কর্নেল লুথরার দপ্তরে ব্যস্ততা, অকল্যান্ডে যে-কে-সেই
বাংলাদেশের মানুষের উপর পাক জঙ্গীশাহীর নেকড়েরা যে দিন ইতিহাসে জঘন্যতম আক্রমণ শুরু করে দিল আর তার ফলে যেদিন আশ্রয়প্রার্থীদের উদ্বেল তরঙ্গ ভারতের উপকূলে অবিশ্রান্ত ভাবে আছড়িয়ে পড়তে লাগল, সেদিন এক ধূসর সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের কয়েকজন অফিসার গিয়েছিলেন সীমান্ত পরিদর্শনে। আশ্রয়প্রার্থীদের হাল দেখে একজন তরুণ আই-এই-এস অফিসার মন্তব্য করেছিলেন: এঁরা তাে গুরু—ভেড়ার মতাে রয়েছে, মশা-মাছির মতাে মরবে। প্রভু অফিসার কথাটা শুনে তরুণ অফিসারের মুখের উপর তাঁর চোখ জোর করে রাখলেন, ভ্রু কুঞ্চন করলেন। তরুণ অফিসারটি লজ্জা পেলেন, কিছুটা অপ্রস্তুতও। বাঙালী বলে কি অতিশয়ােক্তি করাে ফেলেছি—এই ভেবে। ওপারের আকাশে ওঠা কালাে মিশমিশে মেঘের দিকে চেয়ে, কপাল পেরিয়ে ঝাপিয়ে পড়া মাথার চুল আলগাভাবে সরাতে সরাতে বলেছিলেন, আমার কথাগুলাে মিথ্যে হলে, স্যার, আমার চেয়ে দুনিয়াতে আর কেউ খুশী হবে না।
আমাদের সকলের দুর্ভাগ্য, তরুণ আই-এ-এস’এর উক্তি যে যথার্থ, তার প্রমাণ সীমান্তের দুকূল ছাপিয়ে পশ্চিম বাংলার পথে-প্রান্তরে, বনে-জঙ্গলে, পথে-ঘাঠে, গাছতলায় এবং হতশ্রী, ভেঙ্গে-পড়া শরণার্থী শিবিরগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে, পড়বে আর ভবিষ্যৎ? ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন, ভবিষ্যৎ যেন মানুষের কল্পনাশক্তির চৌহদ্দির মধ্যে থাকে, তা যেন সীমান্ত অতিক্রম করে উদ্বাস্তু না হয়, তা যেন পুরােপুরি দেউলিয়া না হয়।
যেহেতু বাংলাদেশের গােটা দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। তাই, ভারত সরকারের কথাই আগে আসে। কেন্দ্রীয় সরকারের মনােভাব দৃষ্টিভঙ্গী তার প্রশাসন যন্ত্রকে এই সেদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত নড়বড়ে করে রেখেছিল। এখনও যে তা খুব সক্রিয়, কর্মক্ষম হয়েছে, এ কথা তার অতি-বড় শত্রুও বলবে। তাবে, নিদ্রিত ভারত সরকার এখন চোখ মেলে দেখছেন, পূর্বাঞ্চলে, বেশী করে পশ্চিমবঙ্গে, আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে এবং তার আঁচ খাস দিল্লীতে লেগেছে।
২৬ নম্বর থিয়েটার রােডের কথা আজও অনেকের মনে থাকতে পারে। বহু-বিতর্কিত মেহেরচঁাদ খান্না কলকাতায় এই বাড়ীতে অনেককাল কাটিয়েছেন। এখন সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের শরণার্থী রিলিফ দপ্তর গড়ে উঠেছে। দপ্তরের ‘প্রিজাইডিং ডিটি কর্নেল লুথরা। ছিমছাম পটু চেহারার সৈনিক পুরুষটি ভােরবেলা নাস্তা করে বেরােন, তার পর সারাদিন বাড়ী যাওয়া হয়ে ওঠে না, রাত্রিতে বাড়ী ফিরতে ৮টা, ৯টা, ১০টাও হয়। বন বন করে বাইরের কাজে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যতটুকু অফিসে থাকেন, দিল্লী থেকে ট্রাঙ্ক কলের পর ট্রাঙ্ক কল। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি স্বামীনাথন বা প্রধানমন্ত্রীর জয়েন্ট সেক্রেটারি ট্যান্ডল জানতে চাইছেন, অবস্থা কি, পার্লামেন্টে সদস্যদের অমুক অভিযােগের কি উত্তর প্রধানমন্ত্রী দেবেন। আর সবার উপরে প্রশ্ন: আশ্রয়প্রার্থীরা। কি এখনও সমানে আসছে? উত্তর যায়, আরও বাড়ছে। হু’ আচ্ছা, বলে টেলিফোনে ছেদ পড়ে। ওদিকে লুথরার দপ্তরে খবর যায়, কোচবিহার থেকে ফাদার হুডনি এস-এ-এস করছেন, কোচবিহার সার্ভিসের মাল এয়ারপাের্ট থেকে খালাস হচ্ছে না কেন? উদ্বাস্তু শিবিরে কাজ-কর্ম অচল হয়ে পড়ছে। কাষ্টমস্ কর্তৃপক্ষের বক্তব্যঃ আমাদের রেডক্রস ছাড়া অন্যদের প্রপার চ্যানেল দিয়ে আসতে হবে। নরওয়ে থেকে পাঠানাে শুটকি মাছ সম্বন্ধে শুল্ক বিভাগের একই বক্তব্য। লুথরার হস্তক্ষেপে কোনােটা মেটে, কোনাে ক্ষেত্রে তাতেও হয় না। এইভাবে দিন অরম্ভ হয়, দিন শেষ হয়। গাড়ীতে ঘােরাঘুরি, টেলিফোনে ডাকাডাকি, ফাইলে চালাচালি যত হয়, কাজ তত এগােয় না। কিন্তু, যেহেতু অফিস মাষ্টারের কর্ম-পর্ব সাত-সকালে শুরু হয়, তাই সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যেই থিয়েটার রােডে অফিস বসে, দিনের কাজ চলতে থাকে। কিন্তু রাজ্য সরকারের অকল্যান্ড দপ্তর দেখলে কান্না পাবে। সকাল দশটা বেজে যায়, সারা অফিস খাঁ-খাঁ করে। পে-বয়কট, অফিস গেটে বিক্ষোভ স্লোগানের পােষ্টারে অফিস মােড়া, রােদে সেগুলাে বিবর্ণ, বৃষ্টির জলে খানিক-খানিক ধুয়ে গেছে। এরই মধ্যে অফিসাররা আসেন, কাজের চাপে এবং বােঝায় কয়েকজন অফিসার হিমসিম খান এবং তাদের সঙ্গে কিছু সংখ্যক কর্মী। পশ্চিমবঙ্গের মরা-বাঁচার প্রশ্নে অন্যদের কোনাে পার্টিসিপেশনের লক্ষণ পর্যন্ত নেই।
অন্য দিকে রাজ্যের ৮টি সীমান্ত জেলা থেকে অনবরত জরুরী বার্তা আসছে। প্রশাসনের বােঝা বইতে পারছে না, সব কাজ বন্ধ রেখেও কাজের চাপ দুঃসহ হয়ে উঠেছে। জেলার সরকারি কর্মীরা সবাই রিলিফ নিয়ে ব্যস্ত। বর্ষা এসে গেছে, চাষী সার বীজ কৃষি ঋণের জন্য হুন্যে হয়ে ঘুরছে, কোথাও কারাের দেখা নেই, পাত্তা নেই, বি-ডি-ওদের স্নান খাবারের সময় নেই, মহকুমা অফিসার, জেলা ম্যাজিষ্ট্রিট প্রশাসনের দিকে নজর দেবার মুহূর্ত মাত্র সময় পাচ্ছেন না। প্রশাসনের চাকা বন্ধ, গতি রুদ্ধ। রাজ্য সরকারের উপর মহলে এখন যে চিন্তাভাবনা প্রধান হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে: শরণার্থী রিলিফের জন্য এখনই কর্মী এবং অফিসার নিয়ােগ করতে হবে। একজন ডিরেকটর জেনারেল নতুন ডাইরেকটোরেট অফিসের পরিচালনা করবেন। এর ব্যয়ভার কেন্দ্রীয় সরকারকে বহন করতে হবে। কলকাতার কেন্দ্রীয় শরণার্থী দপ্তর রাজ্য সরকারের সঙ্গে সার্থক যােগাযােগ রক্ষা করছে না, প্রশাসন সমন্বয় আসছে না, একে পাকা করার ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারকে করতে হবে। শরণার্থী সাব-কমিটি সম্প্রসারিত করতে হবে এবং মন্ত্রিসভায় ঘন-ঘন এ কাজের পর্যালােচনা আবশ্যক।
রাজ্য সরকারের প্রশাসনে আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্ন এমনিতেই এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শরণার্থী স্রোতের সঙ্গে কত জঞ্জাল ভেসে আসছে, কে তার খবর রাখছে? কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী যখন কলকাতায় এসেছিলেন, আই-জি প্রসাদ বসু তখন অবিলম্বে ৪ ব্যাটেলিয়ান পুলিশ এই রাজ্যে এখনই পাঠাবার জন্য ভারত সরকারের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন। তিনি এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের জন্য ২০ ব্যাটেলিয়ান অর্থাৎ আরও ১২ হাজার পুলিশ দরকার। সরকারি অন্তরঙ্গ মহলে আই-জি এমন কথাও বলেছেন, শরণার্থী সমস্যার যে বহর, তাতে ২০ ব্যাটেলিয়ান পুলিশেও কূল পাওয়া যাবে না। শরণার্থী সমস্যার সব ব্যর্থতার চাপ তাে শেষ পর্যন্ত পুলিশের ওপর পড়বে। শরণার্থীদের সঙ্গে কত পাক গুপ্তচর অবাধে ভারতে ঢুকছে, সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা পাকিয়ে তােলার জন্য। তা রুখবার জন্য কোনাে ব্যবস্থা নেই, রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত হচ্ছে না। রাজ্যের বাইরে শরণার্থী পাঠাবার জন্য যে সামান্য ব্যবস্থা হয়েছে, তাতেও বাগড়া দেবার জন্য শিবিরে-শিবিরে কানাকানি,প্রচার কার্য চলছে, কে তাদের ওপর নজর রাখছে? পেট্রাপােলের এক শিবিরে ৭ হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে নানা শিবিরে নিয়ে যাবার জন্য স্পেশ্যাল গাড়ী ছাড়ার সময় অর্ধেকের ওপর লােকের কোনাে পাত্তা নেই। কারা ওদের কানে বিষ ঢেলে রাজ্যকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? সরকারি অফিসারেরা ফিসফাস করছেন, পাছে কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসাররা বলে বসেন, এই তাে, বাঙ্গালী শরণার্থীরা পশ্চিম বাঙ্গলার বাইরে যেতে চায় না।
সমস্যার ব্যাপকতা সারা দেশকে যেভাবে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করেছে, এ থেকে পরিত্রাণের পথ দেশের সামনে নেই। কি রাজ্য সরকার, কি কেন্দ্রীয় সরকার, কারাের কাছে এই মুহূর্তে উত্তর নেই। প্রশাসনে অমুক কাজটা হচ্ছে না, হলেই বা সমস্যার কতটুকু সুরাহা হত? কর্মীদের দক্ষতা কর্মক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়লে সমস্যার কতখানি সমাধান হবে? এখন শুধু আমাদের সামনে একটি কর্তব: আসুন আমরা যে-যার দেবতার কাছে প্রার্থনা করি এবং আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত থাকি।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৩ জুন ১৯৭১