You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.02 | জয় বাংলা ২ জুলাই ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা (এবং ইউনিকোড ভার্সন) - সংগ্রামের নোটবুক

জয় বাংলা ২ জুলাই ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পৃষ্ঠা-এক

পাকিস্তানের অস্ত্র প্রেরন

বাংলাদেশ প্রশ্নে আমেরিকা নতুন ভিয়েতনাম সৃষ্টি করতে চায় কি?

বিশ্বের বিবেকবান ও স্বাধীনতাকামীদের শত প্রতিবাদ ও আবেদন সত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নিরীহ, নিরস্ত্র ও গণতন্ত্রকামী মানুষকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তিনটি জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানকে সাহায্য দান করেছে। এই জাহাজগুলোতে আটটি জঙ্গিবিমান, প্যারাসুট, কামান, ট্রাকের যন্ত্রপাতি রয়েছে এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ নিয়ে জাহাজগুলো ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেছে।  ইয়াহিয়া বাহিনীর অকথ্য অত্যাচার যে ৬০ লক্ষ মানুষ দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের জন্য মার্কিন সরকার আর্থিক সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এ মুহূর্তে পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেওয়ায় নিক্সন সরকারের দু’মুখো নীতি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বিক্ষোভের মুখে পাকিস্তান এইট কনসোর্টিয়াম আর সাহায্য দেবে না

প্যারিসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান এইড-কনসোর্টিয়াম সদস্যরা সম্মুখীন হয়ে শেষ পর্যন্ত অধিবেশন স্থগিত রাখেন এবং ঘোষণা করেন যে বর্তমান অবস্থায় পাকিস্তানকে আর যে কোন রকম সাহায্য দেওয়া সম্ভব নয়। লন্ডন থেকে আগত শত শত বাঙালী প্যারিসে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

বিশ্ব ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিঃ কার্গিল পাকিস্তানকে সাহায্যকারী সংস্থা কনসোর্টিয়ামের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের স্থগিত রাখার সুপারিশ করেছেন। মিঃ কার্গিল গত মাসের প্রথম ভাগে পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা সফর করেন । এই সফরকালে মিঃ কার্গিল লক্ষ্য করেছেন যে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা,  যুদ্ধাবস্থা ও আর্থিক মন্দার জন্য বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের পরিস্থিতি বিদেশি মূলধন বিনিয়োগের পক্ষে মোটেই উপযোগী নয়। তাছাড়া বাংলাদেশ ইয়াহিয়াশাহীর দস্যু সৈন্যদের ধ্বংসলীলার দৃশ্য তাঁর চোখ এড়ায়নি। ফলে বাংলাদেশ যুদ্ধ বন্ধ না করা পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিকশাহীর হাতে সাহায্য দেয়া তিনি নিরাপদ মনে করেন না।

মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে প্রচন্ড  বিক্ষোভ

পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র প্রেরণের প্রতিবাদে বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ লোকেরা গত ২৫শে জুন নয়াদিল্লিস্থ মার্কিন দূতাবাসের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।  এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব করেন বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি জনাব কে, এম শাহাবুদ্দীন।

স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে এবং পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র প্রেরণের প্রতিবাদে ধ্বনি দিতে দিতে বিক্ষোভকারী দল দূতাবাসে গমন করেন এবং সেখানে মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক সেক্রেটারি মিঃ ডোনাল্ড এবং হার্ট জনাব শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। 

জনাব শাহাবুদ্দীন মার্কিন প্রতিনিধি হাতে একটি স্মারকলিপি দেন। এই স্মারকলিপিতে পাকিস্তান বন্দরে যাওয়ার আগে অস্ত্রবাহী মার্কিন জাহাজ গুলোকে আটকে দেওয়া এবং অস্ত্রশস্ত্র গুলো যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি করা হয়েছে। স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়েছে যে এই সময়ে পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার অর্থ বাংলাদেশ আরো গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানকে সাহায্য করা এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করা। মিঃ হার্ট বলেন যে, বাংলাদেশের সমস্যা তিনি উপলব্ধি করেন এবং তিনি অবিলম্বে এই স্মারকলিপির বক্তব্য তাঁর সরকারকে জানিয়ে দেবেন।

বাংলাদেশ বাসি মর্মাহত

রুশ নভোচারী লেঃ কঃ জর্জি দারোভলক্সি, ফ্লাঃ ইঃ ভ্লাদিস্লাভ ভলকভ  ও স্টেট ইঃ  ভিক্টর পাতসারেভের মৃত্যুতে বাংলাদেশের জনগণ জানাচ্ছে রুশ জনগণের প্রতি তাদের আন্তরিক সমবেদনা ও শ্রদ্ধা। চব্বিশ দিন একটানা মহাশূন্যে অবস্থানের পর গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন তাঁরা মৃত অবস্থায়। মানুষের জ্ঞান ভান্ডার কে বাড়ানোর জন্য এই তিনজন বীর প্রাণ দিয়েছেন। বাংলাদেশ বাসি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাঁদের এই বীরত্বগাথা কে।

মুক্তিযুদ্ধে আপনার করণীয় কি ?

পাঞ্জাবি শোষক গোষ্ঠীর তল্পিবাহক ইয়াহিয়ার সরকার স্বাধীন বাংলাদেশে যে নারকীয় হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে তার নজির ইতিহাসে নেই। মূলে ইসলাম, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, এক জাতির বুলি আওড়িয়ে সে তার পশুর সৈন্যদের হিংস্র কুকুরের মত লেলিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে। সারাদেশে সৃষ্টি করেছে এক বিভীষিকার রাজত্ব, ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। স্বাধীন বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ, বাঙালি জাতির গৌরব তাদের পীঠস্থান। বাংলাদেশকে এই দানবীয় পিশাচের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য আজ বাংলাদেশের মুক্তিকামী সমস্ত জনতা ইস্পাতকঠিন শপথের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আজ রক্তের শপথ নিয়েছে বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা, তারা আজলা ভরে বুকের রক্ত ঢেলে দেবে, বিনিময়ে স্বাধীন বাংলার বুক থেকে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করবে। সুতরাং লড়ছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা। সিংহের মতো তারা ওৎ পেতে বসে থাকে সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাক সৈন্যের উপর নির্মমভাবে হত্যা করছে হানাদার দস্যু পাকসেনাদের। প্রতিদিন শত শত্রুর রক্তে স্নাত হয়ে বাংলার মাটিকে করছে কলুষমুক্ত। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে, অপূর্ব বীরত্বে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরেছে পাকসেনা। প্রতিদিন শত শত পাকসেনার মৃত্যুতে পাক সেনাবাহিনীতে হাহাকার উঠেছে। তারা আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছে এমনিভাবে আর কিছুদিন যুদ্ধ চললে বাংলাদেশ থেকে আর একটিও পাক সৈন্যও জীবিত ফিরে যেতে পারবে না।মুক্তিযোদ্ধাদের অতুলনীয় বীরত্বে সারা বিশ্বের মানুষ আজ বিস্মিত মুগ্ধ তাদের অপূর্ব সাফল্যে আজ শত্রুদের অন্তিমদশা উপস্থিত।

বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কর্তব্য করে যাচ্ছেন, একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। তাদের অজেয় দেশপ্রেম,  তাদের ত্যাগ,  তাদের অপূর্ব নিষ্ঠা সারা বাঙালি জাতিকে এক গৌরবময় মহিমা দান করেছে।

মুক্তিযোদ্ধারা যেমন তাদের কর্তব্য করে যাচ্ছেন অপূর্ব নিষ্ঠার সাথে তেমনি আজ বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের একান্ত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিটি কাজে সর্বতোভাবে সাহায্য করা। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করছে দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, মধ্যবিত্ত সমগ্র জনসাধারণের সক্রিয় সমর্থনের ওপর।

মুক্তিযোদ্ধারা যেমন এদেশের কৃষক শ্রমিক জনতার শ্রেষ্ট সন্তান, তেমনি বাংলাদেশের মানুষকেও, মুক্তিযোদ্ধাদের একান্ত আপন জন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের নিরাপত্তা এবং সাফল্য সম্পূর্ণরূপে গ্রামের কৃষক, শ্রমিক জনতার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। বর্তমান যুদ্ধে অবলম্বিত গেরিলা যুদ্ধের নীতিই হলো শত্রুর সন্ধান নেওয়া, শত্রুকে অতর্কিত আক্রমণ করা, ধ্বংস করা এবং নিজেকে রক্ষা করা। সুতরাং, শত্রুর সন্ধান নিতে হলে, শত্রুকে অতর্কিত আক্রমণ করতে হলে সর্বশেষে গেরিলাদের আত্মরক্ষা করতে হলে সংঘর্ষের এলাকার এবং তার চারপাশের এলাকার কৃষক শ্রমিক জনতার সক্রিয় সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুর চোখ এড়িয়ে শত্রুকে আক্রমণ করতে সাহায্যও তারাই করবেন। তাছাড়া শত্রুকে আক্রমণের আগে এবং দ্রুত পশ্চাৎ অপসরণের সময়েও আশ্রয় দিয়ে সাহায্যও তারাই করবেন। একথা অনস্বীকার্য যে আজ মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামের একদল অনুচর শত্রুকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে। এরা সবসময় চেষ্টা করছে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুকে চিনিয়ে দিতে। এদের ঘৃণ্য প্রচেষ্টায় এরা যদি সাফল্য লাভ করতে পারে তাহলে মুক্তিযুদ্ধে এরা চরম ক্ষতি সাধন করবে। সুতরাং, বাংলাদেশের মানুষের প্রথম কর্তব্য হবে এই সমস্ত শত্রুর দৃষ্টি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করা। তাহলে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের আশু করণীয় হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির সাথে যোগাযোগ রাখা, শত্রুর গতিবিধির খবর গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে পৌছিয়ে দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়া, তাদের সাহায্য করা, শত্রুকে এবং শত্রুর চরদেরকে ধ্বংস করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা। এছাড়া তাঁরা নিজেদের প্রচেষ্টা চালিয়েও শত্রুর চরদের খতম করবেন। গ্রামকে শত্রু চর মুক্ত করতে না পারলে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহায়কদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।

উপরে উল্লিখিত উপায়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করতে হলে গ্রামগুলোকে সংগঠিত হতে হবে।  নিঃসন্দেহে এ কথা বলা চলে যে, মুষ্টিমেয় শত্রুর অনুচর ব্যতিরেকে সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকূলে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে একথাও একান্ত সত্য যে গ্রামে দু’একটি শত্রুচর  থাকলেও গেরিলা যোদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারীগণ কেউ নিরাপদ নযন। সুতরাং সুযোগ পেলেই শত্রুকে খতম করে দিতে হবে।

পৃষ্ঠা-দুই

 

“——আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম!”

সম্পাদকীয়

তোমরা তোমরা আমরা আমরা

আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত তার অসংখ্য কর্মী ও সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে তথাকথিত পাকিস্তান সরকারের প্রচারক যন্ত্রগুলো কতকগুলো বিশেষ বিশেষণ ব্যবহার করে থাকে।  সরাসরিভাবে প্রকৃত নাম উচ্চারণ করার বাধা কোথায় আমরা তা বুঝি না।  বিশেষণগুলো হলো—দুষ্কৃতিকারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, দেশদ্রোহী, ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি।  

        এই বিশেষণগুলোর ব্যবহার পাকিস্তান সরকারের পক্ষে যদি নেহাৎ লজ্জা জনিত হয়ে থাকে আমাদের কিছু বলার নেই। কারণ বৃদ্ধা স্ত্রীরোকটিকে যখন তার স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তখন লজ্জাবনত ভাবে সে বলেছিল 

           “বিশেষণে সবিশেষ কহিবারে পারি

              জান সে স্বামীর নাম নাহি ধরে নারী”

সরাসরিভাবে স্বামীর নাম উচ্চারণ করতে ইয়াহিয়া সরকারের যদি বাধে তাহলে আমাদের বলার কেই বা থাকতে পারে। এটা হল তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এই বিশেষণগুলোর ব্যবহার যদি ঘৃণা জনিত হয় অথবা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা এবং অগণিত স্বাধীনতাকামী মানুষের নাম স্মৃতির অন্তরালে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের অবশ্যই কিছু বলার আছে।

ইয়াহিয়া খানের জানা দরকার শেখ মুজিব শুধু মুক্তিপাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতাই নয়, শেখ মুজিব কৃষক-শ্রমিক-জনতা ও আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার ‘মুজিব ভাই’। শেখ মুজিব একটি নাম– একটি ইতিহাস। এ নামের প্রভাবে একদিকে যেমন সাম্রাজ্যবাদী, সামন্তবাদী, আমলাতন্ত্র, সামরিক জান্তা ও যাবতীয় কায়েমী স্বার্থবাদীদের প্রাসাদ চক্র খান খান হয়ে ধুলায় লুণ্ঠিত হতে  চলছে অন্যদিকে তেমনি বঞ্চিত লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসাবে জন্মলাভ করেছে। তার নেতৃত্বে ত্যাগ তিতিক্ষা নির্যাতন ও অগ্নিপরীক্ষায় পরীক্ষিত। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে গিয়ে আজ বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত। তার অলোকিক জনপ্রিয়তা আজ বাস্তব কঠিন বাস্তব। তার অপরিসীম সংগঠনী ক্ষমতা আজ সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। মুজিবের আর এক নাম সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামের জন্ম হয়েছে মানবাধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও দুঃস্থমানবতার সেবায় নিয়োজিত দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামীলীগের অঙ্গনে। যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম, পরিস্ফুটন পরিব্যপ্তি এবং অসাধারণ বিস্তৃতি ঘটেছে নিরলস নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও সাধনার মধ্য দিয়ে। নির্বাচনে শতকরা সাড়ে আটানব্বইটি আসন ও শতকরা ৮১ জনের সমর্থন লাভ করা একমাত্র ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিষ্কলুষ সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত জনপ্রিয়তার মাধ্যমেই সম্ভব। অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন সশস্ত্র বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়ে সুদীর্ঘ ৪৩ বছর লেগেছিল ভারতের স্বাধীনতা লাভ করতে। আর ২৫মার্চ পর্যন্ত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন করে রাতারাতি সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়ে মাত্র তিন মাস মুক্তিফৌজের সাথে অসম যুদ্ধের পর আধুনিক সমনাস্ত্রে সুসজ্জিত ইয়াহিয়ার বাহিনীর নাভিশ্বাস উঠেছে। এটা সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের সংগঠনী শৃঙ্খলা এবং নেতৃত্বের প্রতি অটুট আস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।

আর মুক্তিফৌজ ও আওয়ামীলীগ এরা একে অপরের পরিপূরক। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত । হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার কঠিন শপথ তারা আবদ্ধ।

        কাজেই আওয়ামীলীগ  এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ইয়াহিয়া কিভাবে উচ্চারণ করলো বা না করলো তাতে কিছু যায় আসে না।  তাদের পরিচয় সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মনের মণিকোঠায় ও বিশ্বমানবতার হৃদয় মন্দিরে।  স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।  সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জাতি হিসেবে একটি স্বাধীন সত্তা আর ইহা বেঁচে থাকবে এর ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নিয়েই। এই মহাসত্যকে বানচাল করার ক্ষমতা ইয়াহিয়া খানদের নাই। তাদের প্রতি আমাদের কথা মাত্র একটি। “তোমরা তোমরা আমরা আমরা। তোমরা ও আমরা মিলে ভবিষ্যতে যে তাহারা হবে এটাও অসম্ভব।

পৃষ্ঠা-তিন

 

“আমাদের বাঁচাও, আরও সৈন্য, গোলা পাঠাও” 

মুক্তিফৌজ বেষ্টিত পাক সেনাদলের আর্ত্ত বার্তা

পাক সেনাবাহিনীর মেজর কোটি ৫৭ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা নিয়ে উধাও

“আমাদের বাঁচাও, দ্রুত আরও সৈন্য ও গোলাবারুদ পাঠাও।  তিন দিক থেকে মুক্তিফৌজ মর্টার ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ঘিরে ফেলেছে।” সম্প্রতি বাংলাদেশের কোন এক স্থান থেকে দখলদার সামরিক হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে একটি পা্ক সৈন্য ইউনিটের এই আত্মচিৎকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনিটারে ধরা পড়ে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে দখলদার সামরিক কন্ট্রোলের কাছে প্রেরিত আরো কয়েকটি বার্তা ও রেডিওগ্রাম মনিটারের মাধ্যমে ধরা পড়ায় এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে সেখানকার সব স্বাভাবিক বলে সামরিক কর্তারা হরদম যে প্রচার চালাচ্ছে তা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।  আরও বোঝা যায় যে, সবচাইতে যেটা সেখানকার সামরিক কর্তৃপক্ষকে বেশি করে ভাবিয়ে তুলেছে তা হচ্ছে মুক্তিফৌজের ক্ষিপ্রগতি  আক্রমণের অনিশ্চয়তা।

ওইসব বার্তা থেকে এও বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের সব স্বাভাবিক নয়। সামরিক অফিসারদের মধ্যে লুটতরাজের প্রবণতা ধাপে ধাপে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে জনৈক অফিসার কিছুকাল হল এক ব্যাংক থেকে ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা তুলে সেই ব্যাংক থেকে উধাও হয়েছেন বলে মনিটার করা এক বার্তায় ধরা পড়ে। পাক সামরিক প্রশাসনের অব্যবস্থা সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে অসন্তোষ এর মাত্রা দিন দিন বাড়িয়ে তুলছে ।

প্রথম যে বার্তাটি (কল নং ৬২) মুক্তিফৌজ মনিটার করে ধরে তাতে বলা হয় যে, পাকিস্তান বাহিনীর একটি ইউনিটের লোকেরা গত দুমাস ধরে বেতন পায় নি।  ফলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান অর্থনীতির উপর নানা কারণে ক্রমশ চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে নিযুক্ত পাক সৈন্যরা গত কয়েক মাস থেকে নিয়মিত বেতন পাচ্ছে না এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারছে না। এর ফলে পাকবাহিনীর বেশ কিছু লোকের মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠেছে।

আর একটি বার্তা দখলীকৃত বাংলাদেশের একজন অফিসারের কাছে থেকে আর একজন সামরিক অফিসারের কাছে প্রেরিত একটি রেডিওগ্রাম।  এ বার্তায় বলা হয় যে জামশেদ নামে একজন আই-জি আর একজন সামরিক অফিসার কে জানাচ্ছেন, ২৯ এপ্রিল মেজর মাদূত নামে একজন সামরিক অফিসার একটি ব্যাংকে গিয়ে ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা তোলেন এবং সেই থেকে উধাও হযন। সামরিক কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত না সে অফিসার না সে টাকার হদিস করতে পেরেছে।

 বৃহস্পতিবার সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া এক সংবাদে আরও জানা যায় যে, রংপুরের মনকাচরের কাছে এক নৌ-সংঘর্ষে পাক বাহিনীর কাছ থেকে মুক্তিফৌজ  তিনটি স্পিডবোট ছিনিয়ে নেয়।

 গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এক সংবাদে আরও জানা যায় যে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ১৩৫০ মাইল আসাম মেঘালয়ের ৬২০ এবং ত্রিপুরা সঙ্গে ৫৫৭ এই ২৫৫৪ মাইল সীমান্ত স্থায়ীভাবে দখলে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সামরিক প্রশাসন বজায় রাখতে মোট ৭ ডিভিশন সৈন্য দরকার বলে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ মনে করছেন। বর্ষা শুরু হয়েছে এবং বর্ষন প্লাবনের দুর্যোগে গেরিলা বাহিনীর অনিশ্চিত আক্রমণকে পর্যুদস্ত করার জন্য পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ৫ ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের জন্য আরও ৩ ডিভিশন সৈন্য ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে।

 ওই সূত্র আরও জানা যায় যে, বাংলাদেশের জন্য এই বিপুল বাহিনীর ব্যয় বহন পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষকে এক বিরাট সংকটের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। প্রতি ডিভিশনে সাধারণ ও অফিসার মিলে ১৬,০০০। মাথাপিছু বেতন ছাড়া অন্যান্য ব্যয়ের পরিমাণ মাসিক ৭০০ টাকার মত পড়ছে। এ হিসেবে প্রতিটি ডিভিশনের জন্য মাসিক ব্যয় হচ্ছে ১ কোটি ১২ হাজার টাকা। ৫ ডিভিশনের জন্য মাসিক ব্যয় হচ্ছে ৫ কোটি টাকার উপর। বেতন বাবদ ব্যয়ও ছয় থেকে সাত কোটি টাকার মতো। এছাড়া আরো তিন ডিভিশন সৈন্য বাহিনী গড়ে তোলার ব্যয়ও কয়েক কোটি টাকা। এই বিপুল ব্যয় ভার  বহন করা ক্রমশ পাকিস্তান সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে বলে এই সূত্রে জানা যায়।

 ওই সূত্রে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট ঘনিয়ে আসার ব্যাপারে চারটি কারণ উল্লেখ করা হয়:

(১) বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর দখল বজায় রাখার ব্যাপারে সৈদ্যদের খাদ্য রসদ ইত্যাদি পাঠানোর ক্রমবর্ধমান অসুবিধা। কারণ মুক্তিফৌজ অনেক অঞ্চলে রেল সেতু ইত্যাদি উড়িয়ে দিয়েছে, পথঘাটের ক্ষতিসাধন করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

(২) চা, পাট, চামড়ার উৎপাদন ও ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে।

(৩)  পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প ব্যবস্থা ব্যবসায় বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছে । কারণ সেখানকার শিল্প ব্যবস্থা বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল এবং (৪) পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে এবং ক্রমশ বন্ধ হতে চলছে।

ইয়াহিয়ার প্রলাপ

পাকিস্তানের সমর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আগা মুগাম্মদ ইয়াহিয়া কান মুখ খুলেছেন। ২৬ শে মার্চের পর এই তার প্রথম বক্তৃতা। তিনি ৫৫ মিনিট ধরে বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু তার এই বক্তৃতার মধ্যে ফুটে উঠেছে ব্যর্থতার সূর। পরাজিত কন্ঠ। আগের আসফালন আর তেজ ছিল না তার কণ্ঠে।যে সমর নায়ক ভেবেছিলন মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সারা বাংলাদেশের প্রতিরোধকে তিনি চূর্ণ করে দিতে পারবেন, তার সমস্ত স্বপ্নই ব্যর্থ হয়েছে। তিনি ও তার সেনাবাহিনী জড়িয়ে পড়েছেন এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। তিনি আজ বিশেষভাবে ভাবিত তার এবং তার সেনাবিাহিনীর ভবিষ্যত নিয়ে। সেনাবাহিনীর বিপযয়ের সাথে সাথে অর্থনৈতিক সঙ্কটও তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি ব্যয়সংকোচনিীতির কথা বলেছেন। তিনি দূঃখ করেছেন, বিদেশ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা ছাড়তে হবে।কারণ, সাহায্যকারী দেশগুলো পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। তার ভাষায় এটি হচ্ছে পাকিস্তানের অভ্যান্তরিন ব্যাপারের হস্তক্ষেপের সামিল। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। একদিকে বাংলাদেশে পাক বাহিনীর সামরিক ব্যর্থতা অন্য দিকে অর্থনৈতিক সঙ্কট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে চিন্তা ক্লিষ্ট করে তুলেছে। তিনি বলেছেন বর্তমান অবস্থায় পাকিস্তানে সামরিক শাসন উঠিয়ে নেওয়া যায় না। তাকে আরো কিছু দিন চালাতে দিতে হবে। এদিকে পাক বেতার থেকে ঘোসণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের অবস্থা শান্ত। অন্যদিকে ইয়াহিয়াকে স্বীকার করতে হচ্ছে, অবস্থা শান্ত হয় নি। আর সেই জন্যই দেশে এখনও সামরিক শাসন প্রয়োজন। পাক জঙ্গীশাহীর মিথ্যা প্রচার আজ বিশ্বের কাছে নগ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে।

বিশ্বের অনেক দেশ আশা করেছিল ইয়াহিয়া তার বক্তৃতায় জন সাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা করবেন এবং তার বক্তৃতার মধ্যে থাকবে জনগনের দাবীর স্বীকৃতি ও বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথা। কিন্তু এসব কিছুই নেই তার বক্তৃতার মধ্যে। তিনি এখনো ভাবছেন, সেনা শক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখবার কথা। ভাচছেন বাহু বলে হয়তো শেষ রক্ষা হবে। তার আসল লক্ষ্য এখন কয়েক মাসের মধ্যে একটি মাত্র পথ পরিষদ খাড়া করে, কেন্দ্রে এবং প্রদেশে হাতের পুতুল সরকার তৈরি করে যতদিন পারা যায় টিকে থাকা। তিনি বলেছেন, বর্তমান অবস্থায় গণ পরিষদের মারফত কোন সংবিধান রচনা সম্ভব নয়। তিনি নিজে যে সংবিধান রচনা করে দিবেন, তাকেই মোটামুটি স্বীকার করে নিতে হবে গণপরিষদকে। কিন্ত গণপরিষদ মারফত সংবিধান রচনা করা সম্ভব নয় কেন? তার এই নীতি পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হবে কি না সন্দেহ। ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র আজ সকলের চোখেই গণতন্ত্র ও মানব অধিকারের শত্রুরূপে চিহ্নিত হতে চলেছে।  ইয়াহিয়াও জঙ্গীবাদের নগ্নরূপে আজ প্রকাশিত হয়ে পড়েছে সকলের সন্মুখে। তাদের কথা ও যুক্তির অসংগতি আজ আর কার পক্ষে ধরা অসম্ভব নয়। তাদের নিজের কথাই যাচ্ছে তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে। একদিকে তারা বলছেন বাংলাদেশের অবস্থা তাদের আয়ত্তে। আবার তারাই বলছেন বর্তমান অবস্থায় সংবিধান রচনার গণপরিষদের পক্ষে সম্ভব নয়। সামরিক শাসন দরকার দেশের নিরাপত্তার জন্য।

 আমরা বাঙালিরা আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছি। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো সমাধান আমরা মেনে নেব না। মুক্তিসংগ্রাম এগিয়ে চলছে । শত্রুসৈন্য প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করছে বাংলাদেশের মাটিতে। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই একদিন শেষ নিশানা ঘুচে যাবে জঙ্গীবাদের।

 বিশ্বের যেসব শক্তিবর্গ ভাবছিলেন বাংলাদেশের সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব, ইয়াহিয়ার বক্তৃতা নিরাশ করবে তাদের। যারা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলতো এখন আর কোন কথা বলার অবকাশ থাকবে না তাদের। সারা পৃথিবী আজ বুঝছে ইয়াহিয়া ও সামরিক বাহিনী বিষয়।  আমাদের সংগ্রামের পথে আজ আর তাই থাকছে না কোনো রাজনৈতিক বাধা। সমস্ত জনমত এখন কাজ করবে আমাদের পক্ষে।

 ইয়াহিয়া ও জঙ্গীশাহী  প্রমাণ করেছে তারা কোন রাজনৈতিক সমাধান চায় না। তারা এখনও ভাবছে বন্দুকের মারফত সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। অস্ত্রের ভাষার উত্তর দিতে হবে অস্ত্রের ভাষায়। অন্য কোন ভাষা বোঝানো সামরিক শাসন। শত্রুকে নির্মূল না করা অবধি চলবে সশস্ত্র সংগ্রাম। বাঙ্গালী আজ ঐক্যবদ্ধ।  তার লক্ষ্য আজ পরিষ্কার । চূড়ান্ত বিজয় তার হবেই। জয় বাংলা।

পৃষ্ঠা-চার

মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের অর্থনীতি

কামাল মাহবুব

আধুনিককালে কোন ব্যক্তির পক্ষে যেমন বৃহত্তর জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব নয়, তেমনি কোন রাষ্ট্র বা দেশের পক্ষে সম্ভব নয় অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের আওতামুক্ত হয়ে এককভাবে পরিচালিত হওয়া। বর্তমান সময়ে একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অন্য রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হতেই হবে-তাও সে যত বৃহৎ শক্তি না কেন। এর কারণ হচ্ছে অর্থনীতি। কোন দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও দেশের একক অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। পাকিস্তানের মতো দরিদ্র দেশের তো নয়ই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক প্রেরণা হলো অর্থনৈতিক মুক্তি। বিগত ২৩ বছরের বাঙালির ইতিহাস শোষণ-বঞ্চনা আর নিঃস্ব হওয়ার করুণ কাহিনী । একই রাষ্ট্র নামে পরিচিত হয়েও উপনিবেশিকতার এহেন  ছদ্মবেশ ধারণের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাকিস্তানের বাইশটি ধনকুবের পরিবার দেশকে এক ঘাটে বিক্রি করে অন্য ঘাট থেকে ক্রয়ের ক্ষমতা রাখেন। দেশের সমগ্র অর্থনীতি এদের করতলগত।  রাজনৈতিক উত্থান-পতনের এরা প্রত্যক্ষ দৃশ্যমান না হলেও, সমুদয় দৃশ্যাবলী কে নিয়ন্ত্রণ করেন।

মূলতঃ এই বাইশটি পরিবারের ষড়যন্ত্র দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে পশ্চিমাদের কব্জায় ও কলকব্জায় সঞ্চিত রেখেছে । বাংলাদেশের সকল সম্পদ লুন্ঠন করে গড়ে উঠেছে ইসলামাবাদে আকাশচুম্বী ইমারত। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অপরিসীম বৈষম্য পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের ভান্ডার ফাঁপিয়ে তুলেছে, আর আর দিনের পর দিন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হয়েছে রিক্ত, নিঃস্ব, সর্বহারা।

অর্থনৈতিক চক্রান্তের করুন শিকার বাংলাদেশের মানুষ দুর্ভাগ্য ও দুর্দশার সর্ব শেষ প্রান্তে এসে ঠেকেছে। পশ্চিমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক হয়ে দাঁড়াল ঋণগ্রহীতা ও ঋণ প্রদানকারীর পর্যায়ে।  ক্রমান্বয়ে ওরা হল বিক্রেতা আমরা খাদ্দের, ওরা হল মালিক আর আমরা শ্রমিক,  ওরা মহাজন আর আমরা মহা অভাজন । সম্মুখ যুদ্ধ নয় , অর্থনৈতিক পৃষ্ঠদেশে গুপ্তাঘাত করে দিনে দিনে আমাদের রক্ত শোষণ করল ওরা।  ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ হয়ে  উঠল একটি বিক্রয় কেন্দ্র।  শুধু এক কাপড় বিক্রি করেই এদেশের কোটি কোটি টাকা ছিনিয়ে নিল ওরা।  পাকিস্তানের আদর্শবাদীতা নয়, ধর্মীয় আবেগ অনুপ্রেরণা নয় inকিংবা রাষ্ট্রীয় সংহতিও নয়, ঐ  অর্থনৈতিক বাজার রক্ষার মোহেই বাংলাদেশকে মুক্তিদানে ওদের চরম অনীহা।  বাংলাদেশের মতো একচেটিয়া বিক্রয়স্থল পশ্চিমা পুঁজিপতিদের কাছেস্বর্গদ্যানসম। তা থেকে ব্রষ্ট হওয়ার নীতি ওরা কোনোকালেই অবলম্বন করতে চায় নি। তাই বিগত তেইশ বছরের বাংলাদেশ উপনিবেশিকতার নির্মম আলেখ্য।

         অথচ বাংলাদেশে এত কাল যুগিয়েছে পাকিস্তানের আয়ের সিংহভাগ।  বুকের রক্ত জল করা বাঙালির পাট বিক্রির টাকায় অর্জিত হয়েছে অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা।  আর সেসব মূদ্রা ব্যয়িত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমিকে সুজলা-সুফলা করার জন্য।  অন্যদিকে, সোনার বাংলার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেছে ধীরে ধীরে।  পশ্চিম পাকিস্তানে জমির লবণাক্ততা দূরীকরণে আমরাই যোগাই যাবতীয় অর্থ,  আর বাংলাদেশের সর্বনাশা বন্যার তান্ডব লীলাকে রোধ করার জন্য অর্থের অভাব চিরাচরিত ঘটনা। 

         সাড়ে সাত কোটি বাঙালির দুর্ভাগ্যজনকে অর্থনীতির প্রথম প্রতিরোধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রদত্ত ঐতিহাসিক ছয় দফা।  বাংলাদেশের সৃস্পষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষমতা, বৈদেশিক বাণিজ্যসহ অন্যান্য অরাথনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় ছয়দফা একটি রক্ষাকবচ– যা প্রতিটি বাঙালীর ন্যায় সঙ্গত দাবী। এই অর্থনৈতিক মুক্তি লাভের জন্য জনগনের সমর্থনের ঐক্যবদ্ধ রায় বিগত সাধারণ নির্বাচন।

          বিশ্বাসঘাতকতার অপর নাম ইয়াহিয়া খান। পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের তল্পিবাহক ইয়াহিয়া সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আর্থিক মুক্তি ধুলিস্যাৎ করতে চেয়েছে বিমান ট্যাংক আর যুদ্ধজাহাজ চালিয়ে। একটি দেশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের অভিনব পদ্ধতি সত্যি কি চমৎকার!

         কিন্তু ইয়াহিয়ার পৈশাচিক ক্রিয়াকাণ্ড বাংলাদেশের অস্ত্রপ্রচার করতে গিয়ে খুন করে বসল পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিকে। বাংলাদেশের বাজারে মাল পাঠানো বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে পশ্চিমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় লকডাউন ঘোষণা ছাড়া উপায় রইল না ।ফলে রুষ্ট ছাঁটাইকৃত শ্রমিক অসন্তোষে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান ধূমায়িত হল। বাংলাদেশের মতো নির্ভেজাল বিকল্প বাজার রাতারাতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আর তাই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধসে পড়ার উপক্রম করল। অর্থনীতির বিপর্যয় সাধন করে আজ পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের দৃষ্টিতে ইয়াহিয়া খান অনর্থ বাধিয়ে বসেছে। এরই নাম সম্ভবত স্বীয় নাসিকা কর্তন করে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করা।

 পাকিস্তানের তালি মারা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ইয়াহিয়ার ভাতা ও ত্রাতা এম এম আহমদ বিশ্বভিক্ষায় বেরুল। কিন্তু ততদিনে বাংলাদেশের স্বাভাবিক অবস্থার স্বরূপ সুস্পষ্ট হয়েছে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে। পঁচিশে মার্চের পর থেকে যে অসাধারণ স্বাভাবিক অবস্থা বাংলাদেশ ইয়াহিয়া সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, তাতে প্রমাণিত হল বিগত তেইশ বছরের অবস্থা কি অস্বাভাবিক ছিল। এহেন স্বাভাবিক অবস্থাকে জিইয়ে রাখার জন্য চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন হল। চীনের পোষ্যপুত্র হয়েও বিপর্যয়ের ঘনঘটা কিন্তু কাটেনি।  পাকিস্তানের গৌরী সেন বিশ্বব্যাংক পৌরাণিক পরিচ্ছদ ত্যাগ করে অর্থ প্রদানে গড়িমসি করায় অবস্থা মুমুর্ষূ আকার ধারণ করেছে।

 এদিকে বিশ্ববাজারে পাকিস্তানি পন্যতরীর ভরাডুবি অবস্থা।  ব্রিটেনের বাণিজ্য ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক গ্যারান্টি সংগ্রহে প্রত্যাখ্যাত হয়ে লোকসানের আয়নায় লোকসানের চেহারা দেখে আতঙ্কিত হল শাসকগোষ্ঠী ।  ওদিকে পাকিস্তানী টাকার মূল্যমান নেমে এসেছে এক ডলারের বিনিময়ে ২০ টাকায়। অন্যের ঘরে আগুন দিতে গিয়ে ইয়াহিয়া খান নিজের ঘরে অগ্নিকাণ্ড বাঁধিয়ে বসেছে।

 তবুও যুদ্ধ চালাতে হবে বাংলাদেশে। গত মাসের এক সামরিক নির্দেশ জারি করে সৈন্যবাহিনীকে হুকুম করা হয়েছে — “লিভ অন দ্য ল্যান্ড“।  সৈন্যবাহিনীর রসদ সরবরাহ অসম্ভব হয়ে উঠেছে এখন।  সুতরাং বাঙালি গ্রামবাসীদের কাছে থেকে কলাটা মূলোটা নিয়ে দিন চালাও।  এতে তোমাদের জীবন ধারণ আর বাঙ্গালীদের জীবননাশ দুই উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হবে। অত্যাচারী সামরিক জল্লাদ অন্য এক ফরমানে বাস্তুত্যাগী বাঙ্গালীদের সম্পত্তি ও ধানপাট বিক্রি করে  রাজকোষাগারের অর্থ সঞ্চয় আদেশ দিয়েছেন।  কিন্তু এতদ্ সত্ত্বেও কিছুই কুলাচ্ছে না। একে তো বাঙ্গালীদের পাটচাষ পনেরো আনা বন্ধ হয়ে গেছে, অন্যদিকে সিংহলের উপর দিয়ে বিমান ও জাহাজ ঘুরিয়ে আনার ব্যয়ভার কম নয়। তারপর, যুদ্ধচালনার শ্বেতহস্তি প্রতিপালন কি যে অস্বাভাবিক ব্যাপার !

পাকিস্তানের এহেন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিবাহিনী। সামরিক প্রতিরোধের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলেছেন যাঁরা। স্বাধীনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় উদ্দীপ্ত প্রতিটি বাঙালি ট্যাক্স বন্ধ করে এবং পাট চাষের বদলে ধানের ফলনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সামরিক সরকারের জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে।  সামরিক যুদ্ধে না হোক, অর্থনৈতিক যুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রত্যেকেই আজ সৈনিক। বাংলাদেশের চোরাবালিতে তাঁরা ইয়াহিয়ার মৃত্যুশয্যা পেতে রেখেছেন।

 অর্থনৈতিক মুক্তিই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের একান্ত বাসনা।  মুক্তিযুদ্ধের দুর্জয় সংকল্পে সমগ্র জাতি এখন সেই আকাঙ্ক্ষার চরিতার্থের সুযোগ লাভ করেছে।  সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হাতে আজ সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র,  অর্থনৈতিক অবরোধ।  মেশিনগানের চাইতেও ভয়ংকর এই অস্ত্রে পাকিস্তান দেখতে পেয়েছে তার মৃত্যুর অনিবার্য ইশারা। 

          আজ সেই সুবর্ণ দিন প্রত্যাগত যখন রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া খানের একটি মাত্র পথ অবশিষ্ট থাকবে। তা হলো —  সমগ্র নিলামে তুলে বাংলা থেকে রক্তপাত অব্যাহত রাখা।  কিন্তু সে রক্তধারা হবে হানাদার বাহিনীর দেহ-ক্ষয়িত।  শ্ত্রু সৈন্যর রক্তস্রোতে  স্নাত হয়ে স্বাধীনতার সূর্য পূর্ব দিগন্তে উদ্ভাসনের প্রতীক্ষায় রয়েছে।

পৃষ্ঠা- ছয়

 

রাজশাহীতে জঙ্গিশাহীর বর্বরতা

অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ

সেদিনের কথা ভুলবো না। পুলিশ লাইনে পুলিশের সঙ্গে পাক সেনাদের যুদ্ধ হচ্ছে । আঠারোটি  ঘন্টার যুদ্ধ। পুলিশের হাতে রাইফেল, পাক সেনারা ব্যবহার করছে গোলা ও মর্টার।  একটা অসম যুদ্ধে যা হতে পারে, এ যুদ্ধেও হয়েছিল ঠিকতার তারিখটা মনে আছে ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সাল স্থান রাজশাহী শহর। পুলিশ বাহিনী প্রকৃত দেশ প্রেমিকের মতো লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেছে, বাকি আহত ও অন্যান্যরা হটে গেলেন রণক্ষেত্র থেকে। পুলিশের সম্বন্ধে আমার ধারনা সে দিন পাল্টে গিয়েছিল। পুলিশের নিন্দা না করে জল গ্রহণ করা বাঙ্গালীর স্বভাব ছিল না, দুনিয়ার তাবৎ অপরাধ পুলিশের ঘাড়ে চাপাতে পারলে তবেই আমাদের অপরাধবোধগুলি শান্তি পেত। সেই পুলিশ ভাইরা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বাংলা ও বাঙালির প্রথম মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। শহীদ হয়েছে, পুলিশের সমস্ত দোষ ত্রুটি অপরাধকে মহাপুণ্য রক্তে ধুয়ে পবিত্র করে দিয়ে গেছে। বারংবার সেই পুলিশ ভাইদের প্রতি আমার মাথা নত হয়েছে। সেলাম আমার শহীদ ভাইরা, সেলাম জানাই তোমাদের, সেলাম আমার পুলিশ ভাইরা, তোমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছো, সেলাম তোমাদের। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী অমর হও।

আজ মনে পড়ছে, বড্ড বেশি মনে পড়ছে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কথা। পরনে লুঙ্গি,  গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবী,  পায়ের চপ্পল, মুখে শুভ্র দাড়ি এবং মাথায় টুপি।  সভায় এসে দাঁড়াতেন, চারিদিকটা দেখে নিতেন এবং তারপর বলা শুরু করতেন। বলতেন, এই যে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার নামে শত শত পুলিশ আমার মিটিংয়ে পাঠানো হয়, সেসব অল্প মাইনের সেপাই ভাইদের কথা কি আপনারা জানেন? তারপর কিছুক্ষণ থামতেন। পরে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলতেন, তোমরা যখন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে সুখে থাকো, এমনকি এক দিনের ট্যুরে গেলেও বিবি কে সঙ্গে নিয়ে যাও, তোমরা কি একবারও ভাবো এইসব সেপাইদের কথা।  স্ত্রীর সোহাগ, পুত্র-কন্যার মুখের বুলি, মা বাবার স্নেহ থেকে তারা বঞ্চিত,  জীবন কাটে তাঁদের ব্যারাকে; শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় এই সেপাইরা দেশের শান্তি রক্ষা করছে –  কিন্তু তার বিবি কোথায়, বাচ্চারা কোথায়,  বৃদ্ধ মা-বাবা কোথায়?  সেপাই ঘুষ খেলে তা হয় আলোচনার বিষয়, তোমরা যে দিনে দুপুরে ডাকাতি করছো তার হিসেব তোমরা দিয়েছো?

না ওই সামান্য মাইনের সিপাইদের খোঁজ কেউ করে না। তাদের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে তথাকথিত ‘ভদ্রলোকেরা’ বিবেকের ময়লা পরিষ্কার করেন। নিজেদের পাহাড়প্রমাণ পাপ গোপন করার কি নির্মম প্রয়াস আমাদের। কিন্তু যেদিন মুহুর্ত এলো প্রকৃত সংগ্রামের আমার চির বঞ্চিত চির-অবহেলিত সেপাই ভাইর পরিচয় দিলেন বীর্যের, সাহসের  এবং মহান দেশপ্রেমের। আমার শহীদ সেপাই ভাইরা, তোমাদের লড়াইতে আমি ছিলাম না কিন্তু ছিলাম তোমাদের পাশে পাশে।  সামনের সারির হে বীর বাঙ্গালী শহীদ সেপাই বন্ধুগণ, ইতিহাস তোমাদের ভুলবেনা। বাংলাদেশের মান ইজ্জতকে তোমরাই তুলে ধরেছো। মা-বোনের লজ্জাকে তোমরাই রক্ষা করেছে।  জিন্দাবাদ বীর শহীদ ভাই, জিন্দাবাদ।

তিন মাস থেকে লড়াই চলছে এবং চলবে। সামান্য মাইনের সেপাইরা শহীদ হয়েছেন। সমস্ত পুলিশ লাইনগুলোতে যুদ্ধ হয়েছে, বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সবকিছু।  ব্যারাকের সেপাই ব্যারাকে ফেরেনি। আমার সেপাই ভাইদের সন্তানেরা কোথায়, তাদের বাপ-মা কোথায়? না,  কেউ তাদের খোঁজ জানেন না। কেউ সন্ধান করেননি তাদের তারাও কি জানেন, তাদের প্রিয় সন্তান জীবন দিচ্ছেন প্রতি দিনে  প্রতি মুহূর্তে। তাদের প্রিয় স্বামীরা কোথায় আছেন, জানেন না তারা। আর সেইসব শিশুরা, যারা বাবার ফেরার জন্য বসে ভাবছে।  হয়তো ভাবছে, বাবা এলে ভারি মজা হবে। বাবা কত সুন্দর সুন্দর খেলনা আনবে। বাবা কত গল্প বলবে, সেই সব শিশুরা দিন গুনবে, তবু বাবা ফিরবেন না। লজ্জানত বধু শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে কথা বলে না। শুধু কাঁখে কলসি করে জল আনতে গিয়ে  দিগন্তরে নিরুদ্দেশ পথের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, কত লোক তো আসে,  কিন্তু তার সেতো আসে না। এমনই কতদিন তাকাবে । একদিন আর তাকাবে না, শুধু কাঁদবে।  সমস্ত অন্তর জুড়ে হাহাকার পরিণত হবে এক সমুদ্র কান্নায়। মা খেতে বসবেন, ভাত মুখে নিতে গিয়ে মনে পড়বে ছেলের কথা। ভাত আর  নামবে  না গলা দিয়ে। গড়িয়ে গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়বে মায়ের চোখের জল। ভাত খাওয়ার আর হয়ে উঠবে না।  কে কবে আপন রক্তের ফুলকে মৃত জেনে খেতে পারে।  শিশুর কান্না,  বধুর কান্না আর মায়ের কান্না সব মিলিয়ে হবে এক কান্নাময় মহাসমুদ্র।

“মা মাগো,মা”–  ছেলেটি বারবার চেঁচিয়ে ডাকছে। পাশে দাঁড়িয়ে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক। জ্ঞান ফেরেনি তখনও।  ঘাড়ের আর গলায় গুলির আঘাত। কেউ বলছে বাঁচবে,কেউ বলছে বাঁচবে না। পরের দিন আবার গেলাম। দেখি তাকাচ্ছে। মুখটা ফ্যাকাসে, মাথার চুল গুলো কামিয়ে দিয়েছে। বললাম একটু ভালো বোধ করছ কি? চোখের ইশারায় কি যেন বলতে চেয়েছিলে। কিন্তু তার আগেই ওর অশ্রুর আভাস দেখা দিয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। হাত দিয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরলো। না বলা সমস্ত কথা আমার জানা হয়ে যায়। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে ফরিদ। পুলিশের নাম লিখিয়েছিল মাকে দুটো অন্ন জোগাতে পারবে বলে।  গোঁফের স্বল্প রেখা, টোপা টোপা গাল, ছেলে মানুষি দুটি ভীরু চোখ। বলছিলাম, তুমি কিছু খাবে ভাই? ফলমূল বা অন্য কিছু?  বলছিল না।  বলেছিলো এ মাসে তো কোন মাইনে পেলাম না।  জানেন মায়ের কাছে একটি পয়সাও হয়তো নেই। মার্চের সাতাশ তারিখের রাজশাহীর পুলিশ লাইনে ফরিদ লড়াই করেছিল। ফরিদ আমাকে বলেছিল শেখ সাহেব আটাশ তারিখে মাইনে দেবেন বলেছিলেন। মাইনে কি আমরা পাবো?  ফরিদ মাইনে পায় নি, মাকে টাকা পাঠাতে পারেনি। হাসপাতালে ওর একটু করে উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু তেসরা এপ্রিল শুরু হলো পাকসেনাদের বিমান আক্রমণ। হাসপাতালের ডাক্তার নার্চ ওয়ার্ড-বয় মেথর সবাই পালাতে শুরু করলো। আহত সেপাই ও অন্যান্য রোগীদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এমন নির্মম কাহিনী ইতিহাসে নেই। মানুষ হয়ে মানুষকে কি করে কেউ মারতে পারে? হ্যাঁ পারে,  ইয়াহিয়া এবং তার জল্লাদ সেনারা সব পারে। পারিনি শুধু আমরা,  পারিনি বাংলাদেশের শান্ত নিরীহ মানুষরা তাদের টাকায় এবং সম্পদ গড়ে ওঠা পাক সেনাবাহিনী নির্মমভাবে তাদেরই হত্যা করেছে। ভাতৃত্ববোধ আর ইসলাম ধর্মের নামে বাংলাকে শ্মশান করে,  বাঙালিকে ভিখিরী করে,  বাংলার সংস্কৃতির টুটি চেপে ধরে, বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করতে উদ্যত তারা।

রাজশাহী শহর থেকে আশ্রয় নিয়েছে গাঁয়ে। এক বাড়িতে গিয়ে দেখি একজন আহত সেপাই সেখানে শুয়ে আছেন বিছানায়। কথায় কথায় সেই সেপাই ভাইটি বলেছিল, “কি জানেন, যদি আমাদের হাতে গোলাপ থাকতো,  তাহলে ওরা কিছুতেই আমাদের সঙ্গে পেরে উঠতো না।  আমাদের হাতে শুধু রাইফেল,  তাও পুরনো ব্রিটিশ আমলের।  ওদের হাতে সব আধুনিক গোলাগুলি।”  বলতে বলতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।  ভুলে গেলেন তার ব্যথা-বেদনা।  বললেন,  লড়াইতে আমরা জিতব স্যার,  দেখবেন, আমরা জিতব। আমি জানতাম ওরা জিতেছে। নৈতিক দিক থেকেই শুধু নয়,  ওরা জিতেছে প্রকৃত যুদ্ধেও।  একদিকে ভাড়াটে পাক-সেনা,  অন্যদিকে দেশপ্রেমিক সেপাই ভাইরা। কে জিতেছে?  ইতিহাসের রায় সেপাই ভাইদের দিকে। এ রায় কেউ রুখতে পারবে না ।

জয় বাংলা।

পৃষ্ঠা- নয়

দর্পণ

আশরাফুল আলম

মা,

মুক্তিসেনাদের ক্যাম্প থেকে তোমাকে লিখছি। এখন বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। তাঁবুর ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সমস্ত দিগন্ত জুড়ে ভীষণ মেঘ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তাঁবুর কাছেই একটা ছোট্ট ডোবা পানিতে টইটুম্বুর। আজ সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে কি না তাই। সন্ধ্যার পর পরই তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি। বাইরে মেঘ, বৃষ্টির শব্দ, বিদ্যুতের চমক থেকে থেকে মেঘের ডাক সব মিলিয়ে মন্দ লাগছে না। আচ্ছা মা, সারারাত এমনই চলার পর সকালের ঝকঝকে আকাশে সূর্য ওঠে তার আলো খুব উজ্জ্বল হয় তাই না?

এই মুহূর্তে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। বর্ষা এলে আমাদের বাড়ির পাশের খালটা পানিতে ভরে যেত। তখন আর হেঁটে খালটা পার হওয়ার উপায় থাকত না। খালের উপর দিয়ে এক বাঁশের তৈরি সাঁকো দেওয়া হতো। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে সাঁকোর উপর দিয়ে আমি কিছুতেই খালটা পার হতে পারতাম না। কেউ জোর করে পার করতে চাইলে ভয় হয়তো কান্নাই জুড়ে দিতাম। শুধু মনে হতো খালে একবার পড়ে গেলে আমি আর উঠতে পারবনা। অথচ আমি আজ রাইফেল ধরতে শিখেছি। বাঙ্কারে রাতের পর রাত কাটাতে ভয় পাইনা। শত্রুর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে পাল্টা প্রচন্ড আক্রমণে তাদের বিপর্যস্ত করার মত দুর্জয় সাহস আমার রক্তে রক্তে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। মা আমি কি ভীষণ সাহসী হয়েছি তোমাকে বোঝাতে পারবোনা। ছোটবেলার সেই সাঁকো পার হওয়ার কথা মনে পড়লে, সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়।এখন আমার মধ্যে কি আশ্চর্য পরিবর্তিত সত্তা খেলা করছে। বাংলাকে আমরা যে ভালোবাসি।

মা ছোটবেলায় মেলায় গিয়ে আমি একবার হারিয়ে গিয়েছিলাম। মেলায় দিশেহারা হয়ে অনেকক্ষণ একলা একলা বেশ কিছুক্ষণ ঘুরলাম। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। আমার কেমন যেন কান্না পাচ্ছিল।  আমি হারিয়ে গেছি।  মনে হচ্ছিল আর কোনদিনই হয়তো তোমার কাছে ফিরে যেতে পারবো না।  উপায় না দেখে কাঁদতে কাঁদতে ভুল পথে বাড়ির পথ ধরলাম। সেই সে মা রসুলপুরের সেই বিরাট বটগাছটার কাছে আসতেই বুঝতে পারলাম ভুল পথে এসেছি। তখন চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিয়েছিলাম। স্কুলের মাস্টারমশাই ওই পথ দিয়ে আসছিলেন। তিনি আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেন। বাড়িতে এসে দেখি তুমি কাঁদছিলে। তুমি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলে। কতদিন আগের কথা, এখন সেসব কথা ভাবলে অবাক লাগে।

অথচ সেদিন তো তুমি কাঁদলে না মা। আমি রণাঙ্গনে চলে এলাম। গুলি সেল মর্টার নিয়ে আমার জীবন শুরু হল। ইয়াহিয়ার বর্বরতাকে রুখবার জন্য বুক বেঁধে দাঁড়ালাম। পশ্চিম পাকিস্তানের শত্রুদের দখলকৃত এলাকাকে মুক্ত করার জন্য দুর্জয় শপথ নিলাম এখন শত্রুর প্রতিরক্ষায় বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়। কখনো বা রাতের আধারে শত্রু ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালাই। আমাদের এ যুদ্ধ ন্যায়ের যুদ্ধ মা,  জিৎ আমাদের হবেই।

মা, সেদিনের সেই সন্ধ্যেটাকে আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে। আজকের মত আকাশে সেদিন এমন মেঘ ছিল না। বৃষ্টি পড়ছিল না। সমস্ত আকাশটা তারায় তারায় ঝকঝক করছিল । তুমি উঠানে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে ‘চাল ধোয়া হাত’ মুছছিল।  আমি তোমাকে বললাম, “মা, আমি চলে যাচ্ছি।” তুমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে। “মা, আমি মুক্তিবাহিনীতে চলে যাচ্ছি।”

ঠিক সেই মুহূর্তে দিগন্তের কোল ঘেঁষে একটা উজ্জ্বল তারা উল্কা হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল। তুমি তা দেখেছিলে মা, কিন্তু তুমি চমকে উঠো নি।  উনুনের আলোতে তোমার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তোমার চোখ দুটো গর্ব্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।  তুমি আলতো ভাবে আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তাকালে। বাড়ির পেছন দিকের জামগাছেটার কিছু পাতা বাতাসে দোল খেয়ে আবার স্থির হয়ে গেল।

মা,  সেই রাতেই তুমি আমাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সত্যের প্রতীক ধ্রুবতারাটাকে ভীষণ উজ্জ্বল মনে হচ্ছিল। মা, কতযুগ পেরিয়ে গেছে, কত সভ্যতা কত ইতিহাস বিবর্তিত হয়েছে, কত বর্বরতা ন্যায়ের আগুনে ছাই হয়ে গেছে,  কিন্তু মা মহাকালের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ধ্রুবতারাটা  কিন্তু উল্কা হয়ে আকাশের বুকে মিলিয়ে যায় নি। ইতি—

 তোমার স্নেহের

মুকুল

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত—

বৃটেনও পাকিস্তানকে সাহায্য দেবে না

বাংলাদেশের পরিস্থিতির সুষ্ঠু রাজনৈতিক সমাধােনের ব্যাপারে কার্যকরী প্রচেষ্টার যথেষ্ট প্রমান না পাওয়া পর্যন্ত বৃটেন পাকিস্তানে সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখবে। গত ২৩শে জুন বৃটিশ পার্লামেন্টে এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন পররাষ্ট্র সন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হোম।

পৃষ্ঠা- দশ

আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো কয়েকটি দিক

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

প্রাকৃতিক সম্পদ:

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান এবং উন্নয়নের ব্যাপারে ক্ষমাহীন অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে।  এই ব্যাপারে কোনরকম ব্যাপক পানি বা ভূতাত্ত্বিক জরিপও চালানো হয়নি।  এ ধরনের জরিপের ফলে মূল্যবান খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ পাওয়া যেতে পারে। কাজেই এসব প্রাকৃতিক সম্পদ কার্যকরভাবে ব্যবহারের কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য অবিলম্বে এ ধরনের জরিপের কাজ আরম্ভ করা হবে।

নদী পরিচর্যা উন্নয়ন:

বাংলাদেশের অসংখ্য নদ-নদী এক বিরাট প্রাকৃতিক সম্পদ। তবে অন্যান্য সম্পদের ন্যায় একমাত্র গবেষণা ও ব্যাপক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই নদী সম্পদকে সমাজের প্রভূত কাজে লাগানো সম্ভব।  কিন্তু এ ধরনের পরিকল্পনার অভাবে ভূমি ক্ষয়ের মত সমস্যাগুলো গুরুতর আকার ধারণ করেছে।  এক্ষেত্রে যে ক্ষমাহীন অবহেলা দেখানো হয়েছে অবিলম্বে উচ্চ ক্ষমতা নদী-গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করে তার প্রতিকার করা দরকার। এই ইনস্টিটিউট পানি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা ও নদী ট্রেনিং স্কীম  গ্রহণের মাধ্যমে এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদকে সমাজের প্রয়োজন কাজে লাগাবে।

মৎস্য সম্পদ:

যে সমাজে শতকরা ৭০ জন লোক প্রোটিন স্বল্পতায় ভোগে সে সমাজে মৎস সম্পদের অসীম গুরুত্ব বলে শেষ করা যায় না।  কাজেই সামুদ্রিক মৎসসহ মৎস্য সম্পদের উন্নয়নের জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা অবশ্যই গ্রহণ করা হবে। এই সেক্টর থেকে কেবল যে অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে তা নয়, এ আমাদের লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রোটিনও যোগাবে। এ ব্যাপক পরিকল্পনার মধ্যে থাকবে মৎস্য উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, মৎস্য বন্দর উন্নয়ন, গভীর সমুদ্রে মৎস শিকার, নৌ বিহার ও মোটর চালিত অভ্যন্তরীণ মৎস শিকার, নৌবহরের উন্নতি বিধান, মাছ রাখার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গুদাম ও বিতরণ ব্যবস্থা এবং বৈজ্ঞানিক মৎস চাষ উন্নয়ন।

মৎস্য উন্নয়ন স্কীম গ্রহণের ব্যাপারে প্রকৃত জেলেদের দ্বারা পরিচালিত মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির গুলোকে সর্বপ্রকার উৎসাহ ও সাহায্য দেওয়া হবে।

গবাদি পশু,  হাঁসমুরগী এবং ডেরী ফার্মিং

গবাদি পশু উন্নয়ন এবং হাঁস-মুরগি ও ডেরী ফার্মিংএর প্রতি নিদারুণ অবহেলা করা হয়েছে।  বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগী ও ডেরী ফার্মিংয়ের উন্নয়নকল্পে দেশের সকল অঞ্চলে ব্যাপক পরিকল্পনা গৃহীত হবে।

শ্রমিকদের অধিকার:

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা মোতাবেক শ্রমিকদের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের যৌথ দরকষাকষি অধিকার এবং ধর্মঘটের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। শ্রমিকদের এ ধরনের অধিকার খর্ব করার উদ্দেশ্যে প্রণীত সকল আইন বাতিল করা হবে। সরকার যাতে শ্রমিকদের ন্যায্য স্বার্থ উন্নয়নে গঠনমূলক ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ এবং সেই সঙ্গে শিল্প উৎপাদন নিশ্চিত করার মাধ্যমে মৌলিক সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারে সে জন্য সরকারের শ্রম  সংক্রান্ত্র যন্ত্রের পুনর্বিন্যাস করা হবে।

সরকার শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা এবং শ্রমিকদের ট্রেনিং ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করবে এবং ট্রেনিং ইনস্টিটিউশনে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং তাদের ভবিষ্যত উন্নতির জন্য শিক্ষা দেওয়া হবে।

শ্রমিকদের জীবন ধারণের উপযোগী মূল বেতন দেওয়া হবে এবং চাকুরীর নিরাপত্তা বিধান করা হবে। একই কাজের জন্য পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সবাই যাতে সমান বেতন পায় তার ব্যবস্থা করা হবে। শ্রমিকদের এবং তাদের পরিবার বর্গ কে অবশ্যই নিম্নলিখিত মৌলিক সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।

(১) বিনা ভাড়ায় বাসোপযোগী গৃহ।

(২) বিনা খরচায় চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা

(৩) অসুস্থতার সময়ে পুরো বেতনে ছুটি

(৫)  অক্ষমতা ও অবসর গ্রহণের ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা প্রদান

(৬) ন্যুনপক্ষের মাধ্যমিক স্কুল পর্যায় পর্যন্ত বিনা খরচে শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা।

(৭) মহিলা শ্রমিকদের বেলায় পুরা সুযোগ-সুবিধাসহ ম্যাটারনিটি ছুটি।

উপরোক্ত অধিকার সুনিশ্চিত করা ছাড়াও ন্যায় ও সাম্য পরায়ন সমাজ গঠনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিচালনার সঙ্গে শ্রমিকরা ক্রমেই বেশি করে সংযুক্ত হয়ে উঠবে।

একই সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য শ্রমিকরা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তার মুনাফায় তাদের একটা অংশ পাওয়ার অধিকার থাকা উচিত। এতে উৎপাদন বৃদ্ধি অংশ শ্রমিকরাও পাবে।

সরকারি এবং আধা সরকারি সংস্থাগুলোয় চাকুরীরত শ্রমিকদের জীবন ধারণের উপযোগী বেতন, চাকুরীর নিরাপত্তা এবং অসুস্থতা ও অবসরকালীন সুবিধা সহ কল্যাণমূলক সুবিধার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

কর্মসংস্থান:

বেকারত্বই নিকৃষ্টতম সামাজিক অবিচার। প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থানের চূড়ান্ত লক্ষ্য হাসিলের জন্য কর্মসংস্থানের সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা সমগ্র অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আমাদের সমাজের বিপুল জনসম্পদকে কাজে লাগাবার জন্য জনশক্তির ব্যাপক পরিকল্পনা অত্যাবশ্যক। সর্বাধিক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে যে সব মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে তার কয়েকটি হল:-

(১) সড়ক নির্মাণ, সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কাজ, স্কুল ভবন নির্মাণ ও এই ধরনের অন্যান্য কাজের জন্য পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ণ।

(২) শিল্প এবং কৃষিতে অধিক উৎপাদন পদ্ধতির (Labour intensive techniques) প্রবর্তন।  (৩) পল্লী এলাকায় কুটির শিল্প গুলোকে ব্যাপক সাহায্য দান।

                                                                                                              ( চলবে)

নিক্সনের কাছে তার

বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এর তীব্র প্রতিবাদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের খবরে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তীব্র প্রতিবাদ করে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে একটি প্রতিবাদ তারবার্তা প্রেরণ করেছেন।

গত ২৩ শে জুন উক্ত তারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তানকে নতুন করে বিমান এবং জাহাজ ভর্তি সামরিক অস্ত্র শস্ত্র দেওয়ার খবরে বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও আহত হয়েছে।

 তিনি আরো বলেন পশ্চিম পাকিস্তান সমর নায়কদের কাছে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে তার খুচরো যন্ত্রাংশও তারা সরবরাহ করেছে। মার্কিন সরকার অবগত আছেন যে, ইসলামাবাদ এই মার্কিন অস্ত্র শস্ত্র এমনকি ত্রাণকার্য়ের জন্য প্রদত্ত নৌকাগুলো পর্যন্ত ব্যাপকহারে নারী-পুরুষ ও শিশু হত্যার কাজে এবং গ্রাম ধ্বংসে, ক্ষেতের ফসল শস্য ভান্ডার নষ্ট করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে জরুরী তার প্রেরণ করেছেন

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের নেতৃবৃন্দের কাছে গত ২৫শে জুন মুজিবনগর থেকে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে।

জেদ্দায় আসন্ন বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের প্রাক্কালে এই টেলিগ্রাম পাঠিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিশংস অত্যাচারের প্রতি তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

 তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শতকরা ৮০ জন মুসলমান। ইয়াহিয়া সরকার জনগণের নির্বাচনের রায়কে অগ্রাহ্য করে বিশ্বাসঘাতক এর মত অন্যায় যুদ্ধ শুরু করেছে বলেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।

 অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, দশ লক্ষেরও বেশি লোককে তারা হত্যা করেছে । ৬০ লাখের বেশি লোক গৃহহারা হয়ে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে এবং এখনও হাজার হাজার লোক প্রতিদিন দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে । পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদাররা মসজিদসমূহ ধ্বংস করেছে, মসজিদের ইমামদের এবং নামাজরত মুসলমানদের গুলি করে হত্যা করেছে আর তারা এসব করেছে ইসলামের নামেই।

 তিনি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুরোধ করেছেন যেন তারা বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সম্মেলনে তাঁদের প্রভাব খাটান।

পৃষ্ঠা- এগারো

একটি যুদ্ধ বহু ইতিহাস

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

হোন্ডা চলছিল আস্তে আস্তে। দুলাল বললে, “আমার মাথা ঘুরছে। জীবনে কোনদিন এ সব করুণ দৃশ্য দেখব ভাবতে পারিনি। কী আশ্চর্য তাই না। বাঙ্গালীর স্বার্থে কথা বলতো বলেই ‘ইত্তেফাক’ অফিস এই পশুরা ধ্বংস করেছে।” সত্যিই তাই, কেবল দালাল পত্রিকার অফিসগুলো ছাড়া অন্য সব পত্রিকার অফিস গোলার আঘাতে পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। এই পশুরা ধ্বংস করেছে ‘স্বরাজ’ ও ‘সংবাদ’ এর অফিস। এই দুটো পত্রিকা সোচ্চার হয়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভাঁওতাবাজির বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় ঢাকা, চট্টগ্রামে পাঞ্জাবি সেনারা যেভাবে নির্বিচারে গুলি চালায় তার প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে ‘স্বরাজ’।  এই সাপ্তাহিক পত্রিকা বয়স ছিল মাত্র মাস তিনেক।  বাঙ্গালী দরদী হওয়ায় অকাল মৃত্যু ঘটলো পত্রিকাটির।

বাসায় আসার আগে ‘সংবাদ’ অফিসের দিকেও গেলাম। পুরনো ঢাকায় এই পত্রিকাটির অফিস। নবাবপুর রোড দিয়ে যেতে হয়। দেখলাম অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। যাও দুই একটা দোকান খোলা, সব বিহারীদের। আর জোর দখল করেছে ওরা অনেক বাঙালি বাড়ী। যেতে যেতে দেখি আমারই পরিচিত একটি দোকান দখল করেছে বিহারীরা। দোকানটার বাংলা নাম পাল্টে কি একটা নাম লিখে রেখেছে উর্দুতে।

‘সংবাদ’ ঢাকার সব দৈনিক কাগজ গুলোর মধ্যে প্রাচীনতম। অবশ্য ‘আজাদ’ ছাড়া।  দেশের বিখ্যাত সব সাংবাদিক কোন না কোন সময়ে এই পত্রিকায় কাজ করেছেন। সবারই অপরিসীম দরদ রয়েছে এই সংবাদপত্রটি জন্য। গিয়ে দেখি পাঞ্জাবি সেনাদের বেপরোয়া গোলার আঘাতে পত্রিকা ভবনটি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে গেছে। গোলাবর্ষণ করেই নরপিশাচরা ক্ষান্ত হয়নি, মেশিন রুমেও শয়তানরা আগুন দিয়েছে। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে মেশিনের কিছু ধ্বংসাবশেষ। ইট-সুরকির জমেছে সারা এলাকা জুড়ে। আর এই ইট সুরকির স্তুপের নিচে চাপা পড়ে আছে বিখ্যাত সাংবাদিক ছোটগল্প লেখক শহীদ সাবেরের শহীদ দেহ। বাংলাদশে এ নামের সাথে অনেকেই পরিচিত। সারাদিন কাটাতেন প্রেসক্লাবে, রাতের বেলায় ঘুমাতেন সংবাদ অফিসে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দেহ একেবারে শীর্ণ।

যেদিন মিলিটারি সংবাদ অফিসে আগুন দেয়, সে সময় উনিও ছিলেন ভেতরে। আগুন লাগানোর পর কর্মচারীদের অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন। কিন্তু পালাতে পারেননি শহীদ সাবের, চির নিদ্রায় শায়িত হয়ে রইলেন অফিসের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে।

বাসায় ফিরে আর ঘুমাতে পারছি না। হাজারো চিন্তা ভিড় করেছে মাথায়। নিজের মা-বাবার কোন খবর পাইনি, বেঁচে আছে কি মারা গেছে তা জানার উপায় নেই।  বাবা মা ভাই বোন সবাই চাঁটগায়, আরো রয়েছে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব। ভাবছি কে কোথায় কে জানে। এমন সময় আমার বন্ধু সেলিম এসে বলল, জানিস মধুদা কে মিলিটারি মেরে ফেলেছে। কথাটা শুনে অনেক ক্ষন স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম।  কেন?  কি দোষ করেছিল মধুদা।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনের মধুদা যে সারা বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে পরিচিত তা নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের কয়েকটি সংবাদপত্রে মধুদা সম্পর্কে ফিচার বেরিয়েছিল।

সেলিমের মুখেই পুরো ঘটনা শুনলাম। মধুদা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে থাকতেন সপরিবারে।  স্ত্রী এক কন্যা ছাড়া মধুদার সাথে থাকতেন তাঁর ছেলে ও ছেলের বউ । ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র মাস তিনেক আগে।  ২৫ শে মার্চ রাত্রে জল্লাদ সেনারা মধুদার ফ্ল্যাটে ঢোকে,  কাউকে তারা বাদ দেয়নি।  ছেলেমেয়েরা চেয়ে থেকে যেন দুঃখ করতে না পারে সেজন্য গুনে গুনে সবাইকে তারা হত্যা করেছে।  সেলিম বলল – আমি অনেক সাহস করে দিয়েছিলাম । মধুদা তো একটু মোটাসোটা ছিলেন,  দুই দিনের বাসি মড়া পচে ফুলে গেছে।  বুঝলি আমার সাথে মাত্র সাতাশ দিন আগে শহীদ মিনারের এক ফাংশনে দেখা।  দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনছিল, অবাক লাগে, তাই না? বাঙালি বলে মধুদাকে প্রাণ দিতে হলো।

যতই দিন যাচ্ছে, শহরের লোক পালাচ্ছে দলে দলে। অবশ্য বাঙালিরাই। দোকানপাট সব বন্ধ, এমনকি রেস্টুরেন্ট গুলোও চলেনা।  দু-একটা খোলা থাকে দুপুর পর্যন্ত।  কিন্তু কোন খদ্দের হয়না।  দোকানে ঢুকে আড্ডাবাজি বা চা খাওয়ার প্রবৃত্তি আর বাঙ্গালীদের নেই। জোর করে সামরিক সরকার শহরের সিনেমা হল চালু করেছে ।কোন হলে বাংলা ছবি চলছে না।  উর্দু ও পাঞ্জাবি, দর্শকও ওরা। অফিস আদালতে হাজিরা শতকরা দশ পনেরো ভাগ। সেদিন দেখা হল এক বন্ধুর সাথে। একটা বেসরকারি সংস্থায় উচ্চ পদে চাকরি করে। গাড়ি বাড়ি সব কোম্পানির।  জিজ্ঞাসা করলাম, কিরে অফিসে বসে বসে কি করিস? উত্তরে বন্ধু বলল, কি আর করব, যেখানে শ দুয়েক লোক রোজ অফিসে আসতো, এখন অফিস তো প্রায় শূন্য বললেই চলে। আমরা সাত জন যাই,  আর আর কেরানী পিওন সব মিলিয়ে ধর আরো মাত্র আট জন।  এতে কি অফিসের কাজ চলে, আর তাছাড়া কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই,  নেই টাকা-পয়সার লেনদেন, এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ফাইল মুভ করে না। কি ঘোড়ার ডিম এর কাজ,  বসে বসে চা খাই, গল্প করি আর ভয়ে কাঁপি কখন মিলিটারি আসে রাতের বেলায় বাসায়, বুঝিস তো পশ্চিমা ফার্ম।  কোন ব্যাটা কি বলে বসে মিলিটারিকে আমাদের মানে বাঙালি স্টাফদের সম্পর্কে। মানে এক কথায় অফিসে এখন কাজই হচ্ছে না।

ইয়াহিয়ার পরস্পর বিরোধ ভাষণের প্রতিক্রিয়া

 

বেঈমান ইয়াহিয়া গত ২৮শে জুন এক বেতার ভাষণ দিয়েছেন। এই বেতার ভাষণে দুশমন ইয়াহিয়া সমস্ত পার্লামেন্টের ইতিহাসে চুনকালি মেখে ঘোষণা করলেন যে এবার তিনি নিজেই সংবিধান রচনা করবেন – যে সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা ব্যতীত জাতীয় পরিষদে আর করণীয় কিছু থাকবে না।  এই ভাষণের আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো তার অপকীর্তির অন্যতম সাকরেদ সিন্ধুর কোটিপতি পশ্চিমাদের দালাল জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর দাবি প্রকারন্তে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন যে চার মাস পর ভেবে দেখবেন কবে নাগাদ তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।  ভুট্টো দাবি করেছিলেন অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

পাকিস্তানের গণতন্ত্র মৃত

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই ভাষণে দেশে-বিদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব এম হোসেন আলী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নেতার ভাষণ এর কথা উল্লেখ করে বলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বীকার করলেন, ‘পাকিস্তানের গণতন্ত্র মৃত’।

তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের মাটি থেকে দখলদার পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের বিতাড়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ এই দখলদারমু সৈন্যমুক্ত হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাংলাদেশের জনগণকে কিছুই দেয়নি।

গণহত্যাতেই ইয়াহিয়ার উল্লাস

পাকিস্তানের সংকট এবং বাংলাদেশের প্রশ্নের সমাধান সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট খান তার বেতার ভাষণে যে রাজনৈতিক ঘোষণা করেছেন সে সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধি এবং পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রাক্তন সেকেন্ড সেক্রেটারি জনাব কে এম শাহাবুদ্দিন বলেন, ইয়াহিয়া খানের ভাষণে নিঃসন্দেহ ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, একটি ক্রীড়নক সরকার খাড়া করার জন্য তিনি বিশ্বাসঘাতকও সংগ্রহ করতে পারেননি। তাঁর ভাষণে তিনি নিজেকে বিশ্বের দরবারে প্রমাণিত করেছেন যে তিনি একজন সংবিধানবিরোধী মানুষ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ এবং গণহত্যাতেই উল্লাস করেন।

 জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁর বহু প্রতীক্ষিত বেতার ভাষণে দেশের গণতান্ত্রিক জনমত  এবং গত ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের রায়কে নস্যাৎ করে দিয়েছেন ।

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক জনপ্রিয় সংবিধান রচনা এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি বাতিল করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানের সকল আশা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। সামরিক প্রেসিডেন্টের এই ভাষণ এর ফলে ইসলামাবাদের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বর্তমান গোরিলার লড়াই আরো জোরদার হবে।

পৃষ্ঠা- বারো

রণাঙ্গনে

 

যতই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের উপর আক্রমণাত্মক তৎপরতা জোরদার করে তুলছেন। গত তিন মাসে হানাদার সেনারা যেভাবে চরম মার খেয়েছে তার একটা ছোট্ট প্রমাণ মেলে বিবিসিতে প্রচারিত সংবাদের মাধ্যমে। গত ২৪শে জুন সন্ধ্যা সোয়া আটটার সংবাদ প্রবাহে বিবিসির সংবাদদাতা ঢাকা থেকে বলছেন,  বাংলাদেশের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের হাতে পাক সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির যে তথ্য আমি সংগ্রহ করেছি তার ভগ্নাংশও  সত্য হলে তা হবে ভয়াবহ।  অন্যদিকে রয়টারের সংবাদাতা হাওয়ার্ড হুইটেন জানাচ্ছেন,  প্রতিদিন ৫০/৬০ জন আহত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে। বিদেশি কূটনীতিকদের মতে বাংলাদেশের দখলীকৃত ঢাকায় হানাদার পাক সেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণাত্মক তৎপরতা প্রতিদিন জোরদার হচ্ছে।

সাতক্ষীরায় 600 জন নিশ্চিহ্ন

সাতক্ষীরায় মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে ৬০০ শত্রু সেনা নিহত হয়েছে।  এছাড়া মোট ২৬ টি আক্রমণে তারা ৩০০ জন পাকসেনা কে খতম করেন। ভোমরা, পারুলিয়া, মামুদপুর, খুসকালি, শ্রীপুর ও কাকডাঙ্গায় আক্রমণ চালানো হয়।

ফেনীতে প্রচন্ড সংঘর্ষে পাঁচ শতাধিক শত্রুসেনা খতম

পূর্বাঞ্চল সেক্টরের ফেনী মহকুমায় গত এক পক্ষকালের প্রচন্ড সংঘর্ষে স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধাদের হাতে প্রায় পাঁচশত পশ্চিম পাকিস্তানী শত্রুসেনা খতম হয় এবং দুই শত জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।

 স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, উক্ত সংঘর্ষের আমাদের মুক্তিসেনাদের ৫০ জন আহত হন গত ৪ঠা জুন খানসেনাদের প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে পাঠান নগরের বশিকপুর সেতুতে মুক্তিবাহিনীর পোতা মাইন বিস্ফোরণের পর এ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় এবং এক পক্ষ কাল ধরে এই সংঘর্ষ চলতে থাকে।

 কুমিল্লা রণাঙ্গনে গেরিলা বাহিনীর হাতে প্রায় ৯০ জন খান সেনা নিহত হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে পাক ফৌজ কর্ণেল বাজারে আশ্রয় নেয়। গত ২২ শে জুন কুমিল্লার মান্দাভাগে ৫ জন সৈন্য নিহত হয়।

ঢাকায় বোমা বিস্ফোরণ অব্যাহত

রয়টারের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, সম্প্রতি জাতিসংঘ উদ্বাস্তু হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খানের ঢাকা সফরের সময় ঢাকায় আটটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে সামনে গেরিলা যোদ্ধাদের গ্রেনেড আক্রমণে একজন আহত হয়। আরেকটি আক্রমণে তিনজন খান সেনা নিহত হয়।

 স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, গত ২৩ শে জুন ভোর চারটায় ঢাকা বিমানবন্দরে একটি বোমা বিস্ফোরণের পর বন্দর পাহারারত দখলদার দস্যুসৈন্যদের মধ্যে থমথমে ভাব বিরাজ করছে।  আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, ঢাকা বিমান বন্দরে বিদেশি সাংবাদিকদের নিয়ে একটি বিমান অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বিকট আওয়াজ করে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়।  স্বাধীন বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা অবস্থা যে মোটেও স্বাভাবিক নয়, ঢাকার মাটিতে পা দিতেই বিদেশি সাংবাদিকগণ তা প্রত্যক্ষ করলেন। হানাদারদের কড়া পাহারা সত্ত্বেও এ ধরনের বিস্ফোরণ হওয়ায় বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বিব্রত হয়ে পড়েছে।

 গত সপ্তাহের রাজশাহীতে পরপর তিনদিন সারা শহরে বোমা বিস্ফোরিত হলে খান সেনারা ভীত-বিহবল হয়ে পড়ে এবং এখন তাদের বড় একটা ছাউনি থেকে বের হতে দেখা যাচ্ছে না।

রাজশাহী শহর আক্রান্ত

আমাদের স্বাধীনতাকামী তরুণরা রাজশাহী শহরের ঢুকে প্রবল আক্রমণ চালিয়েছেন।  মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা গত রোববার রাতে তিন  দিক থেকে শহরটিতে প্রবেশ করেন। এ সব আক্রমণে পাক সেনাবাহিনী বড় বেকায়দায় পড়েছে। মুক্তিবাহিনী মীরগঞ্জ চারঘাট ও নবাবগঞ্জ– এই তিন দিক থেকে রাজশাহী শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই আক্রমণ কালে মুক্তিবাহিনী মর্টার, হাতবোমা ও হালকা মেশিনগান ব্যবহার করেন।

 এক খবরে প্রকাশ মুক্তিবাহিনী ও পাক সেনাদের মধ্যে নোয়াখালী সোনাইমুড়ি ও চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। গেরিলা বাহিনী পাকসেনাদের একটি জীপ মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয়। তাতে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে পাক টহলদার বাহিনীর ৬ জন গেরিলাদের হাতে নিহত হয়।

শনিবারের সংঘর্ষে ৬০ জন সৈন্য নিশ্চিহ্ন

মুক্তিবাহিনী গত ২৬শে জুন বিভিন্ন রণাঙ্গনে ব্যাপক আক্রমণ চালান। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চল সেক্টরে কমপক্ষে ৬০ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয় এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী কিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়েছেন।

 গত ২২ শে জুন কুষ্টিয়ার একটি গ্রামে মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের আক্রমণে ১৬ জন পাক হানাদার খতম হয়েছে। গেরিলাদের সঙ্গে বৌদ্যনাথতলা ও কৃষ্ণনগরের কাছে দুটি আলাদা জায়গায় পাকহানাদারদের ৬ ঘন্টা ব্যাপী গোলা বিনিময় হয়। উভয় পক্ষই মর্টার নিয়ে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চালায়। খুলনা জেলার গনরাখালিতে পাকসেনা ভর্তি ট্রাকের উপর গেরিলা বাহিনী আক্রমণ করেন এবং সেখানেও কিছু পাক সৈন্য নিহত হয়।

দালালরা খতম হচ্ছে

বিভিন্ন শহর-গ্রাম থেকে মুসলিম লীগ ও জামাত-ই-ইসলামের গুন্ডা ও হানাদার সৈন্যদের পদলেহী দালালদের পতন করা কাজ ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিফৌজ পাটকেলঘাটা, টালা, পাইকগাছা, আশাশুনি, বদরতলা, কলারোয়া প্রভৃতি স্থানে ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করেছেন।

একজন পাক সেনা থাকা পর্যন্ত মুক্তিফৌজের সংগ্রাম চলবে

মুজিবনগর।  মুক্তিফৌজের দুইরণাঙ্গনের কমান্ডারদের মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর জিয়াউর রহমান এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে পাক সামরিক বাহিনীর একেবারে চলে না যাওয়া পর্যন্ত দেশের পরিস্থিতি কখনো শান্ত হতে পারে না এবং ততদিন পর্যন্ত মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

 তারা দুজনেই ইয়াহিয়ার ভাষণকে ডাহা মিথ্যা ছড়াছড়ি বলে আখ্যায়িত করেন।