বাংলাদেশ একটি দুঃখের গান
বিট জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের ওপর একটা গানের রেকর্ড বার করেছেন। অতএব এরপর, আমরা আশা করতে পারি, বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ, দুর্দশা আর যন্ত্রণার এই গাথা পশ্চিমের নাইট ক্লাবে, এল-এসডি’র আড্ডায় আস স্ট্রিপ জয়েন্ট’–এ মানুষকে মাতাল করব, ঘুম পাড়াবে কিংবা উত্তোজিত করবে, যেমন করেছে, অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে, হরে কৃষ্ণ’ কিংবা হরি ও।
এটা নিঃসন্দেহে একটা ঘটনা, কেননা আর কোনােভাবে বাংলাদেশে ট্র্যাজিডির কাহিনীকে এতটা আন্ত র্জাতিকভাবে সর্বসমক্ষ হাজির করা যেত কি? খবরের কাগজ? ওরা বড় বাড়িয়ে আর বানিয়ে লেখে। ক্যামেরার ছবি? দোহাই, ওগুলাে দেখে আমরা আর মনের শান্তি আর রাত্রের ঘুম নষ্ট করতে চাইনা। তার চাইতে অনেক ভালাে স্বল্পালােকিত বৈঠকভানায় পানীয়ের গ্লাসটি হাতে নিয়ে অনেক বেশি সহনীয়। তাতে বেদনা আছে, বেদনার আনন্দ আছে, এবং মানুষ মানুষের কি করেছে সেটা ভেবে ভেবে দার্শনিক হবারও একটা সুযােগ আছে।
সাহায্যও কি কম হবে? জর্জ হ্যারিসন শুধু গান গাননা, টাকাও বানাতে জানেন। এবং এই কাজে তার সঙ্গে আছে বিশ্ববিখ্যাত ওস্তাদ রবিশঙ্কর যাঁর জনপ্রিয়তা সর্বত্রই অসাধারণ। হ্যারিসনের প্রযােজনায় রবিশঙ্করও একটা অ্যালবাম বার করছেন যেখানে তিনি মাতৃভূমির মর্মান্তিক লাঞ্ছনায় তাঁর অন্তরের বেদনাকে প্রকাশ করবেন। এই দুটি রেকর্ডের সমস্ত টাকা জমা হবে জর্জ হ্যারিসন-রবিশঙ্কর বিশেষ জরুরী ত্রাণ তহবিলে এবং খরচা হবে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের কল্যাণে।
কিন্তু বাংলাদেশের এই পরিণতি তে আমরা চাইনি। যখন অন্যায় অত্যন্ত নগ্ন ও বীভৎস, যখন দশ লক্ষ মৃতদেহের ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম রক্তস্নান সারা হলাে, যখন সত্তর লক্ষ গৃহহারা মানুষের হাহাকার যন্ত্রণায বােবা হয়ে গেছে, তখন পৃথিবীর মানুষ কি শুধু গান গেয়ে তৃপ্ত থাকবে? হে ভগবান, এখন কি গান গাইবার সময়? দাক্ষিণ্যের প্রয়ােজন আছে ঠিকই, সত্তর লক্ষ বিতাড়িত মানুষের জন্য অবিলম্বে আরাে বেশি সাহায্য পাওয়া দরকারও। কিন্তু যে অন্যায় এই মানুষগুলিকে উদ্বাস্তু করেছে, যে পশুশক্তি মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের পবিত্র মৌলিক অধিকারের ওপর দিয়ে বুলডােজার চালিয়ে একদার সােনার বাংলাকে মশানভূমিতে পরিণত করেছে, তার বিরুদ্ধে স্বার্তলােলুপ রাষ্ট্রনায়কদের কিছু বলবার না থাকতে পারে, পৃথিবীর মানুষেরও কি আর কিছু করবার নেই? জর্জ হ্যারিসনের রেকর্ড বিক্রির টাকা দিয়ে বাংলাদেশের জন্যে অস্ত্র কিনে পাঠানাে যায় না? দুনিয়ার শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী যারা গণতন্ত্র, মানবতা আর মানবাধিকার নিয়ে পরােয়া করেন তারা কি পারেন না হাতিয়ার নিয়ে সেই বাংলাদেশে এসে দাঁড়াতে যেমন একদা একটি ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগ্রেড গিয়েছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে—যেখানে গণতন্ত্র, মানবতা আর মানবাধিকার সবচেয়ে নির্লজ্জভাবে পদদলিত? যখন একটি জাতি নিশ্চিহ্ন হবার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, যখন আমাদের চোখের সামনে ইতিহাসের জঘন্যতম অবিচার সংঘটিত হচ্ছে, তখনাে কি কিছু সহজ আর্থিক উপঢৌকনে পৃথিবী তার বিবেকের মুখ বন্ধ করে রাখবে? বাংলাদেশের ট্র্যাজিডি কি শুধু অসহায় কান্নায় কয়েকটা গানের রেকর্ড কিংবা ছবি, না হয় কিছু কবিতার মধ্যে বােবা হয়ে থাকবে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২২ জুলাই ১৯৭১