বাঙলাদেশের ভাবনা শুধু বাঙালীর?
আমরা বাঙালী বলেই শুধু দুই বাংলার প্রতি আমাদের নাড়ীর টান। তাই আমরা কেবলই জানতে চাইছি কেন্দ্রীয় সরকার শরণার্থীদের জন্য বা পূর্ব বাংলার নিপীড়িত স্ত্রী-পুরুষদের জন্য কী করবেন। আমাদের টান বেশী বলে হয়তাে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি আমরা সব সময় বুঝতে পারি না, একথা আমাদের মেনে নেওয়া উচিত। দিল্লীতে এখন আলােচনা হচ্ছে, ভারতবর্ষের পক্ষে কিছু করার পথে বাধা কোথায়? এক, পূর্ব বাংলার জনগণ কি ভারতীয় হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানাবেন বা প্রথমে জানালেও বেশী দিন তারা চাইবেন কি? দুই, ধরুন, যদি ভারতীয় হস্তক্ষেপে বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের কবলমুক্ত করা গেল, তারপর কি নিজেদের প্রতিরক্ষার ভার তারা নিজেরা নিতে পারবেন? তিন, পাকিস্তান সহায়ক গােষ্ঠীর দেশগুলি যেমন পাকিস্তান এবর সাহায্য করতে রাজী হল না, ভারতীয় হস্তক্ষেপ শুরু হলে, ভারতের সাহায্য কি তারা বন্ধ করে দেবে না? চার, চীন কী করনে, তা কে বলতে পারে? ক্ষিপ্ত আহত এক সিংস্র জন্তুর মত যদি পাকিস্তান যুদ্ধে নামে, তাহলে বাংলাদেশ এমন কি পশ্চিম পাকিস্তান ছারখার হয়ে গেলেও কি তারা লড়বে না? এরকম মীয়া লড়াইয়ে কী ভারতবর্ষের নামা উচিত? এক সঙ্গে চীন ও পাকিস্তান, এক সঙ্গে পশ্চিম, উত্তর, পূর্ব ফ্রন্টে যুদ্ধ চালানাে কি উচিত?
পাঁচ, পাকিস্তানি সামরিক কর্তারা দরকার হলে সাহায্য পাবার জন্য নিজেদের দেশকে বন্ধক রাখা থেকেও কী পিছপা হবেন? পূর্ব বাংলাকে মুঠির মধ্যে ধরে রাখবার জন্যে পাকিস্তানের যা খরচ করতে হবে কতদিন সে বইতে পারবে? এ বছরে বাজেটের অর্ধেকের বেশী যাবে প্রতিরক্ষা, সেটা তাে দেখাই গেছে। এই সমস্ত বিতর্ক যখন চলে তখন আমরা বাঙালীরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠি। আমাদের সামনে ভবন জ্বালিয়ে দেওয়া গ্রাম, ধর্ষিতা মেয়েদের করুণ চেহারা, মায়ের কোলে মৃত শিশু আর কাতারে কাতারে শরণার্থী। যারা দুই বাংলার বিপর্যয় ঠিক আমাদের চোখে দেখেন না, তাদের দৃষ্টিভঙ্গী বােঝতে আমি চেষ্টা করছিলাম। কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম বাংলার শাসনভার যখন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন তখন মনে হচ্ছে যে, হয়তােবা আগামী তিন চার মাসের মধ্যে এই ভীষণ সমস্যার সমাধান করবার একটা চেষ্টা হবে। কারণ এটা মানতেই হবে, না মানলে চলবে না, যে পশ্চিম বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যা ঠেকাতে ও শােধরাতে না পারলে সারা পূর্ব ভারত ভেসে যাবে।
পশ্চিম বাংলায় রয়েছে ভারতের কয়লার ও ইস্পাতের এক তৃতীয়াংশ, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের অর্ধেক, রাসায়নিক শিল্পেরও বেশ খানিকটা। শিল্পে উদ্যোগ বাংলাদেশের মেহনতী মানুষের শতকরা প্রায় ৭০ জন অবাঙালী, কলকাতায় গত দু’বছর ধরে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট চলেছে, তার কুফল উত্তর প্রদেশের পূবের জেলাগুলােতে, বিহার ও ওড়িশায় তৎক্ষণাৎ ছড়িয়েছে।
ধরুণ যদি পশ্চিম বাংলা তলিয়ে যায় তাহলে হতাশা ও আত্মজিজ্ঞাসা দেখি নি। পূর্ব বাংলায় প্রচণ্ড দমননীতি, পশ্চিম বাংলায় লক্ষ লক্ষ বুভুক্ষু শরণার্থী, অথচ এখানে তার বিশেষ কোন প্রতিক্রিয় দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের কথা আলােচনা হচ্ছে না, সেকথা বলছি না, খুবই হচ্ছে। টাকা-পয়সা তােলার জন্য পাড়ায় পাড়ায় কমিটি হয়েছে, কিছু কিছু সিনেমা থিয়েটারে চ্যারিটি শাে চলেছে। সেদিন সন্ধ্যাবেলা শুনে এলুম কিছু ছাত্র-ছাত্রীরা কবিতা পড়লাে, টাকা তুললাে। কাগজে বাংলাদেশ এখনও প্রথম পাতায় স্থান পাচ্ছে।
এখানে কিন্তু প্রায় সবারই এক ধারণা: এ তাে বাঙালীদের সমস্যা। বাঙ্গালীরাই এটা মেটাতে পারে আমরা হয় কিছু টাকা-পয়সা তুলে দেবাে। এই সেদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারেরও এই একই মনােভাব ছিল।
যখন যেখানে আকাল, মহামারী হয়েছে—তখন সেখানে স্থানীয় বা রাজ্য সরকার করণীয় বা তার বন্দোবস্ত করবেন আর কেন্দ্র না হয় বিলটি চুকিয়ে দেবে।
কিন্তু ৬০ লক্ষ ঘর-ছাড়া অত্যাচারিত মানুষকে নতুন জীবনে আহ্বান করতে চাইলে, শুধু যে বিল চুকোলে চলে না, সে ধারণা এখানে চালু হতে বেশ সময় লাগছে। সেদিন বাংলাদেশ সম্বন্ধে অধিবেশ শুনতে গিয়ে দেখি লােকসভা প্রায় খালি। এপ্রিল-মে মাসে বাংলাদেশের দুর্দশার জজ্যে যখন এখানে প্রচুর সহানুভূতি ছিল, তখন যারা এখানে বাড়ি-ঘর গিয়ে টাক-পয়সা, কাপড়চোপর সংগ্রহ করতে বেরিয়েছিলেন, তারা লােকদের বলতে শুনেছেন “হ্যা, আপনাদের ওখানে খবর তাে খুবই খারাপ।” “কি হচ্ছে আপনার দেশে? আপনাদের ওখানে, আপনাদের দেশ’ আপনাদেরই সমস্যা।
দিল্লীতে পশ্চিম বাংলার সরকার বা তার রাজনৈতিক কর্তা ব্যক্তিদের প্রভাব কম। এটা নতুন কথা নয়, আজ বেশ ক’বছর ধরে এমনই হয়ে আসছে। সীমান্তের কাছাকাছি জেলাগুলােতে এমন একটা বারান্দা নেই, দাওয়া নেই, কাছারি-বাড়ি নেই বা গাছতলা নেই যেখানে খেদানাে মানুষেরা এসে আশ্রয় না নিয়েছে। এদের মর্মন্তুদ কাহিনী শুনতে থাকলে বাস্তব-অবাস্তব সব যেন তালগােল পাকিয়ে যায়। আর অন্য দিকে দিল্লীতে বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে শুনবেন ‘ইন্টেলেকচুয়্যাল’ আলােচনা হচ্ছে।
একজন অভিজ্ঞ পাঞ্জাবী সাংবাদিক বললেন কলকাতায় শুনে এলাম যে, কুড়িজন আওয়ামী লীগের সদস্য নাকি আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে চান। দ্রলােক জানেন না, যে পূর্ব বাংলা থেকে হাজার হাজার সরকারি চাকরি এদিকে চলে এসেছেন, দলে দলে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের, স্কুলের কলেজের শিক্ষক। এসে তারা কলকাতার বেকার সমাজেরই ভিড় বাড়িয়েছেন। কাজ নেই, খাওয়া নেই, গাটে পয়সা নেই, অনেকের আবার আত্মীয় পরিজনের খবর নেই। সর্বোপরি, সামনে যে সমস্যা তার সুরাহা হবার কোনাে আশা নেই। তারা কি এই দুঃসহ অবস্থা আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারবেন?
দিল্লীর বৈঠকে কেউ আবার ভারিক্কী চালে বলছেন,—“যারা চলে আসছেন, তারা সবাই হিন্দু। এদের জানা নেই যে, মুসলমানেরা নেহাৎ প্রাণের দায়ে না পড়লে ভারতে আসবেন কেন? তাদের সসম্মানে ফিরে যাবার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হবেই, এখানে সেকথা কেউ কি মাথার দিব্যি দিয়ে বলতে পারে? আজ ২৩ বছর ধরে পাকিস্তান সরকার অনবরত প্রচার চালিয়েছেন যে, ভারতবর্ষে মুসলমানরা অপাঙতেয়, নির্যাতিত। সে অপপ্রচারের কী কোন ফল হয় নি?
আমি চেষ্টা করছি দিল্লীর আবহাওয়া বােঝাতে? মাঝে মাঝে প্রচণ্ড রাগ হয়। বাঙালীরা কি আমাদের পররাষ্ট্র নীতি বেধে দেবে নাকি? পাকিস্তান নিজের ভারেই ধ্বসে পড়বে। মুজিবর রহমান মস্ত ভুল করেছিলেন, অহযােগ আন্দোলনের পরে কী করবেন ভাবেননি, এইসব শুনতে হয়। আর দেখতে হয় প্রচণ্ড দোনােমনা। লােকসভায় সেদিন যেমন একজন বললেন, “ভারতবর্ষ আজ হ্যামলেট, কেবলি ভাবছে টু বি অর নট টু বি।”
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ জুলাই ১৯৭১