You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.27 | বিশাল শরণার্থী তরঙ্গ আসছে | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বিশাল শরণার্থী তরঙ্গ আসছে

শরণার্থী স্রোতের বিরাম নেই। প্রতিদিন আসছেন তারা হাজারে হাজারে। পুনর্বাসনমন্ত্রী খালিদকার বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে ওদের সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটিতে। ব্যর্থ হতে চলেছে তার অনুমান। প্রায় পাঁচ লক্ষ শরণার্থী ইতিমধ্যেই দলের অধিকাংশ ফরিদপুর এবং বরিশাল জেলায় অধিবাসী। তাছাড়া বাংলাদেশের আরও তিন কোটি মানুষ গৃহহারা। তারা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আশ্রয়ের সন্ধানে। যাযাবরের মত বেশী দিন কাটাতে পারবেন না তারা ইয়াহিয়ার রাজত্বে। শেষ পর্যন্ত ওদের পাড়ি জমাতে হবে ভারতের মাটিতেই। এসব সংবাদ পরিবেশন করেছেন বিদেশী সাংবাদিকরা ইসলামবাদের প্রচার যন্ত্রের প্রলাপের চেয়ে নিজেদের চোখে দেখা ঘটনাবলীর উপর তারা গুরুত্ব দিয়েছেন বেশী। ইয়াহিয়া বলেছেন—পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক। দলে দলে শরণার্থী ফিরছেন নিজেদের বাড়ীঘরে। প্রকৃত অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আগের চেয়েও বেশী পরিমাণ শরণার্থীর ভারতে আগমনের সম্ভাবনা। কেন ঘটছে এই অঘটন? জবাব পেতে বেশী দূর যাবার দরকার নেই। পাক-সৈন্যদের অত্যাচারে শহরগুলাে ফাঁকা। শহরবাসীরা পালিয়েছিলেন গ্রামে। হিন্দু এবং জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের খোঁজে ইসলামাবাদের বর্বররা দিচ্ছে গ্রামাঞ্চলে হানা। জ্বলছে বাড়ীঘরে। গুলী খেয়ে মরছেন জোয়ান জোয়ান ছেলে এবং স্কুল-কলেজের ছাত্র। নারী ধর্ষণ অতি সাধারণ ঘটনা। এটা যে একটা অপরাধ—এ ধারণা মুছে গেছে।
পাক-চমুরদের মন থেকে। জঙ্গীশাহীর নাগালের মধ্যে রয়েছে যেসব অঞ্চল সেখানে নেই কোন প্রশাসন। মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সমর্থকরা পেয়েছে খােলা মাঠ। তাদের সঙ্গে জুটেছে গুন্ডার দল। লুঠপাট চালাচ্ছে তারা অবাধে। খুশীমত মেয়েদের বার করে নিচ্ছে ঘর থেকে। ভয়-ডর বাহিনীর বেয়ােনেটের মদৎ। অনিশ্চিত নিরাপত্তা নিয়ে কেউ থাকতে পারেন না ভিটে মাটি আঁকড়ে। ক্ষেতের ফসল নষ্ট হচ্ছে ক্ষেতে। চাষ। আবাদের পাট যাচ্ছে উঠে। প্রতিদিন এগিয়ে আসছে দুর্ভিক্ষের কালােছায়া। ইতিমধ্যেই তা হেঁকে ঘরেরে বিস্তৃত অঞ্চল। ক্ষুধার জ্বালায় অনেক ছাড়ছেন স্বদেশে। পা বাড়াচ্ছেন ভারতের দিকে। ইয়াহিয়ার অত্যাচারে এবং দুর্ভিক্ষের তাড়নায় যারা আসছেন ভারতে তাঁদের শ্রেণী বিভাগ অসম্ভব। গােটা সমস্যাটার জন্যই প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ইসলামাবদ। ওরা যতই বলুন পূর্ব পাকিস্তানে নেই কোন খাদ্যভাব তাতে চাপা পড়বে না নির্ভেজাল সত্য কাহিনী। আশ্রয়ের আশায় যারা আসছেন ভারতে তারাই বয়ে আনছেন দুর্ভিক্ষের। ভয়াবহ ছবির পটভূমিকা।
কি করবেন এখন কেন্দ্রীয় সরকার? পাক-বাহিনীর দ্বারা বিতাড়িত এবং দুর্ভিক্ষের কবলিত—এই দুই শ্ৰেণীকেই আশ্রয় দেওয়া ছাড়া নেই কোন উপায়। এদের সম্মিলিত সংখ্যা হয়ত ছাড়িয়ে শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে পুনবিবেচনা। বন্যার জলের মত এসে পড়বেন তারা। পশ্চিম বাংলা এবং পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে নেই তিল ধারণের স্থান। অনেক আগেই সৃষ্টি হয়েছে এখানে অবর্ণনীয় নারকীয় দৃশ্য। অপরাপর রাজ্যে শরণার্থী পাঠাবার কাজ চলছে শম্বুক গতিতে। আগামী ক’সপ্তাহের মধ্যেই বিপুল সংখ্যায় যারা আসবেন তারা মাথা গুঁজবেন কোথায়? সতর্ক হােন নয়াদিল্লী। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরী রাখুন শরণার্থী শিবির। আপতত বাচুন এই দুর্ভাগার দল। তাতে অবশ্য হবে না সমস্যার সমাধান। কে জোগাবে তাদের ভরণ-পােষণের টাকা। প্রয়ােজনের তুলনায় গােটা বিশ্বের দান অতি সামান্য। ইয়াহিয়ার কৃতকর্মের জন্য শেষ পর্যন্ত ভারত কি সাজবে দেউলিয়া? নয়াদিল্লী কি এখনও চেয়ে আছেন দুনিয়ার দিকে? গত চার মাসে। কি পেয়েছেন তারা? সামান্য সাহায্য এবং দিস্তায় দিস্তায় প্রশংসাপত্র। যারা তা দিয়েছে তাদের মধ্যে আছে আমেরিকা। এই রাষ্ট্রের কর্তারাই পাকিস্তানে পাঠাচ্ছেন সমরসম্ভার। সংখ্যা বাড়াচ্ছেন শরণার্থীদের। ইয়াহিয়ার শরীরে পরাচ্ছেন তারা গন্ডারের চামড়া। তাকে করে তুলছেন দুর্ভেদ্য। এদের কাছে সুবিচার প্রত্যাশ্য বাতুলতা। একমাত্র ভরসা বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনী। ওরা যখন মুক্তঅঞ্চলে দৃঢ় ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকতে পারবেন তখন মন্থর হবে শরণার্থী আগমনের স্রোত। এই অঞ্চলের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে গৃহহীনদের মনে জাগবে নিরাপত্তাবােধ। তাদের অনেকেই পাবেন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভরসা। বাইরের মদৎ ছাড়া আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত পাক-বাহিনীকে হটান সম্ভব নয়। এ মদৎ দিতে হবে ভারতকে। বাংলাদেশ থেকে ইয়াহিয়ার উচ্ছেদে বিলম্ব ঘটলে মহাবিপদ। আর্থিক চাপে ভেঙ্গে পড়বেন নয়াদিল্লী। মারমুখী ইসলামাবাদ। লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া তাদের পক্ষে খুবই সম্ভব। কিন্তু আক্রমণের সময় নির্বাচনের সুবিধা দেওয়া যেতে পারে না যুদ্ধবাজদের। এগিয়ে আসতে হবে মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় সাহায্যে। দেরী করার সময় নেই। তার জন্য যদি যুদ্ধে নামতে চান ইয়াহিয়া খান, নামুন। বুড়িগঙ্গার পানি জুটবে না তার বরাতে। আয়ুব খানের মতই ইছছাগিলের পানি খেতে হবে তাকে। এতে স্বাদ থাকবে না। কারণ এই পানিতে মিশবে পাক-চমুর রাশি-রাশি তাজা খুন।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৭ জুলাই ১৯৭১