর নির্যাতন সম্পর্কে আলাপ আলোচনা হবে। বেঙ্গল বুদ্ধিষ্ট এসোসিয়েশনের উদ্যোগে কলকাতাস্থ বুদ্ধিষ্ট টেম্পল ষ্ট্রীটে প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব উদযাপিত হয়। অধিকৃত বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর বর্বর অত্যাচারের জন্য বৌদ্ধ নরনারীগণ দারুণ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বৌদ্ধরা হিংসায় বিশ্বাস করেন না। তথাপি পাকিস্তানী ফৌজ যেভাবে একজন বৌদ্ধ কর্মীকে হত্যা করেছে তার নিন্দা করার মত ভাষা তাদের জানা নেই এবং এ ধরণের হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ মানবতা বিরোধী কাজ বলেই তারা মনে করেন।’
এ ছাড়া, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও হাজার হাজার বৌদ্ধ রয়েছেন। সেখানে তাদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা না থাকায় উৎসবে সমবেত বৌদ্ধগণ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা জানান, এরই মধ্যে বহু বৌদ্ধ পাকিস্তানী ফৌজ ও আমলাশাহীর দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
০০০০

টাইগারম্যানের পদত্যাগের অন্তরালে
( কলকাতা প্রতিনিধি প্রেরিত )
ঢাকায় বিশ্ব ব্যাঙ্কের উন্নয়ন কাজের সাথে জড়িত মার্কিণ স্থপতি ৪০ বৎসর বয়স্ক মিঃ ষ্ট্যানলি টাইগারম্যান ঢাকা থেকে কলকাতায় পৌছে ২৮শে সেপ্টেম্বর বলেছেন যে, বাংলাদেশে ফ্যাসিষ্ট ইয়াহিয়া চক্রের সাথে জড়িত থাকা অমানবিক ও নৈতিকতা বিরোধী বলে আমি চাকরী ছেড়ে দিয়েছি। আবেগ জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন,“আমি কোনদিন আর ইয়াহিয়ার পাকিস্তানে যাবো না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রয়োজনে ডাক পড়লে অবশ্যই আমি তথায় হাজির হবো।”
তিনি ঢাকা ছেড়ে ব্যাঙ্কক হয়ে ২৬শে সেপ্টেম্বর কলকাতা আসেন। তিনি বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং পাকিস্তান সরকারকে তারযোগে তার পদত্যাগের কারণ জানিয়ে দিয়েছেন।
মিঃ টাইগারম্যান কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানী ফৌজ-চক্রের অত্যাচার ও নির্যাতনের দৃশ্য আমার সহ্য হচ্ছিল না। গোট ঢাকা শহরই একটি ব্ন্দী শালায় পরিণত হয়েছে। সর্বত্র শুধু ত্রাস আর আতঙ্ক।ভয়ে কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলেন না। এই ফ্যাসিষ্ট বর্বতা অসহ্য।
মিঃ টাইগারম্যান ১৬ বার ঢাকা গিয়েছেন। তিনি বলেন, কিন্তু ছয় মাস পরে ঢাকায় ফিরে শহরটিকে চিনতে বেগ পেতে হলো। জঙ্গী চক্র শহরটিকে তছনছ করে দিয়েছে। হাজার হাজার বাঙ্গালীকে আটক রাখা হয়েছে। তাই একজন স্থপতি এবং সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে আমি মানবতার দুষমণদের সংস্রব ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেই।
মিঃ টাইগারম্যান বলেন, ঢাকায় অবস্থানরত প্রতিটি বিদেশী নাগরিক আমার মতো মানবিক যন্ত্রনায় ভুগছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বার বার বলেন, আমি মানুষ। ফ্যাসিষ্ট চক্র শুধু মানুষকেই হত্যা করছে না—তাদের সর্বস্ব জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
মিঃ টাইগারম্যান ঢাকায় বর্তমান অবস্থার এক আনুপূর্বিক বিবরণ দান করেন। তিনি বলেন ঃ সারা শহরের সেই পরিচিত বাড়ী, মন্দির ও মসজিদ ধ্বংস স্তুপে পরিণত। রাস্তায় বড় বড় দেয়াল খাড়া করা হয়েছে। শত শত চেক পোষ্ট। রেডিও সহ বিভিন্ন সরকারী অফিসের সামনে ২০ থেকে ২৫ ফুট উচু প্রাচীর খাড়া করা হয়েছে। রাস্তার মানুষ বোবার মতো পথ চলে। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে শহরের পথঘাট জনমানবহীন হয়ে পড়ে। ২৪ ঘণ্টা সামরিক বাহিনী, পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ, জামাতে ইসলামী স্বেচ্ছাসেবক, রাজাকাররা বন্দুক ও ষ্টেনগান নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সর্বত্র ভয়।”
ঢাকায় কেন তিনি পদত্যাগ করেননি এ প্রশ্নের উত্তর মিঃ টাইগারম্যান বলেন ঃ“সেখানে পদত্যাগ পত্র দাখিল করলে আমি হয়তো ঢাকা ত্যাগ করতে পারতাম না। সে অবস্থায় আমার ওপর যে কোন রূপ আঘাত আসতে পারতো। আমাকে হত্যা করে হয়তো সেনাবাহিনী একটি না একটি কারণ দেখিয়ে দিতো। হত্যার পর দুর্ঘটনায় আমার মৃত্যু হয়েছে বলে ঘোষণা করতো। তারা পারেনা এমন কিছু নেই।”
ঢাকা ত্যাগের আগে আমেরিকান কনসুলেটকেও তিনি তার মনোভাব জানাননি।
০০০০

তোমার পতাকা যারে দাও—
বিভিন্ন পাকিস্তানী দূতাবাসে কর্মরত কতিপয় বাঙ্গালী পদস্থ কূটনীতিক এবং দূতাবাস কর্মী সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করেছেন।
নেপালের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জনাব মুস্তাফিজুর রহমান গত ৩রা অক্টোবর কাঠমুণ্ডুতে বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্য ঘোষণা করেছেন। জনাব রহমান তার বাসভবনে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করে নেপালের প্রধান মন্ত্রী শ্রী কীর্তিনিধি বিস্থার কাছে লিখিত এক পত্র পড়ে শোনান।
ঐ পত্রে তিনি লিখেছেন, “আমি এমন এক সরকারের সঙ্গে আর যুক্ত থাকতে পারছি না, যে সরকার গোটা বাঙ্গালী জাতির সামগ্রিক বা আংশিক উৎসাদনের উদ্দেশ্যে আপন মানুষদের অধিকার, জীবন, স্বাতন্ত্র, ধর্মীয় ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সমস্ত রকম মৌলিক অধিকার নির্মম ভাবে পদদলিত করে চলেছে।” তিনি বলেন, “আমি তাই পাকিস্তানের স্বৈরতন্ত্রী সরকারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে গণতন্ত্র সম্মতভাবে নির্বাচিত বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রী সরকারের প্রতি আমার আনগত্য ঘোষণা করছি।”
গত ৪ঠা অক্টোবর নয়াদিল্লীস্থ পাক দূতাবাসের মন্ত্রী পর্যায়ের উপদেষ্টা ও চ্যান্সারির প্রধান জনাব হুমায়ুন রসিদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। এরই পাচ ঘন্টা পূর্বে পাক হাই কমিশনের পার্সোন্যাল এ্যাসিষ্ট্যান্ট জনাব ফরিদউদ্দীন আহমেদ সপরিবারে পাক হাই কমিশন ত্যাগ করে বাংলাদেশ মিশনে যোগ দিয়েছেন।
জনাব হুমায়ুন চৌধুরী তার সুসজ্জিত বৈঠকখানা সাংবাদিক সভা ডেকে জানান যে, তিনি পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকদের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে মাতৃভূমির মুক্তি আন্দোলনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জনাব চৌধুরী আরো বলেন যে, পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য ইতিহাস ইয়াহিয়া খানকেই দায়ী করবে, শেখ মুজিবর রহমানকে নয়। শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই নয়, মানবতার বিরুদ্ধেও জঘন্য অপরাধ করার জন্য ইয়াহিয়া খানের বিচার হওয়া উচিত।
৪৩ বৎসর বয়স্ক কূটনীতিক জনাব চৌধুরী ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান ফরে সার্ভিসে যোগ দেন এবং তারপরে রোম, বাগদাদ, করাচী, লিসবন ও জাকার্তায় বিভিন্ন কূটনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি এই বছর এপ্রিল মাসে দিল্লীর পাক দূতাবাসে যোগ দেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে তার স্ত্রী এবং তার দুই সন্তান উপস্থিত ছিলেন। তারা জনাব চৌধুরীর সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
নয়াদিল্লীস্থ পাক দূতাবাসের অপর কর্মচারী জনাব ফরিদ উদ্দীন আহমেদ বলেন যে, পাক হাই কমিশনার সাজ্জাদ হায়দার ৪ঠা অক্টোবর সকালে তার ঘরে নিজে তাকে প্রহার করে। প্রেস উপদেষ্টা এম, আই, বাটও তাকে মারধর করে।
জনাব আহমেদ ও তার স্ত্রী তাদের চারজন ছেলেমেয়ে নিয়ে বেলা দু’টা নাগাদ হাই কমিশন দেয়াল টপকিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে বাংলাদেশ মিশন অফিসে চলে যান। পাক-মিশনের পশ্চিম পাকিস্তানীরা তার পিছু ধাওয়া করে। জনাব আহমেদ তাদের জিনিসপত্র হাই কমিশনে ফেলে আসেন।
তিনি বলেন, হাই কমিশনের পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মীরা বাঙ্গালী কর্মীদের উপর উৎপীড়ন চালাচ্ছে। তাকে এবং মিশনের বাকী দশজন কর্মীকে ইসলামাবাদে বদলীর আদেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন যে, হাই কমিশনার সাজ্জাদ হায়দার এবং প্রেস উপদেষ্টা এম, আই, বাট তাকে প্রহার করে এবং বলে “বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতক, হাই কমিশন থেকে বেরিয়ে যাও।”
জনাব আহমেদকে নিয়ে বারোজন বাঙ্গালী দূতাবাস কর্মী বাংলাদেশ মিশনে চলে গেলেন।
০০০০

বাংলাদেশের বন্দরে আর যাবো না
দু’টি ব্রিটিশ এবং একটি পোলিশ জাহাজ কোম্পানী বাংলাদেশের জলসীমায় তাদের জাহাজ পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
২৯শে সেপ্টেম্বর একটি বিদেশী সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান খবর দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দরে মুক্তিবাহিনীর সাম্প্রতিক ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি বিদেশী জাহাজ কোম্পানী তাদের এ সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে জানিয়ে দিয়েছেন।
০০০০

রংপুরে খণ্ডে প্রচণ্ড সংঘর্ষ
মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী যোদ্ধারা দুর্বার গতিতে পাকিস্তানী সামরিক ঘাটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। গত ৩০শে সেপ্টেম্বর রংপুর-দিনাজপুর-রাজশাহী অঞ্চলে ভুতমারীতে গেরিলা যোদ্ধারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে খান সেনাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৪ জনকে হত্যা করেছেন। গত সপ্তাহে গেরিলা যোদ্ধারা রউমারী এলাকায় ব্যাপক আক্রমণ চালালে দখলদার ১০০ সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়। এছাড়া ২ শত রাজাকার গুরুতররূপে আহত হয়।
০০০০

কুষ্টিয়ায় উভয় পক্ষের মধ্যে মুখোমুখী সংঘর্ষ
গত ২২শে সেপ্টেম্বর দুই কোম্পানী পাক ফৌজ তেতুলবাড়ীয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যানের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিলে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলেন। মুখোমুখী এক সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ৩ জন সৈন্য খতম হয় এবং ৫ জন গুরুতররূপে আহত হয়। ভীত সন্ত্রস্ত খান সেনারা মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খেয়ে পলায়নকালে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও তাদের পোষাকাদি ফেলেই কেটে পড়ে।
উক্ত দিন মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক যোদ্ধারা দস্যু সৈন্যদের ওপর আরো একটি আক্রমণ চালান। ফলে ৩ জন সৈন্য নিহত ও ১৩ জন আহত হয়।
কুষ্টিয়া জেলার টংটর কাছে বেলগাছিয়া গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যরা হামলা চালায়। ফলে ১০ জন নিরীহ নাগরিক নির্মমভাবে নিহত হন।
মুক্তিবাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং ৫ জন খান সেনাকে খতম করেন।
০০০০

যশোর-খুলনা
যশোর-খুলনা খণ্ডের পাজিঘাট, কারামার, পশ্চিমবাগ ও শ্যামপুকুর গ্রামের পাকিস্তানী ঘাটির ওপর মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা হাল্কা মেশিনগান ও ভারী মর্টার ব্যবহার করেন। ফলে একুশ জন খান সেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর মর্টারে ৩টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়।
০০০০

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে খৃষ্টান বিতাড়ণ
( জয়বাংলা প্রতিনিধি )
বাংলাদেশ থেকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের নির্বিচারে হত্যা ও বিতাড়ণের লোমহর্ষক ও মর্মন্তুদ সংবাদের আংশিক বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে খৃষ্টানদের বিতাড়ণের তথ্য নির্ভরযোগ্য খবরে পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশকে অমুসলিম শূন্য ও যে সব মুসলমান দেশে থেকে যাবে তাদের দাসে পরিণত করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে কেবলমাত্র মুসলমানদের আবাস্থলে পরিণত করার গোপন চক্রান্তের সংবাদ ফাস হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানকে ১৯৪৭-৪৮ সালের মধ্যেই হিন্দু ও শিখ শূন্য অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সরকারী পর্যায়ে দাঙ্গা বাধিয়ে দেড় কোটির মতো হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত নাগরিককে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়ণ করা হয়েছে। এরপর এদের সম্পত্তি বিহারের মুসলিম অধিবাসীরা বাংলাদেশে গিয়ে সরকারী সম্মতিতে দখল করে নিয়েছিল। ১৯৭১ সালে হিন্দুদের সার্বিক বিতাড়ণ কাজ যথেষ্ট তৎপরতা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সমাধা করা হয়েছে। তবে এবার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়েছে।
কিন্তু এক সময় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মিঃ জিন্নাহ বলেছিলেন ঃ “পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের পূর্ণ অধিকার থাকবে। জাতি-ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে তারা পাকিস্তানের নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের মতোই অধিকার এবং সুযোগ সুবিধে পাবে।”কিন্তু ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশ কিছু সংখ্যক খৃষ্টান বিতাড়ণের পর বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর পর সামরিক জান্তা পশ্চিমাঞ্চলকে খৃষ্টান শূন্য এলাকায় পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়ে বর্ত্তমানে ঝাপিয়ে পড়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তানে বর্ত্তমানে ৭ লাখ খৃষ্টান রয়েছে। খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন যে, সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে জিন্নার উক্তিটি শুধুমাত্র সরকারী নথিপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তব অবস্থার সাথে ঘোষিত জিন্না নীতির কোন মিল নেই।
পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টানরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি চালাচ্ছে বলে সম্প্রতি নতুন অভিযোগের ঝড় তোলা হয়েছে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরও খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তির প্রতিহিংসামূলক অভিযোগ এনে বহু খৃষ্টানকে বিতাড়ণ করা হয়েছিল। এরপর তাদের সম্পত্তি এলাকার ভূস্বামীরা দখল করে নেয়। বাংলাদেশ সঙ্কটে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে যুদ্ধের পায়তারা শুরু হওয়ার পর সামরিক জান্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাকী খৃষ্টানদের বিতাড়ণ শুরু করে দিয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতি যদিও খৃষ্টানরা অনুগত তবুও তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগ করা হচ্ছে। সরকার অথবা প্রশাসনে তাদের কোন অংশ নেই। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার থেকে খৃষ্টানদের বঞ্চিত করে তাদের প্রায়শঃই পাকিস্তান ত্যাগ করে কানাডা অথবা মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।
লাহোর এবং করাচীর কতিপয় খৃষ্টান নেতা পৃথক বিবৃতিতে জঙ্গীশাহীর এই অমানবিক কার্যকলাপের পরোক্ষ নিন্দা করে পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টানদের পাকিস্তানী জাতিত্বের অঙ্গীভূত করে নেওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছেন।
লাহোরের বিশপ মহামান্য ইনিয়াৎ মাসিহ এক বিবৃতিতে বলেছেন যে, খৃষ্টানদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা না হলে বোঝা যাবে যে, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সঙ্গীনের সন্ত্রাসের রাজত্বে বসবাসরত পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টান নেতা পরোক্ষভাবে তারা যে পাকিস্তানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক তা বলেই দিয়েছেন।
বিশপ মাসিহ বলেছেন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই খৃষ্টানদের সাথে বিভেদমূলক ব্যবহার করে আসা হচ্ছে। পাকিস্তানী পতাকার সাদা অংশ যদিও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করছে তবু বিনা দ্বিধায় বলা যায় তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য কোন ব্যবস্থাই এ পর্যন্ত কোন সরকার নেয় নি।
স্বাধীন খৃষ্টান লীগের প্রেসিডেণ্ট মিঃ যশোয়া ফজল দীন বলেছেন যে, পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানী খৃষ্টানদের পাকিস্তানী জাতিত্বের বাইরে রেখেছেন।
বিশ্ববিবেক জঙ্গী ইয়াহিয়া শাসনের বিরুদ্ধে সক্রীয়ভাবে সোচ্চার এবং মানবতার দরবারে তাদের আসামীর কাঠগড়ায় উঠাতে না পারলে অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তান খৃষ্টান-শূন্য হয়ে যাবে।
০০০০

বুদ্ধিজীবী কনভেনশনে গণহত্যার নিন্দা
বোম্বাই-এর লেখক, বুদ্ধিজীবী ও মনীষীরা এক কনভেনশনে মিলিত হয়ে বাংলাদেমে পাকিস্তানের পরিকল্পিত গণহত্যার নিন্দা করেছেন। সর্বসম্মতভাবে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার সমালোচনা করা হয়।
উক্ত কনভেনশনে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত উর্দু লেখক শ্রী কিষাণ চন্দর। তিনি বাংলাদেশ ও মুক্তি বাহিনীল প্রতি একাত্মতার কথা ঘোষণা করেন।
বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবী করে ও সকল দেশের কাছে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দাবী করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। কনভেনশনের প্রারম্ভে বাংলাদেশের গায়ক জনাব আবদুল জব্বার দু’খানি দেশাত্ববোধক সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
০০০০

বাংলাদেশের সমর্থনে সিকাগো-তে বিক্ষোভ
সিকাগোর ‘ফ্রেণ্ডস অব ইষ্ট বেঙ্গল’ পি, আই, এ-কে দুটো ৭০৭ জেট বিমান ভাড়া দেওয়ার জন্য ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। জনসাধারণের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য সৈন্য এবং ট্যাঙ্ক বোঝাই বড় বড় কাগজের উড়োজাহাজ ছোড়া হয়। বিক্ষোভ উপলক্ষ্যে যে পথসভা হয় তাতে বহু লোক যোগ দান করেন। পুলিশ দুই জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পি, আই, এর বিমানের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে সৈন্য আনা নেওয়ার কাজ করা হয়।
০০০০