ফিরে যাও টুঙ্কু আবদুল রহমান
শরণার্থী দর্শনে আসবেন টুঙ্কু আবদুল রহমান। তিনি একা নন। সঙ্গে থাকবেন একটি ঐশ্লামিক প্রতিনিধি দল। আগামী দু’তিন দিনের মধ্যে ঘটবে কলকাতায় তাদের পদার্পণ। খানদানী আদমী টুঙ্কু সাহেব। দীর্ঘদিন ছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। রাজনীতি ছেড়ে হয়েছেন ইসলামের খিদমতগার। নিয়েছেন বিশ্ব
মিক সংস্থার সেক্রেটারী জেনারেলের দায়িত্বভার। সফর করেছেন তারা ঢাকা। গ্রামাঞ্চলে গিয়েছিলেন কিনা জানা নেই। দিবাচক্ষে দেখেছেন সব। বুঝে ফেলেছেন শরণার্থী সমস্যার আসল রহস্য। কোন অপরাধ নেই ইয়াহিয়া খানের। তার সৈন্যদল তৈরী করে নি সন্ত্রানের রাজত্ব। যত নষ্টের গােড়া মুক্তিফৌজ। ওরাই চালাচ্ছে হানাদারী। ওদের ভয়েই সাধারণ মানুষ ছাড়ছেন ভিটেমাটি। আশ্রয় নিচ্ছেন ভারতে। শরণার্থীদের নিজেদের বাড়ীঘরে ফিরিয়ে নেবার জন্য ভারী উৎসুক টুঙ্কু সাহেব। নয়াদিল্লীর সঙ্গে বলবেন তিনি কথাবার্তা। পূর্ব বাংলা থেকে সরাসরি ভারতে আসবার ইচ্ছা ছিল তার। জানের ভয়ে আসতে পারেন নি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বড়ই উত্তপ্ত। সামরিক উত্তেজনা চলছে সেখানে। বিমানে উড়ে আসাটা হটকরিতা। ওটা গুলী করে ফেলতে লাগে কতক্ষণ? তাই তিনি সিধে পথে না এসে বাঁকা পথে আসবেন ভারতে। সত্যিকারের ঐশ্লামিক ভিদমতগার টুঙ্কু আবদুল রহমান। পক্ষপাতিত্ব তাঁর শােভা পায় না। তাই তিনি দিয়েছেন নিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি। এই নিরপেক্ষতা তার একার নয়। সঙ্গী ধর্মভাইরাও হয়ত থাকবেন নিরপেক্ষ। জর্ডান, ইরান, কুয়ায়েত প্রভৃতি আদর্শনিষ্ঠ রাষ্ট্রের পরম নিষ্ঠাবান ধর্মগুরুদের কে বলবে পক্ষপাতদুষ্ট? যারা এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখাবে চিরদিনের জন্য বেহেস্তের দরজা বন্ধ হবে তাদের জন্যে। টুঙ্কু সাহেবের কল্পনার পক্ষগুলাে কারা? ভারত এবং পাকিস্তান? শরণার্থীরা ভারতের নাগরিক নন। স্বদেশ থেকে তারা বিতাড়িত এবং নয়াদিল্লীর আশ্রয়প্রাপ্ত। মুক্তিবাহিনীর ভয়ে তারা যদি ভিটেমাটি ছেড়ে থাকেন তবে আসল পক্ষ মাত্র দুটি বাংলাদেশ সরকার এবং পাক-সরকার। প্রথমেই উচিত ছিল এ দুটি পক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা। তা তিনি করেন নি। দুর্ভাগার দল যাতে নিরাপত্তা বােধ নিয়ে দেশে ফিরতে পারেন তা দেখতে চান নয়াদিল্লী। এই নিরাপত্তার গ্যারান্টি কে দিতে পারেন? স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার, না দখলদার পাক সরকার? শরণার্থীদের ডেকে জিজ্ঞাসা করুন টুঙ্কু সাহেব—তাঁরা চান কোন সরকারকে? তাঁদের রায় মেনে নিলেই তাে ল্যাঠা যায় ঢুকে। এই সঙ্গে গত নির্বাচনের ফলাফলটা মনে রাখলে ভাল করবেন টুঙ্কু আবদুল রহমান। কিন্তু তার সঙ্গীদের নিয়ে হবে বিপদ। ওদের অনেকেই হয়ত জানেন না নির্বাচন জিনিসটা কি? সামন্ততন্ত্রী উৎস তাদের পক্ষে এসব গােলমেলে পদ্ধতির উপলব্ধি সহজ নয়। টুঙ্কু রাজনীতি ছাড়লেও রাজনীতি ছাড়ে নি টুঙ্কুকে। ঢাকা সফরের অভিজ্ঞতার বয়ান থেকেই বােঝা গেছে তার মতলব। পূর্ববাংলা থেকে সরাসরি কলকাতায় এসে সীমান্তে কারা করত তার বিমানের উপর গুলীবর্ষণ? মুক্তি বাহিনীর হাতে আপাতত নেই বিমানবিধ্বংসী কামান। যদি থাকত তবে গত ক’মাসে তারা ঘায়েল করতে পারতেন অনেক পাক-বিমান। টুঙ্কু সাহেব যে সংস্থার সেক্রেটারী জেনারেল সে সংস্থার অন্যতম স্তম্ভ পাকিস্তান অবশ্যই বিমান-বিধ্বংসী কামানের গােলা ছুড়বে না তার প্রিয় নেতার বিমানের দিকে। বাকী রইল ভারত। আকারে ইঙ্গিতে টুঙ্কু আবদুল রহমান কি বলতে চাচ্ছেন বাংলাদেশ সমস্যা আসলে পাক-ভারত বিরােধ।
গত ক’মাসে ভারত দেখেছে অনেক নিরপেক্ষ বিদেশী নেতার গােপন ষড়যন্ত্র। বাদ পড়বেন না গােটাকয় প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্র নায়কেরা। কেউ কেউ দিচ্ছেন ভারত এবং বাংলাদেশ সীমান্তে রাষ্ট্রসংঘ বাহিনী মােতায়েনের প্রস্তাব। আবার কোন কোন মহল করছেন শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিশ্বসভার পর্যবেক্ষক দল পাঠাবার জল্পনা-কল্পনা। ওরাই নাকি করবেন স্বদেশ প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুণর্বাসনের তদারকী। বৃটেন এবং আমেরিকা ও ব্যবস্থায় অতিমাত্রয় উৎসাহী। ঐশ্লামিক সংস্থা এ দুটি রাষ্ট্রের আশীর্বাদের ল। টুঙ্কু আসছেন তাদের হয়েই ওকালতী করতে। যেসব অন্ধের চোখে ধরা পড়ে নি ইয়াহিয়ার গণহত্যার বীভৎস দৃশ্য তাদের ধর্মীয় ঐক্য-চেতনা একটা ন্যক্কারজনক বুজরুকী। ইসলামাবাদের এক কদর্য স্বৈরাচারীকে রক্ষার উৎকট প্রচেষ্টা মানবতার চরম অপমান। ব্যক্তি হিসাবে টুঙ্কুর বিরুদ্ধে নে িকারও বিদ্বেষ। তিনি যে মিশন নিয়ে আসছেন তার ভিতরে রয়েছে বিস্তৃত ষড়যন্ত্রজাল। বাংলাদেশ সফরের পর যে মন্তব্য তিনি করেছেন তাতে নেই সত্যের ছিটেফোটা। মিথ্যা নিয়ে যার আরম্ভ ব্যর্থতায় হবে তার সমাপ্তি। কি দরকার আছে পন্ডশ্রমের। ফিরে যাও টুঙ্কু আবদুল রহমান। তােমার বিকৃত জিহ্বার অসত্য অন্দোলন দেখতে চান না কোন সত্যসন্ধ নাগরিক। আর যদি সত্যিই চাও স্বগত সম্ভাষণ তবে বলকার পাপে বাংলাদেশের এই দুরাবস্থা? কে জ্বালিয়েছে এখানে শ্মশানের অনির্বাণ চিতা?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৮ জুলাই ১৯৭১